Advertisement
E-Paper

কবির কাছের, তবু স্বীকৃতিহীন

শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন অজিতকুমার চক্রবর্তী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা অনুবাদের ভার দিয়েছিলেন তাঁকে। গতকাল ছিল তাঁর মৃত্যুর শতবার্ষিকী। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন অজিতকুমার চক্রবর্তী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা অনুবাদের ভার দিয়েছিলেন তাঁকে। গতকাল ছিল তাঁর মৃত্যুর শতবার্ষিকী।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০

তেতলার খোলা ছাদ রোদে ভরে গেছে তখন। তিনি শুয়ে আছেন— যেন ঘুমিয়ে আছেন— মুখখানা হাসিতে যেন উদ্ভাসিত। মা পায়ের কাছে নীরবে চোখ বুজে হাতজোড় করে বসে— চোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরে পড়ছে।

স্মৃতি ছুঁয়ে এ বর্ণনা অমিতা ঠাকুরের। পিতা অজিতকুমার চক্রবর্তীর মৃত্যু-মুহূর্তের সেই বর্ণনায় যুক্ত হয়ে যাবেন সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁরা গান ধরলেন, যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে...। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ চলে গেলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য অজিতকুমার, কলকাতার ৯৪/১ বি, গড়পার রোডের বাড়িতে। অসমাপ্ত রইল রামমোহনের জীবনী রচনার কাজ, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের অনুরোধে যা শুরু করেছিলেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা, তখন যা ‘যুদ্ধজ্বর’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল, তাতেই মৃত্যু হল তাঁর।

অজিতকুমারের মৃত্যুর তিন দিন পর, ১৯১৯-এর ১ জানুয়ারি জগদীশচন্দ্র বসুকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অজিতের অকাল-মৃত্যুতে সাহিত্যের ক্ষতি হবে। তার গুণ ছিল— সে সম্পূর্ণ নির্ভীকভাবে সকল পক্ষের বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করতে পারত। ঠিক বর্তমানে সে রকম আর কোনো বাংলা লেখক ত মনে পড়ছে না।’’ আর একটি চিঠিতে অমল হোমকে লিখছেন, ‘তার (অজিত) যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলি সে দিয়েছে আমাকে ঘিরে। ইদানীং সে একটু দূরে সরে গিয়েছিল, সেটা একদিক থেকে ভালই হয়েছিল তার স্বাতন্ত্র্যবিকাশে।’

তা-ই যদি হয়, তবে স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে অজিত কেন লিখবেন, ‘গুরুদেবের কাছে আদপে যাই না। কারণ তাঁর সঙ্গে বেশি মিশলে লোকের হিংসার উদ্রেক হয় এবং তা ছাড়া আমি মনেই ভেবেছি যে আমি তাঁর সঙ্গে কাজের সম্বন্ধ ছাড়া কোনো সম্বন্ধ বাহিরে রক্ষা করব না। ভিতরে যা কিছু আছে তা ভিতরেই থাক।’ লিখেছেন, ‘আসল কথা হচ্ছে গুরুদেবেরই মোটে আমার উপর স্নেহ নেই— স্নেহ সামান্য থাকলে শ্রদ্ধা ও আশা কিছুই নেই। সেই জন্যে আমাকে আঘাত করা যার তার পক্ষে সহজ। এণ্ডরুজ যে গুরুদেবকে বলতে সাহস পেল যে আমি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কোন কাজের নই— এটা গুরুদেব বরদাস্ত করলেন তো? তিনি যদি সামান্য প্রতিবাদটুকু করতেন তবেই এসব সমালোচনা কবে নিরস্ত হয়ে যেত।’ রবীন্দ্রনাথও কি ভুল বুঝেছিলেন?

যন্ত্রণা নিয়েই শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল অজিতকুমারকে। প্রশান্তকুমার পাল ‘রবিজীবনী’তে জানাচ্ছেন, আর্থিক ও অন্যান্য কারণে বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছিল। বিদ্যালয় ছেড়ে মহর্ষির জীবনী রচনার জন্য বৃত্তি নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। তখন ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে অজিতকুমার। কিন্তু আশ্রমের প্রতি টান আর গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট ছিল তাঁর। আশ্রমে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিও দেন তিনি। ১৯১৮-র ২৮ অক্টোবর লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি তার প্রমাণ। ‘শান্তিনিকেতনে তোমার আসা সম্বন্ধে এখনো কিছুই স্থির করিনি।... এখানে স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্যে একটা কোনও উপায় বোধ হয় শীঘ্র করা যেতে পারবে।’

তা আর করতে হয়নি। চলে গেলেন অজিতকুমার। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম পর্বে তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠা সকলেরই জানা। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে কথা একাধিক বার বলেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অনুবাদক, সঙ্কলক ও সম্পাদক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা স্বীকৃতি পেয়েছিল কবির। নিজের একাধিক রচনা অজিতের হাতেই অনুবাদের জন্য নিশ্চিন্তে তুলে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন এবং রবীন্দ্রনাথের কথা বিলেতবাসীর কাছে অজিতকুমার পৌঁছে দিয়েছিলেন ১৯১০-এই। বিলেতের পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন সম্পর্কে প্রথম সংবাদ (১ অক্টোবর, ১৯১০) প্রকাশের কৃতিত্বও তাঁর। রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী ‘অজিতকুমার’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ও দেশে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের অনুবাদ করে বিদগ্ধ মানুষকে শুনিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ ঘটিয়েছেন। সেই অজিতকুমারকে যখন শান্তিনিকেতন ছাড়তে হল, তখন তাঁর যন্ত্রণা অনুমেয়। ম্যানচেস্টার কলেজে পড়াশোনার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১০-এর ৩ সেপ্টেম্বর বিলেত যাত্রা করেন অজিতকুমার।

১৮৮৬-র ১৯ অগস্ট তাঁর জন্ম। শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছিলেন ১৯০৪-এর গ্রীষ্মাবকাশের পর। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সদ্য বিএ পাশ করেছেন তখন। বিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি, বাংলা ও ভূগোলের শিক্ষক। পাশাপাশি নাট্যাভিনয়, পত্রিকা সম্পাদনা, লেখালিখি। সঙ্গীতশিক্ষকের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। রবীন্দ্র-সহযোগী হয়েছেন নানা গ্রন্থ প্রকাশের কাজেও। এরই ফাঁকে বিলেত যাত্রা। চার মাস আগে বিয়ে করেছেন আশ্রমকন্যা লাবণ্যলেখাকে। বিলেতে গিয়ে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাস চারেকের মাথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশে ফিরে আসতে হয়। এসে শুরু করেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ বইটির কাজ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বইটিকে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রথম প্রবেশক বলে উল্লেখ করেছেন। ‘আত্মপরিচয়’ আর ‘জীবনস্মৃতি’র মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বইটি, লেখা হচ্ছে ‘জীবনস্মৃতি’র সমসময়ে। ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয় ১৩১৮ সালের আষাঢ়-শ্রাবণে। বই হয়ে বেরোয় পরের বছর পৌষে। ভাদ্র ১৩১৮ থেকে ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত হয় ‘জীবনস্মৃতি’।

‘আত্মপরিচয়’ থেকে ‘জীবনস্মৃতি’র বয়ানে যে বদল, তাতে কি অজিতকুমারের ‘রবীন্দ্রনাথ’ রচনার ভূমিকা আছে? শিশিরকুমার দাশ লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘কবিজীবনী’ থেকে জীবনের সমস্ত ‘বৃত্তান্ত’ বাদ দিতে চেয়েছিলেন। অজিতকুমার জীবনী-রচনায় ইতিহাসের আদর্শকে অস্বীকার করলেন না, বরং জীবনচরিত ও কাব্য উভয়কেই মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। কবির অন্তর্জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টা, কাব্য ও জীবনের সম্পর্ক সন্ধানের চেষ্টাও এই প্রথম।

বত্রিশ বছরের জীবনে মহর্ষি, রামমোহন ছাড়াও জিশুর জীবনী লিখেছেন। পত্রপত্রিকায় ছড়ানো রচনা, অনুবাদ ছাড়াও আছে বারোটি বই। ছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী’র সম্পাদক। তবুও যেন তিনি স্বীকৃতিহীন। বিলেতে ‘সোনার তরী’র কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন সত্ত্বেও তা প্রকাশ পায়নি। কবির অনেকগুলি রচনার অজিত-কৃত অনুবাদ হয় প্রকাশিত হয়নি, হলেও চেপে যাওয়া হয়েছে অনুবাদকের নাম। গতকালই পেরিয়ে যাওয়া তাঁর মৃত্যুশতবর্ষও যেন বড় নীরব।

Ajit Kumar Chakravarty Rabindranath Tagore Litterateur অজিতকুমার চক্রবর্তী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy