Advertisement
E-Paper

‘বাবু যাকে ভোট দিতে বলল...’

কলকাতায় টেলিভিশন চালু হওয়ার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল লোকসভা নির্বাচন। কী ভাবে ইলেকশন কভার করতে হবে টিভির পরদার জন্য, আমাদের তো কোনও ধারণাই ছিল না। তখন ভারতে টিভি চ্যানেল মানে কেবল দূরদর্শন। কিন্তু কলকাতায় বসে আমরা অন্য কোনও দূরদর্শন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখতে পেতাম না। বিদেশের টিভির অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া তো ছিল কল্পনার বাইরে।

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
১৯৭৭-এর সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের লাইন।

১৯৭৭-এর সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের লাইন।

কলকাতায় টেলিভিশন চালু হওয়ার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল লোকসভা নির্বাচন। কী ভাবে ইলেকশন কভার করতে হবে টিভির পরদার জন্য, আমাদের তো কোনও ধারণাই ছিল না। তখন ভারতে টিভি চ্যানেল মানে কেবল দূরদর্শন। কিন্তু কলকাতায় বসে আমরা অন্য কোনও দূরদর্শন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখতে পেতাম না। বিদেশের টিভির অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া তো ছিল কল্পনার বাইরে।

এখন যে-সব ইএনজি ক্যামেরায় টেলিভিশনের জন্য বাইরে শুটিং করতে দেখা যায়, তখন তো সে-সব ক্যামেরা পৃথিবীতে আবিষ্কারই হয়নি। তাই আমাকে ইলেকশন কভারেজের জন্য এমন একটা ১৬ মিলিমিটার ফিল্ম ক্যামেরা দেওয়া হল, যাতে সরাসরি একই সঙ্গে ছবি আর শব্দ শুট করা যায়। আমরা মুখে মুখে বলতাম ‘সিঙ্ক ক্যামেরা’। আমাদের বেশির ভাগ ক্যামেরাই তখন ‘সাইলেন্ট ক্যামেরা’, যাতে কেবল ছবিই শুট করা যেত।

টালিগঞ্জের পুরনো রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োকে পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রথম টিভি স্টুডিয়ো তৈরি করা হয়েছিল, সেখানেই আমাদের ‘কলকাতা টেলিভিশন সেন্টার’ কাজ শুরু করে। তার কাছেই, আনোয়ার শাহ রোডে যোগেশচন্দ্র কলেজে হয়েছিল ইলেকশন বুথ। ভোটের দিন সক্কালবেলায় ক্যামেরাম্যান বিমান সিংহ আর সাউন্ড রেকর্ডিস্ট শান্তনু মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তো কলেজে হাজির হলাম। তখন ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। বিমানদাকে বললাম, তুমি ক্যামেরায় আমার শট নাও তো! বিমানদা খুব রেগে গেলেন, বললেন, আমরা তো ইলেকশন কভার করতে এসেছি, তোমার শট কেন নেব? বললাম, কোথায় এসেছি, কী দেখছি, তার একটা বিবরণ দিই। বিমানদা বললেন, সেটা কি ইলেকশন কভারেজ হবে! বললাম, চলো না, একটা পথ তো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিমানদা আমাকে ক্যামেরায় ধরলেন।

আমি যখন রিপোর্টিং করছি, চোখে পড়ল, এক জন মহিলা বাজারের ব্যাগ হাতে কলেজের গেটে এসে দাঁড়ালেন। সহকর্মীদের বললাম, চলো ওই মহিলার একটা ইন্টারভিউ নিই। বিরক্তি এবং সংশয় প্রকাশ করলেও তাঁরা ক্যামেরা ও শব্দযন্ত্র চালু করলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এখনও ভোটগ্রহণ শুরু হয়নি, আপনি এত সকালে এখানে! তিনি বললেন, বাবুদের বাড়িতে কাজ করি, বাজার করতে পাঠিয়েছে, সেই সুযোগে ভোটটা দিয়ে যাব, তা না হলে আর বেরোতে দেবে না। সেটাই ছিল বাংলা টিভি চ্যানেলে ভোটের দিনের প্রথম সাক্ষাৎকার।

তার পর একটু একটু করে ভিড় বাড়তে লাগল। বিভিন্ন জনের ছোট ছোট প্রতিক্রিয়া আমরা শুট করতে লাগলাম। দেখালাম, ভোটারদের লাইন ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে, ব্যালট বাক্সে ভোট দিচ্ছেন ভোটাররা, পোলিং এজেন্টদের তৎপরতা, এক বৃদ্ধাকে কোলে করে নিয়ে আসছে তাঁর নাতি, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মাঝে মাঝে বচসা বাধছে। এক জন পুলিশকর্তা এলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিলাম। পোলিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কয়েক জন পরিচিত বিখ্যাত মানুষকে ভোটের লাইনে দেখে মনে হল, তাঁদের শট থাকলে এবং দু-এক কথায় প্রতিক্রিয়া থাকলে হয়তো দর্শকদের ভাল লাগবে। টিভি সেন্টারে এসে যখন ফিল্মের ক্যানগুলো জমা দিচ্ছি, তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি, আচ্ছা, এটা ইলেকশন কভারেজ হল তো! শান্তনু বলল, দেখিস, কাল আমরা পাবলিকের হাতে মার না খাই!

এ বার একটু দূরের বুথের দিকে চললাম আমরা। শুটিং করে সেন্টারে এসে শুটিং মেটিরিয়াল দিয়ে যেতে হচ্ছে, কেননা ফিল্ম প্রসেস করতে হবে, সময় লাগবে। যখন বেশি দূরে চলে যেতে লাগলাম, তখন সঙ্গে অন্য গাড়ি চলল, যারা শুটিং মেটিরিয়াল আমাদের কাছ থেকে নিয়ে সেন্টারে নিয়ে আসবে। যত দূর সম্ভব কলকাতার নানান অঞ্চলের ভোটগ্রহণ পর্ব শুটিং করে, গেলাম গ্রামের দিকে। এগোতে এগোতে গিয়ে পৌঁছলাম উলুবেড়িয়া অঞ্চলে। তখন ভোটগ্রহণের সময় শেষ হয়ে আসছে। এক শীর্ণকায় মানুষ গরু চরাতে চলেছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ভোট দিয়েছেন? বললেন, ‘হ্যাঁ, দুপুরবেলায় বাবু বলল ভোট দিয়ে আসতে। যাকে ভোট দিতে বলল, তাকেই দিয়েছি।’ কোন বাবু? ‘যার গরু চরাই, সেই বাবু।’ ওই সাক্ষাৎকারটা দিয়ে বাংলা টিভির প্রথম ভোট-প্রতিবেদন শেষ করেছিলাম এ কথা বলে, ‘ইনি হচ্ছেন তাঁদেরই এক জন, যাঁরা ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রক কে হবেন, তা আজ ঠিক করে দিলেন।’

পর দিন শান্তনু অফিসে এসে বলল, বাজারে তো শুনলাম লোকেরা ভাল বলছে। পরে বুঝেছি, এই দ্বিধা সংশয়ের মধ্যে দিয়েই টিভিতে নির্বাচনের দিনের কভারেজের একটা ফরম্যাটের জন্ম হয়েছিল। সেই ফরম্যাটের ব্যবহার এই ঝকমকে ইলেকট্রনিক সম্প্রচারের সময়েও চলেছে। তখন আমাদের খুব অল্প সংখ্যক কর্মী, তাই নিউজ এবং প্রোগ্রাম সেকশনের কর্মীদের মধ্যে ইলেকশনের সময়ে কোনও পার্থক্য থাকত না। আমাদের টেকনিকাল সেকশনের তৎপরতা খুব বেশি জরুরি হয়ে উঠত।

পর পর নির্বাচন কভারেজের মধ্যে দিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়তে লাগল। সংবাদ বিভাগে অনেক নতুন কর্মী আসতে লাগলেন। মনে পড়ে, প্রথম দিককার নিউজ এডিটর অমিতাভ চক্রবর্তীর কথা, প্রযোজক অভিজিৎ দাশগুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর কথা। ছিলেন দেবাংশু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতীপ রায়। ধীরে ধীরে এলেন শিশির ভট্টাচার্য, ভবেশ দাশ, সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ দত্ত, শৈলেন ভট্টাচার্য, শ্যামল রায়চৌধুরী, উদয়ন দাশগুপ্ত, স্নেহাশিস সান্যাল, সুকুমার মুখোপাধ্যায়, সজয় দাশগুপ্তরা। আরও পরে এলেন স্নেহাশিস শূর, সুস্মিতা গুপ্তা, রাজীব ভট্টাচার্যরা। আমাদের কাজটা ছিল একটা টিমওয়ার্ক।

স্টুডিয়োতে ফলাফল জানানোর জন্য বিরাট একটা বোর্ড তৈরি করা হত। উপস্থাপক একটা বড় লাঠি হাতে দর্শকদের দেখার জন্য কোনও সংখ্যা বা কোনও ছবি নির্দেশ করতেন। প্রার্থীদের ছবি লাগিয়ে, তাঁদের নাম, কে কত ভোট পেলেন সে-সব সংখ্যা হাতে লিখে, ক্যাপশন তৈরি করে এমন ভাবে সব সাজিয়ে রাখা হত, যাতে সম্প্রচারের সময় সব ঠিকঠাক দেখানো যায়। কোনও যন্ত্রপাতি নেই, সব হাতে হাতে করা, কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।

বিভিন্ন পার্টির পলিটিকাল টেলিকাস্ট যখন থেকে শুরু হল, তখন থেকে বিখ্যাত সব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা দূরদর্শনে আসতে লাগলেন তাঁদের বক্তৃতা রেকর্ড করতে। যেহেতু আর কোনও টিভি চ্যানেল ছিল না, তাই দূরদর্শনের মাধ্যমে দলের বক্তব্য প্রচারের বিষয়টি তখন খুব গুরুত্ব পেত।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

Magic Box Rabibasariya Pankaj Saha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy