Advertisement
০২ মে ২০২৪

সোঁদরবনের শেয়াল

সোঁদরবনের ত্যাঁদড় শেয়াল বাঘমহাশয়কে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। কেবল তাঁর নিন্দে রটিয়ে বেড়ায়। বলে— ওর আছেটা কী! রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! ঘড়ঘড়ে স্বরে কেবল গরগর করে বলেই টাইগর। টাইগরগর না ছাইগরগর। বলি ও রয়্যাল কীসে! সেই তো বাপু বেড়ালমাসির ভাগ্নে! থাকার মধ্যে গায়ের রংটাই যা হলুদ! তা আমার রংটাই বা কম কী!

তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

সোঁদরবনের ত্যাঁদড় শেয়াল বাঘমহাশয়কে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। কেবল তাঁর নিন্দে রটিয়ে বেড়ায়। বলে— ওর আছেটা কী! রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! ঘড়ঘড়ে স্বরে কেবল গরগর করে বলেই টাইগর। টাইগরগর না ছাইগরগর। বলি ও রয়্যাল কীসে! সেই তো বাপু বেড়ালমাসির ভাগ্নে! থাকার মধ্যে গায়ের রংটাই যা হলুদ! তা আমার রংটাই বা কম কী! কারা যেন আবার ওকেই দক্ষিণরায় বলে পুজো করে। ছোঃ! দেখে আর হেসে বাঁচি না।’

বাঘের কানে সব কথাই আসে। তাঁর মনে বড় দুঃখু। সোঁদরবনের ভোঁদড় তাঁর শৈশবের বন্ধু, তার কাছেই মনের কথা খুলে বলেন। ‘বলো তো ভাই, আমি ওর কোন ঝাঁকা ল্যাজে টান দিয়েছি! কবে ওর খোঁচা গোঁফের গোছায় মোচার কষ ঘষেছি?’

ভোঁদড় বলল, ‘আসল কথা হিংসে! ওর না আছে তোমার মতো রূপ, না গুণ, না ওই হাড় হিম করা বাঘজাই বাজখাঁই কণ্ঠ! শিং-ও নেই যে বাইসনের মতো শিংগরবে ফুঁসবে, স্বর যদি হত বজ্রঘোষ তা হলেও নয় সিংহরবে যাম ঘোষণা করতে পারত। হুকা হুকা করেই বেচারাকে পুকার দিতে হয়! ওদিকে তুমি শিকার ধরে, নিজের পেটটি ভরে খেয়ে যা ভুক্তাবশেষ রেখে যাও, ত্যাঁদড়টা তাই তারিয়ে তারিয়ে খায়! আবার বড়াই করে ঘাসে গড়াই দিয়ে বলে কিনা, ওর মতো বুদ্ধি নাকি কারও নেই।’

শেয়ালের সেয়ানা বক্তিমে আর বারফট্টাই সোঁদরবনের বাঁদরের আর সইল না। সে যদিও বাঘের বন্ধু নয়, তবু বাঘ প্রতিবেশী এবং বনের রাজা বলে কথা, দেখা হলে বাঁদর সব সময়ই বলে, ‘পেন্নাম হই।’ জবাবে বাঘ বলেন, ‘হুম্, হালুম, তথাস্তু।’ সঙ্গে সঙ্গে বাঁদর বুঝে যায়, হম্বিতম্বি যতই করুন, বাঘমহাশয়ের বুদ্ধি এখনও নড়বড়ে। নইলে, কোনও প্রস্তাব নেই, আবেদনপত্র নেই, কেউ তথাস্তু বলে?
শুভমস্তু, কল্যাণ হোক, মঙ্গল হোক কত কী বলা যায়! এক বার তো হিজলবনে কুমিরবাবুর সাতছানার জন্মদিনের ভোজে গিয়ে বলে বসলেন— ব্যাঙাচির মতো কুমিরছানার লেজও কি খসে পড়ে?

অপমানে কুমিরের কান্না আর থামানো যায় না! একটা ব্যাঙের সঙ্গে কুমিরের তুলনা? না হয় দু’জনেই জলে-ডাঙায় ঘোরাঘুরি করে। তাই বলে বাঘ আর বাঘডাশা কি এক? বাদুড় কি ভোঁদড়ের মাসতুতো ভাই? বাঁদর কি গায়ে চাদর দেয়? চামচিকে কি শিকেয় ঝোলে? হাতি অবশ্য মাঝে মাঝে ছাতি মাথায় দেয়, কিন্তু গরু কক্ষনো গাছকে তরু বলে না, কোনও কুকুর মুগুর ভাঁজে না এমনকী মাগুরমাছেও তাদের আগ্রহ নেই, আজ অবধি কোনও ছাগল পাগল হয়নি। তাদের বুদ্ধি অল্প হলেও স্থির।

বাঘমহাশয় তখন সবচেয়ে উঁচু ঢিবিটায় রাজকীয় চালে বসে ভোঁদড়ের সঙ্গে আগডুম বাঘডুম খেলছিলেন। কুমিরের বিলাপে তিনি কর্ণপাত করলেন না। প্রজার বিলাপে রাজা-বাদশার কান না দিলেও চলে। তাঁরা তো আর কানপাতলা নন যে বললেই শুনবেন আর বিশ্বাস করে বসবেন! বাঘমশাইয়ের মোসায়েবি করবেই বা কে।

কুম্ভীরাশ্রু দেকে অবশ্য বাঁদরেরও মন গলেনি। যে কথাগুলো বলে কুমির বিলাপ করছিল, তার কোনও সারবত্তা ছিল না। তবে ছাগলের অল্প বুদ্ধি যে স্থির, সেটা খুব সারগর্ভ কথা। কীভাবে কিছু চিবিয়ে খাওয়া যায়, এই বিষয় ছাড়া তার বুদ্ধি আর কোনও দিকে নড়ে-চড়ে না। বুদ্ধিতে সেরা বাঁদর জানে, ও বস্তু থাকলেও মাঝে মাঝে বোকা সাজতে হয়। যাদের তা কম আছে, তারা সব সময়ই চালাক-চালাক ভাব করে আর বিশ্বাস করে বসে যে চালাকিটা কেউ বুঝতে পারছে না! কিন্তু বাঘ সে গোত্রের নন। তিনি খুব চালাক, না খুব বোকা— বাঁদর তা ঠাহর করতে পারেনি এখনও। সেই সে-বার, কুমিরের খুড়তুতো ভাই ঘড়িয়াল, শিকার বিষয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করল। গোসাবা নদীর জল জমে জঙ্গলের মধ্যে এক দহ, তারই ভরা জলের ছলছলানো কূলে সভা। ‘এককামড়ে কর্তন’ শীর্ষক ব্যাঘ্রগম্ভীর বক্তিমে দিয়ে বাঘমহাশয় দহয় এলেন গলা ভিজিয়ে নেবেন বলে। জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলেন ঠায় দাঁড়িয়ে। অবশেষে বলে বসলেন, ‘আমি তো দক্ষিণরায়, জলের ওপারে উনি কি তবে বামরায়?’

রাজপ্রমাদ শোধরায় কোন দুঃসাহসী? সকলেই হ্যাঁ-না তাই-না করছিল, বাঘের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে ঘোড়েল তো মুগ্ধ, এককামড়ে এখুনি কী কর্তন করা যায় ভাবছিল, শেয়ালের সাক্ষাৎ জ্যাঠতুতো ভাই অতি চালাক খ্যাঁকশেয়াল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে উঠল, ‘হুয়া হুয়া বেশ হুয়া! উনি গেরুয়া বাঘেরুয়া!’

ব্যাঘ্রমহাশয় কিন্তু এই ব্যঙ্গের ব্যাপ্তি ঠিক বুঝতে পারলেন। ঘ্রাঁউ ঘ্র র র র বলে চক্ষের পলকে বিশাল লম্ফ দিয়ে খ্যাঁকশেয়ালের ঘাড়ে পড়ে দু’বার ঝাঁকানি দিতেই চতুরশিরোমণি অক্কা পেল। বাঘমহাশয় ভারী অবজ্ঞাভরে বললেন, ‘ঘড়িয়ালকুলের জন্য আমার দান।’ মুফতে খাদ্য পেয়ে নিমেষে ঘোড়েলগুলো সেটা সাবড়ে দিল। খ্যাঁকশেয়ালের অমন ঝাঁকড়া লেজখানা পর্যন্ত নিঃশেষ।

এ থেকে কী বোঝা যায়? বাঘমহাশয় বোকা, না বুদ্ধিমান? তর্জন-গর্জন শুনলে বাঁদরের মনে হয়, যাঁর অমন রূপ আর অত শৌর্য-বীর্য, তাঁর বুদ্ধির দরকার কী! থাকলেও হয়, না থাকলেও। শেয়াল যতই বড়াই করুক, বাঘের নখের যুগ্গিও সে নয়। এক দিন শেয়াল যখন বাঘের নিন্দেমন্দ করছে, বাঁদর বলল, ‘বাঘ মেরে দেখাও দিকি, কত ক্ষমতা তোমার।’

‘এ আর এমন কী!’ বলেই শেয়াল গা ঢাকা দিল।

সেই সন্ধ্যা থেকেই শুরু হল এক আজব উৎপাত। বাঘমহাশয় শিকারের উদ্দেশে যে দিকেই যান, শেয়াল দূর থেকে তাঁকে অনুসরণ করে আর গলা ছেড়ে চ্যাঁচায় ভেউ ফেউ কেঁউ উ উ! ভাগো বাঘো মাঘো!

জঙ্গলের প্রাণীরা সব লুকিয়ে পড়ে। বাঘের আর শিকার জোটে না। ভোঁদড় জল থেকে মাছ ধরে দেয়, তাইতে কি তাঁর পেট ভরে? ক’দিনেই খিদের জ্বালায় বাঘমহাশয় পাগল-পাগল হয়ে উঠলেন। তাঁর ঝলমলে হলুদ রং ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অমন পেশল গা এখন হাড়সর্বস্ব! শেয়াল হু-হু হি-হি খিক্-খিক্ করে হেসে বলল, ‘কেয়া হুয়া? ক্যায়সা হুয়া? বাঘে এ বার ধরবে ঘাস, নইলে হবে স্বগ্গোবাস।’

বাঁদর বলল, ‘ভাই, এটা ঠিক নয়। এটা আইনবিরুদ্ধ। রাজা হতে চাও তো সামনাসামনি লড়ো। লুকিয়ে চতুরালি করে আপন শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা ঘৃণ্য অগণতান্ত্রিক কর্ম। তার ওপর খেতে না দেওয়া তো দণ্ডনীয় অপরাধ।’

‘যাও তো! আমাকে ন্যায় শিখিয়ো না। ছলে-বলে-কৌশলে জয়লাভ করাই হল লক্ষ্য। নিকেশ করো যতেক প্রতিপক্ষ।’

বাঁদরের ভারী খারাপ লাগল। সে এক হরিণছানাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ক্ষুধার্ত বাঘের কাছাকাছি এনে নিজে গাছের মগডালে বসে বলল, ‘সম্রাট, আমি আপনার ভৃত্য, দাসানুদাস, আপনার জন্য শিকার এনেছি।’

হরিণছানা বাঘের সামনে পড়ে ভয়ে কেঁপে বলল, ‘রাজামশাই, আপনি ক্ষুধার্ত বটে। কিন্তু বাঁদর আমায় ভুলিয়ে এ দিকে এনেছে, আমায় ধরে খাবেন এই কি রাজার রাজ? এ কি শিকার, না ভিক্ষা? গাধার পাঠশালায় আমরা পেয়েছি এই শিক্ষা। শহিদ হতে আপত্তি নেই কোনও, রাজা যদি রাজার মতো হন।’

বাঘ বললেন, ‘ঠিক বলেছ ঠিক। রাজার মতো হওয়াই চাই, সকল কাজে সেরা। ধিক্ আমাকে ধিক্।’

তিনি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। ‘হতভাগা শৃগাল। তোমার গালমন্দ অনেক আছে জমা, আর পাবে না ক্ষমা। তোকে সাবাড় করে রাতে, আহার করব প্রাতে।’

হরিণছানা তুড়ুক পুড়ুক নেচে বলল এই তো চাই! যাকে যা মানায়। ও-দিকে ঝোপের মধ্যে বসে শেয়াল তো জয়ের আহ্লাদে ছিল আটখানা, এখন বাঘের প্রতিজ্ঞা শুনে গুটিয়ে গর্তে সেঁধোল। ফেউফুকারি তো বন্ধ করলই, ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া হুক্কা খুয়া খুয়া বলতেও আর সাহস পেল না।

বাঁদর মগডাল থেকেই বলল, ‘পেন্নাম হই রাজা।’

বাঘ আড়চোখে চেয়ে বললেন, ‘তথাস্তু।’

আর সোঁদরবনে কোনও কোঁদল নেই। ভোঁদড়ের সঙ্গে গপ্পো করে বাঘমহাশয়ও দিব্যি রসেবশে আছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anandamela Rabibasariya Tilottama Majumdar Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE