Advertisement
E-Paper

মগডাল, জিরাফ আর অনেক পিঁপড়ে

মগডালটি সবচেয়ে উঁচুতে। অসংখ্য ডালপালাকে পিছনে ফেলে বিশাল কাণ্ড থেকে সদ্য সে বেরিয়েছে। কী স্নিগ্ধ সবুজ তার রং! কী কচি ও কোমল তার গা!

রাজীব কর

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০০:০০

মগডালটি সবচেয়ে উঁচুতে। অসংখ্য ডালপালাকে পিছনে ফেলে বিশাল কাণ্ড থেকে সদ্য সে বেরিয়েছে। কী স্নিগ্ধ সবুজ তার রং! কী কচি ও কোমল তার গা!

দেখতে দেখতে দিন কয়েকের মধ্যে তার গায়ে এসে জুটল ছোট্ট ছোট্ট বাদামি পাতার পোশাক। প্রতিদিন সূর্যের প্রথম কিরণটি সে-ই প্রথম স্পর্শ করবে। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটি সবার আগে সে শুষে নেবে। রাতের তারাগুলিকে সে দেখবে সবার আগে। হাওয়া তাকে দোলনায় দোলায়। বৃষ্টি ধুয়ে দেয় তার দুধ-ভাত খাওয়া মুখ। রোদ এসে তাকে আশীর্বাদ করে। মগডাল নিজেকে ঈশ্বরের দূত ভাবতে শুরু করে। ভাবে তার সমকক্ষ কেউ নেই। অহংকার তাকে উদ্ধত করে।

মগডাল মেঘের সঙ্গে কথা বলে। বলে, ও মেঘভায়া, তোমরা থোকায় থোকায় চলেছ কোথায়?

মেঘেরা বলে, তোমাকে বলব কেন? আমরা তোমার চেয়েও উঁচুতে থাকি। ভেসে ভেসে যেখানে খুশি যাই। ওপর থেকে মাটিকে দেখি। আবার, ইচ্ছে হলে বৃষ্টি হয়ে নামি মাটির কোলে। তুমি কি পারো এ সব?

মগডালের দুঃখ হয়। তবে কি তার বন্ধু হবে না কেউ? শিশুরা যেমন মায়ের কোলে উঠে চাঁদকে ধরতে হাত বাড়ায়, মগডালও তেমনি চাঁদ ধরতে যায়। কিন্তু পারে না। তখন বুঝে, নিজেকে সে যত বড় আর উঁচু ভাবে তার চেয়েও উঁচু আছে অনেক কিছু। চাঁদও তার বন্ধু নয়। সে এত ছোট আর নরম যে কোনও পাখিও তার কাছে বসে না। মগডাল বড় একলা। ঊর্ধ্বমুখিতা ছাড়া তার আর গতি নেই।

পর্বত-আরোহীদের মতো বৃক্ষারোহী একদল পিঁপড়ে ট্রেকিং-এ বের হয়। খড়খড়ে কাণ্ড বেয়ে ওপরে ওঠে। নিঃশব্দে পৌঁছে যায় মগডালে। তাদের দেখে মগডালের মনে আশা জাগে। একসঙ্গে এত পিঁপড়কে সে বন্ধু হিসেবে পাবে। বন্ধুরা, তোমরা কোথা থেকে আসছ?

আমরা মাটির গর্ত থেকে আসছি গো, পৃথিবীর গভীর থেকে। যখন জানলাম তুমি একলা, তোমার বড় দুঃখ, তখন মনে হল— যাই, দেখা করে আসি একবার।

বেশ, বেশ! তোমরা ভাল পিঁপড়ে। আমার কী সৌভাগ্য, বন্ধু পেলাম।

মগডাল তো পৃথিবীর খবর রাখে না। জানে না এখানে বন্ধুবেশে থাকে অনেক শত্রুও। তাই পরম নিশ্চিন্তে পিঁপড়েদের আশ্রয় দিল তার পাতায়। কয়েক দিন পর পিঁপড়েরা ‘কুট কুট’ করে কচি বাদামি পাতাগুলো ফুটো করতে থাকে। অল্প সময়েই মগডাল বুঝতে পারল, যারা এসেছে তার বন্ধু সেজে, তারা আসলে ধ্বংসদূত! ‘কুট কুট’ করে সর্বস্ব খেয়ে তবে ছাড়বে। মগডাল জোরসে নাড়া-ঝাড়া দেয়। পিঁপড়েরা জোরে আঁকড়ে থাকে। কী বিপদ! তবে কি সে এ ভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে? কে শুনবে তার কান্না, আর্তনাদ? মগডালের মনে হল বেশি উঁচুতে উঠলে, আর নিজের চেষ্টায় না উঠলে এ ভাবেই বুঝি একলা হয়ে যেতে হয়। আশেপাশে কেউ থাকে না। কিন্তু শত বিপদ বাধাতেও হাল ছাড়তে নেই। মগডালের মন বলছে, একটা কিছু ঘটবে। অদ্ভুত কোনও একটা ঘটনা তাকে ঠিক বাঁচিয়ে দেবে।

ঘটলও তাই। মগডালের মন মিথ্যে বলেনি। হঠাৎ এক দিন সে দেখে একটা ভীষণ উঁচু জন্তু এ দিকেই আসছে। ওরই নাম তো জিরাফ। মগডাল চেঁচিয়ে ওঠে— জিরাফভায়া, জিরাফভায়া, আমাকে সাহায্য করো, আমাকে বাঁচাও। জিরাফ ভাবে, এ কী রে বাবা, ভারী মুশকিলে পড়া গেল। কচি ডাল-পাতা দেখে যাকে খেতে এলাম সে কিনা বলে বাঁচাতে! মগডাল কেঁদে কেঁদে বলে, দেখো না, এই পিঁপড়েগুলো আমাকে তিল তিল করে শেষ করে দিচ্ছে। আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচাও!

জিরাফকে লম্বা-চওড়া দেখতে হলে কী হবে, আসলে তার মনটা বড্ড নরম। তার খুব মায়া হয়। নিজের খিদের কথা ভুলে যায়। বলে, কিচ্ছুটি ভেবো না বন্ধু, এক্ষুনি পিঁপড়েদের শায়েস্তা করছি। এই না বলে ফোঁস ফোঁস করে দু’চার বার ভয়ানক নিশ্বাস ছাড়ে। সেই ঝড়ে পিঁপড়েরা যায় উড়ে। তার পর মগডালে দু’এক বার মুখ ঘষে জিরাফ আদুরে গলায় বলে, তুমি খুব নরম!

মগডাল আহ্লাদে আটখানা। তার আর কোনও ভয় নেই। জিরাফের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে সে বলে— ভায়া, তুমি এত বড় আর শক্তিশালী হলে কী করে? আমিও তো তোমারই মতো উঁচু, তবু এত দুর্বল!

জিরাফ বলে, ভায়া, তুমি হয়তো অহংকারী, তাই এত দুর্বল। অহংকার কখনও শক্তি হতে পারে না, অহংকার হল শক্তিহীনতার অন্য নাম। আমি কেন এত বড়, জানো? মৌন থাকি, আওয়াজ করি না। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে পাই, আবার মাটিকেও দেখি। মেঘের গায়ে মুখ ঘষে দিই, আবার গা চেটে দিই ঘাসেদের। মাটিকে ভুলি না কখনও। তোমার সঙ্গে আমার খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক। তবু বিপদে পড়ে সাহায্য চাইলে বলে তোমাকে আমি মুড়িয়ে খেলাম না। বরং অন্য শত্রুদের হাত থেকে বাঁচালাম। এ বার বুঝেছ, কেন আমি বড়, উঁচু আর সুন্দর?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy