Advertisement
E-Paper

ভাল ডাকাত

নৈ হাটি থানার দারোগা রঘু ডাকাতের কাছ থেকে হঠাৎ চিঠি পেলেন। রঘু লিখেছে, সে নিজেই দারোগার কাছে আসবে। দারোগা তো হতভম্ব! সরকার তখন হন্যে হয়ে রঘুকে খুঁজছে, তাকে ধরার জন্য গুচ্ছ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছে।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

নৈ হাটি থানার দারোগা রঘু ডাকাতের কাছ থেকে হঠাৎ চিঠি পেলেন। রঘু লিখেছে, সে নিজেই দারোগার কাছে আসবে। দারোগা তো হতভম্ব! সরকার তখন হন্যে হয়ে রঘুকে খুঁজছে, তাকে ধরার জন্য গুচ্ছ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছে। দারোগা থানার চার পাশে অনেক সেপাই মোতায়েন করলেন। এক দিন সেপাইরা দেখে, দূর থেকে এক লম্বা-চওড়া মানুষ থানার দিকে এগিয়ে আসছে। সে খানিক কাছে এলে দেখা গেল, নেহাতই এক নিরীহ জেলে। দু’খানা বিরাট মাছ তার মাথায়। বলল, সুখচরের জমিদার নাতির মুখেভাত উপলক্ষে মাছগুলো দারোগাকে উপহার পাঠিয়েছেন। দারোগা খুশ। লোকটাকে বকশিশও দিলেন। কিছু দিন পর ফের রঘু ডাকাতের চিঠি। লিখেছে, সে দারোগার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। দারোগাবাবু মাছ কেমন খেলেন?

দারোগাকে এই যে চিমটি কাটা, এটা আসলে এক প্রতিবাদী রঘুকেই চিনিয়ে দেয়। রঘু সব সময় ছিল সাধারণ মানুষের পক্ষে, আর অত্যাচারী জমিদার বা প্রশাসনের বিপক্ষে। যে গুণটি রঘুকে সবচেয়ে বিখ্যাত করেছিল, তাকে ‘বাংলার রবিনহুড’ তকমা দিয়েছিল, তা হল তার দয়া। ব্রতপার্বণে সে গাঁয়ের মানুষকে দানধ্যান করত। নীলকরের অত্যাচারে ঘর পুড়ে যাওয়া মানুষদের টাকা দিয়ে সাহায্য করত। কোন ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়ে পণের টাকা জোগাড়ের অভাবে আটকে গেছে, বরযাত্রী ফিরে যাচ্ছে, রঘু তাদের মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। মেয়ের বাবার হাতে পণের টাকা গুঁজে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে সে তখন ভগবান। তাই রঘু ডাকাতের চালচলনের হদিশ পেত না পুলিশ। লোকে তার ঠিকানা জানলেও, বলত না, ধরিয়ে দিত না।

বাংলার গ্রামে গ্রামে তখন কোম্পানি সেরা ধানের জমিগুলো বেছে নিয়ে দাগ দিচ্ছে। নীল চাষ হবে। প্রথমে ‘পাঁচকাঠিয়া’, পরে তা বেড়ে দাঁড়াল দশ কাঠায়। আর হুকুম-না-মানা চাষিদের ঘরে লাগল আগুন। পাইক দিয়ে তাদের কাছারিতে তুলে নিয়ে গিয়ে চলল বেদম মারধর। শোনা যায়, নীলকুঠির পাইকদের হাতে মার খেয়েই মারা যান রঘু ডাকাতের বাবা। তখনও সে ডাকাত হয়নি। তবে, লাঠিখেলায় অপ্রতিরোধ্য। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রঘুনাথ আচার্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। থানায় আগুন দিয়ে, নীলকুঠি পুড়িয়ে লুঠপাট চালায়। ছেলে-ছোকরাদের ডেকে বলে, লাঠি ধর। নীলকরের অত্যাচার সইবি না। ওরা মারলে তোরাও মারবি। রঘু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। গ্রামের মানুষরাই ঢাল হয়ে তার চার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু বিশ্বনাথ ডাকাত। তাকে বিখ্যাত করেছে নদিয়ার স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি লুঠের গল্প। কৃষ্ণনগর অঞ্চলে নীলকর ফেডি ও তার দলবলের অত্যাচার সীমা ছাড়িয়েছিল। বিশাল বাহিনী নিয়ে এক রাতে বিশে ডাকাত সেই কুঠি আক্রমণ করল। তুমুল সংঘর্ষে মারা গেল ফেডির অনেক অনুচর। ফেডির স্ত্রী মাথায় কালো হাঁড়ি চাপিয়ে পুকুরে ডুব দিয়ে রক্ষা পেল। আর ফেডিকে ডাকাতরা নিয়ে এল নিজেদের আস্তানায়। সবাই বলল, ফেডির রক্ত চাই। কিন্তু ফেডি প্রাণভিক্ষা করতে, বিশ্বনাথ তাকে ছেড়ে দেয়। অকৃতজ্ঞ ফেডি কিন্তু তার পরই ধরিয়ে দিল বিশ্বনাথকে। অল্প দিন পরেই বিশ্বনাথ জেল পালিয়ে ফেডির কুঠি আক্রমণ করে। ফেডি আহত হল। কিন্তু এ বারও তাকে প্রাণে মারল না বিশ্বনাথ। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ফৌজের হাতে বিশ্বনাথ ধরা পড়ে, নীলকরদের দোসর এক জমিদারের বাড়ি লুঠতে গিয়ে। মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল তার। প্রকাশ্যে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

সাধারণ ঠগি, ঠ্যাঙাড়েদের চেয়ে বাংলার এই ডাকাতরা আলাদা। নিরীহ মানুষ নয়, এদের টার্গেট ছিল অত্যাচারী, সাহেবভজা জমিদার। আড়াল থেকে সর্বস্ব লুঠ করত না এরা। একেবারে চিঠি দিয়ে, দিনক্ষণ জানিয়ে, তৈরি হওয়ার সময় দিয়ে, বাঘের মতো আসত। নৃশংস ছিল, খুনজখমে হাত কাঁপত না এতটুকু। কিন্তু শিশু আর মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়াকে অধর্ম মনে করত অনেক ডাকাত সর্দারই। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ইন্দিরা’তে তার প্রমাণ মেলে।

ইন্দিরা বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পথের মধ্যে ডাকাত পড়ল। পালকি-সমেত ইন্দিরাকে উঠিয়ে নিয়ে চলল তারা। রাত এক প্রহরে এক নিবিড় বনের ভেতর পালকি নামানো হল। ইন্দিরার গয়নাগাঁটি, দামি কাপড় লুঠের পর তারা পালকির রুপোও খুলে নিল। কিন্তু ইন্দিরাকে স্পর্শমাত্র করল না। বরং ঘন জঙ্গলে, গভীর রাতে তারা তাকে পশুর মুখে ফেলে যায় দেখে ইন্দিরা যখন ভয়ে তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, তখন দলের সর্দার তাকে বলে, ‘বাছা, অমন রাঙ্গা মেয়ে আমরা কোথায় লইয়া যাইব?’ আবার এক যুবা দস্যু যখন অতি উৎসাহে বলছে, ‘আমি ইহাকে লইয়া ফাটকে যাই, সেও ভাল, তবু ইহাকে ছাড়িতে পারি না’, তখন দলের সর্দার তাকে লাঠি দেখিয়ে বলে ওঠে, ‘এই লাঠির বাড়িতে এইখানেই তোর মাথা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইব। ও সকল পাপ কি আমাদের সয়?’

শিবে ডাকাতের গল্পে দেখি, সিপাহি যুদ্ধের সময়, মুর্শিদাবাদের এক মুসাফিরখানায় কাজ করত বছর বারোর ছেলে, বাচ্চু। কাজে একটু ভুল হলেই জুটত বেধড়ক মার। তার পাওনা টাকা তো সে পেতই না, এমনকী কেউ তাকে বকশিশ দিলে, সেটাও কেড়ে নিত মালিক। সেই মুসাফিরখানাতেই আসত এক বাঙালি ঘোড়সওয়ার, শিবদাস। সে বাচ্চুকে খেতে দিত, অনেকটা করে টাকা দিত। বাচ্চুও তার দুঃখের কথা মন খুলে বলত শিবদাসকে। তার পর এক দিন বাচ্চুর চাকরি গেল। ছ’মাস কাজ করার টাকা পেল না, বরং যা-তা গালাগাল দিয়ে, পিটিয়ে, মালিক তাকে বের করে দিল। এই বার ওই ঘোড়সওয়ার স্বমূর্তি ধরল। সে শিবে ডাকাত, জানতে পেরে মালিকের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। শিবে ডাকাত মালিকের জোচ্চুরির জরিমানা হিসেবে শ’খানেক টাকা আদায় করে, বাচ্চুর হাতে তুলে দিল।

মনোহর ছিল দুর্দান্ত ডাকাত। এখন দক্ষিণ কলকাতার যে পথের নাম মনোহরপুকুর, আজ থেকে দুশো বছর আগে সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল, খাল, বিল, জলা হোগলার বন। সেখানেই তার আস্তানা। এক বার গভীর রাত্রে সেই পথে ফেরার সময় মনোহর ও তার সঙ্গীদের নজরে পড়ে, খালের পাড়ে কাদা-জলে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে দুটি দেহ, এক স্ত্রীলোক এবং বছর পাঁচ-ছয়ের একটি ছেলে। মেয়েটি বাঘের থাবায় গুরুতর আহত। দস্যুরা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে মনোহরের বাড়ি।

ডাকাতদের সেবা সত্ত্বেও মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। এ বার ছেলেটির কী হবে? কার ছেলে, কোথায় থাকে, কিছুই জানা নেই। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের গল্পে দেখা যায়, মনোহরের বুড়ি পিসি মনোহরকে উপদেশ দিচ্ছেন, ছেলেটির গলা টিপে তাকে বাদার জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হোক। উত্তরে মনোহর গর্জে উঠে বলছে, ‘তুই মাইয়া মানুষ হইয়া এমন কথা বলিস্। ডাকাত বটি কিন্তু এ হাতে কোনদিন মাইয়া মানুষ আর ছোট ছোট ছাইল্যা মাইয়া মারি নাই। পিসি তুই কি পুতনা রাক্ষসী!’ সেই ছেলেকে মনোহর ডাকাত নিজের কাছে রেখে মানুষ করে। গ্রামের পাদরির কাছে নিয়ে যায় লেখাপড়া শেখাতে।

সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। তখন জমিদাররাও ডাকাত হত। দিনের বেলা জমিদারি সামলে রাতের আঁধারে ছিপ নৌকোয় অন্যের জমিদারি লুঠতে বের হত তারা। শান্তিপুরের কুখ্যাত ডাকাত দেবী ঘোষ ও নবীন ঘোষও জমিদার ছিল। এক বার দুই ভাই প্রকাণ্ড বজরা চেপে চলেছে কোনও এক জমিদার বাড়ি লুঠতে। তারা ‘দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কুৎসিত পুরুষ। মাথায় সেকালের রীতি অনুযায়ী ছিল একরাশ ঝাঁকড়া চুল, গলায় সোনার মাদুলি, দুই বাহুতে সোনার বাজু, হাতে সোনার বালা।’

বজরা তখন কামারডেঙ্গির কাছে। ছাদের ওপর থেকে দেবী ঘোষের চোখে পড়ল, ষোলো-সতেরো বছরের একটি মেয়ে ঘাটে বসে কাঁদছে। বজরা থেকে নেমে সে মেয়েটির কাছে গেল। মেয়েটি দেবী ঘোষের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে, ‘বাবা, আমাকে আপনি রক্ষা করুন।’ তার নাম সুলোচনা। মা-বাপ নেই। মামার কাছে মানুষ। মামা তার সঙ্গে আশি বছরের এক বুড়ো কুলীনের বিয়ে ঠিক করেছেন। এ দিকে সুলোচনার মন বাঁধা পড়ে আছে বলরাম মুখুজ্জের ছোট ছেলে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে। সে কথা জানতে পেরে তার মামা সেই রাতেই সুলোচনার সঙ্গে সেই কুলীনের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। বেচারি সুলোচনা তাই পালিয়ে এসেছে। গঙ্গায় ডুবে মরতে।

সেই দিন শেষ রাতে নহবত বাজল দেবী ঘোষ, নবীন ঘোষের বাড়িতে। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখছেন, ‘সানাইয়ের সুরে সমস্ত বাড়ি ও পল্লী হইল উৎসব-মুখর। লোকজনের হৈ-হৈ রব। ভূরিভোজনে সকলে তৃপ্ত হইয়া গেল।’ দুই ভাই দাঁড়িয়ে থেকে সুলোচনার সঙ্গে বিয়ে দিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের। লোকে জানল, দেবী ঘোষের মেয়ের বিয়ে।

বিয়ের পরের দিন। বরকনের বিদায়ের সময় দেবী ঘোষ সুলোচনাকে বুকে টেনে বলল, ‘জানিস আমি কে?’ সুলোচনা জানল, তার নতুন বাবা আর কাকা আসলে ডাকাত। শান্তিপুরের ত্রাস। শুনে সুলোচনা বলল, ‘কে বলে আপনারা ডাকাত, আপনারা দেবতা! দেবতার কাছে কি জাত-বিচার আছে, বাবা?’ এ ঘটনার পরেই নাকি দু’ভাই ডাকাতি একেবারে ছেড়ে দেয়।

ভবানী পাঠক বিখ্যাত ‘দস্যু’। তাঁর ভয়ে বরেন্দ্রভূমি কম্পমান। কিন্তু জঙ্গলে একা, অসহায় প্রফুল্লকে তিনি মা বলে ডেকেছিলেন। অনুচরদের কাছে তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, তারা যেন প্রফুল্লর কোনও অনিষ্ট না করে, আর কাউকে করতেও না দেয়। ইজারাদারে রঞ্জনপুর গ্রাম লুঠলে, ভবানী পাঠকের দল সেই ইজারাদারের কাছারি লুঠে, গ্রামের লোকের ধনসম্পত্তি গ্রামের লোকের হাতেই দিয়ে আসার তোড়জোড় করেন। নিজের দস্যুবৃত্তির সমর্থনে প্রফুল্লকে বলেন, ‘আমি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করি।’ তাঁর বয়ানে কাছারির অত্যাচারী কর্মচারীদের প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে লিখছেন, ‘সিংহাসন হইতে শালগ্রাম ফেলিয়া দেয়, শিশুর পা ধরিয়া আছাড় মারে, যুবকের বুকে বাঁশ দিয়া দলে, বৃদ্ধের চোখের ভিতর পিঁপড়ে, নাভিতে পতঙ্গ পূরিয়া বাঁধিয়া রাখে। যুবতীকে কাছারিতে লইয়া গিয়া সর্ব্বসমক্ষে উলঙ্গ করে, মারে, স্তন কাটিয়া ফেলে, স্ত্রীজাতির যে শেষ অপমান, চরম বিপদ্, সর্ব্বসমক্ষেই তাহা প্রাপ্ত করায়।’ ভবানী ঠাকুরের কথায়, ‘এই দুরাত্মাদিগের আমিই দণ্ড দিই। অনাথা দুর্ব্বলকে রক্ষা করি।’

এখানে তিনি নিছক ডাকাত সর্দার নন, বরং সমাজের রক্ষাকর্তা এক অসামান্য পুরুষ। এমনই এক মানুষ, যিনি রংপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কোম্পানির শাসনকে থমকে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারেন। ইংরেজ শাসনের গোড়ায়, যখন আমজনতার চোখে বিদেশি শাসনের কুৎসিত রূপটা ততটা বিকট ভাবে ধরা পড়েনি, সে সময় হয়তো ভবানী পাঠক, রঘু, বিশে ডাকাতদের প্রয়োজন ছিল। তারা একেবারে নিখুঁত ভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল, কাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে, কারা দেশের আসল শত্রু।

futi.chatterjee@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy