Advertisement
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

রমজানে নিয়মিত রোজা রাখে এই হিন্দু পরিবার

বারাসতের অদূরে ভাঙাচোরা এক মসজিদ। তাকে নতুন প্রাণ দিলেন দাঙ্গার শিকার এক হিন্দু পরিবার। রমজানে আজও তাঁরা নিয়মিত রোজা রাখেন। ঋজু বসুবারাসতের অদূরে ভাঙাচোরা এক মসজিদ। তাকে নতুন প্রাণ দিলেন দাঙ্গার শিকার এক হিন্দু পরিবার। রমজানে আজও তাঁরা নিয়মিত রোজা রাখেন। ঋজু বসু

মসজিদের ইমামের সঙ্গে পার্থসারথি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

মসজিদের ইমামের সঙ্গে পার্থসারথি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

মাস দেড়েক আগে জ্যাঠামশাই মারা যেতে নিয়মমত ন্যাড়া হয়েছিলেন তিনি। এখন সবে গুঁড়িগুঁড়ি চুল উঁকি দিচ্ছে। বড়সড় একটা রুমাল মাথায় বেঁধে মসজিদের ছাদটায় রোজাদারদের কাতারে ইফতারে বসলেন পার্থ।

চল্লিশের যুবাকে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না বন্ধুরা। মজা করে ডাকে, ‘মহম্মদ’ পার্থসারথি বসু! পার্থর তাতে বয়ে গিয়েছে। দিনভর উপবাস শেষে আল্লাহকে ইমামসাহেবের ধন্যবাদ জ্ঞাপন মিটতে, মোবাইলে নিষ্ঠা ভরে টাইম মিলিয়ে খেজুরটা-কলাটা মুখে দিয়ে পিত্তরক্ষা করবেন।

বারাসত ডাকবাংলোর মোড় থেকে বড়জোর মিনিট দশেকের পথ। আশপাশে এক ঘর মুসলিমেরও বাস নেই এ তল্লাটে। কয়েক কিলোমিটার দূরে মধ্যমগ্রামের কোঁড়া, চন্দনপুর, কাটুরিয়া বা মছপুল থেকে আসেন রোজাদারের দল। বারাসত-হৃদয়পুর রুটের অটোচালক আবু হোসেন মণ্ডল, সবজিবিক্রেতা আর্শাব আলি বা ঝকঝকে কলেজপড়ুয়া আজ্জু ওরফে শেখ আজহারউদ্দিনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, পাড়ার ডাক্তারবাবু মনোতোষ মিস্ত্রি বা রেলের অফিসার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

মসজিদের পাশে চলতে ফিরতে কপালে হাত ঠেকান অমুসলিমরা। কিংবা আদ্যিকালের বাদামগাছটার বাঁধানো বেদিতে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যান। ইফতারের আগে রাস্তার কল থেকে জল ভরে দেওয়াতেও হাত লাগান কেউ কেউ। পাশেই আম-লিচুর মস্ত বাগান! কিছু দিন হল, সেখানে আবার ঠাকুর গড়ছেন পটুয়া নিশি পাল। পড়ে থাকা কাঠামোয় খড় লেপে আর কিছু দিন বাদেই শুরু হবে মা-দুগ্গা গড়ার কাজ। নিত্যকার জুম্মার জমায়েত, মসজিদের ছাদের ইফতার, রমজানের তারাবির নমাজ বা কোরান-পাঠে তাতে কখনও সমস্যা হয়নি।

বারাসতে পশ্চিম ইছাপুর নবপল্লির এই মসজিদটাই ধ্যানজ্ঞান বোসবাড়ির ছেলের। এ তল্লাটে ২০-২৫ বিঘা জমি জুড়ে বোসেদের বিষয়-আশয়। আজকের বুড়ো কর্তা দীপক বসু কালীপুজোয় বাড়িতে উপোস করেন। কিন্তু এই ৬৭ বছরেও রোজ সকাল-বিকেল মসজিদে হাজির হওয়া চাই। সকাল সাতটায় নিজের হাতে মসজিদের মেঝে ঝাড়পোঁছ করলে, তবেই শান্তি। এই বয়সে নিজে রোজা রাখতে পারেন না। কিন্তু তাঁর পুত্র পার্থ ওরফে ‘বাপ্পা’র ফাঁকির জো নেই।

‘ওরা সারা দিন জলস্পর্শ না-করে আছে, আমি কী করে খাই!’ ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর হল পার্থও রোজা রাখতে শুরু করেছেন। স্বামীর খেয়ালটুকুকে মর্যাদা দিতে ভোরের সেহ্‌রি-র আগে চা-রুটি করে দিতে রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠছেন পার্থর স্ত্রী পাপিয়া। গত বছর রমজানে ব্যবসার কাজে বেশ কিছু দিন হৃষিকেশে ছিলেন পার্থ। পবিত্র হিন্দু তীর্থেও রোজার রুটিনে নড়চড় হয়নি।

বারাসতে দেশান্তরী খুলনার বসু পরিবার অবশ্য কল্পনাও করেনি, তাঁদের ভাগ্যের সঙ্গে এ ভাবে জড়িয়ে যাবে একটি মসজিদ।

’৬৪ সালে পুব পাকিস্তানের দাঙ্গার আগে কোনও দিন ‘ইন্ডিয়ায় থিতু হব’ ভাবেনইনি কেউ। পার্থর ঠাকুরদা প্রয়াত নীরদকৃষ্ণ বসু পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাতের ‘খিদমত-ই-পাকিস্তান’ খেতাবধারী। চট্টগ্রাম বন্দরের গেজেটেড অফিসার ছিলেন। খুলনার ফুলতলার আলকাগ্রামের বোসেদের জীবনে গভীর ঘা রেখে গিয়েছিল তখনকার ঘটনা। রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে টানা ১১ দিন দফায় দফায় পুকুরে ডুব দিয়ে মুখটুকু তুলে লুকিয়ে ছিলেন এ বাড়ির ছেলে মৃণালকান্তি। নীরদকৃষ্ণের সেজো ছেলে নারায়ণকৃষ্ণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। তাঁকে খতম করে ওরা ফের চড়াও হবে ভেবে গলায় দড়ি দেন তাঁর স্ত্রী গৌরী। নীরদকৃষ্ণ ও তাঁর ভাই বিনোদবিহারীর সন্তানেরা এর পরেই বারাসতের ওয়াজুদ্দিন মোড়লের বিশাল সম্পত্তি পালটাপালটি করে এ পারে চলে আসেন।

যে জমির মালিকানা মিলেছে, তাতে যে একখানা মসজিদ রয়েছে, তা অবিশ্যি গোড়ায় কেউ খেয়াল করেননি। জমির পরচাতেও কিছু লেখা ছিল না। মেরেকেটে তিন কাঠা জায়গা। ভাঙাচোরা পোড়ো মসজিদটা কবেকার মধ্যযুগের তা বলতে পারেনি কেউ। সাপখোপের ভয়ে কেউ ভেতরেও ঢুকত না তখন। ‘ও রাখা না-রাখা সমান’ বলে মাথা ঘামাতেই চাননি সাবেক মুসলিম মালিকরা। কিন্তু বাদামগাছের ধারের মসজিদে ভক্তি ভরে বাতি জ্বেলে নীরদকৃষ্ণের স্ত্রী লীলাবতীর মনটাই অন্য রকম হয়ে গেল। ‘এ মসজিদে বাতিধূপের যেন অভাব না হয় বাবা,’ ছেলেদের বলেছিলেন তিনি।

গুটিকয়েক রাজাকারের অত্যাচারের জন্য একটা গোটা ধর্ম ও তার মানুষদের দোষ দিতে পারব না। কিছু মানুষের বিশ্বাসের স্মারক ধর্মস্থানের অমর্যাদা হতে দেওয়াও তো সম্ভব নয়! — এটাই ছিল নীরদকৃষ্ণের জীবনদর্শন। বোসেদের হাতে মসজিদ তাই নতুন প্রাণ পেল। নিজেরা কখনও ধর্ম পালটানোর কথা ভাবেননি। বিশ্বাসী হিন্দু পরিবার নিজের ধর্মাচরণ বজায় রেখেছে। শুধু ক্ষুদ্রতাকে প্রশ্রয় দেননি তাঁরা।

‘লোকদেখানো বাড়াবাড়ি মানি না। এটুকু বুঝি, একসঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় সমস্যা নেই!’— স্মিত হাসেন পার্থর বাবা দীপকবাবু। ধীরে ধীরে সাধ্যমত মসজিদ সংস্কারের পথে হেঁটেছেন বসুরা।

মসজিদের গায়ে বড় হরফে লেখা, ‘প্রভুকে প্রণাম করো’! তার পাশে, ‘আমানতি মসজিদ’। এই বসু পরিবার আবার চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের ভক্তির পীরবাবা আমানত আলি শাহের মুরিদ (শিষ্য)। তাঁর নামে হুজুরঘরও গড়ে উঠেছে। বসুদের পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গেও ক্রমশ একাকার এ মসজিদ।

এ বাড়ির কেউ মারা গেলে, তাঁকে একবারটি ঠিক নিয়ে আসা হবে এখানে। শ্মশানে শেষযাত্রার আগে আজান দেবেন ইমামসাহেব। বিয়ের পরে নতুন বউকেও প্রথম বার শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে মসজিদে প্রণাম করতে আসতে হবে। আর এ বাড়িতে নবজাতকের অন্নপ্রাশনের দস্তুর নেই। তার বদলে মসজিদে ইমামসাহেবের হাতে একটু পায়েস মুখে দেওয়ার রীতি। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের উসকানির কাছে হার না-মানা পারিবারিক মূল্যবোধেরও আমানত এই মসজিদ-প্রাঙ্গণ।

আড়াই দশক আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন তোলপাড় গোটা দেশ। নিঃশব্দে উলটো পথে হাঁটছিল, এই মফস্‌সলি মহল্লা। টালির চাল, বাঁশে ঘেরা মসজিদ ফের চাঙ্গা করে তুলতেই নতুন করে ইটের গাঁথনি বসছিল তখনই। পার্থ, তাঁর জেঠতুতো দাদা-ভাইরা ভরসন্ধেয় দল বেঁধে মসজিদেই পড়ে থেকে পাহারা দিতেন। বাপ-জ্যাঠাদের কড়া আদেশ, তাঁদের এই পারিবারিক মসজিদটিতে কোনও আঁচড় যাতে না পড়ে।

পড়েওনি, বলা বাহুল্য। এমন জাগ্রত মসজিদের কোনও ক্ষতি প্রাণে ধরে কে-ই বা হতে দেবেন! পাড়াপড়শি সবার বিশ্বাস, এই মসজিদই তাঁদের রক্ষাকর্তা। রাজনীতির ঝড়বাদলের কোনও অভিঘাত এখানে ছাপ ফেলতে পারেনি। দীপকবাবু কেরোসিনের ডিলার। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যৎসামান্য টাকা রেখে এখনও বারো আনাই উজাড় হয় মসজিদের যত্নে। এই বোসবাড়িরই ছেলে বম্বের প্রয়াত ফিল্ম ডিরেক্টর দিলীপকুমার বসু। তুতো ভাইরা মিলে ভাগাভাগি করে মসজিদের চেহারা ফিরিয়েছেন। ইমাম, মুয়াজ্জিনদের ডেকে এনে বসানো হয়েছে। সঙ্কটে-সমস্যায় হিন্দুরাও আসেন। কিন্তু কবচ-তাবিজ বিক্রির কোনও প্রশ্ন নেই।

‘বিশ্বাস বিশ্বাসের জায়গায় থাকুক! ধর্মব্যবসা কিন্তু হতে দেব না,’ জোর গলায় বলেন দীপকবাবু। অনেক বছর আগে তাবিজ-মাদুলি বিক্রির দোষে এক ইমামকে বরখাস্তও করেছিলেন বসুরা। তিনি পালটা ঘোঁট পাকাতে গেলে ‘বোসবাড়ির মসজিদ’ শুনে কেউ সে অভিযোগে আমলই দেননি।

পার্থর হাত দোয়া চাওয়ার ভঙ্গিতে, ইমাম সাহেব করজোড়ে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

কেউ যাতে আঙুল তুলতে না-পারে, তাই এ মসজিদে নগদ অনুদান গ্রহণেরও নিয়ম নেই। নানা ব্যবসায় জড়িত থাকলেও স্থানীয় মুসলিমদের জমিতে হাত দিতে হতে পারে ভেবে প্রোমোটারি এড়িয়ে চলেন বসুরা। একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠনের তরফে এক বার মসজিদের দায়ভার কাঁধে নেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। বসুরা তাঁদের বসিয়ে চা খাইয়েছেন। আর ‘এই প্রাণের মসজিদ কী করে ছেড়ে থাকব’— সবিনয় নিজেদের অপারগতাটুকু বুঝিয়েছেন।

ইফতারেও রাজনীতির ছোঁয়াচ লাগার জো নেই। কোনও নেতানেত্রীকে ডাকা হয় না। ‘ইফতার-পার্টি’ শব্দটাতেই ঘোর অ্যালার্জি পার্থর। ‘ইফতারের আবার পার্টি কী? এখানকার রোজাদারদেরও জাঁকজমক ভরা মোচ্ছব এড়িয়ে চলতেই অনুরোধ করা হয়!’

সম্প্রীতি: দীপকবাবুর ইফতার-তদারকি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ইফতারের সময় তবু আনন্দের হাট বয়ে যায়। ফি সন্ধেয় ইমামের কোরান পাঠের আসরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভিড়। পার্থ বলেন, ‘আমরা মানি, কোরান কিন্তু শুধু মুসলিম নয়, সবার পড়ার জন্য!’ সাতাশের রোজার দিন পড়া সম্পূর্ণ হলে সাধ্যমত চাঁদা তুলে পাড়ার সক্কলকে মাছ-ভাত খাওয়ান নিয়মিত রোজাদাররা। বিকেলে ইমাম আখতার আলি আসেন মোটরবাইক হাঁকিয়ে। সন্ধেয় তারাবির নমাজ শুরুর আগে মসজিদে বসে এক প্রস্থ মাছ-ভাত খেয়ে ওঠেন। কিন্তু পিতৃপ্রতিম দীপকবাবু আশপাশে থাকলে, তাঁর মুশকিল। এক টিপ খইনি মুখে দিতেও আখতারভাইকে আড়াল খুঁজতে হবে। ধরা পড়লে বকুনি। সবার গার্জেন দীপকবাবুর স্নেহের শাসন জারি থাকে সারা ক্ষণ।

ধর্ম-রাজনীতির খোপকাটা যাপন এখানে অবান্তর! বারাসতের অখ্যাত মহল্লায় তিন কাঠার জমির ভারতবর্ষ নিরন্তর বলে চলেছে, ‘একসঙ্গে বাঁচবই’!

অন্য বিষয়গুলি:

Hindu Muslim Communal Harmony Rituals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy