Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২০

পরিক্রমণ

গাড়ি যত হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে তিয়াষার ততই অস্থির লাগে। প্রথম দিন যখন ও গিয়েছিল খবরটা করতে, তখন এই অশান্তি অস্থিরতা ছিল না।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

রাজশ্রী বসু অধিকারী
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: স্বামী বিলাসের মৃত্যুসংবাদ শুনে ভেঙে পড়ে বনানী। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অমল ডাক্তারের কথামতো বনানীকে জানায় সে থানা-পুলিশ করবে। সই করিয়ে নেয় অভিযোগপত্রও। এ দিকে অফিসে বসে তিয়াষার কাজে মন বসে না। তার মন হারায় ডাক্তার অভিরূপের কথা ভেবে। নিজের এই ছবি অচেনা তিয়াষার কাছে। মনের অবস্থা সে প্রকাশ করে ফেলে সহকর্মী শিমরনের কাছে।

শুধু কি খবরের কাগজের খবরের জন্য তার সঙ্গে কথা বলা? না কি ওই উজ্জ্বল চোখগুলোর মোহ? যাকে এক বার দেখলে বার বার দেখতে হয়? কপালে ঝাঁপিয়ে এসে পড়া এলোমেলো চুলের গুচ্ছ, ভাবনার ভঙ্গি, পথভোলা হাসির ঝলক... তোমাকে এমন টান টানল তিয়াষা যাতে ভেসে যেতে বসেছে তোমার কেরিয়ার? মাথায় উঠেছে কাজকর্ম!

নাহ... আজ আর হবেই না। রাতে এক বার চেষ্টা করতে হবে। তার আগে সাধনদার কাছে অনুমতি নিতে হবে যাতে কালকের মর্নিং শিফটে লেখাটা দেওয়া যায়। আর রাতের মধ্যে হয়ে গেলে তো কোনও কথাই নেই। রাতে মেল করে দেবে।

অনেক ভাবনাচিন্তা করে হাতের কাজ গুটিয়ে সাধনদার চেম্বারে এসে দাঁড়ায় তিয়াষা।

“আরে, তিয়াষা... তুমি এসে গেছ? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। কুইক,’’ এক তাড়া কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে সাধনদা।

খবরের কাগজের অফিসের তো এটাই দস্তুর। কখন কোথায় যেতে হবে ঠিক থাকে না। তিয়াষা অবাক হয় না। হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নিতে নিতে এক বার শুধু জিজ্ঞেস করে, “কোথায় সাধনদা? আমি বলতে এসেছিলাম যে, আমার লেখাটা শেষ হয়নি। যদি কাল সকালে...”

“আরে, শেষ হয়নি শাপে বর হয়েছে। দেখ গিয়ে হয়তো তোমার স্টোরিলাইন বদলে গেল এত ক্ষণে। তোমাকে এখনই হাসপাতালে যেতে হবে।’’

“ক...কেন?’’ গলা দিয়ে আওয়াজ বার হতে চায় না তিয়াষার। কেউ যেন চেপে ধরেছে শ্বাসনালি। কী একটা অজানা ভয়ে যেন ভিতরটা স্তব্ধ হয়ে যেতে চাইছে। শরীরে ভিতরটা কেমন যেন দুর্বল লাগছে। একটু যেন টলে গেল তিয়াষা।

“আরে? কী হল তোমার? এই তিয়াষা? শরীর খারাপ লাগছে? তুমি নাহয়... আমি অন্য কাউকে বলছি। আসলে এটা তুমিই প্রথম কভার করেছ, তাই ভাবলাম...”

“না...না...আমিই যাব সাধনদা... আমি ঠিক আছি,” তড়িঘড়ি বলে ওঠে তিয়াষা।

“আচ্ছা... দাঁড়াও...” দু’মিনিট... আমিও নাহয় যাই তোমার সঙ্গে... গলার কাছে ছোট একটা প্রবলেম হচ্ছে, সেটাও একটু দেখিয়ে নেব... নেগলিজেন্স হয়ে যাচ্ছে।’’

গাড়িতে আসতে আসতে ব্যাপারটা খুলে বলে সাধন দত্ত, ‘‘কিছু ক্ষণ আগেই থানা থেকে আই ও অনিল শতপথী ফোন করেছিলেন। বললেন, ওর উপর পেশেন্ট পার্টির প্রেশার আসছে, কেন ডক্টর মুখার্জিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। আসলে আমি যত দূর জানি, শতপথী কখনও ওর বৌয়ের ব্যাপারে এই ডাক্তারের সাহায্য পেয়েছিল, সেই কারণে ওকে হাইডিংয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তার রাজি হননি। কিন্তু উনি বুঝতে পারছেন না, যেখানে কেসটায় থ্রি হান্ড্রেড ফোর দেওয়া হয়েছে, সেখানে এক বার নাম আসা মানেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যারেস্ট। উনি অবশ্য শতপথীকে কী বলেছেন তা জানি না। শতপথী চাইছে লাইফ ডেলি যেহেতু প্রথম থেকে ঘটনাটা কভার করছে, তাই ডাক্তারের একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হোক আমাদের কাগজে। ব্যাপারটা গুরুতর। তাই আজকেই কভার করা দরকার।’’

“কিন্তু, ক’দিন আগেই তো আমি দেখা করেছি। ওর স্টেটমেন্টের উপরেই তো আমি আজকের কপিটা প্রায় শেষও করে এনেছি। শুধু শেষ করতে পারছিলাম না... দু-একটা কারণে...” বলল তিয়াষা। কী কারণে শেষ করা যায়নি সে কথা মুখ ফুটে সাধনদাকে বলা যায় না, তাই তিয়াষা চুপ করে যায়।

“অ... তুমি কথা বলেছ ওর সঙ্গে? ঠিক আছে, আর এক বার কথা বলে নাও... তার পর দেখছি দরকার হলে, কভার পেজে বড় করে খবরটা করা যায় কি না,” সাধনদাও কিছু যেন চিন্তা করতে করতে চুপ করে যায়।

গাড়ি যত হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে তিয়াষার ততই অস্থির লাগে। প্রথম দিন যখন ও গিয়েছিল খবরটা করতে, তখন এই অশান্তি অস্থিরতা ছিল না। ওখানে গিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার পর এই অভিরূপই ওকে সুস্থ করে তুলেছে। এর মাঝখানে ওর ভিতরে কী এমন হয়ে গেল যে নিজেকে আর কিছুতেই সাধারণ এক জন রিপোর্টারের ভূমিকায় মানাতে পারছে না! এ রকম করলে যে ওর কাজের ক্ষতি, কেরিয়ারের ক্ষতি সে কথা বার বার ভাবার চেষ্টা করছে নিজের মনে। কিন্তু মনকে বশে আনতে পারছে কই! সত্যিই যদি ওর নামটা যোগ হয় তা হলে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাবে মানুষটার। কিন্তু এই মুহূর্তে তিয়াষার মনে হচ্ছে সেই ক্ষতিটা যতটা না অভিরূপের হবে তার চেয়ে অনেক বেশি মনে বাজবে ওর কাছে। মনে হচ্ছে যেমন করেই হোক এই ক্ষতিটা আটকাতে হবে। দরকার পড়লে শতপথীর সঙ্গেও কথা বলবে তিয়াষা। টেনে বার করবেই আসল সত্যিটাকে। মনে মনে নিজের পরবর্তী কর্মপন্থা স্থির করে ও। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মেঘ এসে ঢেকে দেয় মনের আকাশ। সত্যিই কি পারবে ও অভিরূপকে বাঁচাতে? কে ও? এক জন সাংবাদিক মাত্র। ও যত অভিরূপের সপক্ষে কপি লিখুক না কেন, সেই বক্তব্য, আসলে কতটুকু কাজে আসবে? আর ভাবতে পারে না তিয়াষা। মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘাড় হেলিয়ে দেয় গাড়ির ব্যাকসিটে। আর ঠিক তখনই সাধনদা ডাকে ওকে, “নেমে এস, হাসপাতাল এসে গিয়েছে।’’

নামতে গিয়ে বাধা পায় ওরা। গেটের মুখে না হলেও প্রায় পঞ্চাশ জন লোক প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে বসে আছে। তারা চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে, “খুনি ডাক্তার মুখার্জির উপযুক্ত শাস্তি চাই... ডাক্তার মুখার্জি জবাব দাও...”।

তিয়াষা খামচে ধরে সাধনদার হাত, “এ সব কী? এই বিক্ষোভের কোনও খবর তো আমাদের কাছে ছিল না সাধনদা?’’

“ছিল। আমি জানতাম বিক্ষোভ হচ্ছে, সেই জন্যই আরও তাড়াতাড়ি এলাম। চলো ভিতরে, চ্যানেলের লোকজন সব আগেই এসে গিয়েছে, ওদের আগে মুখার্জিকে কভার করতে হবে।”

“আপনি... আপনি জানতেন? কই আমাকে বললেন না তো...”

“বললে তুমি কী করতে? আমাদের কিছু করার তো নেই। তা ছাড়া যত বেশি গন্ডগোল হবে আমাদের তো ততই লাভ... পা চালাও...”

তিয়াষা দাঁড়িয়ে পড়ে, গলা শক্ত হয়ে আসে ওর। “আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম এটা কিন্তু করতাম না। আমার জুনিয়রকে অন্ধকারে রেখে দিতাম না।’’

“আরে বাবা কী কাণ্ড, তুমি এত সিরিয়াস হচ্ছ কেন? এটা তো আমাদের কাছে নতুন কোনও ঘটনা নয়। ঝামেলা হবে, আমরা ছুটে যাব, রিপোর্ট করব...ব্যস... আগে বলিনি এখন বলছি... হোয়াট মেকস দ্য ডিফারেন্স?’’ আলগা একটু হাসির মতো করে ক্যাজ়ুয়ালি বলে যায় সাধন।

“ব্যাপারটা কি যথেষ্ট সিরিয়াস নয়? আর আপনিই তো শিখিয়েছিলেন, সৎ সাংবাদিক কেমন হবে? শুধু কাগজের লাভ দেখব? একটা মানুষের ভবিষ্যৎ দেখব না? আমি তা পারব না সাধনদা... আপনি বরং কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে দিন।”

“ছেলেমানুষি কোরো না, ভিতরে যেতে দিচ্ছে না ওরা কাউকে। এস ওখানে কথা বলতে হবে। আমরা বরং এই বিষয়টা পরে আলোচনা করব।’’ এগিয়ে যায় সাধন। আন্দোলনকারীদের কাছে গিয়ে নিজের আই কার্ড দেখিয়ে কথা বলে। পিছন পিছন তিয়াষা। ঠিক করেছে আর একটুও দেরি করবে না। রাত জেগে হলেও কপিটা আজকেই শেষ করবে। আর নিজে গিয়ে এক বার শতপথীর সঙ্গে কথা বলবে। তবে তার আগে অভিরূপের সঙ্গে আর এক বার মুখোমুখি বসা দরকার।

১২

তিয়াষা চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল সামনের দিকে। যে মানুষটা নুয়ে পড়া ঘাড়ে টেবিলে মুখ গুঁজে বসে আছে ওর সামনে, তাকে ও চেনে না। যারাই মুখার্জির সান্নিধ্যে এসেছে তাদের সবাইকেই উনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে জাদু করে রাখেন। এমনটাই তিয়াষার ধারণা। সেই উজ্জ্বল মানুষটা যেন ঝড়ে ভাঙা নৌকার মতো বসে আছে সামনে। তিয়াষার বুকের ভিতরে মোচড় দেয়। টেবিলের উপর এলোমেলো ভাবে ফেলে রাখা হাতটার উপর হাত রেখে আলগা চাপ দেয় ও।

“এ ভাবে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। তাকান আমার দিকে।”

“সব শেষ। আমি শেষ,’’ চোখ বুজে থেকে বলে অভিরূপ।

“না... কিচ্ছু শেষ নয়,’’ প্রায় ধমকে ওঠে তিয়াষা, “আমি আপনাকে এ ভাবে ভেঙে পড়তে দেব না... ইউ হ্যাভ টু প্রোটেস্ট।’’

এত ক্ষণে অভিরূপের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে টেবিলের সামনের দিকে এগিয়ে এসে গুছিয়ে বসে সে, “আপনি কাল অনুরোধ করলেন তাই এলাম। কিন্তু আই হ্যাভ টু লিভ... সত্যিই আমার সময় নেই। মাই নেম হ্যাজ় বিন ইনক্লুডেড ইন এফআইআর... যে কোন মুহূর্তে আমি অ্যারেস্ট হয়ে যাব।’’ কথাটা বলেই কেমন ছটফট করে ওঠে অভিরূপ। তিয়াষা আবারও চেপে ধরে ওর হাত। আরও সুদৃঢ় শোনায় ওর গলা, ‘‘না... এমনটা ঘটবে না ... আই হ্যাড আ টক উইথ শতপথী। উনি সাত-আট দিনের মধ্যে এমন কিছু করবেন না। প্রেশারে পরে ওকে নামটা ইনক্লুড করতে হয়েছে।’’

“ইয়েস...আমি এই বিপদের গন্ধ পেয়েছিলাম। এখন বুঝতে পেরেছি, অনেক অনেক শত্রু বাড়িয়ে ফেলেছি আমি।”

“তা তো করেছেন, কিন্তু আমি জানতে চাই আসল ঘটনাটা কী ঘটেছিল?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Literature Book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE