Advertisement
E-Paper

‘বিলিতি’ Beggar

ধরা যাক, আপনি মাস দুই হল প্যারিসে এসেছেন। সক্কাল-সক্কাল ঘুম ভেঙে বিছানা ছাড়তে গিয়েও শরীরে এক প্রকার রাজকীয় শিরশিরানি অনুভব করে বার কয়েক ‘অহো! ইউরোপ’ জপে আবার লটকে পড়ছেন তোশকে। দ্যাশ থেকে ফোন এলেই ‘ইউ ব্লাডি ইন্ডিয়ান!’ বলে গাল পেড়ে ফোন-কর্তার বাপের নাম বেনিয়াটোলার বাপ্পা করে দিতে ইচ্ছে করছে।

সোমঋতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০২

ধরা যাক, আপনি মাস দুই হল প্যারিসে এসেছেন। সক্কাল-সক্কাল ঘুম ভেঙে বিছানা ছাড়তে গিয়েও শরীরে এক প্রকার রাজকীয় শিরশিরানি অনুভব করে বার কয়েক ‘অহো! ইউরোপ’ জপে আবার লটকে পড়ছেন তোশকে। দ্যাশ থেকে ফোন এলেই ‘ইউ ব্লাডি ইন্ডিয়ান!’ বলে গাল পেড়ে ফোন-কর্তার বাপের নাম বেনিয়াটোলার বাপ্পা করে দিতে ইচ্ছে করছে।

ট্রেনে-বাসে সহযাত্রীর গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে গেলে চ্যাটচেটে ঘাম লেগে সদ্য গজানো ইউরোপীয় হ্যাল-টা হেলেঞ্চা হয়ে যাচ্ছে না। শহরতলির ট্রেন দিব্যি ফাঁকা। মানে সেখানে বসে সকাল দশটা বা বিকেল পাঁচটার হাসনাবাদ বা ক্যানিং লোকালের কথা মনে পড়ে গেলে আচমকা রাত বারোটায় একা ফ্ল্যাটে বসে ‘এক্সর্সিস্ট’ বা ‘কনজিয়োরিং’ দেখার মতো ফিলিং হচ্ছে। কামরাগুলো মোটামুটি যেমন-তেমন। হঠাৎই মারকাটারি চেহারার স্যুটেড-বুটেড এক জোয়ান মদ্দা লোক এসে সব সিটে সিটে ছোট ছোট চারকোনা সবুজ বা গোলাপি কাগজ রেখে গেল। কথা নেই, বার্তা নেই। হঠাৎ! উলটো দিকের সিট থেকে বেশ পড়া যাচ্ছে। সেই সবুজ বা গোলাপি কাগজের চার দিকে কারুকার্য। মাঝে লেখা, ‘আমি ঘরছাড়া। বাড়িতে আমার এক বউ, দুই ভাই, চার ছেলেমেয়ে। আমি কাজ করি না। ভাইয়েরাও না। তাই আমাদের দয়া করে এক ইউরো বা দুই ইউরো বা কোনও রেস্তোরাঁর একটা টিকিট দিলে বাধিত হব।’

বেশির ভাগ যাত্রীই নজর করেও করছে না। দু-এক জনের হাত যাচ্ছে মানিব্যাগের দিকে। আর তখনই আপনি দিয়ে বসলেন কড়কড়ে ২ ইউরো। (দিব্যি জানেন কিন্তু, ওতে আপনার ফেরার টিকিট বা নিদেন পক্ষে একখানা চিনি দেওয়া ক্রেপ্‌স হয়ে যেত। কিন্তু ওই যে! আচমকা আবেগ, বা, ভাল বাষায়, ‘বাড়’ খেয়ে যাওয়া অতি বিষম বস্তু)। হ্যাঁ, তার পরে সেই স্যুটেড-বুটেড ভিক্ষুক তো দোতলা ট্রেনে সিটে সিটে লিফলেট বিলি করে তখন ফিরতি পথে। কী নিঃশব্দ মার্জিত বিচরণ! কোথাও শুকনো চিরকুট, কোথাও তার সঙ্গে কিছু মুদ্রা সংগ্রহ করে মৃদুস্বরে ‘মেসি বোকু’ (অসংখ্য ধন্যবাদ) বলে ধাঁ। আর আপনিও তখন পুরো ব্যাপারটার নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ ও হতবাক। এমন কর্পোরেট লেভেলের ভিক্ষেকে কি নিছক ভিক্ষে বলে তাচ্ছিল্য করা যায়? তার বদলে মাধুকরী-টাধুকরী গোছের ভারিক্কি নাম দিলে কিঞ্চিৎ মর্যাদা রক্ষা হত হয়তো। সাধে কি বলে প্রথম বিশ্ব!

অন্য আর এক দিন। আপনি ধরা যাক তুর ইফেল (মানে আইফেল টাওয়ার) চত্বরে। ১২৬ বছরের স্থাপত্যটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন আর ভাবছেন, এটা নিয়ে বাড়াবাড়িটা আসলে ঠিক কতটা বাড়াবাড়ি। হঠাৎ চার দিকে পিনপিন করতে শুরু করল বসনিয়া, এস্তোনিয়া, রোমানিয়ার কিছু লোকজন (মানে তাদের দাবি অনুযায়ী আর কী)। তাদের এই নেই, ওই নেই, তাই নেই। ভারী দুঃখ। আবার গেল ইউরো পাঁচেক। ফিরতি ট্রেনে ফিরছেন ফরাসি মফস্‌সলে। নামবেন আর খানিক বাদেই। দরজার কাছে হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস। চমকে তাকিয়েই দেখেন, ‘আহা! মরি মরি! মহেন্দ্র-নিন্দিত কান্তি!’ কোনও ঠিকানা জানতে চাইছে কি না আসলে, নিজের সদ্য আহৃত ফরাসি জ্ঞান দিয়ে সেটা যাচাই করতে করতেই বুঝে গেলেন, এ-ও সেই একই কেস। ‘খাবার কিনব। একটা বাগেত বা ক্রোয়াসঁ। কিছু খুচরো হবে কি মাদমোয়াজেল?’

এ যে বড় মুশকিল! চেহারাটা তো মোটামুটি একটু বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে রে ভাই! এর পরে যে কাস্টিং ডিরেক্টর রাখতে হবে! পিচুটি-চোখো, উকুন-চুলো, দাঁতের আসল রং সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দেওয়া সনাতন পাগলা, মুক্তোদা, লালবুড়িদের দেখে দেখে তৈরি চোখে, এ হেন সুপুরুষ বা সু-নারী ভিখারিকুল তো রীতিমত সাংস্কৃতিক শক! তার পরে আবার লাগাতার শীতেল হাওয়ার দৌলতে এই দেশগুলোয় কালো বা ছাইরঙা কোট-জ্যাকেট পরাই দস্তুর। তা হলেই তো হয়ে গেল। ‘গাহি সাম্যের গান’।

সব মিলিয়ে প্রথম-প্রথম এই ‘বিলিতি বেগার’দের (আহা, হলই নাহয় এট্টু জিয়োগ্রাফিতে ভুল! বাঙালির কাছে বিদেশ মানেই বিলেত!) প্রতি একটা সম্ভ্রম জেগে ওঠে বইকি! তবে লাগাতার মানিব্যাগ হালকা হওয়াটা ওই তল্লাটে মানে একটু ইয়ে টাইপের ব্যাপার ডেকে আনতে পারে তো! সন্ধেবেলা সুপ্যারমার্শে বা পাতিসেরি থেকে পাঁউরুটি কিনতে গিয়ে পয়সা থুড়ি সেন্ট নিয়ে টানাটানি পড়ে গেলে, পরের দিন ওই জাতীয় কপোর্রেট ভিক্ষুককে দেখে আর অমন গদগদ ভাব না-ও জাগতে পারে। বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় দু’চারটে গালাগাল দিয়ে বলতে ইচ্ছে করতেই পারে: মামদোবাজি পেয়েচো না কি হে! এন্তার কাগজ ছাপিয়ে আহ্লাদ করে বলচো, ‘আমি না ভাই, কোনও কাজ করি না ভাই! আমার অন্ন-সংস্থানের সুবন্দোবন্ত করে দাও না ভাই!’ আর আমি এ দিকে হেদিয়ে মরছি চাড্ডি ইউরো কামাতে গিয়ে!

দক্ষিণ ফ্রান্সের মার্সেই’তেও ওই ব্যাপার। পুরনো বন্দরের কাছাকাছি এন্তার লোকজন। ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে, এমনকী গিলছেও। পুরনো শহরে চরকিপাকের মাঝে মাঝে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ব্যাগ, মোবাইলপত্র দেখে নিচ্ছেন আপন মনেই (আসলে এখানে আসার আগে প্যারিসের লোকজন এমন ভয় দেখিয়েছে! বন্দর এলাকা। পিলপিল করছে স্মাগলার, চোর-ছ্যাঁচড়-জোচ্চোর-ছিনতাইবাজ। তক্কে-তক্কে থাকে ওরা। কাজেই, খুব সাবধান!) দোকানপাট, মিউজিয়াম-হাট দেখতে দেখতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখেন, এক অশীতিপর খুনখুনে বুড়ি মিটিমিটি হাসছে। মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকানোর দরকার নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাসিটা আপনার উদ্দেশেই। আপনিও ফেরত দিলেন সেন্টিমিটার মেপে। আর অমনি, ‘আরে! সত্যি বলছি, নেশা-টেশা কিচ্ছু না। এই বয়সে আর কি ও সব পোষায় বলো! একটু দ্যাখো না, হেঁ হেঁ, মানে পার্সে তোমার খুচরো-টুচরো আছে কি না কিছু? কী ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে না? মাইরি বলছি, একটু হট চকোলেট কিনে খেতাম।’ আবার সেই হাই-ভোল্টেজ কালচার শক। খানিক আগেই আপনাকে প্রাতরাশ সারতে হয়েছে অর্ধেকটা শুকনো বাগেত আর বুড়ো আঙুলের সাইজের কাপে এসপ্রেসো দিয়ে। একটু বেশি চিনিও মেলেনি। আর এ কি না হট চকোলেট খেতে চায়! খুচরো নেই। নোটও নেই। পার্স দেখালাম! তবুও শান্তি নেই। সে বুড়ি নাছোড়। বলে, ‘কার্ড থেকে একটু তুলে নাও না! আমি ভাঙিয়ে নিচ্ছি।’ অবশেষে তাকে এক দোকানে বসিয়ে খানিক গচ্চা দিয়ে সে যাত্রা রক্ষে।

আছে আরও এক রকম। তারা এক অদ্ভুত কায়দায় পথের এক পাশে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে হাত বা তাতে ধরা একটা পাত্র সামনের দিকে এগিয়ে রাখে। সেটা কি নিজের সোজা হয়ে বসার সামর্থ্যহীনতা প্রমাণ করতে, না কি সেই ছুতোয় মুখটা লুকিয়ে রাখতে (যাতে কেউ চিনতে না পারে) বোঝা দায়। কেউ আবার দেখি, গড় হয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে মাথার ক্যাপটা এগিয়ে রেখেছে সামনে। জামাকাপড় একটু মলিন হয়তো। কিন্তু হঠাৎ দেখলে লোকে ঘাবড়ে গিয়ে ভাবতেই পারে, রাস্তাঘাটে বেমক্কা অজ্ঞান হল না কি? এমনটা চোখে পড়েছে প্যারিসেও। আবার চেক প্রজাতন্ত্রের শহর প্রাহা-র নামজাদা চার্লস ব্রিজেও। সেইখানে ব্রিজের নাক বরাবর একটা করে মূর্তি, তার পরে ওই ভিখারি বা ভিখারিনি একটা করে।

ইতালীয়, বিশেষত রোমান ভিক্ষুকেরা বেশ কসমোপলিটান কিন্তু! কত রকম যে সেজে আছে, তার ইয়ত্তা নেই! যোগবলে শূন্যে ঝোলা ভারতীয় সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে ঘাসপাতা গায়ে লটকানো আফ্রিকান উপজাতি (অরিজিনাল অরিজিনাল দেখতে, কাজেই প্রশ্ন তুলে লাভ নেই), কলোসিয়াম চত্বরে সে এক হইহই ব্যাপার। তারা আবার রেট সম্পর্কে খুবই সচেতন। পাঁচ ইউরোর একটুও কম যদি দেন, অমনি পিছন পিছন দৌড়ে এসে ফেরত দিয়ে যাবে। নয়তো লাল পালক লাগানো শিরস্ত্রাণ-সমেত রোমান সৈনিক ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’-এর কায়দায় এসে হাতে অ্যালুমিনিয়ামের তলোয়ার ধরিয়ে দিয়ে আপনার মধ্যে একটা বেশ মিনার্ভা-ভাব জাগিয়ে তুলে অন্তত কুড়ি ইউরো সাইড করার তালে থাকবে। আর সময়টা যদি হয় ক্রিসমাস, আপনি যদি খ্রিস্ট-পরবের দিনে ভ্যাটিকানের দিকে সান্ধ্য ভ্রমণে বেরোন, তা হলে কে যে কোত্থেকে কী চেয়ে বসবে (ফোনের ব্যালান্স থেকে শীতের জুতো), আর আপনিও মাইকেলএঞ্জেলো থেকে ডিরেক্ট ইনফিউজিত ভক্তিভাবে কতটা দিয়ে বসবেন, আন্দাজ করা ইমপসিব্‌ল।

স্পেনীয় শহর মাদ্রিদে আর এক চিত্তির! মাদ্রিদীয় ধর্মতলা পুয়ের্তা দেল সোল (বাংলায় যাকে বলে সূর্যের দরজা) চত্বরটা, পিঠে ঢাউস ব্যাগ-চড়ানো একলা ট্যুরিস্টকে বোমকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হেজেন-ডাসে এক চামচ ডুবিয়ে জিভে ঠেকানোর মুহূর্তে ঠিক ‘শোলে’র ঠাকুরের স্পেনীয় সংস্করণ (হাত দুটো নেই) নাকের ডগায় এসে দুর্বোধ্য কিছু বলে ঘ্যানঘ্যানাবে। ওই দিকে, এক বান্দা আবার ছাগল, ভেড়া আর উটের মাঝামাঝি কিছু একটা সেজে মুখ নাড়িয়ে বিকট একটা আওয়াজ করছে। প্রবল সরু, যক্ষ্মারোগী-সদৃশ এক জন কিউপিড সেজে ঠায় দাঁড়ানোর আগে দু’টান দিচ্ছিল সস্তার তামাকে। ঝোলা ঠিক ভরে যাবে সন্ধের আগে। মুখ-চোখের কনফিডেন্সই বলে দিচ্ছে সে কথা।

তবে, একটা কথা বলতেই হয়। ভিক্ষুক-পুরাণ থেকে একটু বেরিয়ে গিয়ে। হ্যাঁ, ওদেরকে এর মধ্যে ঢোকানোটা একটু অসভ্যতাই হবে। ওই যে, বার্সেলোনার ওই জাদুকর-ড্রামার! হাঁড়ি, সসপ্যান, বালতি উলটিয়ে দুটো লাঠি দিয়ে বাজাচ্ছে! প্রাহা-র প্রাসাদের গা ঘেঁষে বসে থাকা ওই লোকটা, কিংবা প্যারিসের মঁ-মার্তের এক কোনায় ফুটপাতে বসা ওই তরুণী! উলটোনো কড়াইয়ের মতো দেখতে একটা অদ্ভুত জলতরঙ্গ বাজিয়ে সদ্য-আগত বসন্তটায় নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে! নাঃ, তাদেরকেই বরং ইউরোগুলো দিলে হত। কী আর করা যাবে? চিরকালই সৎ চেষ্টার বদলে ধুরন্ধর মার্কেটিং-এর জয় হয়েছে, এই ফিল্ডটাই বা বাদ যাবে কেন?

somrita87@gmail.com

foreign beggar somrita bhattacharya paris france Italy India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy