Advertisement
E-Paper

ফোনঠাসা পৃথিবীর রূপকথারা

আমার চার্জ ফুরিয়ে গেল। সারা রাত চার্জে দেওয়া ছিল। আলো জ্বলছিল। সকালে খুলে নিয়েছি। সবটা হয়েছে কি না, চেক করিনি। পকেটে ভরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছি। রোজই এমন হয়। ওই তাড়াহুড়ো। কারণ রোজই দেরি করে ফেলি। এই এটা-ওটা করতে করতে, চশমাটা হারিয়ে যায়। তার পর এমন একটা জায়গা থেকে খুঁজে পাই যেখানে রাখার কথা নয়। মানিব্যাগও হারায়।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০০:০৩
ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

আমার চার্জ ফুরিয়ে গেল। সারা রাত চার্জে দেওয়া ছিল। আলো জ্বলছিল। সকালে খুলে নিয়েছি। সবটা হয়েছে কি না, চেক করিনি। পকেটে ভরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছি। রোজই এমন হয়। ওই তাড়াহুড়ো। কারণ রোজই দেরি করে ফেলি। এই এটা-ওটা করতে করতে, চশমাটা হারিয়ে যায়। তার পর এমন একটা জায়গা থেকে খুঁজে পাই যেখানে রাখার কথা নয়। মানিব্যাগও হারায়। কাগজে লেখা দরকারি জিনিসের লিস্ট, সেটাও কোথায় যেন চলে যায়। আমি নিশ্চিত জানি যে মোজাও হারাত, এক পাটি। কিন্তু জুতো পরি না, তাই মোজাও নেই। শুধু হারায় না সবুজ রঙের ছোট জলের বোতল। রাস্তায় জল কিনে খেতে গায়ে লাগে। তাই ওটা রাখি আমার ঝোলাব্যাগে। ওটাই এক মাত্র ভারী জিনিস, বুঝতে পারি সঙ্গে আছে, জলটা খলবল করে। জল খেতেও ভুলে যাই, ভরা বোতল ব্যাগে চড়ে আবার বাড়ি ফিরে আসে। আগে রাস্তায় সবুজ বাক্সের মতো ঘরের জানলা থেকে জল দিত। আজকাল আর দেখতে পাই না। আস্ত জলঘরগুলোও বোধ হয় হারিয়ে গেছে।

অথচ ফোন কিন্তু হারায় না। বোধ হয় সব সময় আঁকড়ে ধরে থাকি তাই। আসলে এক বার জলে লেগে পুরোপুরি বোবা হয়ে গিয়েছিল। চাঁদনির ফুটপাতে সারিয়ে দিল, তার পর থেকে চিঁ-চিঁ করে ডাকে। ওই ডাক যাতে মিস না হয় তাই ওকে হাতছাড়া করি না। মেসেজ এলে ফোন বাজে না, গাড়িতে হঠাৎ ধাক্কা লেগে ছিটকে গিয়ে পড়ে থাকা ছাগলছানার মতো থরথর করে কাঁপে, কয়েক বার। পরিচিত কেউ আমাকে মেসেজ করে না। আসে কিছু বড়লোকি বিজ্ঞাপন, গেম্স ডাউনলোডের বায়না আর নির্দোষ কুপ্রস্তাব। এক বার তো আলজিরিয়া থেকে কোন উগ্রপন্থী ফোন করেছিল। ওগুলো ধরতে নেই। জানতাম না। ‘রং নাম্বার’ বলে কেটে দিয়েছিলাম। কিচ্ছু হয়নি। টকটাইম আর চার্জ ফুরিয়ে যাবার ভয়ে কাউকে ফোন করি না বিশেষ। মিস্ড কল দিই। সম্প্রতি অন্য একটা ব্যাপার হয়েছে অবশ্য। এক জন আমাকে মিস্ড কল দেয় রাতে। তখন আমি তাকে ফোন করি। আমি বা সে, কেউ বিশেষ কোনও কথা বলি না। কথার মধ্যে লম্বা গ্যাপ থাকে, দুজনেই চুপ করে থাকি। বুঝতে পারি যে সে আছে, লাইন কেটে যায়নি। ট্রেনের হর্ন শুনতে পাই। মনে হয় কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে।

এই মুহূর্তে কিন্তু সত্যিই এক জনকে ফোন করার দরকার ছিল। দেখি ফোনের চৌকো চোখটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে। চালু করার চেষ্টা করলাম ব্যাটারি খুলে। কিছুই হল না। অসহায় লাগছিল। কাজের ব্যাপারে ডেকেছে, তবে ফোন করে যেতে বলেছিল। অফিসটা ঠিক কোথায় সেটা জানার দরকার ছিল। ফোনে না পেলে কিছুই হবে না। পরে বলবে, ‘এই ইরেসপন্সিবল লোকগুলোকে কাজ দিতেও ঘেন্না করে।’ অথচ আমার যে সত্যিই কোনও দোষ নেই সেটা আমি ছাড়া কেউই জানে না। রাগ হল। ভাবলাম ঘাটের মড়া ন্যাকা যন্তরকে ফুটপাতে আছাড় মারি। মাথা ঠান্ডা করলাম। সামনে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁর হাতেও ফোন। চেহারা দেখে মনে হল ট্যাক্সি খুঁজছেন, বাস নয়। তার পরেই দেখলাম স্ক্রিনে কী সব টেপাটেপি করছেন। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম বলি, ‘কাইন্ডলি ফোন করতে দেবেন একটা? লোকাল। আমার চার্জ শেষ। মানে, ইমার্জেন্সি।’ আড়চোখে দেখতে পেলাম উনি একটা ম্যাপ দেখছেন। আজকাল তো ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে নেওয়া যায়। স্যাটেলাইট ট্যাক্সিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে অপেক্ষা করা মানুষের কাছে। দারুণ ব্যাপার। উনি সেটাই করছেন, ফোনে বলেও দিলেন এই মহাপৃথিবীর ঠিক কোন বিন্দুতে তাঁর অবস্থান। তার পর তৃপ্ত মুখে সিগারেট ধরালেন। দেখে আমারও ইচ্ছে হল। একটাই আছে যদিও।

ওঁর ফোনে আর এক জনের সঙ্গে কথা বলতে চাই সেটা পাশে দাঁড়িয়েও বলে উঠতে পারলাম না। বোধহয় ভয়ে, হীনম্মন্যতায়। উনি, ওঁর ফোন, ভীষণই স্মার্ট। হয়তো তাই। হলদে রঙের ঘড়ঘড়ে ট্যাক্সি নয়, রাজহাঁসের মতো পরিষ্কার সাদা ক্যাব ভেসে এল নিমেষের মধ্যে। উনি অনায়াসে ঢুকে পড়লেন, ধুপ করে বন্ধ হয়ে গেল কাচ তোলা নিটোল দরজা। ভীষণ ভক্তি হচ্ছিল আমার, এই পুরো ব্যাপারটার প্রতি। আমি প্রায় দরজাটা বন্ধই করে দিচ্ছিলাম, বলতে যাচ্ছিলাম, ‘সাবধানে যাবেন স্যর।’ সেটা করে উঠতে পারলাম না, ভেসে গেল ক্যাব, ওঁকে এসি সুখের নরম চাদরে মুড়ে নিয়ে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম, আমার ঠোঁটের দু’পাশে একটা সেনসেশন হচ্ছে, একটা ভীষণই পরিতৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে রয়েছে আমার মুখে। আমার আবার নজরে পড়ল হাতে ধরা প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়া মালটার দিকে। রাগ নয়, একটু মায়া হল। অনেক দিন আছে আমার কাছে। অনেক কথা শুনিয়েছি ওকে। আমি ওকে যা বলেছি, ও তা-ই শুনিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে। যা শুনেছে আমাকেও তাই বলেছে। এমন অনেক কথা আছে যা নিতান্তই অদরকারি। কিন্তু গোপনীয়। সে সব কখনও বলেনি অন্য কাউকে। বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। ভাবতে ভাবতে আমি বুঝতে পারছিলাম, আবার একটা দেবদূতীয় হাসি ছড়াচ্ছে আমার মুখের চার পাশে।

যা গেছে তা যাক। কাজটা এমনিতেও হত না। অনেক দেরিও হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। এই সময়ে সিগারেটটা ধরাতে পারলে ভাল হত। বোকার মতো আগেই পুড়িয়ে ফেলেছি। এ-দিক ও-দিক দেখলাম। ঘাড় ঘামতে শুরু করেছে। একটু পরেই রোদ চড়াবে, পুড়িয়ে মারবে আমার মতো রাস্তার লোকদের। সদ্য ব্যর্থতার গার্বেজ সর্বাঙ্গে মেখে বাড়ি ফেরা অসম্ভব। অন্য কোথাও যেতে হবে, ছায়া চাই। যেখানে গেলে কেউ জানবে না যে আমি এসেছি। কাছেই রবীন্দ্র সরোবর। হাঁটতে শুরু করলাম। সুন্দর গেট পেরিয়ে, নতুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে, মায়াভরা গাছেদের পাশ দিয়ে জলের ধারে এসে পড়লাম। এমন দুঃসময়েও জলে রোদ্দুর হাসছে, মাথার ওপর পাখিরা তাদের সংসারের গল্প করছে। লাকি, এদের ফোন লাগে না। বাঁধানো বসার জায়গা আছে পর পর। বেশির ভাগ ফাঁকা। একটায় দুজন বসে আছে পাশাপাশি, একটু নির্জনতার লোভে এখানেই এসে বসেছে। একটু দূরত্ব রেখে আমি ওদের ওখানেই বসলাম। তার পর জলের ও-পারে গাছপালার পিছনে সাউথ সিটি-র বড় বাড়িগুলো দেখতে লাগলাম অন্যমনস্ক মুখ করে।

আমি যে এসে বসেছি সেটা ওরা খেয়ালই করে নি। কথা বলে যাচ্ছিল, আমিও কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। উচিত নয়, তাও। আড়চোখে নজরও রাখছিলাম। খুবই অদ্ভুত ভাবে কথা বলছিল ওরা দুজনে। চাপা স্বরে, তাই পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম না। লেক গার্ডেনস স্টেশন দিয়ে ট্রেন যাওয়া-আসা চলছে পর পর, অনেক ক্ষণ ধরে একটা উদাসী মালগাড়িও গেল বার বার হর্ন বাজিয়ে। ওদের কথা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। একটু পরে আমার কানটা সেট হল, সব ছাপিয়ে কী বলছে সেটা শুনতে পাচ্ছিলাম। খটকা লাগল। এক জন খুবই ধৈর্য ধরে বলে যাচ্ছে ঠিক কী করে ইন্টারনেট থেকে একটা সিনেমা ডাউনলোড করা যায়। আর মেয়েটা বলছে নিজের বাড়ির অশান্তির কথা। বাবা সেই যে চলে গেছে, আর ফেরেনি। সংলাপগুলো মিলছে না, আমার অস্বস্তি হচ্ছে। দুজনেরই উত্তেজনা রয়েছে, গলার স্বরে সেটা স্পষ্ট। আগের চেয়ে অনেকটা ঘন হয়ে বসেছে। আমি যে কাছেই বসে, খেয়ালও করছে না। সাহস করে মুখটা ঘোরালাম একটু। দুজনেরই মাথা কাত হয়ে রয়েছে, ঠেকে আছে কাঁধের সঙ্গে। মেয়েটার হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরে আছে ছেলেটা, অন্যমনস্ক ভাবে টানাটানিও করছে হাতের চুড়িগুলো নিয়ে, আলগা করে। আশ্চর্য, ওদের এক জনের মাথা ছুঁয়েছে নিজের ডান কাঁধ। অন্য জনের বাঁ কাঁধ। তার মধ্যে রয়েছে একটা করে জ্যান্ত সেলফোন।

suvolama@gmail.com

Rabibashariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy