Advertisement
E-Paper

শ্রীযুক্তা টিকটিকি অন্তঃসত্ত্বা

চল্লিশের দশকে তরুণ কবির লেখা। পোস্টকার্ডে কবিতা লিখে পাঠান বন্ধুদের। নিঝুম ট্রামলাইনে বসে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করেন। অশোক মিত্র পরে স্বেচ্ছায় কবিতা থেকে মিছিলে!চল্লিশের দশকে তরুণ কবির লেখা। পোস্টকার্ডে কবিতা লিখে পাঠান বন্ধুদের। নিঝুম ট্রামলাইনে বসে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করেন। অশোক মিত্র পরে স্বেচ্ছায় কবিতা থেকে মিছিলে!

শুভাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ২১:০৪

এ-ছ’বছরে দেখা যাচ্ছে তাহলে আর বদলাইনি। সময়-কাটানোর মহদুদ্দেশ্যে সে-সময় টিকটিকিগিন্নিকে পাহারা দিতুম, নন্দ নিবাসের এই একতলার ঘরেও আপাতত সারাদিন পড়ে পড়ে তা-ই করি।” একটি চিঠিতে লিখছেন অশোক মিত্র। সুদূর ‘লঙ্কা’ থেকে! বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ওই ‘লঙ্কা’ এলাকাতেই। এখনও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিস লঙ্কায়, গোধূলিয়া মোড় থেকে দিবারাত্র অটো যাতায়াত করে। নন্দ নিবাসের ৪ নং ঘরের বাসিন্দা অশোকবাবু তখন তরুণ, বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। চিঠিটা লিখেছিলেন কবি-বন্ধু নরেশ গুহকে। নরেশবাবুর এক প্রশ্নের উত্তরে অশোকবাবু পরের চিঠিতে খোলসা করেন, “নন্দ নিবাস আর কিছুই নয়, বড়ো বড়ো হোস্টেল পূর্ণ হয়ে যাবার পর তবু–আসতে–থাকা ছেলেদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে কতগুলো হোস্টেলের মতো খোলা হয়, তাদেরই একটি।”

দুটো চিঠিই ১৯৪৯–এর জানুয়ারিতে লেখা। প্রথমটা চার তারি‌খে, দ্বিতীয়টা চোদ্দোয়। এত ঘন ঘন? জেনে রাখা ভাল, জানুয়ারির পয়লা থেকে একটানা দু’মাস তাঁরা পরস্পরকে চিঠি লিখেছেন। এক-আধটা পোস্টকার্ডে হতে পারে, দু-এক দিন বাদ যায়নি এমনও নয়, তবে অধিকাংশ চিঠিই দীর্ঘ এবং দুই যুবার ব্যক্তিগত আন্তরিক কথনে ভরপুর।

‘টিকটিকিগিন্নিকে পাহারা’ দেওয়ার প্রসঙ্গটিতে অশোক মিত্রের বালক বয়সের একটি কবিতা লেখার ঘটনা জড়িয়ে আছে। বাধ্য হয়ে কাশীবাস, ইংরেজি–নিতে–নিত অর্থনীতি নিয়ে ফেলা অশোক মিত্রের আর ভাল লাগছিল না। ঘরটাতে হাওয়া-বাতাসের প্রবেশ নিষেধ—‘‘বারাণসীর পুণ্যতীর্থে প্রাত্যহিক স্বতোধারায় বয়ে যায় না, কোদাল-কুড়ুল দিয়ে খাল কেটে তাকে বওয়াতে হয়।’’ এমন ভাবে জীবন কাটছে তাঁর। বালক বয়সে লেখা একটি গদ্য-কবিতা মনে পড়ছে, কবিতা-লেখককে প্রত্যহ বিকেলে কেন বাসায় পাওয়া যেত তখন, তারই এক অপরূপ বিবৃতি: ‘‘আমার ঘরের দেয়ালে/ শ্রীযুক্তা টিকটিকি অন্তঃসত্ত্বা।/ মাতৃত্বের টলোমলো গৌরবের উপর/ যাতে নারীধর্ষণের সকলঙ্ক ইতিহাস/ সাংবাদিক প্রোজ্জ্বল অক্ষরে লিখিত না-হয়/ সেজন্যে পাহারায় আছি।’’

নরেশ গুহর স্বলিখিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে, অশোক মিত্রের লেখা অজস্র চিঠির মধ্যে ৬৭টি চিঠি তিনি রক্ষা করতে পেরেছিলেন অথবা প্রকাশযোগ্য মনে করেছিলেন। প্রায় সব ক’টি চিঠিই প্রকাশের ইচ্ছেয় স্বহস্তে পুনর্লিখন করেছিলেন, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। কোনওটার টীকাও করেছিলেন। সব ক’টি চিঠি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, একটি পত্রিকায় কিছু চিঠি প্রকাশের দিন পর্যন্ত সে-সব চিঠি নাড়াচাড়া করার সুযোগ হাতছাড়া করিনি।

অনেক চিঠিতেই অশোক মিত্র কবিতা যুক্ত করে দিতেন। কখনও আবার শুধুই কবিতা পাঠাতেন। ১৯৪৯-এর ২৬ অগস্ট বা ১৯ অক্টোবরে চিঠি নেই, শুধুই কবিতা। দ্বিতীয়টির কয়েক পঙ্‌ক্তি: “আর সকলের মতো,/ এটা আমিও ভালো করেই জানি/ সে-মেয়ের জীবন আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হবে না।/… যে-মেয়েকে ভালোবাসলুম/ অথচ যে-মেয়ের ভালোবাসা পেলুম না,/…তবু সে-মেয়েকেই,/ সে-করুণ-মুহূর্তকেই ভালোবাসা।/ জানি এর পর মৃত্যু।” কবিতাটা সম্পর্কে নরেশ গুহর মন্তব্য: “কবি হিসেবে অশোক কেন আমার প্রিয়, বোধ করি, এই কবিতাটা তার প্রমাণ।”

মেয়েটি কে? দুই বন্ধুই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। নরেশ গুহর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। মৃদু হেসে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল অন্য কোনও চিঠিতে লুকিয়ে আছে কাঙ্খিত নামটি। তবে কি ২ জানুয়ারি লেখা চিঠিটাই উত্তর? “ঢাকাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরে আমার এক সহপাঠিনী জুটলেন, অসম্ভব ক্ষীণাঙ্গিণী, অসম্ভব পড়ুয়া।…জীবন যখন শুকায়ে যায় তিনি বুঝি করুণাধারায়ই এসে থাকেন! এখন বলুন তো আমি কী করি? কী করি! কী করি! তবে কি গলায় দড়ি?” এগারো দিন পরে লেখা আর একটা চিঠির সঙ্গে যুক্ত ‘ঋণশোধ’ নামের কবিতা: “মূর্খ! মূর্খ!/ আত্মার আত্মীয়তাই প্রেম।/ কোনো পুরুষ আত্মার সমকক্ষতায় ভেসে বেড়াতে পারে/ এমন মেয়ে কোথায়?”

এই ভিন্ন সুর আরও স্পষ্ট হয় আর একটি চিঠিতে: “প্রেমের চেয়ে অনেক ভালো প্রেমের কবিতা। আসলে ‘সক্রিয়ভাবে’ প্রেমে পড়লে প্রেমের কবিতা অন্তত লেখা অসম্ভব। হৃদয়ের সমস্ত তন্নিষ্ঠা তখন তো প্রেমকে জড়িয়ে আবেশঅবশ, কবিতা লেখার সময় কোথায়, সচেতনতা কোথায়?” ১৯৫১-র ১৪ নভেম্বরের চিঠিটি অত্যন্ত রহস্যময়। সেখানে এক, দুই, তিন করে পাঁচ জন মেয়ের কথা আছে। যেন একটা উত্তরপত্র, যেন যাঁদের নিয়ে আপনি ‘সন্দেহ’ করছেন তাঁরা পাঁচ জন হলেন এমন: “আর বেশিদিন কুমারী ভূষিতা থাকবেন না তিনি। আজ কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন, আগামী ২১ নভেম্বর আপনাদের পাড়ার হরিসাধন দাশগুপ্তকে তিনি হিন্দুমতে বরণ করছেন।” কিংবা “কুমারী কাঞ্চনলতা সাবরওয়ালকে কোনো দিন চোখেই দেখিনি।” এই সমস্ত রহস্যের যবনিকা পড়ে গেল ব্যাঙ্কক থেকে পাঠানো ২৮ এপ্রিল ১৯৫৬ তারিখের চিঠিতে। বৈশাখ মাসে নরেশ গুহর বিবাহ জেনে অভিনন্দন জানিয়ে অশোক লিখলেন: “আমিও বিবাহ করছি। সব কিছু শেষ হয়ে গেছে বলেই; স্মৃতিকে, রক্তকে অন্ধকার আগুনে ডুবিয়ে পুড়িয়ে মারতে চাই বলে। অসম্ভব দুরাশা। তবু, সব আশা শেষ হয়ে গেছে বলে।” চিঠিগুলি আজও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস’-এ ডিজিটালি সংরক্ষিত।

এই চিঠিতেই নিরুপম চট্টোপাধ্যায়কে বন্ধুদের ‘বিবাহ অভিযানের’ পথিকৃৎ হিসেবে ‘অভিহিত’ করেছেন অশোক। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ‘চার ইয়ার’ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও অন্তরের যোগ অটুট ছিল। ‘চার ইয়ার’ মানে অশোক মিত্র, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ ও নিরুপম চট্ট্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর চতুর্ভুজ। রাত বাড়ে, ‘কবিতাভবন’-এর আড্ডা ততই গভীর হয়। গভীর রাতে ২০২ নম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁরা ঠিক করেন, রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ট্রাম লাইনের সবুজ ঘাসে বসে চাঁদের আলোয় কবিতা পড়বেন। বসেও পড়েন। অশোক হয়তো আধশোয়া। মুখস্থ বলে যাচ্ছেন ‘ঝরা পালক’-এর কোনও কবিতা। আর একটু হেঁটে গেলেই জীবনানন্দের বাসা। যাবেন সেখানে? না, আজ থাক। ভোর হয়ে এসেছে। দেশপ্রিয় পার্কের পাখিগুলো ডেকে উঠছে। চার জন হেঁটে চলে এলেন সত্যেন দত্ত রোডের ৫ নম্বর বাড়িতে, নরেশ গুহর ভাড়া বাড়িতে। বাইরের ঘরে শুয়ে পড়লেন এলোমেলো।

তবু অশোক ও অরুণকুমারের মধ্যে কিসের দেওয়াল? দুজনেই দুজনকে যেচে চিঠি লিখবেন না। অশোক অকপটে জানান নরেশকে: “অরুণবাবুও আমাকে চিঠি লেখেন না, আমিও লিখি না। কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে, তবু কী যেন হয়েছে। কোনো-এক দেয়াল, যেটাকে ভেঙে ফেলা যায় না, কারণ সেটার শরীর নেই। অথচ সে-দেয়াল ছায়াশরীরী; ছায়ার বিরুদ্ধে তলোয়ার চালিয়ে লাভ নেই, পরাজয় আমার পক্ষে সুনিশ্চিত, অরুণবাবু চেষ্টা করলে তাঁর পক্ষেও।” ভাবীকাল এই দেওয়ালে আজও সুড়ঙ্গ কাটতে পারেনি, সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অরুণকুমারের কবিতায়: ‘তুমি ডান দিকে যাচ্ছ বুঝি/ তুমি বামে? যাও, ফের দেখা হবে।’

“অশোক মিত্রের অকারণ অবিচল বন্ধুতা আমার জীবনের পরম সম্পদ।… বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পরেও অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র মহাশয়ের অনেক রচনায় আমার মতো অর্বাচীন অমার্ক্সিস্টের প্রতি তাঁর সদ্ভাবের উল্লেখ থাকায় মহাকরণের অনেকেই অবাক হতেন এবং বিরক্তি বোধ করতেন।”— লিখেছেন নরেশ গুহ। তাঁদের বন্ধুত্ব অবিচল ছিল। প্রথম পরিচয়ের দু’বছরের মধ্যেই অশোক জানিয়ে দিয়েছেন, “আপনাকে আমি যে চিঠি উৎসর্গ করে থাকি তা এ-পৃথিবীতে আর কাউকেই করা যেত না।” নরেশের কাছেই তিনি যেন উন্মুক্ত করতে পারতেন নিজেকে।
“চিঠি লিখছি আর্মানিটোলা স্কুলকে, আমার শৈশবকে, যে অপরিমিত শান্তি সে-শৈশব পৃথিবীতে ছিল তাকে।… চিঠি লিখছি সেই ক্লাসরুমগুলোকে, বেঞ্চিগুলোকে, বর্ষাদিনে স্কুলের মাঠে জল-জমে-যাওয়াজনিত হদয়ের সেই আনন্দউচ্ছ্বাসকে। চিঠি লিখছি সারল্যকে, পবিত্রতাকে আর নিষ্পাপতাকে।”

Ashok Mitra Finance Minister Communist Chief economic advisor অশোক মিত্র
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy