Advertisement
E-Paper

ঘটক টেলার্স রহস্য

কনক রায় লেনটা যেখানে বড় রাস্তায় পড়তে পড়তে একটু চওড়া হয়ে গেছে, ঠিক সেখানে নভেম্বরের শেষাশেষি এক ভোরবেলা পাড়ার মেথর শিউপ্রসাদ দেখল, একটা পরদার কাপড়ের বস্তা পড়ে আছে।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

কনক রায় লেনটা যেখানে বড় রাস্তায় পড়তে পড়তে একটু চওড়া হয়ে গেছে, ঠিক সেখানে নভেম্বরের শেষাশেষি এক ভোরবেলা পাড়ার মেথর শিউপ্রসাদ দেখল, একটা পরদার কাপড়ের বস্তা পড়ে আছে। খুলে দেখে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। শিউপ্রসাদ হাঁউমাউ করে উঠে, অনেক বছর আগে ঠিক এখানেই একটা পুঁটুলির মধ্যে ন্যাকড়া জড়ানো সেই সদ্যোজাত শিশুকে যে ভাবে কোলে তুলে নিয়েছিল, সে ভাবেই টাকার বস্তাটাকে কোলে তুলে নিল। কোণের বাড়ির সরোজিনী পিসিমা তখন তুলসীগাছে জল দিতে সবে বেরিয়েছেন দোতলার বারান্দায়। তিনি দেখলেন, শিউপ্রসাদ এক বস্তা টাকার ওপর পড়ে কাঁদছে। সরোজিনী তুমুল হইচই করে ভাইয়ের ছেলেদের ঘুম থেকে তুলে দিলেন, ‘গিয়ে দ্যাখ কী ব্যাপার। কিন্তু খবরদার ছুঁবি না। ছুঁলে আমি অনর্থ করব। শিউপ্রসাদ ছুঁয়ে-ছাঁয়ে সব একাকার করেছে। মা গো, এই টাকা এখন কার ঘরে উঠবে গো! বাড়ির ছোটবউ ফুট কাটল, ‘আহা, গদির তলায় যে নোটগুলো রাখেন পিসিমা, সেগুলো কার হাত ঘুরে এসেছে কেউ জানে? ওগুলো সব বাতিল নোট। কাগজ কা টুকরা। এগুলো সব সরকার পুড়িয়ে ফেলবে।’

‘দেখলে দোষ। না দেখলে দোষ নেই।’ বলে পিসিমা তরতর করে নীচে নেমে গেলেন ঘটনা কোন দিকে যায় তা স্বচক্ষে দেখার জন্য।

তত ক্ষণে পুরো পাড়া জেগে উঠেছে। বাড়ি বাড়ি থেকে ঘোষ বোস মিত্র দাস বর্মন হালদার লাহিড়ী সরখেল চক্রবর্তী চৌধুরি সব জড়ো হয়ে গেছে কনক রায় লেনের মাথায়। অপূর্ব রায় হলেন এ পাড়ার একটা গার্জেনের মতো। পাড়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল আর নামডাকওয়ালা পরিবারের এখনকার প্রধান পুরুষ। বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে। এ পাড়ার রাস্তার নামকরণ ওঁর ঠাকুমার নামেই। তিনি মর্নিং ওয়াক স্থগিত রেখে হন্তদন্ত এসে দাঁড়াতেই অনেকে ওঁর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। অবশ্যই এই বেওয়ারিশ পাঁচশো হাজারের নোটগুলোর ভবিষ্যৎ স্থির করার উৎকণ্ঠায়। রণেন বলল, ‘তা হলে জ্যাঠামশাই পুলিশে
খবর দিই?’

শেখর বলল, ‘ক’টা নোট কি শিউপ্রসাদ নেবে নাকি কাকাবাবু? এক খামচা নিলেই ওর হিল্লে হয়ে যাবে।’

অপূর্ব রায় উপস্থিত সকলের মুখের ওপর এক বার তীক্ষ্ণ চোখ বুলিয়ে নিলেন। এখানে যারা এই ভোরে ঘুমচোখে এসে হাজির হয়েছে, তাদের কেউই বড়লোক নয়। নেহাত ছাপোষাই বলা যায়। দু’-একজন ছাড়া। কিন্তু কারও চোখেই রায় খুব একটা লোভ দেখতে পেলেন না। সবাই উত্তেজিত। উত্তেজনার কারণ অনুমেয়। এত টাকা এল কোত্থেকে? পাড়ার টাকা? না বেপাড়ার? যে ফেলেছে সে অনেক অপেক্ষা করে তবে কালোকে সাদা করতে না পারার হতাশায় ফেলেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু ফেললই বা কেন? বাড়িতে পুড়িয়ে ফেললেই তো পারত। সমবেত লোকজনের মুখে এই সব প্রশ্নগুলোই উঠে আসছে। যাদের অবস্থা বেশ ভাল, তারা র‌্যাপার-ট্যাপার জড়িয়ে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এমনিতে বনেদি পাড়া। মেথরের চারপাশে ভিড় জমানোর লোক কমই। অপূর্ব রায় বললেন, ‘পুলিশকে খবর দেওয়ার আগে এক বার রঘুবীরকে ডাক তো জগা। শিউপ্রসাদ কোনও টাকা নেবে না। এ সব কথা চাপা থাকে নাকি? আমাদের তত্ত্বাবধানে এ সব বেআইনি কাজ তো হতে দেওয়া যায় না। কী বলিস শঙ্কর?’

শিউপ্রসাদ বলল, ‘বড়বাবু, বিশ বছর আগে সেই বেওয়ারিশ বাচ্চাকে তো হামাকেই লিয়ে লিতে বলেছিল সব কোই। হামি তো লিয়ে ভি ছিলাম। কিন্তু ভগমান উঠাইয়ে লিলেন। এখন সব না দিন, কুছু তো লিতে দিন।’ তত ক্ষণে দু’-চার জন রঘুবীরকে ডেকে আনতে চলে গেছে। মলয় মল্লিক বলল, ‘কাকাবাবু, মনে হচ্ছে কোটি খানেক হবে।’

অপূর্ব রায় ভ্রুকুটি সহকারে বললেন, ‘দেখছি।’

দশ মিনিটের মধ্যে রঘুবীরকে নিয়ে হাজির হল লোকজন। ভিড়টাও এ বার বাড়ছে। রঘুবীর হল এ পাড়ার একটা প্রাইজ্‌ড পজেশন। একাধারে চাইনিজ টেকঅ্যাওয়ে রেস্টুরেন্টের মালিক আর প্রাইভেট ডিটেকটিভ। বয়স আঠাশ ছাড়ায়নি। রোগা-রোগা ছোটখাটো চেহারা। গায়ের রংটা ফটফটে ফরসা ঠিকই, কিন্তু খুব শুকনো-শুকনো মতো। দু’গালে হালকা ছুলির দাগ আছে। চুলটা আর চোখ দুটো দেখার মতো। তবে এক অর্থে মাকুন্দ। না থাকার মতো একটা গোঁফ আর দাঁড়ির রেখা শুধু। হাতে বুকে কোন রোম নেই। কিন্তু সর্বনাশের ব্যাপার হল, রঘুবীরের হাতের দুটো পাতা আর দু’হাতের দুটো কনুই। এমন শক্ত, কেঠো হাত আর কনুই যে কারও হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। হাত মুঠো করলে আঙুলের ওপর দিকের যে তিনকোনা হাড়গুলো জেগে ওঠে, সেই এক-একটা হাড়ের ঠোকায় যখন তখন একটা নারকেল ফাটিয়ে ফেলতে পারে রঘুবীর। জোরে ঘুসি মারলে গাছের গুঁড়ি-ফুড়ি শিরা উপশিরায় ফেটে যাওয়াটাও কোনও ব্যাপার না। আখরোট তো ছুঁইয়ে দিলেই ফেটে চৌচির। মিত্র বাড়ির কুলদেবতা ননীগোপালের দেড়শো বছরের পুরনো পাথরের বাসন এক বার এমন খাপে খাপে আটকে গিয়েছিল যে কিছুই করা যাচ্ছিল না। তখন রঘুবীর এসে ভেতর দিয়ে কায়দা করে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট্ট বাটিকে গাঁট্টা মেরে ভেঙে দিতেই সব বাসন আলগা হয়ে গেল। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হল, রঘুবীরের বুদ্ধি খুব শাণিত। বেশ কয়েকটা রহস্যের সমাধান করে তার এখন ভালই রেপুটেশন।

রঘুবীর এল বেশ প্রফুল্ল মেজাজে। এসেই বলল, ‘ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল? এ তো প্রায় তিরিশ-পঁয়তিরিশ লাখ টাকা!’

অপূর্ব রায় বললেন, ‘বল রঘু, এ টাকা পাড়ার?’

‘টাকা এ পাড়ারই।’ এক মিনিট সময় নিয়ে বলল রঘুবীর।

‘কী দেখে বুঝলি?’

‘পরদার কাপড়টা দেখুন। ঘটক টেলার্সের নামটা দেখতে পাচ্ছেন?’

সবাই দেখল, সুতো দিয়ে ঘটক টেলার্স লেখা এক টুকরো কাপড় পরদার এক কোণে সেলাই করা। যেমন থাকে।

অপূর্ব রায় বললেন, ‘ঘটক? সে তো কবে উঠে গেছে! দশ বছর তো হল।’

মলয় মল্লিক ভাল চাকরি-টাকরি করে। মলয় বলল, ‘পাড়ার লোক? কে রে বাবা?’

‘বিকেলের মধ্যেই বলে দেব কোন বাড়ি, জ্যাঠামশাই। কিন্তু জানার কি খুব দরকার আছে? কী লাভ জেনে?’

অপূর্ব রায় চোখ ছোট করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, বিকেলেই তোর সঙ্গে দেখা হবে। এখন তবে পুলিশে খবর দেওয়া হোক।’

রঘুবীর আর কোনও কথা না বলে নিজের মোবাইল ক্যামেরায় নানা অ্যাঙ্গল থেকে অনেকগুলো ছবি তুলে তার পর লোকাল থানায় ফোন করে দিল। লোকাল থানায় এখন নতুন যে ওসি এসেছে তার নাম কুহেলি সুলতানা। কুহেলি সুলতানার ভয়ে এখন এখানকার সব ক্রিমিনাল তটস্থ। ঘুষ-ফুষ খায় না। অপরাধীদের ধরতে পারলে কেস-ফেস দেওয়ার আগেই মেরে পাটপাট করে দেয়। সেই মার যে খেয়েছে সে জানে। রঘুবীরকে অনেক বার কুহেলি সুলতানাকে ফেস করতে হয়েছে নানান সময়ে। ও পাড়ার মেয়ে রাই ইলোপ কেসেই বেশি চেনাজানাটা হয়। রঘুবীর সাংঘাতিক ভাবে প্রেমে পড়ে গেছে কুহেলির। কুহেলি কড়া প্রকৃতির মেয়ে। রঘুবীরকে দেখলেই পা থেকে মাথা অবধি মেপে নেয়। রঘুবীরের সমস্যা হচ্ছে, সে কুহেলিকে দেখলেই ফিক করে হেসে ফেলে মাথা নিচু করে ফেলে। কুহেলি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। ‘কী ব্যাপার? এই হাসির মানেটা কী?’

‘সেটা ঠিক বলা যাবে না ম্যাডাম।’ বলে রঘুবীর। কুহেলি এখনও সিঙ্গল। রঘুবীরও তাই। প্রেমের প্রস্তাব দিলে কুহেলি সুলতানা রঘুবীরকে ক্যালাবে কি না কে জানে। খুব মুশকিলের ব্যাপার। ক্যালালে তো অন্ততপক্ষে রঘুবীর হাত দিয়ে আটকাবে? কিন্তু সেটা করলে বীভৎস ব্যাপার হবে। কুহেলি সুলতানাকে দেখলেই তাই রঘুবীর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নেয়। কুহেলি সুলতানার সঙ্গে আজ দেখা হওয়ার একটা সুযোগ আছে ভেবেই এই ভোরবেলা রঘুবীরের মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। রঘুবীর ফেমিনিস্ট আর সিরিয়াস টাইপের মেয়েদের দেখলেই প্রেমে পড়ে যায়। মিস সুলতানা খুবই উচ্চ স্তরের ফেমিনিস্ট এবং আদ্যোপান্ত সিরিয়াস। এ পর্যন্ত রঘুবীর গোটা চল্লিশ প্রেম করেছে। ঠিক এই মুহূর্তেও রঘুবীরের মোট ছ’টা প্রেমিকা। দিনের মধ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টা প্রেম না করলে রঘুবীরের চলে না। প্রেম-প্রেম করেই সে নিজের কেরিয়ারের কেরোসিন অনেক খরচ করে ফেলেছে। নইলে এ ক’বছরে সে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়ে যেত।

এর পর পাড়ায় পুলিশ এল। লোকজনকে জেরা করল। গুনে-টুনে দেখা গেল, সব সুদ্ধু চল্লিশ লক্ষ টাকা। পুলিশ টাকা তুলে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় রঘুবীরকে ইন্সপেক্টর রজত দত্ত বলে গেল, ‘রঘুবীর, ম্যাডাম এক বার যাওয়ার রিকোয়েস্ট করেছেন। পারলে ঘুরে যেয়ো ভাই।’

ও দিকে চল্লিশ লক্ষ শুনে অপূর্ব রায় একদম গুম হয়ে গেলেন। সারা জীবন টাকার পাহাড়ে বসে থেকেছেন, এই সে দিনও বাড়ির ছেলেপুলে বাচ্চাবুড়ো আর বউদের যার কাছে যা ছিল, সব এক ধমকে নিজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলে আনিয়ে গুনেছেন। সর্ব মোট দেড় কোটি মতো। কী করে তিনি দেখেই বলতে পারলেন না টাকার অঙ্কটা আর এতটা কারেক্টলি রঘুবীর বলে দিল?

রঘুবীরের টেকঅ্যাওয়ে চিনে রেস্তোরাঁ খোলে দুপুর তিনটে নাগাদ। দোকানের দেয়ালগুলো সব লাল আর দু’সেট চেয়ার-টেবিল সবুজ। একটায় রঘুবীর নিজে বসে। আর একটায় খদ্দের পাছাখানা ঠেকিয়েই খাবার নিয়ে চলে যায়। চাইনিজ খাবার। দাম অসম্ভব কম। আর তেমনই স্বাদ। সামনে একটা চাতালে সিমেন্টের বেদি আছে। লোকজন সেখানে আড্ডা দিতে জড়ো হয়। মোদ্দা কথা, জায়গাটা বেশ জমজমাট। রঘুবীর কখনও বেশি সময় থাকে না রেস্তোরাঁয়। একটু থাকে, আবার মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে যায় কোনও না কোনও অপেক্ষারত প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করে আসতে। বিচ বিচ মে রহস্য উদ্‌ঘাটনের কাজ করে। আজ বিকেল হতেই অপূর্ব রায় এসে হাজির হলেন রঘুবীরের রেস্তোরাঁয়। পাড়ার আরও ক’জনও টাকার মালিকের পরিচয় জানার উত্তেজনায় এসে হাজির। কিন্তু রঘুবীর ‘এই আসছি’ বলে সেই যে গেল, আর ফেরার নাম নেই। আটটা অবধি অপেক্ষা করে অপূর্ব রায় রেগেমেগে চলে গেলেন। বাকিরাও ফিরে গেল। তিন দিন আর রঘুবীরের কোনও পাত্তাই পাওয়া গেল না।

দিন তিনেক পরে কুহেলি সুলতানা রঘুবীরকে একটা ফোন করল।

‘কী খবর? আছেন কেমন?’

রঘুবীর ফিক করে হেসে ফেলল, ‘ভালই তো।’

‘আসতে বলেছিলাম। এলেন না তো?’

‘আপনার ফোনের জন্য ওয়েট করছিলাম।’

‘পার্সোনাল ইনভিটেশন চাই বুঝি, দেখা করতে? লোকমুখে খবর পাঠালে হয় না?

‘ঠিক সে রকম নয়। আসলে আমি জানতাম অপূর্ব রায় আপনাকে ফোন করবে ওই চল্লিশ লক্ষের নাড়িনক্ষত্র জানার অদম্য কৌতূহলে। আর আপনি তখন আমাকে খুঁজবেন।’

‘হুম। ঠিকই ধরেছেন। টাকাটা কি ওঁর বাড়িরই?’

‘না না। পাগল! ওরা টাকা কখনও ফেলবে না। যে টাকা ওরা দেখাতে পারবে না, সে টাকা ওদের বাড়িতেই পড়ে থাকবে অনন্ত কাল। ওদের মতো অভিজাতরা রাস্তাঘাটে টাকা ফেলতে যাবে না কখনও। সেটা আপনি বোঝেন?’

‘বুঝলাম। আর বাকি গল্পটা?’

‘ওঁর মাথাব্যথার কারণ ওঁর অহঙ্কার। চল্লিশ লক্ষ ফেলে দেওয়ার মতো এ পাড়ায় কে আছে, না জানলে ওঁর রাতে ঘুম হবে না।’

‘হতে পারে।’

‘এ বার আসল রহস্যে আসি। এই টাকার আসল মালিক মজুমদার বুড়ি।’

‘ইনি কে?’

‘সাবিত্রী মজুমদার। আশি বছর বয়স। নাইন বাই সেভেন এ, পশ্চিমপাড়া। দেখে আসবেন বাড়িটা। ভগ্নপ্রায়। এ পাড়ায় বউ হয়ে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে। বন্ধকি কারবার, সুদের কারবার চালাতেন বাড়িতে বসেই। বাড়ির লোকেরাও কেউ কখনও জানতে পারেনি, এতটাই চুপিসারে কাজ করতেন। জীবনে এ পাড়ার বাইরে পা রাখেননি। বিশাল বড় পরিবার ছিল। একসঙ্গে তিরিশ জনের হাঁড়ি চড়ত। চোখের সামনে সেই বংশ নির্বংশ হতে দেখেছেন। এখন বুড়ি মরলে মুখে আগুন দেওয়ারও
কেউ নেই।’

‘ইস।’ কুহেলি সুলতানা একটা ভীষণ নারীসুলভ ইস বলে ফেলল।

‘খুব রিসেন্টলি প্রচুর বন্ধকি কারবারে বাজেয়াপ্ত গয়না বিক্রি করিয়েছিলেন কাউকে দিয়ে। কাকে দিয়ে তা অবশ্য বলতে পারব না। এই টাকা সেই টাকা।’

‘অর্থের প্রতি যার এত লালসা, সে টাকা ফেলে দিল? এরা তো মরণকালেও সম্পত্তি হাতছাড়া করে না রঘুবীর!’

‘বুড়ির তো শত্রুর অভাব নেই। কী বুঝতে কী বুঝেছে কে জানে। ভেবেছে টাকাগুলো কাগজ হয়ে গেল। তার ওপর যদি পুলিশ হানা দেয়? এত দিনের গোপন ইতিহাস। ইনকাম ট্যাক্স রেড ব্যাপারটা ওঁর কাছে পুলিশই আর কী।’

‘কিন্তু এই কনক্লুশনের ভিত্তিটা কী, জানতে পারি?’

‘কারণ ওই। একটা পরদার কাপড় দিয়ে তৈরি থলে। দশ বছর আগে উঠে যাওয়া ঘটক টেলার্স-এর গোপাল ঘটক যে পরদার কাপড় দেখে কোন বাড়ির পরদা ছিল সেটা বলে দেবে, এটা কেউই ভাববে না। তবু এক বার গেলাম ঘটকজেঠুর কাছে। ছবি দেখালাম। কোনও সম্ভাবনা আছে জেঠু, চেনার? জেঠু বলল, ‘আরে কাপড় চিনব কী করে। কিন্তু পুরনো পরদার কাপড় দিয়ে থলে বানাত তো মজুমদারদের ছোট বউ। সে তো আমি জানি। সাবিত্রী মজুমদার। আমার কাছে নিয়ে আসত পুরনো পরদা। নানা সাইজের থলে, ব্যাগ, বটুয়া বানিয়ে নিত। বলত, খুব টেকসই হয়।’ আসলে সুদের কারবারিরা তো খুব কৃপণ হয় ম্যাডাম। এরা কিছুই ফেলতে চায় না। বারবার ভোগ করার জন্য ভোল পালটিয়ে ব্যবহার করে। এই আর কী।’

‘আপনার সব কথা যদি মেনে নিই তাহলে এক বার মজুমদারবাড়ি গিয়ে সাবিত্রী মজুমদারকে দেখে আসতে হয়।’

‘আমি এক বার পেছনের পাঁচিল টপকে দেখে এসেছি। শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন নিজের ঘরের পালঙ্কে।’

‘দরজা ভাঙতে হবে?’

‘হ্যাঁ। নিথর দেহ। কিন্তু বসাটা টানটান।’

‘বাসি মড়া?’

‘এক দিনের হতে পারে।’

‘রাখছি ফোনটা, রঘুবীর।’

‘তা হলে কি পাড়াতেই দেখা হচ্ছে ম্যাডাম?’

কুহেলি সুলতানা রঘুবীরের শেষ প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল।

যখন ওসির গাড়ি ঢুকছে পাড়ায়, তখন রঘুবীর আবার পাড়ায় নেই। চিত্রলেখা সেন নামের নতুন প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে তিরবেগে বনবিতান পার্কের দিকে বাইক ছোটাচ্ছে।

Ghatak Tailors
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy