Advertisement
E-Paper

নাটকবাবু

তখন আমি একুশ। এক দিন কাগজে নান্দীকার-এর একটা বিজ্ঞাপন দেখে, সিলেকশন টেস্টের জন্য গেলাম। দেখি, অন্তত ৫০০ ছেলেমেয়ে ভিড় করে আছে। খুব মনখারাপ হল।

দেবশংকর হালদার

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

তখন আমি একুশ। এক দিন কাগজে নান্দীকার-এর একটা বিজ্ঞাপন দেখে, সিলেকশন টেস্টের জন্য গেলাম। দেখি, অন্তত ৫০০ ছেলেমেয়ে ভিড় করে আছে। খুব মনখারাপ হল। আমি তো অভিনয়ের কিছুই জানি না, চান্স পাব না! এক সময় ঘরের ভেতর গেলাম, সেখানে বসে আছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ওঁরা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। এটা পারি কি না, ওটা জানি কি না। আমি তো ও-সব কিছু জানি না, বললাম, খেলাধুলো জানি, লিটল ম্যাগাজিন করেছি, এই সব। ওঁরা বললেন, এগুলো তো থিয়েটারে তেমন কাজে লাগবে না! জিজ্ঞেস করলেন, গান জানি কি না। একেবারেই গাইতে পারি না, তবু একটা রবীন্দ্রনাথের গান গাইলাম— ‘কোন্‌ ভীরুকে ভয় দেখাবি, আঁধার তোমার সবই মিছে।’ খুব বাজে গাইলাম। পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে এলাম, খুব রাগ হচ্ছিল ওঁদের ওপর।

সাত দিন বাদে রেজাল্ট। জানি আমার হবে না, তবু কেন যে লিস্ট দেখতে গেলাম, কে জানে। আশ্চর্য, আমার নাম দেখি লিস্টে আছে! তলার দিকে। দু’জন হালদার আছে লিস্টে, তার এক জন আমি। খুব আনন্দ হল। বেরিয়ে আসছি, দেখি, আমারই বয়সি একটা ছেলে, সুন্দর দেখতে, সুন্দর জামাকাপড় পরা, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। বলল, ‘আপনার হয়েছে, না?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনার? ‘না, আমার হয়নি।’ দেখেছেন ভাল করে? সে আরও মুখ শুকনো করে বলল, ‘না হয়নি, আমি জানি।’ কী নাম আপনার? ‘গৌতম, হালদার।’ হালদার? চলুন না দেখি আর এক বার, আমি লিস্টে দেখেছি দুজন হালদার আছে। ‘আরে না না, জানি আমার হয়নি।’ টেনে নিয়ে গেলাম। দেখি, লিস্টির এক নম্বর নামটাই জ্বলজ্বল করছে, গৌতম হালদার! ও-ই ফার্স্ট!

এক ঝাঁক নতুন, তরুণ ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হল নান্দীকারের ট্রেনিং প্রোগ্রাম। ‘ফুটবল’ নামের খুব বিখ্যাত আর জনপ্রিয় নাটকটারই পুনর্নির্মাণ করলাম আমরা। মূল চরিত্র হরি, করল গৌতমই। আমি ছোট্ট একটা রোল করেছিলাম, ক্রাউড-এর একটা চরিত্র। এই নাটকটা আমার থিয়েটার-জীবনের একটা বিশেষ জায়গা দখল করে আছে, কারণ আমি পরে এই নাটকটার ‘কালীদা’ (যেটা রুদ্রপ্রসাদ করতেন) বাদে প্রত্যেকটা রোলই করেছি। গোড়ার ওই ছোট্ট রোল, তার পর আর একটু বড় রোল, তারও পরে আর একটু বড়, এমনকী গৌতম যে-বার একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে গেল, তখন হরির রোলও করেছি। এমনই এক শো-তে এক বার একটা বড় চরিত্র করছি। একটা লম্বা কবিতার মতো সংলাপ ছিল, ঠিক হাফ টাইমের আগে। সেটা বলতে বলতে আমি স্টেজের সামনের দিকে এগিয়ে আসব। একটু টেনশনে ছিলাম। কিন্তু প্রথম স্ট্যানজাটা বলার পর, শুনতে পেলাম, সামনের রো থেকে কে এক জন বললেন, বাঃ! ওই একটা শব্দ, একটা হাজার ওয়াট বাল্‌বের মতো আলো ছড়িয়ে দিল আমার ওপরে। বাকি নাটকটা একটা ঘোরের মধ্যে শেষ করে ফেললাম। তাকিয়ে দেখেছিলাম, গেরুয়া রঙের পোশাক পরা কেউ এক জন বলেছিলেন ওই ‘বাঃ’টা। পরে এক জন আমাকে বলেছিলেন, উনি অন্নদাশঙ্কর রায়। আমি এখনও জানি না, উনিই ছিলেন কি না। কিন্তু ওই একটা শব্দ আমার কাছে একটা বিরাট পাওয়া ছিল।

নান্দীকারের একটা ঘরে, নাটকে ব্যবহৃত এটা-ওটা পুরনো জিনিস পড়ে ছিল। তার মধ্যে একটা কোটও ছিল। এক বার, ‘ফুটবল’-এরই শো-তে, একটা রোল করার সময়, সেই কোটটা পরলাম। তখন আমার একুশ বছর বয়স, রোগা-পাতলা চেহারা। এক সিনিয়র দাদা বললেন, ‘এই কোটটা কে পরেছিলেন জানো তো? কেয়া চক্রবর্তী, ‘ভালোমানুষ’ নাটকে। শান্তা থেকে শান্তাপ্রসাদ হওয়ার সময়, মেয়ের পোশাকের ওপর এই কোটটা পরে নিতেন।’ কেয়া চক্রবর্তী! আমি ওঁর অভিনয় দেখিনি। শুনেছি, উনি কী বিরাট মাপের অভিনেতা ছিলেন। ‘ভালোমানুষ’-এর মতো একটা ঐতিহাসিক নাটক, তাতে অভিনয় করা কেয়া চক্রবর্তীর ওই কোটটা আমার কাছে এসে পড়েছে, আমার গায়ে চেপেছে। সে বার আমার পার্টটায় মোটে একটা সংলাপ ছিল, তাতে কী। ওই কোটটা পরে আমি সব ব্যথা ভুলে গেছিলাম। যাঁকে আমি শুধু ইতিহাসে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে আমি গায়ে গা লাগিয়েছি!

নান্দীকারে সেই ট্রেনিংয়ের কথা কিন্তু আমি বাবা বা মা, কাউকেই বলিনি। ট্রেনিং শেষে ‘ফুটবল’ নাটকটার দুটো করে পাস আমাদের দেওয়া হল, বাড়ির লোকের জন্য। বাবাকে গিয়ে দিলাম পাস, বললাম, কাল সময় পেলে যেয়ো। বাবা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এ-সব কবে করলি?’ দেখতে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে, যত দিন বেঁচে ছিলেন, আমার সব থিয়েটারের প্রথম শো দেখেছেন। মা’কে নিয়ে যেতে পারিনি বেশি। এক তো মা সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, সময় পেতেন না। তা ছাড়া ওঁর একটা সমস্যা হত— ছেলে স্টেজের ওপর কষ্ট পাচ্ছে, সহ্য করতে পারতেন না। কেউ আমাকে ঠকাচ্ছে, বা আমিই হয়তো কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি— মা আমার চরিত্রগুলোকে ‘আমি’ বলেই ধরতেন। যেতেন না। কত বার বলেছি মা, এই ‘উইংকল টুইংকল’ নাটকটা এত ভাল, এত মানুষ দেখেছেন, তুমিও চলো। মা বলতেন, ‘না, শুনেছি তুই ওই নাটকে খুব কষ্ট পাস, আমি যাব না।’

এর পর একটা নাটক করলাম, ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’। সেখানে এক দেবতার পার্ট করতাম। শো-এর পর, কয়েক জন দর্শক এসেছেন দেখা করতে, তাঁদের মধ্যে একটি মেয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনার ওই জায়গাটা না খুব ভাল হয়। ওই যে মইয়ের মতো একটা জায়গার ওপর থেকে আপনার ওই সংলাপটা, ‘বোঝার ভার বোঝা বইবার শক্তি বাড়ায়।’ নাটকে একটি মেয়ের ওপর অনেক দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, আর দেবতারা ওপর থেকে দেখে বলছেন তুমি দায়িত্বগুলো পালন করো। মেয়েটি বলছে, আমি এত কী করে পারব? তখনই ওই সংলাপটা ছিল, দেবতারূপী আমি বলতাম, চেষ্টা করো না, বোঝার ভার বোঝা বইবার শক্তি বাড়ায়। মেয়েটি বলল, ‘এই সংলাপটা আপনি এত মজা করে, অথচ এমন দারুণ ভাবে বলেন!’ আমি ভাবলাম, মেয়েটি কি শুধু এই কথাটাই বলছে? সেই মেয়েটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল। পরে প্রেমও হল। আজ সে-ই আমার গৃহিণী। তখন আমি অখ্যাত এক অভিনেতা, ২৫-২৬ টাকা রোজগার করি, আমার কিচ্ছু নেই। ওই নাটকটা আর ওই সংলাপটা দেখে-শুনে প্রেমে পড়ার আদৌ কথা না, কিন্তু আমার মনে হল, মেয়েটি বোধহয় বোঝা নিতে চায়। মানে আমাকেই নিতে চায় আর কী। এই সংলাপটা আমার জীবনে একটা আন্ডারলাইন করা সংলাপ।

খুব ভাল একটা নাটক হল এর পর, ‘গোত্রহীন’। আর্থার মিলার-এর বিখ্যাত নাটক ‘আ ভিউ ফ্রম দ্য ব্রিজ’ থেকে করা। আমার চরিত্রটা সেখানে একটু মেয়েলি টাইপের। সে সাজতে ভালবাসে, কথা বলে একটু অন্য রকম করে। মনে আছে, যখনই মঞ্চে ঢুকতাম, দর্শক একেবারে ফেটে পড়ত। খুব জমেছিল নাটকটা, ২০/২২ বছর চলেছিল। এক দিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। নাটকের পর এক ভদ্রলোক, আমার থেকে একটু বড়, এসে খুব প্রশংসা করলেন। তার পর বললেন, আমি কি তাঁর বন্ধু হতে পারি? পরে বুঝেছিলাম, উনি আমার অভিনয় দেখে, আমাকে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম করে ভেবে, আমার কাছে সমকামী বন্ধুতা চাইছেন। আমি তো ওঁকে বলতে পারছি না আমি এক জন বিবাহিত পুরুষ, আর ওটা স্টেজ, অভিনয়! কিন্তু ওঁর প্রশংসা, আকাঙ্ক্ষাটাও নির্ভেজাল ছিল, বুঝতে পেরেছিলাম।

ওই নাটকের সূত্রেই প্রথম বিদেশ যাওয়া। ’৯৮-তে, নিউ ইয়র্কে একটা থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে। আমেরিকা যাব, কোনও দিন ভাবিইনি। গেলাম, অভিনয় হল পর পর কয়েকটা সন্ধেয়। ‘অফ ব্রডওয়ে’-তে, যেখানে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হয়। হাউসফুল, ওখানকার সব বাঙালিরা ঝেঁপে এসেছেন নাটক দেখতে। নাটক শেষে এক সাহেব দেখা করতে এলেন, জানলাম, পাশেই ব্রডওয়ে-তে ‘আ ভিউ ফ্রম দ্য ব্রিজ’-এরই অভিনয় হচ্ছে। সে নাটকের প্রোডিউসার ও অভিনেতা আমাদের নাটকের কথা জানতে পেরে দেখতে এসেছেন। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দারুণ করেছ তোমরা! আমাদের নাটকে ওই জায়গাগুলোয় কিন্তু দর্শক এত ভাল রিঅ্যাক্ট করে না। আমার তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। খুব ইচ্ছে হল, আহা, ওদের নাটকটা যদি দেখতে পেতাম! ব্রডওয়েতে টিকিট খুব দামি, তবু ব্যবস্থা হল। পর দিন দেখতে গেলাম। বুঝলাম, আমাদের নাটকটা ওই সাহেব-অভিনেতাদের চেয়ে অনেক ভাল। এটা স্পর্ধা মনে হলেও সত্যি।

‘উইংকল টুইংকল’ করে এক দিন বেরিয়েছি, একটি ছেলে, আমারই বয়সি, এসে হাত চেপে ধরল। কিছু বলল না, হাতটা ধরে থাকল শুধু। বললাম, কিছু বলবেন? সে বলল, না কিছু বলব না, আপনার হাতটা একটু ছুঁয়ে থাকব। চোখভর্তি জল। পরের শো-র পর, আবার এল। একই রকম, হাত ধরে আছে। পরের দিন, শো থেকে বেরিয়ে, আমিই ওকে খুঁজছিলাম। যেখানে রোজ থাকে, দেখি, নেই। গেট দিয়ে বেরোচ্ছি, এসে হাতটা ধরল। বলল, আজ ওখানটায় খুব ভিড়, তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আবার বললাম, কিছু বলতে চান আমাকে? বলল, না কিছু বলার নেই। আসলে আমার বাবা ওই নাটকে যে সময়টা দেখায়, তখন হারিয়ে গেছিলেন তো, আপনাকে দেখে আমার বাবা বলে মনে হয়।

‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এর শো করে গ্রিনরুমে পোশাক পালটাচ্ছি। পাঞ্জাবি ছেড়েছি, গেঞ্জি, ধুতিটাও। এ বার শুধু নিজের প্যান্টটি পরব। হঠাৎ দরজা ঠেলে এক ভদ্রমহিলা ঢুকে পড়লেন। আমার তো দিশেহারা অবস্থা! কোনও মতে ধুতিটা তুলে আলুথালু অবস্থায় পেটের কাছটায় চেপে ধরেছি। উনি বললেন, ‘আজকে আপনার ভেতরটা অবধি দেখতে পেলাম!’ আমি ভাবছি, উনি কি এই মুহূর্তের কথা বলছেন, নাকি নাটকের কথা! প্রায় বলে ফেলি আর কী, ‘এতটা ভেতর অবধি দেখতে নেই!’

‘ফুড়ুৎ’ নাটকে আমি যে রকম সাজগোজ করি, নাক লাগাই, দাঁত লাগাই, যে রকম পোশাক পরি, যে ভাবে কথা বলি, তাতে আমাকে ‘আমি’ বলে প্রায় চেনাই যায় না। ক’দিন আগেই এই নাটকের একটা শো হল কলকাতার এক অভিজাত ক্লাবে। হাফ টাইমে শুনতে পেলাম, উদ্যোক্তাদের কলরব। ‘আরে সবই ঠিক আছে, ভাল নাটক বুঝতে পারছি, কিন্তু উনি কোথায়? উনি করছেন না কেন আজকে? ওঁর জন্যই এত টাকাপয়সা দিয়ে আনা হল!’ কেউ এক জন বলল, না না উনি আছেন তো, করছেন তো। ওঁদের কিছুতেই বিশ্বাস যাচ্ছে না, অমুক চরিত্রটাই আমি, জলজ্যান্ত আমিই অভিনয় করছি!

ব্রাত্য যখন আমাকে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এ অভিনয়ের জন্য বলে, আঁতকে উঠেছিলাম। গান গাইতে পারি না, গায়কের পার্ট করব, হয় নাকি! তা-ও আবার দেবব্রত বিশ্বাস! সারা দিন শো করে এসে, রাতে ঘরে হারমোনিয়াম শিখতে বসতাম। প্রচণ্ড ক্লান্ত, তার মধ্যে ভাবছি, এটা কি আমায় করতেই হবে? খোলা জানলার ও-পারে এক ভদ্রমহিলাকে দেখতাম, সারা দিন সংসারের সব কাজের পরেও, সেলাই মেশিন চালাচ্ছেন। আমার সামনে হারমোনিয়াম, ওঁর সামনে সেলাই মেশিন। উনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। আমি যখন ভাবছি আমার সামনের এই যন্ত্রটা আমি বাজাতে পারব না, উনি তখন সেলাই মেশিনটা চালিয়েই যাচ্ছেন। ক্লান্ত, কিন্তু করছেন। ওই রাত বারোটা-সাড়ে বারোটাতেও। ওঁকে দেখেই আমি যতটুকু পারলাম, শিখলাম হারমোনিয়াম। অভিনয় করলাম দেবব্রত বিশ্বাসের রোলে।

এক দিন সকাল-দুপুর-সন্ধেয় তিনটে নাটক। সকাল দশটার নাটকে আমি হিন্দু। বিবেকানন্দের চরিত্র, ‘বিলে’ নাটকে। দুপুরে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’, আমি ব্রাহ্ম, দেবব্রত বিশ্বাস। সন্ধের নাটক ‘শুঁয়োপোকা’-য় আমি খ্রিস্টান, নাম জোসেফ। এক দিনে তিন বার ধর্মান্তরিত হলাম!

‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর শো শুরুর ঠিক ১০-১৫ মিনিট আগে নির্দেশক ব্রাত্য দেখছে, দুটো ছেলে সাজঘরের দিকে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানল, ওরা দেখতে চায়, এই যে একটু পরেই উনি দেবব্রত বিশ্বাস হবেন, তার ঠিক আগের মুহূর্তটায়, কী ভাবে নিজেকে তৈরি করেন? ব্রাত্য দেখল, মুশকিল। গম্ভীর হয়ে ওদের বলল, ‘যাবেন না। এখন তো উনি উত্থিতপদ্মাসন করছেন।’ ওরা ফিরে গেল। কিন্তু ওটাই বিশ্বাস করে, পরে বন্ধুমহলে, বাকি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিল, আমি শোয়ের আগে উত্থিতপদ্মাসন করি!

যে দিন বাবা মারা গেলেন, আমার শো ছিল। বাবাকে দাহ করে, শ্মশান থেকেই স্টেজে গেলাম। নান্দীকারেরই নাটক, রুদ্রপ্রসাদবাবু বললেন, ‘শো-টা বাদ দিয়ে দেব?’ আমি বললাম, না, বাবা নিজেও তো অভিনেতা ছিলেন, আমি দেখেছি আমার ঠাকুরদা যে দিন মারা যান, বাবার বাইরে পালা ছিল। তা সেরে তবেই এসে দাহ করেছিলেন। সেই নাটকে আমার পার্টটাও ছিল এক বাবার। করতে করতে এক সময় হঠাৎ একটু কান্না পেয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই যে এত কিছু করব, এত সব হবে, কিন্তু আজ ফিরে বাবাকে আর দেখতে পাব না। সম্প্রতি আমার মা’র ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হল। মা অসুস্থ, আমি তখন শো করছি বালুরঘাটে। ওখান থেকেই শুনলাম, মা ভেন্টিলেশনে। ভোরবেলা ফিরলাম। নার্সিং হোম থেকে ফোন এল, খুব খারাপ অবস্থা। গেলাম, দেখি, দমটা পড়ছে তখনও, কিন্তু মেশিনে গ্রাফগুলো সব সোজা। মা চলে গেল। নার্সিং হোম থেকে ছাড়তে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে, মা’কে আনা হবে বাড়িতে। আমি মা’কে বলে এলাম, তুমি কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করো, আমি অভিনয়টা করে আসি। ‘ফেরা’ নাটকের শো ছিল বারাসতে। তার পরই দাহ করব। নাটক করে এসে হল সব। পর দিনও শো ছিল, করেছি, এ-দিককার কাজও করেছি। অভিনেতাদের উৎসব, আনন্দ, উদ্‌যাপন, দুর্ঘটনা, সব কিছুতেই থিয়েটার এমন গুঁজে গুঁজে থাকে। তাকে ছাড়া যায় না।

আমাদের যে সাজঘর, সেখানে যে আয়না আর আলো, আমাদের জীবনে সেগুলো বন্ধুর মতো। এই আয়না আর আলোয় প্রতি দিন নিজেকে এক বার না দেখলে মনে হয় যেন কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল না। দু’তিন দিন কোনও অভিনয় না থাকলে, নিজেকে অন্য কোনও আয়নায় দেখলে, ভালই লাগে, তবু মনে হয়, একটা চেনা লোককে দেখতে পাচ্ছি না। ক’দিন আগে লম্বা ছুটিতে বাইরে ছিলাম। সবই করছি, ঘুরছি-ফিরছি, কিন্তু এ-ও বুঝতে পারছিলাম, যে আয়নায় আমি নিজেকে দেখছি, যে আলো মাখছি, এগুলো আমার প্রাপ্য। কিন্তু আর একটা কী অপ্রাপ্তি সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ফিরে এসে যে দিন আবার চেনা আয়নায় নিজের মুখটা দেখলাম, মনে হল, এই আয়নাটাকে আমি চিনি। একে ছাড়া আমার চলবে না।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy