Advertisement
E-Paper

জলের জীবন

রু‌ তার পোনাদের নিয়ে বিকেলবেলায় বেড়াতে বেরিয়েছে। সে যে দিকে যাচ্ছে ছানাপোনারাও তার পিছু পিছু নিশ্চিন্তে দল বেঁধে চলেছে। আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে তারা পাড়ের কাছে এসেছে। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখছে নীল আকাশ।

আশিস কর্মকার

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০

রু‌ তার পোনাদের নিয়ে বিকেলবেলায় বেড়াতে বেরিয়েছে। সে যে দিকে যাচ্ছে ছানাপোনারাও তার পিছু পিছু নিশ্চিন্তে দল বেঁধে চলেছে। আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে তারা পাড়ের কাছে এসেছে। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখছে নীল আকাশ। তার গায়ে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। তার ফাঁক দিয়েই রোদের উঁকিঝুঁকি। এমন সময় হঠাৎ ওপর থেকে ঝপাৎ করে নোংরা জল এসে পড়ল ওদের গায়ে। ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটল যে তারা সরে পড়ার সময়ও পেল না। নোংরায় তো রু-এর বেদম হাঁচি উঠল। হাঁচতে হাঁচতে সে কাহিল হয়ে পড়ল। আর রু-এর ছেলেমেয়েদের কারও কারও শুরু হল শ্বাসকষ্ট। এক জনের অবস্থা তো খুবই সঙ্গিন হয়ে উঠল। ওকে বোধ হয় আর বাঁচানোই যাবে না।

রু হল রুই মাছের আদুরে নাম। অন্য দিকে কৈলা (কৈ মাছের আদুরে নাম) বেড়াতে বেরিয়ে এসে দেখে রু আর তার ছানাপোনার দুরবস্থা। সে রু-এর ছানার বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ‘কী করে হল রে এ সব?’ রু হাঁচি সামলে নিয়ে বলল, ‘রায়বউয়ের আক্কেল খানা কী বল তো দেখি কৈলা। আমরা সপরিবারে বেশ বেড়াচ্ছিলুম, দেখলে না শুনলে না হঠাৎ মাথার ওপর নোংরা কালো জল ঢেলে দিলে!’ কৈলা বলল, ‘কী আর বলি বল তো রু। আমাদের কথাটা কেউ ভাবে না। এই পুকুরে যে আমরা বাস করি, আরও ছোট-বড় অনেক জলের জীব বাস করে তা আর মাথায় রাখে কে? অথচ ছিপ দিয়ে, জাল ফেলে আমাদের ধরে খাওয়ার বেলায় বেশ আছে। কিন্তু আমরা ভাল থাকব কী ভাবে, সেটা তো ভাবে না!’

‘সত্যি আমাদের কথাটা কেউ ভাবে না রে। আজ আমার পোনাটার কিছু হয়ে গেলে কী হবে বল তো।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল রু। রু-কে সান্ত্বনা দিয়ে কৈলা বলে, ‘কী আর হবে। তোর পোনার কিছু হলে মানুষের কী? মানুষ বড় স্বার্থপর হয়ে উঠেছে দিনকেদিন। এই তো সে দিন ব্যানার্জিবাবুদের বাড়িতে কীসের যেন ভোজ হল। ভোজ হয়েছে ভাল কথা। আনন্দ করে খাওয়াদাওয়া কর। তা, থারমোকলের থালা, প্লাস্টিকের গ্লাস ফেলবি তো ফেল এই পুকুরের ধারে।
কিন্তু ধারে ফেললেই কী আর ধারে থাকে বল তো? হাওয়ায়, জলের তোড়ে সবই তো জমছে এই পুকুরে।’

‘তা তো বটেই। ওদের কী আর সে দিকে নজর আছে?’

তাদের এই আলোচনার মধ্যে এসে পৌঁছল শোল। শোলকে রুইয়ের পোনারা শোলুমামা বলে ডাকে। সব শুনে সে বলল, ‘মানুষের শুধু স্বার্থপর হওয়ার কথা কইছ কৈলাদিদি? মানুষ আজকাল লজ্জাশরমের মাথাও খেয়েছে।’

‘বটে! সেটা কেমন?’

‘সে দিন দেখি মাইতিদের ছেলেটা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়েই জলের দিকে মুখ করে— ইস্, ছিঃ ছিঃ, আমি আর বলতে পারছি না কৈলাদিদি।’

‘অনেক ধাড়ি ধাড়ি লোকেরাও তাই করে। জলের নীচ থেকে দেখে আমারই লজ্জা করে।’ বলল রু।

‘আর ওদের বোধটুকুও নেই। ছিঃ!’

এমন সময় পুঁটি তার মোটাসোটা গাট্টাগোট্টা শরীরটা নিয়ে হেলতে দুলতে এল। পুঁটির বয়সটা ওদের থেকে অনেকটাই বেশি। কিন্তু সে তুলনায় শরীরের বাড়নটা সে রকম না হওয়ায় সবাই তাকে বামুনপিসি বলে ডাকে। পুঁটি তো রু-এর পোনাকে দেখে হইহই করে উঠল, ‘সে কী তোর ছেলের দশা এ রকম হল কী ভাবে?’ কৈলা বলল সব কথা। পুঁটির চকচকে শরীরে কালচে একটা পোঁচ দেখে শোল বলল, ‘তোমার শরীরে ও কীসের দাগ দো বামুনপিসি?’

‘কালো দাগ!’ অবাক হয়ে বলল পুঁটি। ‘দেখ তো কীসের দাগ?’ শোল ভাল করে দেখে বলল, ‘তেলকালির দাগ মনে হচ্ছে।’

‘তা হতে পারে। আজ বিকেলে একটু ফাঁকা হয়ে ভাবলাম খানিক বেড়িয়ে আসি। এমনিতেই জানিস তো আমার বেড়াবার ফুরসত হয় না। তা পাড়ের দিকে একটু বেড়াচ্ছিলাম আর আকাশটা দেখছিলাম। এক জায়গায় এসে দেখি ও পাড়ার বোসবাবু তার গাড়িটা ধোয়াচ্ছে পুকুরের ধারে। তার সব তেল-ময়লা জল পুকুরে আসছে। তেলচিটে দাগটা বোধ হয় সেখানেই লেগেছে।’

‘আসলে চারচাকা কিনেছেন তো তাই উনি চারপেয়ে হয়ে গিয়েছেন।’ বলল কৈলা।

‘তা যা বলেছিস কৈলাদিদি। শিক্ষিত লোকের কাজের কী ছিরি।’ কৈ-কে সমর্থন করল শোল। এমন সময় ল্যাটা মাছ ছটফট করতে করতে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। ওকে দেখে পুঁটি জিজ্ঞাসা করল, ‘ও রকম করছিস কেন লো লেটু?’ ল্যাটা এ দিকে এসে বলল, ‘আর বলো কেন বামুনপিসি। শরীরটা ঠান্ডা করতে ভাবলাম একটু কাদার ভেতরে সেঁধিয়ে থাকি। তা ওই পাড়ের দিকের কাদায় সেঁধাতেই শরীরটা জ্বালা-পোড়া করতে লাগল।’ ছটফট করতে করতেই বলল ল্যাটা।

‘তা হবে না কেন?’ বলল পুঁটি। ‘ওই পাড়ের গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজের নোংরা, কারবাইডের ছাই সবই তো ফেলে জলের ধারে। মাটি বিষিয়ে গেছে।’

‘আমি তো সেটা খেয়াল করিনি গো বামুনপিসি।’

‘চোখ-কান সব্বদা সজাগ রেখেই চলাফেরা করতে হবে এখন। নিশ্চিন্দি হয়ে যে চলবি সেই দিন এখন আর নেই রে লেটু।’

এই আসরে আবার তেলাপিয়া এসে হাজির। ওরা তেলাপিয়ার আদুরে নাম রেখেছে তেলাপ্রিয়া। তা থেকে এখন শুধু প্রিয়া হয়ে গিয়েছে। সে এসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ গো বামুনপিসি। সে দিন আমি একটু জলের ওপর ‘ভাসি ভাসি’ খেলছি খেয়াল করিনি ও দিকের ঘাটেতে সামন্তদের বাড়ির বউ কাপড় কাচছিল। সেই সাবান-জল আমার চোখে গিয়ে কী জ্বালা— চোখে একদম সর্ষেফুল দেখার জোগাড়।’

‘তবেই দেখ। চোখ-কান খোলা না রেখে চলার উপায় নেই।’ শোল বলল, ‘এদের বোধভাষ্যি যে কবে হবে?’

এমন সময় রু-এর পোনাটা ছটফট করতে লাগল। দু’বার লম্বা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ল। তিন বারের বেলায় লম্বা শ্বাস নিয়ে আর ছাড়তে পারল না। মাঝ পথেই আটকে গেল সেটা।

‘কী হল খোকা, কী হল?’ বলে কেঁদে উঠল রু। সবাই দেখল পোনাটার শরীর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর শরীরটা আস্তে আস্তে উলটে গেল। চোখের দৃষ্টি হল শূন্য।

রু তার ছানাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। কান্না জুড়ল অন্যরাও। তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পেল না। পুকুরের জলেই মিশে গেল। সব থেকে দুঃখের কথা তাদের এই কান্না জলের ওপরে ডাঙায় থাকা মানুষের কানে মোটেই পৌঁছল না।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy