টা লির চালের খুপরি ঘর। ঘরের পুরোখানাই প্রায় জুড়ে আছে একটামাত্র খাট। বাকি ফালিটুকুতে টেবিল আর রান্নার জায়গা। স্যাঁতসেতে ঘরে হাওয়া ঢোকে না এতটুকু, আলোও না।
‘থাকো কী করে মাসি?’
‘ওটুকু যে আমার নিজের জায়গা দিদি। ছোট হলই বা।’
বারো মাস এজমালি উঠোনে ঘুরপাক খায় নোংরা জল, কাদা। কিন্তু সারা দিন আমার একরত্তি খুদের যাবতীয় দায়িত্ব পরিপাটি সামলে, বারো ঘণ্টার ডিউটি শেষে ওখানেই ফিরবে মাঝবয়সি বেঁটেখাটো চেহারাটা। ফিরবেই। সে দিন বাইরে তুমুল বৃষ্টি। সমস্ত রাস্তা জল থইথই। অটো নেই, দু’চারটে বাস চললেও, দমবন্ধ ভিড়ে ওঠার উপায় নেই।
‘আজ রাতটা এখানেই থেকে যাও মাসি। যাবে কী করে?’
কিন্তু যেই বৃষ্টি ঝমঝম থেকে টুপটাপ, অমনি ছাতা মাথায়, ব্যাগ বগলে ছুট। বস্তির ওই চিলতেখানেক জায়গার ওপর কীসের এত টান? টান নয়। আসলে বোধহয় লোভ। নিজের বিছানার ওমের লোভ। নিজের কেনা স্টোভে, নিজের হাতা-খুন্তি-হাঁড়িতে, ইচ্ছেমত তেল, মশলা ঢেলে ভাত-তরকারি রেঁধে খাওয়ার লোভ। যার ভাল নাম স্বাধীনতা।
সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো লোকের বাড়ি বাড়ি ঘোরা। মা সেখানে বাসন মাজে। তো, ছ’বছরের মেয়েও চলল সঙ্গে, ইলাস্টিক-হীন প্যান্টুলের এক প্রান্ত চেপে ধরে। মায়ের হাতে হাতে কাজটা একটু এগিয়ে দেবে। বদলে দুটো বিস্কুট, নয় ঈষৎ টকে-যাওয়া মিষ্টি। তার পর রাতারাতি দক্ষিণ ভারত পাড়ি। চব্বিশ ঘণ্টার লোক হয়ে। অনেক টাকা মাইনে। ‘নিজের সংসার আর হল কই দিদি। বিয়ের ক’বছর পরেই লিভার পচে বরটা মরল, ছেলেপুলেও হল না। শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও আর রাখল না।’
তার পর থেকেই শুরু হল মুম্বই, কেরল, গুজরাতে পাড়ি দেওয়া, আর অন্যের সংসার, অন্যের সন্তানকে আগলে আসা। সাড়ে উনিশ ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে মোটা টাকা, টুকটাক চিকিৎসা, নিজের একখানা ঘর-বাথরুম, তেল-সাবান-কাপড়ের নিশ্চিন্ত বন্দোবস্ত।
সেখানে মার্বেলের মেঝে, সেখানে ম়ডিউলার কিচেন, গিজারের জল, সপ্তাহান্তের পার্টির এলাহি ভোজের টুকরোটাকরা, বছরে দু’বার নতুন জামা-কাপড়, নামী হাসপাতালে গলব্লাডার অপারেশন। ভরপুর আরাম না থাক, নিরাপত্তা আর স্বাচ্ছন্দ্য তো অঢেল।
সব ছেড়ে দিল। এক কথায়। মার্বেল বদলে গেল সিমেন্টে, মাইক্রোওভেন মুছে গিয়ে এল স্টোভ, খাটে ছারপোকা। কেন? পলকে চোখের পাতা ভারী। ওই যে, বয়সটা পঞ্চাশ পেরোল। বেয়াড়া মন টিকটিক করে বলতে লাগল, তোর নিজের কিস্যু নেই। সব অন্যের। যে দিন শরীর হাল ছাড়বে, তুইও রাস্তা নিবি। একটা বালিশও সে দিন তুই নিজের বলে নিয়ে যেতে পারবি না। তার ওপর দায়িত্ব!
সেই যে বার গুজরাতে দারুণ ভূমিকম্প, তখন তো আমদাবাদের কিচেনে কাজ সারছিল মাসি। পাশের ঘরে ছোট্ট মেয়ে তারই জিম্মায়। আর কেউ নেই। ভূমিকম্প শুরু হতেই বাচ্চা কোলে দৌড়। তার পর অনেক দিন উলটো দিকের মাঠে ত্রিপলের নীচে মাসি আর বাচ্চাকে রেখেই বেরোত সে বাড়ির দাদা-বউদি। এক-এক বার ছুট্টে ফ্ল্যাটে ঢুকে বাচ্চার খাবারটুকু তৈরি করেই আবার সেই ছাউনিতে ফেরা। কী ভয়! গুজরাত ছেড়ে পালিয়ে আসতে চাইলেও উপায় নেই। দাদার সময় হবে, টিকিট কাটবে, বউদি অন্য লোক ঠিক করবে, তবে না ফেরা! ওই জন্যই তো বাবার অসুখের সময়ও কেরল থেকে ফেরা হল না।
অন্যের সংসারের এত দায়িত্ব আর কত দিন! ছুটি চাইল মন। ব্যস, এক দিনে, মাত্র এক দিনেই একলাই ভাড়াবাড়ি ঠিক করে, খাট-আলনা কিনে শুরু নতুন জীবন। নিজের জীবন। বাঁধনহীন মুক্ত জীবন।
পছন্দমত বাড়িতে ডিউটি, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অল্প অল্প টাকা জমানো, মাসে দু’দিন ছুটিতে মায়ের কাছে যাওয়া, মন্দিরে পুজো, বা়ড়ি ফিরে ইচ্ছে হলে টিভি, ইচ্ছে হলে ঘুম। রাত একটা অবধি পার্টি শেষের অপেক্ষায় ঘুম-চোখে বসে থাকার হুকুম নেই। তরকারি পুড়লে, কাপ ভাঙলে মালকিনের ঠান্ডা চাউনি নেই।
খুব সুখ না থাক, অ-সুখও তো নেই।