Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Coronavirus

হাত ধোওয়ার ইতিকথা

এক হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, হাত ভাল করে ধুলে তা জীবাণুমুক্ত হয়। আর তাতেই শূন্যে নেমে এসেছিল প্রসূতি মৃত্যুর হার। সর্বাণী ঘোষঘটনাটা বিশদে জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২০ ০০:১০
Share: Save:

বিশ্ব জুড়ে করোনা-আতঙ্কের এই সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা বলছে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার অন্যতম উপায়, সাবান দিয়ে বার বার হাত ভাল করে ধোওয়া।

হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করার কথা প্রথম বলেছিলেন যিনি, তিনি এক জন হাঙ্গেরিয়ান ডাক্তার, নাম ইগনাজ় ফিলিপ সেম্মেলওয়াইজ়। বলেছিলেন ১৮৪৭ সালে, মানে আজ থেকে ১৭৩ বছর আগে। কিন্তু তার পরিণামে তাঁকে অকালমৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল।

ঘটনাটা বিশদে জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে।

১৮৪৬ সাল। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালের ফার্স্ট অবস্টেট্রিকাল ক্লিনিক, মানে ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে প্রোফেসর ইয়োগান ক্লেইনের সহকারী হিসেবে যোগ দিলেন ইগনাজ় ফিলিপ সেম্মেলওয়াইজ়। তাঁর পদ ছিল চিফ রেসিডেন্ট-এর। কাজ ছিল রোজ সকালে প্রোফেসর আসার আগের প্রস্তুতি নেওয়া, জটিল কেসগুলোর তত্ত্বাবধান করা আর যাবতীয় রেকর্ড লিখে রাখা।

ওই হাসপাতালে ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে দু’টো ওয়ার্ড ছিল। দু’টোতেই ভর্তি হতেন আসন্নপ্রসবা মায়েরা। প্রথম ওয়ার্ড চলত হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে, আর দ্বিতীয়টি চালাতেন কয়েক জন শিক্ষিত ধাত্রী। প্রসবের পর ওই মায়েদের এক ধরনের জ্বর হত, যা ‘পিউয়েরপেরাল ফিভার’ বা ‘চাইল্ডবেড ফিভার’ নামে পরিচিত। ওই জ্বরে মৃত্যু পর্যন্ত হত। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা হল, দুই ওয়ার্ডে ওই জ্বরে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে অনেকটা তফাত। প্রথম ওয়ার্ডে যেটা ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি, দ্বিতীয় ওয়ার্ডে সেটা মাত্র ৪ শতাংশ। সবাই, এমনকি ভর্তি হতে আসা মায়েরা পর্যন্ত জানতেন এই তথ্য। তাই প্রথম ওয়ার্ডে ভর্তি না করার জন্য ডাক্তারদের হাতে-পায়ে ধরতেন তারা। ওখানে ভর্তি হওয়ার থেকে রাস্তায় সন্তানের জন্ম দেওয়াও শ্রেয় মনে করতেন আসন্নপ্রসবারা।

কাজে যোগদানের কিছু দিনের মধ্যেই সেম্মেলওয়াইজ়েরও নজরে পড়ল এই ঘটনা। তিনি ভাবতে বসলেন এর সম্ভাব্য কারণ। দিন-রাত গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকলেন। প্রথমেই বাদ পড়ল ধর্মীয় কারণ, তার পর বাদ দিলেন অতিরিক্ত ভিড়ের তথ্য, কারণ প্রথম ওয়ার্ডের চেয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডেই বেশি ভিড় হত। জলবায়ুগত কারণও বাদ দিতে হল, কারণ দু’টো ওয়ার্ডেই সেটা একই রকম। খেয়াল করে দেখলেন, জুনিয়র ডাক্তারদের নৈপুণ্য ও নিষ্ঠাতেও কোনও ত্রুটি নেই। তা হলে?

সমাধানের সূত্র এল আচমকাই। ১৮৪৭ সালে তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী, জেকব কলেচকা মারা গেলেন পিউয়েরপেলার জ্বরে মৃত এক রোগিণীর শব ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে। স্ক্যালপেলে হাত কেটে জ্বর এবং মৃত্যু। বন্ধুর শব ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে সেম্মেলওয়াইজ় সেই রোগিণীর লক্ষণগুলোই জেকব কলেচকার শরীরে খুঁজে পেলেন।

বুঝতে দেরি হল না যে, এক রোগীর মৃতদেহ থেকেই আর এক জনের শরীরে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মাধ্যম— ডাক্তারের হাত।

দুয়ে-দুয়ে চার করলেন সেম্মেলওয়াইজ়। জুনিয়র ডাক্তাররা শব ব্যবচ্ছেদ করার পর সেই হাতেই যখন বাচ্চা প্রসব করান, তখন মৃতদেহের শরীরের রোগজীবাণু হাত-বাহিত হয়ে চলে যায় প্রসূতির শরীরে। ফল সেই জ্বর এবং মৃত্যু। ধাত্রীরা শব ব্যবচ্ছেদ করতেন না, ফলে তাদের দ্বারা প্রসব করানো মায়েদের ওই বিপদ এবং মৃত্যুর আশঙ্কাও তুলনায় কম থাকত।

সেম্মেলওয়াইজ় তাই জুনিয়র ডাক্তারদের নির্দেশ দিলেন, শব ব্যবচ্ছেদ করার পর প্রথমে ক্লোরিনেটেড লাইম মিশ্রণে (ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট) হাত ধুতে হবে। তার পর প্রসব করানোর কাজ। জুনিয়র ডাক্তারদের আপত্তি ছিল না ওঁর নির্দেশ মানতে।

অচিরেই ফল পাওয়া গেল। প্রথম ওয়ার্ডের মৃত্যু পরিসংখ্যান এক ধাক্কায় প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেল। ১৮৪৭ সালের এপ্রিলে প্রথম ওয়ার্ডের মৃত্যুহার যেখানে ছিল ১৮.৩ শতাংশ, মে মাস থেকে হাত ধোওয়া শুরু করার পর জুন, জুলাই ও অগস্ট মাসে পর্যায়ক্রমে সেটা দাঁড়াল ২.২, ১.২ এবং ১.৯ শতাংশে। এর পরে সেটাও শূন্য হয়ে গেল।

কী ভাবছেন? এই অবিশ্বাস্য সাফল্যে ডাক্তার সেম্মেলওয়াইজ়-এর জয়-জয়কার পড়ে গিয়েছিল সব জায়গায়?

মোটেও না। উল্টে সিনিয়র ডাক্তাররা এটাকে একদমই ভাল চোখে দেখলেন না। হাত কি ধোওয়ার বস্তু? হাত ধুলেই রোগ কমে যাবে, তাই হয় না কি? চলল উপেক্ষা, লাঞ্ছনা আর উপহাস। এমনকি চাকরিও খোয়াতে হল সেম্মেলওয়াইজ়কে।

চলে এলেন বুডাপেস্টে। সেখান থেকে বিভিন্ন ইউরোপীয় জার্নালে তাঁর লেখা পাঠালেন, সিনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ জানিয়ে সংবাদপত্রে খোলা চিঠি লিখতে লাগলেন। কোনও ফল না পেয়ে বাধ্য হয়ে বইয়ের আকারে প্রকাশ করলেন ‘ইটিয়োলজি, কনসেপ্ট অ্যান্ড প্রোফাইল্যাক্সিস অব চাইল্ডবেড ফিভার’। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের কোনও তাত্ত্বিক প্রমাণ দিতে পারলেন না। কাজেই কেউ তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এল না। এমনকি স্ত্রীও বিপক্ষে গেলেন। সবার বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তে তিনি ক্রমশ গভীর অবসাদগ্রস্ত হলেন। সবাই ভাবল তিনি উন্মাদ, তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে জোর করে ভর্তি করে দিলেন পাগলাগারদে। সেখানে দিনের পর দিন ধরে চলা মারধরে তাঁর হাতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেল। সংক্রমণ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। ১৪ দিন পরে, ১৮৬৫ সালের ১৩ অগস্ট মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন।

তাঁর তত্ত্ব স্বীকৃতি পেল তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর বছরখানেক পর, যখন লুই পাস্তুর ‘জার্ম থিয়োরি’ আবিষ্কার করলেন এবং তার সাহায্যে সেম্মেলওয়াইজ়-এর তত্ত্ব পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করলেন।

আজ ইগনাজ় সেম্মেলওয়াইজ়কে সারা বিশ্ব চেনে ‘অ্যান্টিসেপটিক পলিসি’-র পথিকৃৎ হিসেবে।

আজ বাচ্চাদের দেখার আগে, ছোঁয়ার আগে বার বার হাত ধুতে হয় ডাক্তারদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তৈরি করে দিয়েছে হাত ধোওয়ার নির্দেশিকাও। ভাবী ডাক্তারদের পড়তে হয় ‘গোল্ডেন রুল অব হ্যান্ড ওয়াশিং’।

আজ এই করোনা-উপদ্রুত সময়ে সে দিনের সেই অবহেলিত মানুষটির দেখানো রাস্তাতেই তৈরি করা সম্ভব আমাদের সুরক্ষা-বলয়। সেই মানুষটি, সময়ের চেয়ে এগিয়ে মানুষের কল্যাণের কথা ভাবার জন্যই যাঁকে অকালে নিষ্ঠুর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Hand Washing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE