Advertisement
E-Paper

ঘোরালো ভূত

আমি বললাম, ‘দ্বিজুদা আগের দিন সিম্পল ভূতের গল্প বলেছিলে আজ একটা ঘোরালো ভূতের গল্প বলবে, প্লিজ?’ ভূত বিশেষজ্ঞ দ্বিজপদ সাঁতরা— আমাদের দ্বিজুদা চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে একপ্রস্থ জরিপ করল, ভূতেদের সম্পর্কে ফাজলামি করে কথাটা বলছি না জেনুইন শ্রদ্ধা নিয়ে বলছি ভাল করে বুঝে নিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঘোরালো কি না জানি না, তবে কর্তব্যপরায়ণ ভূতের একটা গল্প বলতে পারি।

শুভমানস ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: মণীশ মৈত্র

ছবি: মণীশ মৈত্র

আমি বললাম, ‘দ্বিজুদা আগের দিন সিম্পল ভূতের গল্প বলেছিলে আজ একটা ঘোরালো ভূতের গল্প বলবে, প্লিজ?’

ভূত বিশেষজ্ঞ দ্বিজপদ সাঁতরা— আমাদের দ্বিজুদা চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে একপ্রস্থ জরিপ করল, ভূতেদের সম্পর্কে ফাজলামি করে কথাটা বলছি না জেনুইন শ্রদ্ধা নিয়ে বলছি ভাল করে বুঝে নিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঘোরালো কি না জানি না, তবে কর্তব্যপরায়ণ ভূতের একটা গল্প বলতে পারি। আমার গাড়ির যে সারথি অশান্ত তার মুখেই হালে ঘটনাটা শুনেছি।’

দ্বিজুদা গাড়ির ড্রাইভারকে কখনও ড্রাইভার বলে না, বলে সারথি। কিন্তু আজকাল যা সব হাই পিক-আপ গাড়ি বেরিয়েছে তার ড্রাইভারের নাম অশান্ত ভাবলেই কেমন লাগে! কথাটা বলতেই দ্বিজুদা মুচকি হেসে বলল, ‘না না ভুল করছ, নাম অশান্ত হলে কী হবে, তার মতো শান্ত আর লক্ষ্মী ছেলে ভূভারতে নেই, গাড়ি চালানোটা যে বাহাদুরি দেখানোর জিনিস নয়, তার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না।’

এই বলে দ্বিজুদা শুরু করল গল্প, ‘এক দিন রাত তখন দশটা হবে, অশান্ত এসে হাজির আমার বাড়ি, এইমাত্র খবর পেয়েছে বাঁকুড়ায় তার দিদির বর মারা গিয়েছে, যেতে হবে। কিন্তু ট্রেনে-বাসে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, আমি যদি গাড়িটা দিই তা হলে সে টেনে চালিয়ে তিন-সোয়া তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। শুনে আমি তাকে গাড়ির চাবি আর পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এখনই বেরিয়ে যাও।’

আমাকে এক বারের জায়গায় পাঁচ বার ধন্যবাদ দিয়ে অশান্ত গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে চলে গেল, সালকিয়া দিয়ে জিটি রোড ধরে বালি গিয়ে ধরে নিল দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, ঝাঁ-চকচকে রাস্তায় গাড়ি চোখের পলকে শক্তিগড় ছাড়িয়ে, বর্ধমান ছাড়িয়ে দুর্গাপুরে পৌঁছে গেল, তার পর মোড় ঘুরে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় কিছুটা গিয়ে সেই যে দাঁড়াল নট নড়নচড়ন, সামনে বিকট জ্যাম।

জানা গেল, কলকাতায় রাজনৈতিক দলের মিছিল ছিল বলে পুলিশ ট্রাক-লরিকে কাল রাত থেকে এখানেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, মিছিল শেষ হয়েছে, এ বার তাদের ছাড়তে শুরু করেছে। মুহূর্তে কয়েকশো গাড়ির মধ্যে কে আগে যাবে তার কম্পিটিশন লেগে গেছে সামনে-পিছনে সব পথ সিল হয়ে গিয়েছে, বেড়াল গলারও জায়গা নেই। এই জ্যামের বিভীষিকা কাটিয়ে বাঁকুড়া শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত কাবার হয়ে যাবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল অশান্তর। ভাগনেরা এত ভালবাসে তাকে, ‘মামা মামা’ করে, এত বড় বিপদের সময় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না?

অগত্যা দিদিদের ফোনে খবরটা জানিয়ে গাড়ি রেখে বিষণ্ণ মনে রাস্তার পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে অশান্ত, সামনের প্রাইভেট কারের ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলল, ‘কেমন চা, কাকু? খাওয়া যাবে?’

ড্রাইভারের বয়েস কম, মেরেকেটে পঁচিশ হবে। হাসিখুশি চঞ্চল যুবক, একটু চেনা চেনাও ঠেকছিল, অশান্ত ঘাড় নেড়ে বলল, ‘চলে যাবে।’

চা-দোকানিকে চা বলে ছেলেটি গল্প জুড়ে দিল অশান্তর সঙ্গে। জানা গেল, ছেলেটি দমদম এয়ারপোর্টে গাড়ির মালিককে ছেড়ে ফিরছে, মালিকের বাড়ি বাঁকুড়ার বড়জোড়ায়, সেখানে গাড়ি গ্যারাজ করে বাড়ি ফিরবে সে, কিন্তু রাস্তার হাল দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছে, বুঝেছে রাতটা আজ রাস্তাতেই কাটবে। এই বলে অশান্তকে প্রশ্ন করে তার ব্যাপারটা শুনে সে চিন্তায় পড়ে গেল, যতই হোক মৃত্যুর ঘটনা, ডেডবডি তো আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখা যায় না, সময়ে পৌঁছনোটা জরুরি বুঝেই কী ভেবে বলল, ‘দাঁড়ান একটা ট্রাই নিই, দেখি ভাগ্যে কী আছে আপনার। গাড়িতে গিয়ে বসুন।’

ছেলেটি চা খেয়ে দাম মিটিয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল, প্রায় দশ মিনিট ঠায় বসে থাকার পর সামনের ট্রাকের সারি নড়েচড়ে উঠল, তাদের পিছন পিছন দশ-বারো গজ গিয়েই আবার যে কে সেই, দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ঠিক তখনই অশান্ত দেখল রাস্তা ছেড়ে সামনের গাড়িটা বাঁয়ের ঢালে নেমে যাচ্ছে, ড্রাইভার জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে তাকে বলছে, ‘আমার সঙ্গে আসুন!’

অশান্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছেন ভাই?’

‘এ দিক দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে।
রাস্তাটা ফাঁকাই দেখছি।’ ছেলেটি তাড়া লাগাল, ‘কাকু দেরি করবেন না, গাড়ি নামিয়ে দিন!’

অশান্ত তাই করল। তাকে ফলো করতে বলে ছেলেটি স্পিডে গাড়ি ছুটিয়ে দিল, মধ্যরাত্রির ঘুমন্ত জনপদ চিরে ছুটতে লাগল তাদের গাড়ি। এক সময় জনপদ শেয হয়ে গেল, অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেল, খানাখন্দের মধ্যে লাফাতে লাফাতে গাড়ি চলছে, দু’পাশে দৈত্যের মতো কালো কালো গাছের ছায়া, ভালুকের মতো ঝোপজঙ্গল আর করাত-কলের মতো অবিশ্রাম ঝিঁঝির ডাক সরে সরে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, রাস্তার কোথায় যে শেষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অশান্ত ভয় পেয়ে গেল, ঘামে হাতের তালু ভিজে গেছে, স্টিয়ারিং পিছলে পিছলে যাচ্ছে। ভাবছে এ কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা!’

‘ঘোরালো ভূত! ঘুরিয়ে মারে বলেই এরা হল ঘোরালো ভূত।’ আমি উত্তেজিত ভাবে বললাম, ‘দ্বিজুদা খুব করে ঘুরিয়ে মারল তো আপনার অশান্তকে?’

‘মারল কই বাঁচাল!’ দ্বিজুদা বলে চলল, ‘হঠাৎ অশান্ত দেখল অন্ধকার শেষ, সামনেই আলো-ঝলমল বাঁকুড়া রোড। রাস্তায় উঠেই সে তাজ্জব, দু’পা দূরে দুর্গাপুর ব্যারেজ, পেরোলেই বাঁকুড়া জেলা। তার মানে শর্টকাট রোড ধরে তারা পুরো জ্যামের রাস্তাটা ডিঙিয়ে এতটাই সামনে চলে এসেছে জ্যাম তখনও সে পর্যন্ত গড়ায়নি।

ছেলেটিকে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে অশান্ত তাকে ওভারটেক করে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। দু’পাশে রিফ্লেকটারের অপূর্ব শোভায়-মোড়া চকচকে সুন্দর রাস্তা ধরে গাড়ি যেন পাখা মেলে উড়ে চলল, লুকিং গ্লাস দিয়ে অশান্ত দেখল ছেলেটি তাকে হাত নেড়ে টা-টা করে দিচ্ছে। দিতে দিতেই ভেঙেচুরে যাচ্ছে, ভাঙতে ভাঙতে ধোঁয়া হয়ে সুতো হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছেলেটিও নেই, গাড়িটিও নেই, সব ফরসা। ছেলেটি আসলে ভূত, এসেছিল অশান্তকে ঠিক সময়ে তার দিদির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’

আমি তর্ক তুললাম, ‘এ তা হলে ঘোরালো ভূত হল কী করে দ্বিজুদা? এ তো উপকারী ভূত।’

দ্বিজুদা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘অশান্তও তাই ভেবেছিল, নির্বিঘ্নে ঠিক সময়ে দিদির বাড়ি পৌঁছে জামাইবাবুর সৎকার করে শ্মশান থেকে ফিরে ভোর পাঁচটা নাগাদ আমাকে ফোন করে সব জানিয়ে জানতে চাইল ওই পরোপকারী ভূতটি কে। অলীক, খুব তো ছটফট করছ, এ বার তুমিই বলো ছেলেটি কে ছিল?’

আমি আন্দাজ লাগালাম, ‘জামাইবাবুর কোনও আত্মীয়? সবে মারা গেছে?’

‘হল না।’

‘তবে কি ভদ্রলোকের কোনও ছেলে যে কম বয়সে মারা গেছিল?’

‘হল না।’

‘তবে কি লোকাল ট্রাফিক পুলিশের ভূত?’
ট্রাকের জ্যাম সামলাতে গিয়ে ট্রাক চাপা পড়ে মরেছিল সদ্য সদ্য?’

‘ইন্টারেস্টিং আইডিয়া। তবে তাও না। কম দিন তো ভূত ঘাঁটছি না, তত ক্ষণে আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। অশান্তকে জানালাম তার দিদিকে বলে তাদের পারিবারিক অ্যালবামটা বের করে দেখলে হয়তো তার ছবি তাতে সে পেয়ে যাবে। হুঁ পেয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে বসে আছে ছেলেটি।’

আমি চমকে গেলাম, ‘তবে কি ছেলেটি জামাইবাবু নিজেই ছিল?’

‘এই তো বুদ্ধি খুলেছে! দিদির সঙ্গে তার বিয়ের অনেক আগের যুবক বয়সের চেহারায় জামাইবাবু এসেছিল বলে অশান্ত চিনেও চিনতে পারেনি।’

‘সর্বনাশ!’ আমার চোখ ঠিকরে গেল।

‘কীসের সর্বনাশ? বলো টান। শালাবাবু জ্যামে আটকে কষ্ট পাচ্ছে দেকে আর থাকতে পারেনি, তাকে রেসকিউ করতে চলে এসেছিল। মানুষ মারা যাওয়ার পর নিকটজনের ওপর তার এই টান বেড়ে যায়। তাই ভূতকে ছোট করো না, ভয় করো না, তারা মানুষকে মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসে।’

দ্বিজুদা চুপ করল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy