Advertisement
E-Paper

ঠাকুরের মুকুট সিলিং ছুঁত

সব ভাইবোন মিলে খুব মজা করতাম। পয়লা বৈশাখ বাড়িতে কীর্তন গাইতে আসতেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। ’৪৬-এর দাঙ্গায় গুরুদ্বারের লঙ্গরখানায় খেয়েছি, অভিনয় করে পেয়েছি নকুড়ের সন্দেশ। পুতুল খেলার সময় ছিল না। আজ জন্মদিনে মনে পড়ছে সেই সব।সব ভাইবোন মিলে খুব মজা করতাম। পয়লা বৈশাখ বাড়িতে কীর্তন গাইতে আসতেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। ’৪৬-এর দাঙ্গায় গুরুদ্বারের লঙ্গরখানায় খেয়েছি, অভিনয় করে পেয়েছি নকুড়ের সন্দেশ। পুতুল খেলার সময় ছিল না। আজ জন্মদিনে মনে পড়ছে সেই সব।

মাধবী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছোটবেলা! শব্দটার সঙ্গে জুড়ে আছে কত স্মৃতি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সাদার্ন অ্যাভিনিউতে দাদামশাই শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটা। দাদু ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু কোনও দিন প্র্যাকটিস করেননি। উনি ভালবাসতেন ছবি আঁকতে। ছবি বিক্রিও করতেন। শিল্পী শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিকারের ছবি আজও বিখ্যাত। ছবি বিক্রির পাশাপাশি দাদুর ছিল ডল ডামির ব্যবসা। কাপড়ের দোকানে যেমন পুতুলকে পোশাক পরিয়ে রাখে সেই ডামি পুতুল। সম্ভবত দাদুই ভারতে প্রথম যিনি এই ডামি পুতুলের ব্যবসা শুরু করেন। বড় পুতুল যেমন ছিল, তেমনই ছোটদের জামাকাপড়ের জন্য ছোট পুতুলও তৈরি করতেন। নানান ধরনের পুতুল ছিল বাড়িতে, সে জন্যেই হয়তো লোকমুখে বাড়িটার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পুতুলবাড়ি’। ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তাঁর বই ‘বাঙালনামা’য় বহু বার দাদুর উল্লেখ করেছেন। দাদুকে উনি ডাকতেন ‘শীতলজ্যাঠা’।

এই ‘পুতুলবাড়ি’-তেই আমার জন্ম। ছোটমাসি আমার নাম রেখেছিলেন ‘টুকটুক’। মা আমাকে প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে রাখতেন দেখে দাদু বলতেন, ‘‘এ টুকটুক কোথায়, এ তো টুকানবাবু।’’ দাদুর দৌলতে অনেক ধরনের পুতুল দেখেছি ওই বাড়িতে। উপহারও পেয়েছি অনেক আমরা দুই বোন। দিদি পুতুল পেলেই সেটা ভেঙে ফেলত, সে যতই শক্তপোক্ত হোক না কেন!

লক্ষ্মী পুজো, সরস্বতী পুজো আর পয়লা বৈশাখে এই বাড়ি লোকজনে গমগম করত। ওই দিনগুলোতে আমরা সব মামাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে খুব মজা করতাম। খুব ঘটা করে লক্ষ্মী পুজো হত। তার চেয়েও বড় করে হত সরস্বতী পুজো। দারুণ সাজানো হত। দাদু নিজে তৈরি করতেন বিরাট প্রতিমা। সিলিং ছুঁয়ে যেত ঠাকুরের মুকুট। মাসতুতো ভাই-বোনেরা সবাই একসঙ্গে অঞ্জলি দিতাম, পাত পেড়ে বসে ভোগ খেতাম। পয়লা বৈশাখে কীর্তন হত দাদুর বাড়িতে। কীর্তন গাইতে আসতেন ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নামী শিল্পীরা। আমার দাদুও কীর্তন গাইতেন। ব্যবস্থা থাকত এলাহি খাওয়াদাওয়ার। নতুন জামা পরতাম। গুরুজনদের প্রণাম করলেই টাকা পাওয়া যেত। মানে যাকে ‘পার্বণী’ বলে। দাদু আমাদের এক টাকা করে দিতেন। এক বার পয়লা বৈশাখে আমরা দুই বোন দাদুকে প্রণাম করতে, দাদু আমার হাতে দু’টাকার নোট দিয়ে বললেন, ‘‘তোরা ভাগ করে নিস।’’ আমি সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা দু’টুকরো করে দিদিকে এক টুকরো দিয়ে বললাম, ‘‘নে তোর ভাগটা!’’

মা’র কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় আমি মোটেও শান্ত ছিলাম না। একটা সময় আমরা বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম ঢাকুরিয়াতে। দুষ্টুমি করে বকুনি খেলে, রাগ করে একটা ব্যাগ নিয়ে মাকে বলতাম, ‘‘দাদুর বাড়ি চললাম।’’ চোখ বন্ধ করলে আজও সিনেমার দৃশ্যের মতো দেখতে পাই সেই সব দিনগুলো।

ছোট থেকেই আমার লড়াইয়ের জীবন। সেই জীবনে অক্সিজেনের মতো কাজ করত এই ছোট ছোট আনন্দগুলো। দেশভাগের মতো, আমার ছোট বয়সেই মা-বাবার সম্পর্কটাও ভেঙে গিয়েছিল। ওঁদের কোনও দিন আইনি বিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু দু’জনেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন। বাবার সঙ্গে মায়ের সংঘাতটা ছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী। মনের দিক থেকে ছিলেন বেশ রক্ষণশীল। আর আমাদের আধুনিকমনস্ক মা যুগের তুলনায় ছিলেন এগিয়ে। মনে পড়ে না, কোনও দিন আমাদের দুই বোনকে মা নিজে হাতে চুল বেঁধে দিয়েছেন বা জামা পরিয়ে দিয়েছেন। বলতেন, ‘‘সব নিজে করো, না হলে সাবলম্বী হবে না।’’ তাই হয়তো অনেক ছোট থেকেই নিজের জামাকাপড় কেচে ইস্তিরি করতে শিখে গিয়েছিলাম। আজ জন্মদিনে মা’কে খুব মনে পড়ছে। তখনকার দিনে কন্যাসন্তানের জন্মদিন পালনের সে রকম রীতি ছিল না। কিন্তু মা এ ব্যাপারে ছিলেন মুক্তমনা। আমার জন্মদিন করতেন ঘটা করে। তৈরি করতেন পায়েস আর লেডিকেনি মিষ্টি। মনে আছে, গামলা-ভর্তি লেডিকেনি তৈরি হত বাড়িতে। যে আসত তাকেই মা ওই মিষ্টি খাওয়াতেন। এই কাজটি তিনি আমৃত্যু করেছেন। হয়তো নিজে ভাল নেই, তবু আমার জন্মদিনে মুখে পায়েস তুলে দিয়েছেন।

১৯৪৬। তখন আমার পাঁচ-ছ’বছর বয়স। চোখের সামনে দেখেছিলাম দাঙ্গার ক্ষতবিক্ষত চেহারা। এই সময় আমরা থাকতাম লোয়ার সার্কুলার রোডে। মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে বিপদে পড়লেন। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। সেই সময় শিখ সম্প্রদায়ের কয়েক জন মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের থাকার জায়গাও হয়েছিল গুরুদ্বারে। বিরাট লোহার কড়াইতে রান্না হত। লঙ্গরখানায় সকলের সঙ্গে আমরাও বসে পড়তাম খেতে। সেই দুর্দিনে খুব রাগ হত বাবার উপর। কেন তিনি আমাদের ছেড়ে গেলেন! আমার মন উত্তর খুঁজে পেত না। শুরু হল প্রবল আর্থিক সমস্যাও। অথচ আমাদের তো এই দুর্ভোগে পড়ার কথা ছিল না। আমার মাতামহের মতো পিতামহও ধনী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশে রোজ আমাদের বাড়িতে পঞ্চাশ-ষাট জনের পাত পড়ত!

এই সময়ে মায়ের হাত ধরেই আমার অভিনয়ে আসা। ছোট থেকেই লক্ষ করেছি, গান, অভিনয় এই সবের প্রতি মা’র ছিল দারুণ ঝোঁক। সিনেমায় নায়িকা হওয়ার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাবার অমত থাকায় সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বিচ্ছেদের পর ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবিতে তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ওই একটাই। সিনেমায় ইতি টেনে মা তার পর চলে আসেন মঞ্চে। শ্রীরঙ্গমে নিয়মিত নাটক করতেন। তখন বড়বাবু শিশিরকুমার ভাদুড়ী। দিদি স্কুলে যেত, আর আমি মায়ের সঙ্গে যেতাম থিয়েটারের মহড়াতে।

নাটকের মহড়া দেখতে দেখতে এক দিন মঞ্চে নামার সুযোগ এসে গেল আমার। তখন শ্রীরঙ্গমে হচ্ছিল ‘সীতা’। নাটকে আশ্রমবালিকা আত্রেয়ীর চরিত্রে যে মেয়েটি অভিনয় করছিল, সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিশিরবাবু মাকে বললেন, আমাকে দিয়ে আশ্রমবালিকার চরিত্রটা করাতে চান। করেছিলাম, এবং আশাহত করিনি ওঁকে।

শ্রীরঙ্গমে আমার হাতেখড়ি হলেও প্রভাদেবী আমাকে নিয়ে যান মির্নাভা থিয়েটারে। শ্রীরঙ্গমে না থাকলেও শিশিরবাবুর সঙ্গে অভিনয় করেছি। ওঁর সংলাপ বলা, গলার স্বরের ওঠানামা অবাক হয়ে দেখতাম। অভিনয় শিখেছি ওঁর কাছ থেকেই। আর এক জন মানুষ, যিনি এই সময় আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিলেন, তিনি হলেন ছবি বিশ্বাস। ওঁর সঙ্গে ‘ধাত্রী পান্না’ নাটকটা করতাম। এই নাটকে ওঁর চরিত্রটা ছিল নেগেটিভ। তাই বোধহয় আমি ছবি বিশ্বাসকে ভয় পেতাম। ব্যাপারটা উনি বুঝেছিলেন। আমার ভয় যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, তাই তিনি নাটকের শেষে একটা করে নকুড়ের সন্দেশ খাওয়াতেন আমাকে। খুব রসবোধ ছিল ছবিবাবুর। একই জিনিস পরবর্তীকালে দেখেছি উত্তমকুমারের মধ্যেও।

নাটক করতে গিয়ে সরযূবালা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয়। ‘মা’ বলে ডাকতাম ওঁকে। ‘স্নো হোয়াইট’ গল্প অবলম্বনে ‘তুষারকণা’ নাটকে আমি মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতাম। সরযূবালা দেবীও এই নাটকে অভিনয় করতেন। এক বার কাগজে লেখা হয়েছিল, আমি সরযূবালা দেবীকে ছাপিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছোট, কাগজ পড়তাম না। এক দিন সরযূবালা দেবী আমাকে ডেকে মিষ্টি খাইয়ে বলেছিলেন, ‘‘কাগজ দেখেছিস?’’ আমি যথারীতি ‘না’ বলি। পরে কাগজে কী লেখা হয়েছে জেনে আবার ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। মনে আছে, উনি বলেছিলেন, ‘‘তুই যদি বলিস আবার মিষ্টি খাওয়াতে হবে, তা হলে আবার খাওয়াব।’’

সেই সময় অভিনয়ের জন্য নাচগান জানাটা জরুরি ছিল। আমি নাচ শিখেছিলাম অতীন লালের কাছে, আর গান কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। ‘নরমেধ যজ্ঞ’ নাটকে আটটা গান ছিল। আটটাই গেয়েছিলাম। আমার গান শুনে খুশি হয়ে হিন্দি নাটকের প্রযোজক করমচাঁদ গ্রিনরুমে এসে পাঁচ টাকা দিতে গেলেন।

কিন্তু আমি বেঁকে বসলাম। কিছুতেই টাকা নেব না। তখন ‘নরমেধ যজ্ঞ’-এর পরিচালক রঞ্জিত রায় আমাকে বললেন, ‘‘লে মাঈ, (আমাকে ওই নামে ডাকতেন) নিতে হয়।’’ কিন্তু রাজি করাতে পারলেন না। তখন রঞ্জিতবাবুই টাকাটা নিয়ে আমাকে নকুড়ের মিষ্টি কিনে দিয়েছিলেন। এগুলোই ছিল তখন পুরস্কার। সম্পর্কগুলো এমনই ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল না। আন্তরিকতার বন্ধনে বেঁধে ছিলাম আমরা সকলে।

নাটক করতে করতেই সিনেমায় আসা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘দুই বেয়াই’ ছবিতে প্রথম শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করি। শুটিঙের প্রথম দিন হল এক মজার কাণ্ড! শটে আমার বিপরীতে একটা বাচ্চা ছেলে ছিল। শট শুরু হতেই ছেলেটি সংলাপ ভুলে গেল। ও ভুলে গিয়েছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি ওর সংলাপটা পাশ থেকে বলে দিলাম। যেমন নাটকে প্রম্পট করে আর কী। শট নেওয়া থামিয়ে প্রেমেনবাবু আমাকে ডেকে বললেন, সিনেমায় কেন প্রম্পট করা যায় না। ওই যে শিখেছিলাম, আর কোনও দিন ভুলিনি। এর পর প্রেমেনবাবুর ‘কাঁকনতলা লাইট’, ‘সেতু’ ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘দুই বেয়াই’-এর আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘কাঁকনতলা লাইট’। নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলাম এর অনেক পরে।

আমার অনেক পুতুল ছিল, কিন্তু খেলার সময় ছিল না। সারা দিন তো নাটক, নাটকের মহড়াতেই সময় চলে যেত। দুর্গাপুজোর আগের দিন গোটা রাত মহড়া হত। সকালে ঘুমে জড়িয়ে আসত চোখ। তখন আমরা বাগবাজার স্ট্রিটে থাকতাম। ভোরবেলা মহড়া শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে দেখতাম, কলাবৌকে স্নান করাতে নিয়ে যাচ্ছেন সবাই। আমি প্রথম দোল খেলি ৫০ বছর বয়সে। আসলে দোল খেলব কী করে, গায়ে-মুখে রং লেগে থাকলে তো মঞ্চে অভিনয় করা যাবে না। তাই আমার দোল খেলা ছিল একেবারেই মানা।

পাঁচ বছর বয়স থেকে অভিনয় করে মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলাম। তাই সেই ভাবে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করা হল না। স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু পড়াশোনায় ফাঁক পড়ে যেত। দিদিমণিরা বকুনি দিতেন। কয়েক জন অবশ্য আমাকে পছন্দও করতেন। অবস্থাটা বুঝতে পারতেন। স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল দিদির। পরবর্তী কালে ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিও করে। অবশ্য এ সব নিয়ে এখন আর আমি আফসোস করি না। জীবন আমাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক দিয়েছে!

অনুলিখন: ঊর্মি নাথ

Madhabi Mukherjee Actress Saraswati Puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy