Advertisement
E-Paper

রৌদ্র ছায়া বৃষ্টি

বৃষ্টির পিছনে ছুটতে ছুটতে রৌদ্র অস্থির। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট আচরণ করে। এই যেমন একটু আগে একটু সিরিয়াস কথা চলছিল, হঠাৎ মাথায় কী চাপল, সাঁ করে দিল একছুট। রৌদ্র তো হাঁ। এ কী খেপি রে! ছুটতে ছুটতে বৃষ্টি বলতে থাকে, দাঁড়া এক রাউন্ড ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলে নিই আগে।

শাশ্বতী নন্দী

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩

বৃষ্টির পিছনে ছুটতে ছুটতে রৌদ্র অস্থির। মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট আচরণ করে। এই যেমন একটু আগে একটু সিরিয়াস কথা চলছিল, হঠাৎ মাথায় কী চাপল, সাঁ করে দিল একছুট। রৌদ্র তো হাঁ। এ কী খেপি রে! ছুটতে ছুটতে বৃষ্টি বলতে থাকে, দাঁড়া এক রাউন্ড ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলে নিই আগে।

ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা মানে? কটমট চোখে চেয়ে রৌদ্রও ধেয়ে যায় ওর দিকে। এখন কি খেলার সময়? কত বড় প্রজেক্ট বলে আমাদের হাতে, আর তোর ওপরেই তো সব কিছুর ভার।

এ বার বৃষ্টি একেবারে স্ট্যাচু। কপালের ওপর ঝুঁকে আসা কোঁকড়া চুলের গুছি হাত দিয়ে সরিয়ে ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল নাচাতে নাচাতে বলে, হুম, তা বটে।

তবে? রৌদ্র জানে বৃষ্টিকে সামান্য তোয়াজ করলেই ও গলে জল। তখন কে বলবে ও ক্লাস এইট, হাবভাবে ঠিক ফোর কিংবা ফাইভ। গলা ঝেড়ে আবার সে বলে, যাঁদের যাঁদের খবর দেওয়ার ছিল, দিয়েছিস?

অল কমপ্লিট। বৃষ্টি মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরায়। তবে মিষ্টিদাদুর কেসটা ডাউটফুল। শরীর খারাপ। আসতে পারবে না হয়তো।

যাহ! আর ভালদাদু?

লিটল চান্স।

প্রায় চোদ্দো বছর ক্যালিফর্নিয়ায় কাটিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছে বৃষ্টি ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। তাই প্রতিটি বাক্যে দু’চারটে ইংরেজি শব্দ থাকবেই থাকবে। আই থিঙ্ক, রাগীদাদু আসছে।

সে কে রে? ও, সেই মিলিটারিদাদু? হা হা হা। সত্যি বেজায় রাগী মানুষটা। এক দিন তো এক ফুলচোরকে একশো এক বার ওঠ-বোস করিয়ে শাস্তি দিয়েছিল।

কথা বলতে বলতে ওরা এগোতে থাকে বকুলতলার মাঠের দিকে। কী আশ্চর্য! মাঠ যে একেবারে সরগরম, কচিকাঁচাদের ভিড়ে ঠাসা। একটু বাদে কয়েক জন বৃদ্ধকেও হেঁটে আসতে দেখা গেল। মিলিটারিদাদু সবার আগে। ছড়ি উঁচিয়ে বুক টান করে হাঁটছেন। সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বৃষ্টির যেমন স্বভাব, এক ছুটে গিয়ে মিষ্টিদাদুর হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বলে, আরে, সুইটিদাদু, তুমি এত্ত শরীরখারাপ নিয়েও এলে? ওহ, কী মজা।

বৃষ্টির দেখাদেখি বাকি বাচ্চারাও কলকল করে মিষ্টিদাদুকে ঘিরে ধরল।

উঁ, নো শাউটিং। মিলিটারিদাদু হাঁক পাড়লেন। সবাই একে একে লাইন করে দাঁড়াও আগে। তার পর জানাও আজকের এই হঠাৎ ডাকা মিটিংয়ের কারণ কী?

বৃষ্টি হাত-পা নেড়ে বলে, আমাদের কিছু দাবি আছে। সেগুলো আজ শুনতে হবে, মানতে হবে।

দাবি! মিলিটারিদাদুর সাদা
পুরু গোঁফ সামান্য নেচে উঠল। শুনি কী দাবি?

রোজ বিকেলে তোমাদের একটা কাজ দেওয়া হবে। এই ওল্ড বেনিয়ান ট্রির নীচে বসে আমাদের নানা রকম গল্প শোনাতে হবে। তোমরা এক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত সব চাকরি করেছ। আমরা সেই সব গল্প শুনতে চাই। যেমন, মিলিটারিদাদু শোনাবে যুদ্ধের গল্প, ভালদাদুর সাবজেক্ট স্কুল আর স্টুডেন্টস, আর ওই যে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফরেস্ট রেঞ্জারদাদু, সে আমাদের বাঘ সিংহের গল্প বলবে, আর এই যে গো, তুমি, সবচাইতে জুনিয়রদাদু, বাবার মুখে শুনেছি তুমি নাকি বিরাট সাহসী, এক বার তোমার ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়েছিল আর তুমি সেই ডাকাতকে কী কায়দাটাই না করে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল, ওগুলো সব শুনতে চাই আমরা।

মিলিটারিদাদুর ভ্রু কোঁচকানো, কিন্তু মুখে ফিকফিক হাসি, ইউ মিন, গল্পদাদুর আসর?

ঠিক ঠিক। সমস্বরে কচিকাঁচারা বলে ওঠে। ঘরে আমাদের কথা
ধৈর্য ধরে শোনবার বা গল্প করে
বলার কেউ নেই। সারা দিন তাই তো টিভির দিকে চেয়ে থাকি। তাতেও কি কম বকুনি জোটে! ওঁদের মুখে শুধু একটাই কথা, পড়ো আর লেখো, লেখো আর পড়ো।

বৃদ্ধ মানুষগুলো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে নিষ্পাপ মুখগুলির দিকে। তাঁদের নিষ্প্রভ চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠছে। কারও আবার তোবড়ানো গালে নোনা জলের রেখা।

ভালদাদু আপন মনে মাথা দোলাতে দোলাতে বলেন, সত্যি তো। আমরা তো কেউ কেউ গল্পের জাহাজ। স্মৃতিতে এখনও কত কিছু ভেসে ওঠে। কিন্তু শোনাব কাকে? শ্রোতা নেই। বড় ব্যস্ত সবাই। আবার এ দিকে দেখো, এই বাচ্চাগুলোর মনে কত খিদে। কত কিছু ওরা শুনতে চায়, জানতে চায়। কিন্তু ধৈর্য ধরে সে সব শোনার বা বলার কেউ নেই।

ঠিক হল, পরের দিন থেকেই বুড়ো বটতলায় বসবে গল্পদাদুর আসর। হঠাৎ মিলিটারিদাদু পিলে চমকানো ডাক ছাড়লেন, নাও, ফলো মি। সবাই এসো আমার পিছু পিছু।

খানিক হাঁটার পরই আবার সেই বাজখাঁই গলা, হল্ট।

মাঠের এক কোণে ফুচকাওলা, আইসক্রিমওলা, আলুকাবলিওলাদের ভিড়। মিলিটারিদাদু অর্ডার দিলেন, যার যা পছন্দ পেটপুরে খাও আমার অ্যাকাউন্টে। আজ কত খুশির দিন।
লেটস সেলিব্রেট।

চলল এক চোট খাওয়াদাওয়ার পর্ব। বৃদ্ধ মানুষগুলোর মুখে চোখে টগবগে শৈশব যেন ফিরে এসেছে। কাঠি চুষে চুষে আইসক্রিম খাচ্ছেন। আইসক্রিমের জলে ভিজে যাচ্ছে সাদা ফতুয়া। ও দিকে ফুচকার ঝালে ভালদাদু একেবারে চোখের জলে নাকের জলে। মিষ্টিদাদু ফোকলা দাঁতে হেসেই চলেছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, অনেক দিন পর নিজেদের বড় দামি দামি লাগছে হে।

হঠাৎ রৌদ্র বলে ওঠে, এত দিন আমাদের মধ্যে রোদ ছিল, বৃষ্টি ছিল, কিন্তু ছায়া ছিল না। আমরা বাবা-মায়ের কাছে হয় অতিরিক্ত শাসন, নয়তো অতিরিক্ত আদর পাই। কিন্তু ঠান্ডা ঠান্ডা একটু ছায়ার জন্য ভেতরটা ছটফট করে মরে। এখন থেকে তোমরা সেই ছায়াটুকু দেবে।

আলুকাবলি, ফুচকা, চুরমুর, কোনও আইটেম বাদ দেয়নি বৃষ্টি। এ বার ও আয়েশ করে একটা গোলাপি আইসক্রিম চুষছে। হঠাৎ বোঁ করে এক পাক ঘুরে বলে, রাইট, আমরা প্রতি বিকেলে তোমাদের ছায়ায় জিরিয়ে আবার ঘরে ফিরে যাব। তা হলে টিমের নাম রাখা হোক না, রৌদ্র ছায়া বৃষ্টি। কী রাগীদাদু, নামটা কেমন?

Anandamela Saswati Nandi story
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy