Advertisement
E-Paper

অল লাইন্‌স ইন দিস রুট আর বিজি

ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখা টেলিফোনটা ছিল কালো রঙের এক অদ্ভুত জিনিস। তাতে নম্বর লেখা চাকতির উপরের অংশটা ঘোরালে উলটো দিক থেকে গম্ভীর এক লোক কত নম্বর চাইছি জেনে নিয়ে, সেই নম্বরে যোগাযোগ করে, আরও গম্ভীর গলায় বলতেন, ‘কথা বলুন।’

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
১৯৯০-এর মহালয়ার সকালে বাবুঘাটের গঙ্গায় তর্পণ হচ্ছে টেলিফোনের। বেশির ভাগ সময়ই ওঁরা অকেজো তথা ‘ডেড’ হয়ে থাকতেন কিনা!

১৯৯০-এর মহালয়ার সকালে বাবুঘাটের গঙ্গায় তর্পণ হচ্ছে টেলিফোনের। বেশির ভাগ সময়ই ওঁরা অকেজো তথা ‘ডেড’ হয়ে থাকতেন কিনা!

ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখা টেলিফোনটা ছিল কালো রঙের এক অদ্ভুত জিনিস। তাতে নম্বর লেখা চাকতির উপরের অংশটা ঘোরালে উলটো দিক থেকে গম্ভীর এক লোক কত নম্বর চাইছি জেনে নিয়ে, সেই নম্বরে যোগাযোগ করে, আরও গম্ভীর গলায় বলতেন, ‘কথা বলুন।’ এ তো নিজের শহরের মধ্যেকার যোগাযোগ। ‘ট্রাংক কল’ জিনিসটা প্রাপক ও প্রেরক দুজনের ক্ষেত্রেই ভীষণ ভয়ের ব্যাপার ছিল। এক্সচেঞ্জ-এর অপারেটর নামক ভগবানের কাছে প্রার্থিত নম্বর চেয়ে, কলটা ‘আর্জেন্ট’ না ‘অর্ডিনারি’ তা জানিয়ে, তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতে হত। একে বলা হত ‘ট্রাংক কল বুকিং’। এ সময় হঠাৎ কোনও ফোন এসে পড়লে, বা অন্য কেউ এসে ওই টেলিফোন ব্যবহার করতে চাইলে, তাকে বলা হত, ‘তাড়াতাড়ি করবেন, ট্রাংক কল বুক করেছি।’ এ দিকে দৈবাৎ লাইন লেগে গেলেও, ও-পারের আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে খুঁজে বার করতেই নির্ধারিত তিন মিনিট সময় ফুরিয়ে যেত, যদি না সদয় অপারেটর ‘প্লিজ কন্টিনিউ’-য়ে সাড়া দিতেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টেলিফোন নামের এই তাজ্জব যন্ত্রটা থাকত অফিসে বড়সাহেবের চেম্বারে, বা পাড়ার বড় ডাক্তার, উকিলবাবু বা ব্যবসায়ীর বাড়িতে। অনেক ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত লোকটিকে না পেয়ে, সেই বড়সাহেব বা ডাক্তারবাবুকেই সংক্ষিপ্ত সংবাদ দিয়ে জরুরি কথা শেষ করতে হত। বা বলতে হত: অমুকবাবুকে তমুক সময়ে বা দিনে হাজির থাকতে বলবেন প্লিজ, একটু কথা আছে। তত ক্ষণে হয়তো রটে গেল, অমুকবাবুর বড় জামাই দিল্লি থেকে ট্রাংক কল করেছিলেন। তাতে অমুকবাবুও খানিক পুলক অনুভব করতেন— কথা হল না তো কী, জামাই বাবাজীবন যে পয়সাওলা লোক, দিল্লি থেকে ট্রাংক কল করেন, সেটা তো বেশ বোঝানো গেল! জোর জবরদস্তি অফিস-ক্যান্টিনে বা পাড়ার চা-দোকানে জামাইয়ের সাফল্যের ইতিহাস ফলাও প্রচার হত।

কলেজে উঠলাম। তত দিনে স্যাম পিত্রোদা নামের এক সুদর্শন ভদ্রলোক ভারতবর্ষের (অ)কথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার খোলনলচে পালটে দেওয়ার কাজে লেগেছেন। বন্ধুর বাবা কাজ করতেন ‘পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ’ ডিপার্টমেন্টে। তাঁর কাছ থেকে খবর পেলাম, এ বার থেকে নাকি আবেদন করলেই হাতে-গরম টেলিফোন কানেকশন পাওয়া যাবে। সব এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা নাকি বহু গুণ বাড়ছে, সব ‘সি-ডট’ এক্সচেঞ্জে পালটে যাচ্ছে। বাবাকে খুব বোঝালাম, আমাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন কানেকশন খুব দরকার। আমরা কৃষ্ণনগরে, আর দিদির বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। আমিও তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাড়িছাড়া। ‘হ্যাঁ’টুকু মিলতে, নিজেই দৌড়োদৌড়ি করে ফর্ম জোগাড় করে, বাবাকে দিয়ে ভরিয়ে, জমা দিয়ে এলাম টেলিফোন অফিসে। আশ্চর্য, দু’মাসের মাথায় টেলিফোন অফিসের খয়েরি রঙের খামে বাবার নামে একটা টেলিফোনের ‘অ্যালটমেন্ট লেটার’ও এল! তাতে লেখা, আমাদের বাড়ির ঠিকানায় একটা টেলিফোন সংযোগ শিগগিরই দেওয়া হবে। এর পর দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা। এক দিন এলও সে। সাদা-লাল রঙের জুড়িতে সে এক আশ্চর্য প্রতিভাবান যন্ত্র। তাতে আবার ঘোরানো চাকতির বদলে ক্যালকুলেটরের মতো বোতাম। আমি তো আহ্লাদে আটখানা!

হস্টেলে তখন মোটে দু’-এক জন আমার মতো টেলিফোনওলা উচ্চশ্রেণিতে অবস্থান করে। কেতা জাহির করতে আমার বেডের ওপরের দেওয়ালে বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা বড় বড় করে লিখলাম, সবাই যাতে দেখতে-বুঝতে পারে। এ দিকে তখন দিকে দিকে ৩x৩ ফুট কাচে ঘেরা নতুন এক খাঁচার জন্ম হচ্ছে, যার বাইরে লেখা STD ISD PCO। একে বলে ‘টেলিফোন বুথ’। সবচেয়ে কাছের বুথটা ছিল প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে। ওখান থেকেই বাড়িতে ফোন করতাম। আস্তে আস্তে, নানান টেলিফোন বুথের দোষ-গুণ বিচার করে, আমরা তাদের এক-দুই-তিন র‌্যাংক করা শুরু করলাম। প্রথম বিচার্য, কোন বুথ থেকে চট করে লাইন পাওয়া যায়। তখন এসটিডি করতে গেলেই সুললিত কণ্ঠে শোনা যেত, অল লাইন্‌স ইন দিস রুট আর বিজি। প্লিজ ডায়াল আফটার সাম টাইম। বেশি ক্ষণ চেষ্টা করলে বুথের বাইরে হাঁকডাক শুরু হত। ফোনের লাইন না পাওয়া আর অপেক্ষমাণ জনতার অস্থিরতা রাত বাড়ার সঙ্গে বাড়ত সমানুপাতিক ভাবে। কারণ রাত যত গভীর হত, কথা বলার খরচ তত কমত (একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি)।

বুথ-চালানো দাদা-দিদিরা লাইন ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ নৈপুণ্য অর্জন করেছিলেন। কেউ সব ক’টা সংখ্যা ডায়াল করে, বা অদ্ভুত ভাবে টিপে ধরে, বা বার বার রি-ডায়াল করে ‘লাইন-থ্রু’ করে আমাদের দিকে দয়া-অনুকম্পা মেশানো হাসি ছুড়ে দিতেন। বুথগুলোর নিজস্ব ফোন নম্বরও আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। তারা আমাদের হয়ে নানা তথ্য চালান বা পাচার করত। অমুক মেয়ে খবর দিয়েছে: ‘ওকে বলবেন আগের দিনের জায়গায় ওই সময়ে দাঁড়াতে।’ ‘আগের দিন’, ‘ওই সময়’, এগুলো জানা না-থাকায় অভিসারী বন্ধুটির পিছু নিতে পারতাম না।

বুথ-পছন্দের দ্বিতীয় বিচার্য, সস্তার কল। প্রথম কলের দাম এক টাকা একত্রিশ পয়সা হলেও, সব বুথই দু’টাকা করে নিত। টাকা বাঁচাতে আমরা অনেকটা হেঁটে সরকারি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের বুথে যেতাম। সেখানে খুব ভিড়, সামনে নোটিস: ক্রস কানেকশন বা যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য কথা বলা বা শোনা না গেলেও, বিল উঠলে তা দিতে হবে। কেউ বুথের মধ্যে ক্রমাগত ‘হ্যালো হ্যালো’ করছে আর বাইরে মেশিন থেকে ঘড়াং ঘড়াং বিল বেরচ্ছে, সেই নিয়ে অশান্তি। বুথবালিকাদের (যে মেয়েরা বুথ চালাত) ওপরেও নির্ভর করত বুথের ভালমন্দ। কান রিসিভারে সাঁটা, কিন্তু চোখ চেয়ে আছে ওদের দিকে। আবার সংকটে ওরাই হয়ে উঠত মুশকিল-আসান। এক বার প্রেমিকার সঙ্গে খুব জরুরি কথা বলার আছে, কিন্তু যত বারই ফোন করি, হবু শ্বশুরমশাই ফোন তুলে কমল মিত্র স্টাইলে ‘হ্যালো’ বলছেন। আমিও কেঁপে গিয়ে ফোন রেখে দিচ্ছি, পয়সা যাচ্ছে জলের মতো। বুথের মেয়েটিকে সব বললাম, সে আমার প্রেমিকার প্রিয় বান্ধবী সেজে শ্বশুরমশাইকে জপিয়ে দিব্যি ওকে এনে দিল ফোনের ও-পারে। শ্বশুরমশাই অবশ্য বান্ধবীর ‘চেনা গলা অচেনা লাগছে কেন’ জিজ্ঞেস করতে ভোলেননি। মেয়েটিও বুদ্ধি করে বলেছিল, ঠান্ডা লেগে গলা বসে গেছে!

সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, ইস্টার্ন পার্ক, সন্তোষপুর

sombuddha.chakrabarty@gmail.com

নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy