Advertisement
E-Paper

‘সুপারহিরো ক্লাসদেব’

১৯৯৫ সালের ১ অগস্ট আমি টাকি হাউস গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড বয়েজ স্কুলে চাকরি করতে ঢুকি। আর তার কিছু দিন পর, ৪ সেপ্টেম্বরেই, কলামন্দিরের বিক্ষুব্ধ দর্শক-শ্রোতা আমার সাধের বাংলা রকের মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে, রীতিমত হইহই করে, ‘না নামলে মারব’ ইত্যাদি বলে, আমায় স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

রূপম ইসলাম

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share
Save

১৯৯৫ সালের ১ অগস্ট আমি টাকি হাউস গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড বয়েজ স্কুলে চাকরি করতে ঢুকি। আর তার কিছু দিন পর, ৪ সেপ্টেম্বরেই, কলামন্দিরের বিক্ষুব্ধ দর্শক-শ্রোতা আমার সাধের বাংলা রকের মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে, রীতিমত হইহই করে, ‘না নামলে মারব’ ইত্যাদি বলে, আমায় স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, নতুন চাকরির নতুন সহকর্মীরা সে দিন অনেকেই, নবীন এই শিক্ষকের অনুষ্ঠান দেখতে ওই প্রেক্ষাগৃহে আমন্ত্রিত ছিলেন। ধন্যবাদ জানাই, তাঁরা কেউই পরের দিন সকাল বেলা স্টাফরুমে অপমানে জর্জরিত নতমুখ আমাকে দেখে বিদ্রুপ করেননি। আমাকে নিয়ে অনিবার্য হাসাহাসি আমার সামনে গোপন রাখতে পেরেছিলেন।

এই ব্যাকড্রপ থেকেই আমার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু। আর একটা বড় হাতিয়ার তৈরি হচ্ছিল আমার। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর, প্রথম বার, আমি নাগাড়ে ভালবাসা, সম্মান ও দায়িত্ব পাওয়া শুরু করেছিলাম। এটা পাচ্ছিলাম আমার স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র, সব্বার কাছ থেকেই। অবশ্যই এ একটা নতুন পাওয়া। আমার আত্মবিশ্বাস এ ভাবেই তৈরি হচ্ছিল।

আসলে ছোটবেলায় শিশু ও কিশোর-শিল্পী হিসেবে আমি যত বহুচর্চিত-ই থেকে থাকি না কেন, ’৯২ সাল থেকে নিজের গান লেখা শুরু করবার পর, রিজেকশনের পাল্লাই ছিল ভয়ানক ভারী। কেউ কেউ পাশে দাঁড়াতেন ঠিকই, কিন্তু তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবহেলা, কৌতুক পেয়েছি বেশির ভাগেরই কাছে। এ ভাবেই হয়তো অনেক শিশুপ্রতিভা বড় হতে হতেই হারিয়ে যায়। আমি কিন্তু চাকরিসূত্রেই একটা লড়াইয়ের মঞ্চ পেয়ে গেলাম। আমার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল: অদরকারি প্রথা ভাঙা। কনভেনশন কখনওই আমার সহায়ক নয়। আমার মধ্যে একটা নতুন ভাষা, একটা নতুন আঙ্গিকের উপস্থিতি, নির্মাণ টের পাচ্ছি তখনই। সেটার চর্চা করা থেকে আমি আমার চাকরি-ক্ষেত্রকে খামখা বাদ দিতেই বা যাব কেন? কিছু ভালবাসবার মানুষের প্রয়োজন ছিল প্রথমে। ভালবাসার সন্ধানে আমি সরাসরি আমার নতুন পাওয়া ছাত্রদের দলে ভিড়ে গেলাম।

জীবনের সর্বত্রই দুই পক্ষ। কখনও কখনও তিন পক্ষও বটে! স্কুল প্রাঙ্গণ বরাবরই দু’ধরনের জনতার মধ্যে একটা আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা। শিক্ষক-পক্ষ এবং ছাত্র-পক্ষ। আমি আমার প্রস্তাবনা পর্বের ক্লাসগুলোতে প্রথমেই পরিষ্কার করে দিলাম ছাত্রদের কাছে— এই স্কুলের এক জন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে আমি মোটেই খুশি নই, বরং খানিকটা কোণঠাসা। আমি বয়সে নবীন, তখন একুশ বছর বয়স, স্টাফরুমের প্রবীণরা কী করে বাঁধভাঙার ভুল-ঠিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমার বন্ধু হবেন? তাঁরা আমার অভিভাবকতুল্য... বন্ধু বলতে আমরা সাধারণ অর্থে যা বুঝি, তা হলে হতে পারে আমার ছাত্ররাই, কারণ তারাও তো নতুন, অনভিজ্ঞ। আমি তাই এই স্কুলে নেহাত ডিগ্রির জোরে টিচারদের দলে যুক্ত হতে বাধ্য হলেও, আসলে এক ছদ্মবেশী গুপ্তচর। আমি মনেপ্রাণে ছাত্রদেরই এক জন। ওরা কি আমাকে ওদের খেলার দলে নেবে? ওরা কি বিনিময়ে আমায় কয়েকটা সুবিধা দেবে— যেমন আমার ক্লাসে আমি যখন পড়াব (বেশির ভাগই বইতে যে সব কথা লেখা নেই, সে সব কথা) কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারবে না, করলেই ক্লাস থেকে পত্রপাঠ তাকে বিদায় দেব। যে কোনও কথা বলবার জন্য হাত তুলে অপেক্ষা করতে হবে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসে বিভিন্ন সময়-ভাগ থাকবে, সম্ভাষণ, ঠাট্টা-ইয়ার্কি-কৌতুক, নালিশ এবং বিচার, পড়ানো, লেখালিখি, বাথরুম যাওয়া— ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বোঝানোর সময় আমার ভাবনায় কেউ যেন ব্যাঘাত না ঘটায়। তার পর ছুটির পর আমরা একসঙ্গে খেলতে নেমে যাব মাঠে। ক্রিকেট হতে পারে, দৌড়োদৌড়ি হতে পারে, জড়িয়ে ধরা হতে পারে, আমার কাঁধে চাপা? তা-ও হতে পারে! হবে না কেন?

আমার ছেলেরা অদ্ভুত ভাবে আমাকে গ্রহণ করেছিল সে সময়। আমার শর্তেই রাজি ছিল সকলে। বৃহত্তর কলকাতার আমাকে গ্রহণ করতে পারার অনেক, অনেক দিন আগে আমার স্কুলের ক্লাসঘরগুলোতে অন্য রকম সম্পর্কের নীল নকশা তৈরি হচ্ছিল— আমার সঙ্গে পরের প্রজন্মের আত্মীয়তার নকশা।

সাহিত্যের ছাত্র হিসেবেই যে কোনও লেখকের দুটো লাইনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা না-লেখা লাইনের সন্ধান করা আমার অভ্যেস ছিল। আর ছোট শিশুদের পড়াতে গিয়ে আমি তো অনেককেই পেলাম। সব থেকে বড় কথা, আমি সহজ পাঠ দ্বিতীয় ভাগের রবীন্দ্রনাথকে পেলাম। সহজ পাঠে পড়ি: বনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া শক্তিবাবুকে পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছিলেন দরিদ্র কাঠুরিয়া। খুশি হয়ে শক্তিবাবু তাঁকে দশ টাকা বকশিশ দিতে চাইলে, কাঠুরিয়া টাকা নেননি। তিনি বলেছিলেন, টাকা নিতে পারব না, অধর্ম হবে। আমি জানতাম, তাই আমার ছাত্ররাও খেয়াল করল, কাঠুরিয়ার এই ‘ধর্ম’ কোনও প্রচলিত ধর্ম নয়, এ হল মনুষ্যত্ব।

নাটক করাতে গিয়ে আমি সুকুমার রায়কে পেলাম। চিহ্নিত করতে এবং করাতে পারলাম সর্ব যুগের সর্ব কালের ‘রাজার অসুখ’-কে। সুকুমার-পুত্রের লেখাতেও ব্যাপারটা আমরা পেয়েছি পরে: এক বার ত্যজিয়ে সোনার গদি, রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়, তবে রাজা শান্তি পায়। ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাই রে’— প্রকৃতির কাছে শিশুর শিক্ষালাভের রুশো-চর্চিত মতবাদের সমর্থক এই অনবদ্য কবিতাকে পেলাম। আমি এমনকী তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণির ইতিহাস বই খুলে দেখলাম সেখানে লেখা আছে: ঈশ্বর মানুষকে তৈরি করেননি। বরঞ্চ মানুষই তাদের প্রয়োজনে বানিয়ে নিয়েছে ঈশ্বরের কনসেপ্ট। ব্যস, আমায় তখন পায় কে? আমি যা যা পড়াতে চাইছিলাম, তার সবগুলো ইশারাই তো পেয়ে গেলাম!

আমি আমার ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলাম বাংলার নবজাগরণের বৈপ্লবিক মনীষীদের মুক্তচিন্তাকে, পৌঁছে দিচ্ছিলাম ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ, পৌঁছে দিচ্ছিলাম ভারতের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-র ধারণার সারমর্ম, পৌঁছে দিচ্ছিলাম ডিরোজিয়োকে। পৌঁছে দিচ্ছিলাম বিবেকানন্দকে... তাঁর ছেলেবেলার নাস্তিকতা থেকে বড় বয়সের সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব, এই হয়ে-ওঠা সমেত। পৌঁছে দিচ্ছিলাম গোটা পৃথিবীকেই, সে এ-সব কিছু সিলেবাসে থাকুক ছাই না-থাকুক। আসলে ওই যে বললাম, শুরু করবার রাস্তাগুলো চিনতে পেরে গেছিলাম!

এ-সব রাস্তা অব্যবহৃত পড়ে থাকে বেশির ভাগ সময়েই। কনভেনশনাল লোকেরাই শিক্ষক হন বেশি, যখন উলটোটাই দরকার। আমাকে কেউ কেউ (সিনিয়র শিক্ষক) বলেছিলেন, ছাত্রদের ছুঁতে নেই। দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। এটাই নাকি প্রথা! আমি সে-মতে বিশ্বাসী ছিলাম না। ছাত্রদের শাসন না করলে আমি পড়াতে পারব না। আর শাসন যদি করি, কমপেনসেট করব কী করে, যদি ভালবাসার প্রকাশ না করি? আলিঙ্গন না করি?

ছাত্ররা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরত আমায় স্কুল ছুটির সময়, দলে দলে। আমি একটা বেড়া ভেঙে দিয়েছিলাম। স্পর্শের বেড়া। ছাত্র, শিক্ষক, কেউই কারও কাছে আর অস্পৃশ্য রইল না। ক্লাস ওয়ানের শিশু ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরত পরম মমতায়। অথচ আমি ওর ক্লাসে হয়তো সর্বসাকুল্যে গিয়েছি এক বার! চোখে জল চলে আসত। আমি আমার বাদবাকি জীবনের হেরে যাওয়ার সান্ত্বনা এ ভাবেই পেতাম। ওই ভালবাসাটুকু বহন করে নিয়ে আমি শিয়ালদা অঞ্চলের স্কুল থেকে বাসে চেপে, নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোতে নামতাম। সেখান থেকে অটো ধরে সোজা রিপন স্ট্রিটের এইচএমভি অফিসে। দিনের পর দিন বসে থাকার রুটিন সেখানে আমার, যাতে কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত শুনে ওঠেন আমার জমা দেওয়া, বাড়িতে বানানো, ৪০টা গানের ডেমো ক্যাসেট। স্নান, খাওয়া— এ-সব নিয়ে ভাবলে তখন থোড়াই চলবে!

সম্পর্কের নৈকট্য শুধুমাত্র আদর দিয়ে হয় না। শাসনও লাগে। তবে আদর করতে জানলে শাসনের অধিকারও হয়তো অল্প অল্প জন্মায়। আমরা যে রকম স্কুলে পড়েছি নিজেরা, সেখানে এক-এক জন মাস্টারমশাইয়ের এক-এক ধরনের শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজ... উপকথার অংশ। পড়াতে যখন গেলাম, একটু চিত্তাকর্ষক শাস্তি তৈরি করতেই চাইলাম, যাতে শাস্তি থেকে শারীরিক ব্যথার ভাগটা খানিক কমানো যায়।

বন্দুক নিয়ে ক্লাসরুমের বাইরে চলে যাও। ক্লাসরুমের শেষ যেখানে, সেখান থেকে সুন্দরবনের শুরু। অথবা শুরু হচ্ছে গা-ছমছমে আফ্রিকার জঙ্গল। প্রাচীন শিকার-খেলায় দুষ্টু ছেলেদের প্রথম অধিকার। দশটি প্রাণী শিকার করে আমায় রিপোর্ট দিতে পারলেই ক্লাসে ফিরে আসতে পারবে। শাস্তির এ ভূমিকা শুনে ছাত্রের প্রশ্ন: স্যর, বন্দুক কোথায়?

ওই তো, তোমার সামনে পড়ে আছে যে স্কেল (রুলার), ওটাই বন্দুক। স্কুলের বারান্দা গহন জঙ্গল। আর জন্তুগুলো অদৃশ্য বলেই ওদের মারা স্বীকৃত। রক্তপাত হবে না যে! এমন শাস্তি পেতে কে না চায়! আরও ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখো। সে-সব নিয়ে দশটা সম্পূর্ণ বাক্য বানাও। বানানো হলে আমায় বলো। বললেই আবার ক্লাসে এসে বসবে।

কল্পিত শিকার করবার শাস্তিটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। যারা ক্লাসে ডিসটার্ব করে না, তাদের দুঃখ হত, তারা কেন এই শাস্তি পাওয়া থেকে বঞ্চিত! তাদের বিশেষ অনুরোধে, অপরাধ না করলেও মিনিট দুয়েকের জন্য এই শিকারের সুযোগ তাদের দিতে হয়েছে কখনও কখনও, মনে পড়ে।

কিছু হাড়বজ্জাত বীরপুঙ্গব বয়স-নির্বিশেষে সব ক্লাসরুমেই বর্তমান। তাদের জন্য অবশ্য অন্য ব্যবস্থা। কিন্তু মুশকিল হত, জন্মপাজিরাও অদ্ভুত মিষ্টতায় কখনও কখনও আমায় বলত, স্যর, আপনার হাতে মার না খেলে স্কুলে এসে ভাল লাগে না। এটা তারা বলত গোটা ক্লাসের সামনে প্রকাশ্যে, সবার উচ্চহাস্যের আর একটা আয়োজন করে দিয়ে। হ্যাঁ, আমি মিস করি এই ছেলেদের। দামাল, অকুতোভয়, নিয়মভাঙা, কিন্তু সামাজিক! ওদের দুষ্টুমিকেও ওরা আসলে ক্লাসের অন্যদের বিনোদনের ইভেন্ট হিসেবেই দেখত, যত্ন করে প্র্যাকটিস করত, আমার ধারণা।

সবচেয়ে কড়া হতেই হত পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার সময়। এমনিতে আমি পরীক্ষা বিষয়টি, এবং সেটা যে ভাবে প্রয়োগ করা হয়: অভিভাবক ও ছাত্রদের মনে শিক্ষা ব্যাপারটার জায়গায় পরীক্ষার বসে পড়া (মানে পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর দিয়ে বিচার করা কে কেমন শিক্ষিত)... এ সবের ঘোর বিরোধী। মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে নতুন এবং পুরনো জ্ঞান ভাগাভাগি করলাম, জীবনে প্রয়োগ করলাম... এটাই যে শিক্ষার উদ্দেশ্য, আসল উদ্দেশ্য নয়, একমাত্র উদ্দেশ্য, ‘পরীক্ষা’তাড়িত প্রজন্মের পর প্রজন্মের তা একেবারেই খেয়াল নেই। ফলে পরীক্ষা আর শিক্ষা ভীষণ রকম গুলিয়ে আছে আমাদের চেতনে।

আমার ক্লাস-টেস্টগুলোতে বই খুলে উত্তর লেখার অনুমতি ছিল অবশ্যই, যে হেতু আমার তৈরি করা প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকত পূর্ববর্তী ক্লাসে দেওয়া ছাত্রের মনোযোগে, বইতে নয়। কিন্তু ক্লাস-টেস্টে প্রযুক্ত আমার বৌদ্ধিক স্বাধীনতা খানিকটা হলেও হেরে যেত প্রথাগত পরীক্ষার আয়োজনে। সেই পরীক্ষার হল-এ আমি নেহাতই দারোয়ান। আর প্রহরী বলেই যারপরনাই কড়া। মাছি গলবারও জো নেই। ঘুরে ঘুরে খাতায় ইনভিজিলেটর-এর সই করবার সময় কিছু বেঞ্চের দিকে পিছন করে তো দাঁড়াতেই হত। তখন বাণী দিতাম— আমার পিছনে কোনও দিব্য চোখ নেই। কাজেই সুযোগ নিতেই পারো, আমি দেখতে পাব না। কিন্তু কে বলতে পারে, হঠাৎ যদি ঘুরে তাকাই? তখন কিন্তু ঝামেলা, বিস্তর ঝামেলা।

এই সব চাবুক-বাণীর ‘হিট’ হতে সময় লাগে না। আমার স্কুলের প্রাচীন ক্লাস-প্রবাদে আমি অচিরেই উপাধি পাই— ‘সুপারহিরো ক্লাসদেব’ (সংক্ষেপে এসএইচসিডি)। বাণী এবং অ্যাকশন, দুই-ই যার কড়া! তবে আসল কথাটা হল, নিজেই উপাধি বানালাম, নিজেই ক্লাসে রীতিমত সরকারি ঘোষণা-টোষনা করে উপাধি গ্রহণ করলাম আর কী! এর আগেও আরও ডাকনাম দিয়েছি নিজেকে। যেমন ক্লাস ওয়ানে যারা পড়ে, তারা সব সময়ই গোটা স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে। ওরা কাউকে মানে না, কোনও সহবত জানে না, জানতে এবং মেনে চলতে ইচ্ছুকও না। ফলে ওই ক্লাসে এক দিন পরিবর্ত হিসেবে গিয়ে আত্মরক্ষার্থেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম বিপজ্জনক ‘গণেশকাকু’ হিসেবে, যার মতো নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর লোক গোটা স্কুলেই নাকি আর এক পিস মেলা মুশকিল! আসলে ছাত্ররা আমার ডাকনাম তৈরি করার আগেই নিজের নানা রকম ডাকনাম ওদের গছিয়ে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল। তাই নিজেরই প্রযুক্ত নানা রকম ভীতিপ্রদ ডাকনামের সঙ্গে খাপ খেয়ে যাওয়া বিস্ফোরক ডায়ালগ উদ্‌গিরণ করতে করতে, নিজের ছাত্রদের নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রহরারত আমার কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা হত কিছু দুষ্টু, টোকাটুকিপ্রবণ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর আসন আমাদের স্কুলে পড়লে।

এ ব্যাপারে আমার কোনও দ্বিমত নেই যে, ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা!’ এটা যে কোনও পরীক্ষার হল-এ প্রথমেই বলে দিতাম। তবে পাশাপাশি সারা ক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েও থাকতাম যে! ফলে বড়বিদ্যার অনুশীলন করায় কিঞ্চিৎ অসুবিধে ছিল। এক বার তো একটি বিশেষ স্কুলের দুই ওস্তাদ ছেলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তারা ‘কী করবি কর’ মেজাজে আমার সামনেই টোকাটুকির অভ্যেস ঝালিয়ে নিতে শুরু করল। কী আর করি! তুলে নেওয়া খাতাদুটো নিস্তেজ হয়ে আমার টেবিলে পড়ে রইল ঝাড়া আধ ঘণ্টা।

পরীক্ষা শেষ। গোটা হলের খাতা সাবমিট করে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, ছেলেদুটির মধ্যে একটি দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে একটা বাইক। ছেলেটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল, আমি কোথায় থাকি। এটা জানাতেও ভুলল না, সে অদূর ভবিষ্যতেই আমায় দেখে নেবে।

এটা আমার স্কুলশিক্ষক-জীবনের শেষের দিকের গল্প। তত দিনে আমি প্রায় ‘স্টেজ-এর আমি’ই হয়ে উঠেছি বলা চলে। সটান ঠিকানা দিয়ে দিলাম। তার পর শান্ত ভাবেই বললাম, তুমি অবশ্যই দেখে নিয়ো, কিন্তু মনে রেখো, তুমি দেখবে যখন, আমিও দেখব ঠিক তখনই।

অনেক ছাত্রর সঙ্গেই দেখা হয় আজকাল। নিজের নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত তারা। এই নিপীড়িত টোকাটুকি-বিশারদ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কিন্তু আর কোথাও কোনও দিন দেখা হয়নি।

Rupam islam Rabibashoriyo

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}