Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মিমির বন্ধুরা

একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল বাইরে। পর্দা সরিয়ে মিমি দেখল বাইরে একটা বিকটদর্শন জলহস্তি। ঘাস খেতে খেতে ঘরের সামনে এসে পড়েছে। কাচের দরজা ভেঙে ভেতরে আসবে না তো? খাটে চাদর চাপা দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে মা আর বাপি। মশারির নেটের ফাঁকে তাদের ঘুমন্ত চেহারা দেখে মিমি ভাবল, নাঃ, ওদের এখন ডাকার দরকার নেই। কাচের দরজায় চোখ রেখে একাএকাই জলহস্তির চলে যাওয়াটা দেখল ও।

সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল বাইরে। পর্দা সরিয়ে মিমি দেখল বাইরে একটা বিকটদর্শন জলহস্তি। ঘাস খেতে খেতে ঘরের সামনে এসে পড়েছে। কাচের দরজা ভেঙে ভেতরে আসবে না তো? খাটে চাদর চাপা দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে মা আর বাপি। মশারির নেটের ফাঁকে তাদের ঘুমন্ত চেহারা দেখে মিমি ভাবল, নাঃ, ওদের এখন ডাকার দরকার নেই। কাচের দরজায় চোখ রেখে একাএকাই জলহস্তির চলে যাওয়াটা দেখল ও।

মিমি ক্লাস ফাইভে পড়ে। বিষ্ণুপ্রিয়াদি ওদের ভূগোল পড়ান। উনি এক-একদিন ক্লাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গল্প করেন। আফ্রিকার মাসাইমারার মুক্ত অরণ্যের কথা ওঁর কাছেই প্রথম শুনেছিল। বাপি ওদের নিয়ে সেই মাসাইমারায় বেড়াতে যাবে শুনে, খুব লাফিয়েছিল ও।

কেনিয়া পূর্ব আফ্রিকায়। রাজধানী নাইরোবি। নাইরোবির হোটেলে একরাত কাটিয়ে টানা গাড়িতে সোজা মাসাইমারা পৌঁছেছিল ওরা। ওখানে দু’দিন ঘোরাঘুরির পর এসেছে নাইবাসা ফরেস্টে। রিসর্টে আছে।

নাইবাসার অত বড় লেকটা কচুরিপানায় ভরা। তবে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশটা জলহস্তি আছে। বিকেলে বোটিং করাকালীন তাদের ভাসানো নাকের বুড়বুড়ি উঠছিল নৌকার আশেপাশে। সাংঘাতিক ভয় পাচ্ছিল সবাই। যদিও বোট-চালক ওদের আশ্বস্ত করে ছিল, কোনও ভয় নেই। এখনও পর্যন্ত নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার মতো কোনও ঘটনা ঘটায়নি ওরা।

কেনিয়ায় নাকি সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় জলহস্তির হামলায়। তাই নাইবাসার এই রিসর্টে সন্ধে নামলে আর একা একা ঘর থেকে বেরোন যায় না। ডাইনিং হলে যাতায়াতেও গার্ড নিতে হয়। অসীমকাকু, কাকিমা, ডিডো আর ওরা তিন জন বেড়াতে এসেছে এখানে। তন্দ্রাকাকিমা আর ডিডো তো ভয়েই জড়োসড়ো, অসীমকাকু ভীষণ সাহসী। বারণ না শুনে আটটার সময়, অন্ধকারে, একাএকাই ঘরে ফিরছিল ডাইনিং হল থেকে। দূর থেকে এক জলহস্তির দর্শন পেয়ে দৌড়ে ফেরত যায় খাবার ঘরে! নিয়ম ভাঙার জন্য হোটেলের লোকেদের বকুনি খাচ্ছিল যখন, তখন মিমি ভাবছিল, ইস্, আমি কেন সঙ্গে ছিলাম না?

জলহস্তি চলে গিয়েছে। মিমি মশারির মধ্যে ঢুকে চারপাশটা ভাল করে গুঁজে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল জলহস্তির কথা। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। কৌতূহলটা সামলাতে পারল না মিমি। মা বার বার বলেছেন অচেনা জায়গা, একা একপাও এগোবে না। সব সময় আমাদের বলবে। তবুও দরজা খুলে বাইরে এল।

সাজানো বাগান। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ঘাসের লন, রাস্তা, ধুয়ে যাচ্ছে। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি মেয়ে। হলুদ জামা পরা মেয়েটিকে চিনতে অসুবিধে হল না ওর। সে দিনই তো ওদের গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিল মিমিরা। মেয়েটা মাসাইমারা উপজাতির। চাঁদের আলোয় ওকে কেমন পরিষ্কার লাগছে।

অথচ সে দিন ওকে দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল মিমির। সারা মুখে ময়লা আর মাছি ভনভন করছে। মাকে বলেছিল ও, ওর মুখটা কেউ ধুইয়ে দেয় না কেন? মা বলেছিলেন, দেখছ না, এখানে কী রকম জলকষ্ট! কত দূর থেকে জল আনতে হয়। প্রতি দিন স্নানই হয় না ওদের।

কিন্তু মেয়েটা এখানে এল কী করে? এত কটেজের মধ্যে ওদেরটাই বা চিনল কী করে?

ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল মিমি। তখনই ইশারা করে ওকে ডাকল মেয়েটা। ও এগিয়ে গেল, আর আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ভয়ঙ্কর জলহস্তিটা! ভয় পেয়ে মিমি পিছিয়ে যাচ্ছিল। চট করে ওর হাত ধরে নিল ওই মেয়ে। বলল, ওকে ভয় পেয়ো না। ও আমার বন্ধু। আরও বন্ধু আসছে। সবাই মিলে লেকের জলে স্নান করতে যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?

একে একে হরিণ, হাতি, খরগোশ, জেব্রা, জিরাফেরা এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। রাতের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছিল। সেই বিশাল মিছিলের পায়ে পা মিলিয়ে মিমি এগিয়ে যাচ্ছিল লেকের দিকে। জলের ধারে ফাঁকা বোটগুলো হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। আর ফাঁকা ঘাসজমিতে মুখ ডুবিয়ে ঘাস খাচ্ছে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশটা জলহস্তি। মিমিদের দেখেও কেউ মুখ তুলল না। মিমির মনে পড়ল বোটচালক বলেছিল, সকালে জলে ওরা গা ডুবিয়ে থাকে। রাতে ঘাস খেতে ওপরে উঠে আসে।

সেই মেয়েটি বন্ধুদের সঙ্গে নেমে গেল জলে। মিমি দাঁড়িয়ে রইল পাড়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও দেখল জলে ডুবে, অনেকক্ষণ ধরে ভেসে থেকে তার পর ভাল করে স্নান সেরে ওপরে উঠে এল ওরা। মাসাইমারার মেয়েটির মাথায় ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল তাও মাথার সঙ্গে লেপটে থাকে। দূর থেকে দেখলে ন্যাড়ামাথা মনে হয়। শুধু জামাটাই জলে ভিজে চুপচুপে হয়েছে ওর।

স্নানের শেষে জলহস্তি আর মেয়েটি এল মিমিকে রিসর্টের ঘরে পৌঁছে দিতে। মিমি নিজেদের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল জানলার পিছনে, কাচের আড়ালে। চাঁদের আলোয় ও দেখল জলহস্তিটা নিচু হয়ে ওই মেয়েটাকে তুলে নিল পিঠে। ওরা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল বনের পথে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে চুপ করে রিসর্টের বিছানার ওপর বসেছিল মিমি। একটু বাদেই তৈরি হয়ে ওদের বেরোতে হবে। কিন্তু ও নড়াচড়া করতে পারছিল না। একমনে ভাবছিল আগের রাতের কথা। ওটা কি সত্যিই ঘটেছে? যদি স্বপ্ন হয়, তা হলে এ রকম স্বপ্ন তো মিমি বারবার দেখতে চায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibashariya Sarbanai Bandhapadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE