Advertisement
E-Paper

(অ)যাত্রা কথা

হঠাৎ শুনলাম, আমাদের পালার পরিচালকের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে মেক-আপ নিতে নিতেই! এ দিকে বাইরে পাবলিক চেঁচাচ্ছে, ‘পয়সা ফেরত দাও!’, ‘ব্যাটাদের আড়ং ধোলাই দাও!’ নব বন্দ্যোপাধ্যায়তখন জেলায় জেলায় ঘুরে আমরা যাত্রা করি। হুগলি, বর্ধমান, ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার নানা অঞ্চলে রাত্রিবেলা শুরু হয় আমাদের পালা। লোক ভেঙে পড়ে। গ্রামের পর গ্রাম ঝেঁটিয়ে সাইকেল, রিকশা, গরুর গাড়ি কিংবা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে (সে সময় কিছু অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়িও চলত) অথবা ভ্যানরিকশায় মানুষজন দল বেঁধে আসত দূর-দূরান্ত থেকে।

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

তখন জেলায় জেলায় ঘুরে আমরা যাত্রা করি। হুগলি, বর্ধমান, ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার নানা অঞ্চলে রাত্রিবেলা শুরু হয় আমাদের পালা। লোক ভেঙে পড়ে। গ্রামের পর গ্রাম ঝেঁটিয়ে সাইকেল, রিকশা, গরুর গাড়ি কিংবা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে (সে সময় কিছু অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়িও চলত) অথবা ভ্যানরিকশায় মানুষজন দল বেঁধে আসত দূর-দূরান্ত থেকে। পায়ে হেঁটে তো আসতই। হাতে থাকত তাদের হ্যারিকেন। দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে অসংখ্য মিটমিটে আলোর মিছিল। সে এক দৃশ্য বটে!

প্রচুর সুনাম তখন আমাদের। এলাকার পেল্লায় বিখ্যাত অভিনেতা-পরিচালক উমাশঙ্কর ঘোষ, আমাদের উমাদা, দলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। তিনি একেবারে কড়া নজর রাখতেন, যাতে সেই সুনামে কালি না লাগে।

এক বার, নদিয়ার শান্তিপুরে গিয়েছি। আমি বলে ফেললাম, ‘এ যা ভিড় দেখছি— দশ হাজারের কম নয়।’ সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে সুদীপ বলল, ‘ঠিক আছে, না হয় দশ হাজারই হল— তাতে হলটা কী? আমাদের পেমেন্ট তো আর বাড়ছে না!’ অকাট্য যুক্তি। লোক পাঁচ হাজার কি দশ হাজার, যাই হোক না কেন, দলের সত্তর শতাংশ পেমেন্ট হয়ে গেছে, বাকি তিরিশ শতাংশ পেমেন্ট হবে পালা শেষ হওয়ার পর।

তখনই কানের পাশে ফিসফিসানি শুনলাম, ‘তোদের দুজনকেই উমাদা ডাকছে!’

আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সুদীপ আর আমি সেই চতুর্থ দৃশ্যে একসঙ্গে! অন্তত দশ জনের মেক-আপ আমাদের আগে। তা হলে অসময়ে এই তলব কীসের?

গ্রিনরুমের কাছাকাছি আসতে চক্ষু চড়কগাছ। ওরেব্বাবা! এ যে জনসমুদ্র! লাইব্রেরির বাইরের দিকে একটা ঘরকে সাজঘর হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল আমাদের। সেই ঘরটার কোলাপসিব্‌ল গেট ভেতর থেকে বন্ধ! তালা দেওয়া। গেটের বাইরে গিজগিজ করছে মানুষ— হরেক পোশাকের, হরেক কিসিমের। আমাদের দেখে গেট সামান্য ফাঁক হল। দুজনে কোনও মতে ভেতরে ঢুকে আসবার পর সেক্রেটারি দিলীপ পাল তক্ষুনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘আর কেউ বাইরে যাবে না।’

সে না হয় গেলাম না। কিন্তু ঢাক ঢাক গুড়গুড়টি কীসের? ভেতরেও সাজ-পোশাক নিয়ে কেউ তাগাদা দিচ্ছে না। দু’-এক জন দাড়ি-গোঁফ লাগিয়েছে বটে, কিন্তু কেমন প্রাণহীন সব। ব্যাপারখানা কী? তবে কি কোনও অঘটন? কাউকে চেঁচিয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। ঘরের এক কোণে নিজের পার্টটা নিয়ে বসেছি, এমন সময় প্রদীপ এল— ‘জানিস, উমাদাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে!’

আঁতকে উঠলাম। ‘অ্যাঁ, সে কী!’

এ-দিক সে-দিক দেখে নিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে সতর্ক করল প্রদীপ— ‘চুপ, একদম চুপ!’

নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় জানতে চাইলাম, ‘কী হয়েছে রে?’

‘আরে, মেক-আপ নিচ্ছিল। নিতে নিতেই হার্ট অ্যাটাক!’

‘ওরে বাবা!’

আতঙ্কে আমারই হার্ট তত ক্ষণে জিভের গোড়ায়। কোনও মতে জিজ্ঞেস করতে পারলাম— ‘তা হলে আজকের অভিনয়!’

প্রদীপ ফিসফিস করল, ‘আর অভিনয়! প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলে ভাগ্য জানবি!’

বাইরে তত ক্ষণে হাজারো পাবলিক। চিৎকার উঠছে— ‘পয়সা ফেরত দাও!’, ‘ব্যাটাদের আড়ং ধোলাই দাও!’, ‘ড্রেস-ট্রেস আটকে রাখ!’, ‘এক ব্যাটাকেও ছাড়বি না!’

আর তার সঙ্গে কোলাপসিব্‌ল গেট নিয়ে টানাটানি। ঝনঝন শব্দ। শুনতে শুনতে শিউরে উঠছি। কী বিপদ হল রে বাবা! দৌড় দিয়ে পালাবার পথও রাখোনি ঠাকুর!

মাইকে কর্মকর্তাদের কাতর আহ্বান কানে আসছে— ‘বিশিষ্ট অভিনেতা-পরিচালক উমাশঙ্করের হঠাৎ শারীরিক বিপর্যয়ের ফলে আজকের অভিনয় স্থগিত রাখা হল। এই টিকিটেই যাত্রাপালাটি আবার দেখা যাবে, দিন ও সময় জানিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের সহৃদয় সহযোগিতা কামনা করি।’

সহযোগিতা কত পাওয়া যাবে তো দিব্যি মালুম হচ্ছে, আমি শুধু চোখ বন্ধ করে ঠাকুর ডাকছি! প্রাণ নিয়ে যেন বাড়ি ফিরতে পারি। কেউ এক জন ডাকতে, চোখ খুলে দেখি সাজঘরের সামনে জনতার ভিড় অনেকটাই পাতলা। শিল্পীদের লাইব্রেরির পিছনের দরজা দিয়ে বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মেঠো পথে হোঁচট খেতে খেতে কী ভাবে সে দিন স্টেশনে পৌঁছেছিলাম, আজ ভাবলেও ডান পায়ের বুড়ো অাঙুলটা টনটনিয়ে ওঠে। স্টেশনেই দেখলাম উমাদা-কে। মাথা ভিজে। সারা শরীর কম্বলে ঢাকা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন?’

ম্লান হেসে জবাব দিলেন, ‘ভাল।’

পার্টিরা ছিল ভাল। ট্রেন আসতে ওদেরই কয়েক জন ধরে ধরে উমাদাকে তুলে দিয়ে গেল। লাস্ট ট্রেন স্টেশন থেকে চলতে শুরু করা মাত্র কম্বল ফেলে খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন উমাদা। বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘ওঃ, কী কুক্ষণে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে! এ সবও লেখা ছিল কপালে!’

আমরা ক’জন তখন স্তম্ভিত! কী ব্যাপার? ল্যাজা-মুড়ো কিছুই বুঝতে পারছি না! এর-ওর মুখ থেকে শুনে যেটুকু সংগ্রহ করা গেল, তা হল: পালার নায়িকা ছবিরানির নামে গাঁ-গঞ্জে পোস্টার পড়ত। সেই ছবিকে কে বা কারা ভুল বুঝিয়েছে, শান্তিপুরের আসরে আমাদের পালা হচ্ছে না। ফলে, ছবি নেই, এবং আমাদের সক্কলের ছবি হয়ে ওঠার উপক্রম!

কিছু ক্ষণ পরে উমাদা নিজেই কবুল করলেন, হাসপাতালের তরুণ ডাক্তারবাবুটির সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে তাঁর মতো ধুরন্ধর অভিনেতার পক্ষেও সব কিছু সামলানো মুশকিল হত সেই রাতে। ‘অসুস্থ’ উমাদার চোখের ইশারায় তিনি বুঝে যান, ব্যাপারটা গুরুতর, এবং পরবর্তী ঘটনাবলির রাশ নিজের হাতে তুলে নেন।

ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে ফিল্টার্ড ওয়াটার ভরে রোগীর শরীরে পুশ করা থেকে শুরু করে, কৌতূহলী জনতাকে কিছু সময় অন্তর অন্তর গম্ভীর মেডিকাল বুলেটিন দিয়ে শান্ত রাখা— সব কিছু এমন দক্ষ ভাবে সামলান, তাঁকে হিরোর পার্টে পেলে আমাদের উমাদার পালা আরও রমরমিয়ে চলত!

Travel
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy