Advertisement
E-Paper

বসন্ত এসে গেছে...

ভালবাসা কী চায়? সাফল্য, না পাখির নীড়ের মতো চোখের আশ্রয়? পিছল রাস্তার রেলিং হয়ে সে কত দিন বাঁচায় আমাদের? নাকি প্রেম আসলে শেয়ার মার্কেট, যে আমাদের আস্তে আস্তে এনে দেয় অসাড়তার আরাম? চিরকাল যে সব প্রশ্ন নিয়ে আসে বসন্ত।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

অনুপম রায়

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৫ ০৮:৪৫
Share
Save

থোকা থোকা কুসুম ফুটে আছে। তাতে ভ্রমরের আনাগোনা। অবিশ্বাস্য রঙে আঁকা হয়েছে উপবন। একরাশ সুবাতাস বয়ে আনছে কী অপূর্ব খুশবু। গাছে গাছে কোকিলের কুহুতান। যুগ যুগ ধরে এই তো ছিল কবির কল্পনা। একেই তো আমরা বসন্ত বলে চিনে এসেছি। এই বসন্ত, এখানে এক্ষুনি দারুণ কিছু একটা হবে! কিন্তু হয় কি? এই বসন্তেই কারও সারা গায়ে দেখা দেয় ফুসকুড়ি। দু’দিন বাদে জ্বর এলে বোঝা যায় সেগুলি বসন্তের গুটি। আবার এই বসন্তেই একদল রোমান, জুলিয়াস সিজ়ারকে হত্যা করার চক্রান্ত করে সাফল্য পেয়েছিল। অন্য দিকে এলিয়ট লিখে গেছেন, এপ্রিল ইজ় দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ (আমাদের ক্ষেত্রে সেটা ফেব্রুয়ারি-মার্চ) অথবা বেশ তো ছিলাম নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়ে, আবার কেন কাটা ঘায়ে নুন ছেটাতে এলি রে বসন্ত?

‘ফেলুদা’ কাহিনির ম্যাট্রিক্স

ছেলেবেলায় আমি সবচেয়ে ভালবাসতাম খেলাধুলো করতে। এখনও ভালবাসি, সঙ্গী পাই না তেমন। মাঠে গিয়ে যে ফুটবলে একটু লাথি মারব সেই সুযোগ বছরে এক দু’বারই হয়। সারাদিন স্কুল, টিউশন, বাবা-মায়ের শাসন সব হাসিমুখে সহ্য করে নিতাম শুধু দু’ঘণ্টা মাঠে ছুটতে পাওয়ার আশায়। তার পর একটা বয়স আসে, যখন নারীজাতির প্রতি অদ্ভুত কৌতূহল জন্মাতে শুরু করে। মনে হত, যদি কাউকে একটা মনের মতো পেয়ে যাই, তা হলে আজ বিকেলে আর খেলতে যাব না। তার সঙ্গে গল্প করব। আমার মনে কত কথা, কিন্তু সে কথা শোনার মানুষ কোথায়? কাকে বললে বুঝতে পারবে? সূর্য, সন্দীপন, রাজদীপ এদের বলব? না, এই ছেলেগুলো কিছু বোঝে না। বলব, আর হ্যা হ্যা করে হেসে উঠবে, মনটাই ভেঙে যাবে। জানি না কেন ভাবতাম, শুধু একটা মেয়েই আমার এই অনুভূতিগুলোর ঠিক ঠিক মূল্যায়ন করতে পারবে। আমাকে বুঝতে পারবে।

বেশির ভাগ বাঙালি যুবকদের মতো, বেশ বড় বয়স পর্যন্ত আমার জীবনের অন্যান্য অতৃপ্তির মধ্যে, মূল অতৃপ্তির জায়গা ছিল প্রেম। জীবনে দেখি সবই হয়, পরীক্ষায় ভাল ফল হয়, ভাল কলেজ হয়, ভাল চাকরি হয়, গিটার হয়, কবিতা হয়, কিন্তু কিছুতেই বান্ধবী হয় না। ছেলেদের স্কুল ছিল বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই, কিন্তু যাদের হওয়ার থাকে তারা পাশের স্কুলের মেয়েদেরও সঙ্গেও প্রেম করতে পারে। কোনও টিউশনে কোনও মেয়ে ছিল না। এক জন মেয়ে ছিল একটা টিউশনে, স্যর এক দিন তাকে কী একটু বকলেন, সে কাঁদতে কাঁদতে ছেড়েই দিল টিউশন। তার পর কলেজে ক্লাসে এক জন মাত্র মেয়ে। আমরা কয়েক জন এ দিক ও দিক একটু চেষ্টা করেছিলাম বটে, কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারিনি। প্রতি বসন্তে, পুজোয়, ফেস্টে মনে হত এই বার কিছু হবে, কিন্তু হত না। তার পর বেঙ্গালুরুর অফিস, আরও ভয়ঙ্কর জায়গা। পাঁচতলা বিল্ডিং-এর আমরা তৃতীয় তলায় বসতাম। টিম তো ছেড়েই দিলাম, গোটা ফ্লোরে কোনও মেয়ে ছিল না। আমি অরকুটে প্রোফাইল খুললাম কিছুটা মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্যই। মাঝে মাঝে মনে হত সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গল্পের ম্যাট্রিক্সে ফেঁসে গেছি। পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি, তবু কোথাও কোনও নারীচরিত্র চোখে পড়ছে না।

আসলে নেই ‘অপর্ণা’

এখন মনে হয়, এই যে একটা আশ্চর্য বেঁচে থাকা যেখানে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছি, কিন্তু কিছুতেই করে উঠতে পারছি না, সেখান থেকেই জন্ম নেয় যত রকমের ভুলভাল আইডিয়া। গানের পর গান লিখছি, কবিতার পর কবিতা, ব্লগের পর ব্লগ, কিন্তু অতৃপ্তি যেন যেতেই চায় না। নারীদের ঘিরে তৈরি হতে থাকে বিস্ময়কর সব গল্প। প্রেম তো নয়, যেন এক বিশাল রহস্য করতে নেমেছি।

কবিতা, উপন্যাস, সিনেমা গোগ্রাসে গিলে কিছুটা বুঝে, বাকিটা বদহজম হয়ে নিজেকে কখনও বঙ্কিমের নবকুমার মনে হত, আবার কখনও মার্কেজ়ের ফ্লোরেন্টিনো আরিতজা। বাস্তবে কেউ ভ্রু-পল্লবে ডাক দেয় না। কিংবা হয়তো ডাক দিয়েছে, বুঝতে পারিনি বা আমার ইচ্ছে করেনি সাড়া দিতে।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রটির (অপর্ণা নাম ছিল মনে হয়) মতো প্রেমিকা খুঁজে বেড়াতাম। এ জিনিস যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সে আমাকে কে বোঝাবে? বাস্তবে একটা অসীম (সৌমিত্র), একটা শেখর (রবি ঘোষ) এমনকি একটা দুলি (সিমি গারেওয়াল) পাওয়া গেলেও অপর্ণা কিন্তু এক্সিস্ট করে না। তখন কেউ বললে অবশ্য মানতে চাইতাম না। মনে হত, নিজে পায়নি তাই আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছে। যাই হোক, রাত জেগে জেগে এক সময় প্রচুর চ্যাট করেছি। পরে উপলব্ধি করেছি— চ্যাটে প্রেম করে যেই জন, সেই জন আসলে গর্দভ। দীর্ঘ দিন এক ছাদের নীচে থেকেই যেখানে মানুষ চেনা প্রায় অসম্ভব, সেখানে চ্যাটে তো একুশটা মুখোশ এঁটে দুটো মানুষ কথা বলে। হাল্কা ফ্লার্ট চললেও চলতে পারে, কিন্তু গভীর কিছু ঘটে যাওয়া কপালের ব্যাপার। আসলে নাবিক প্রেমিক বন্দর খুঁজছে, কিন্তু বন্দর বলে যেটা চালানো হচ্ছে, তা আসলে নৌকা বাঁধার ঘাট। এখানে নাবিকের বোকামি হল বন্দরের খোঁজ করাটা, কারণ কথায় আছে, একটি জাহাজ অবশ্যই বন্দরে নিরাপদ, কিন্তু জাহাজ তো আর সেই জন্য তৈরি হয় না। অতএব যাত্রা চলতে থাক।

ধ্রুবতারা থেকে ভিনদেশি তারা

যাই হোক, বিয়াল্লিশটা বসন্ত কাটিয়ে এই কয়েক বছর আগে নিজেকে বুঝিয়ে বলেছি, বাস্তবে ফিরে এসো ভাইটি। কিন্তু বাস্তব মানে কী? কোনটা সত্যি? কোনটা স্রেফ গুলবাজি? আমি তো ছাই কিছু বুঝতে পারি না। আমরা আসলে একটা মানুষের থেকেও বেশি তার একটা ইমেজের প্রেমে পড়ি। আমার কল্পনায় মা সরস্বতীর ভাবমূর্তি এক রকম, কিন্তু আসলে কি তাই? সরস্বতী আসলে কী রকম? আমি তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, কিন্তু তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে? হয়তো প্রথম প্রথম ভালই লেগেছিল ধ্রুবতারা, কিন্তু পরে মনে হয়েছে না, আমি তো আসলে ভিনদেশি তারা। কবি বলছেন, ‘আমারও পরান যাহা চায়, তুমি তাই গো!’ আমি প্রশ্ন করছি, সত্যি কি তাই? এক, আমি কি জানি আমি কী চাই? দুই, জানলেও যা দেখছি তা ঠিক দেখছি কি? রাজনীতিকরা এই জিনিস সব চেয়ে ভাল বোঝে। নেতারা যতই চুরি করুক, দাঙ্গা লাগাক, গায়ের জামাটা কিন্তু সব সময় সাদা। কারণ মানুষ ওই নতমস্তক, করজোড়ে প্রণামের ভাব-ভঙ্গিটাই বারবার দেখতে চাইবে আর প্রেমে পড়বে। সিনেমা জঘন্য, কিন্তু ট্রেলার বানানোয় আমরা ওস্তাদ। কারখানা নেই কিন্তু সামনেই একটা বিশাল প্রবেশদ্বার।বাইরে থেকে দেখে মনে হবে বাপ রে বাপ! কী না কী হয়, ভিতরে ঢুকে দেখবেন বেড়াল আর কুকুরে লুকোচুরি খেলছে।

প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা চরম জটিল। কারণ প্রেম যুক্তিহীন। সেই যুক্তিহীনতাকে নিজের মনগড়া ন্যায্যতা পাইয়ে দিয়ে তার পর আমরা স্যাট করে অন্ধ হয়ে যাই। ব্যস! এবার অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত? তখন স্বয়ং রবি ঠাকুর এসেও যদি বলেন, ‘বৎস ভুল করছ, ফাঁদে পড়ছ...’ প্রেমিক রবীন্দ্রনাথকেই সন্দেহের চোখে দেখবে। আমার প্রেমকে সন্দেহ? ওই প্রেম যে করে, সে জানে। এক একটা সময় যায় যখন প্রেমিক, প্রেম এবং ভক্তি গুলিয়ে ফেলে। আসলে মানুষ একটু বিশ্রাম চায়। এমনিতেই জীবনে এত ঝামেলা, এত পরিশ্রম, কোথায় গেলে যে একটু পাখির নীড়ের মতো চোখ পাওয়া যায়? দুনিয়ায় সবার কাছে ঠকতে ঠকতে একটা জায়গায় এসে মনে হয় এবার ব্রেনটাকে পাশে খুলে রেখে একটু জিরিয়ে নিই। কিছুতে একটা বিশ্বাস করি। যার যে রকম পছন্দ, নারী, পুরুষ, অলৌকিক বাবা, ময়লা জল, ঝাঁটা যা হোক কিছুতে একটা। অন্ধ ভক্তরা যেমন ভয়ঙ্কর, অন্ধ প্রেমিকও কিছু কম যায় না। তফাত শুধু, অন্ধ প্রেমিক মূলত নিজের ক্ষতি করে (আর হাতে গোনা কিছু কাছের মানুষের যারা তার প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী), অন্য দিকে অন্ধ ভক্ত নিজের সর্বনাশ তো করেই, অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।

পিছল রাস্তার রেলিং

প্রেম, ভক্তি সব এক ধরনের অদ্ভুত নেশা। নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলো কোনও কাজে দেয় না, একমাত্র ওষুধ প্রত্যাখ্যান। তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো! গুরু, সে তো বুঝলাম। কিন্তু তার পর কী? দুঃখু-টুক্ষু পেয়ে এবার কি প্রেমিক মোহমুক্ত হতে পারবে? ভক্তির প্ল্যান রিনিউ করাবে? রিহ্যাব থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আবার নেশা করবে? একটা পার্ট টু থাকলে বড় ভাল হত। জীবন বড় কঠিন। পথের শেষ কোথায়? তুমিই তো বলেছ ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়, আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী’... কিন্তু কে আমারে চায়? কেউই তো চায় না আমায়। কেউ পথ দেখায় না। পথ দেখাতে কারও বয়ে গেছে। একটাই সত্য, ঠকতে ঠকতে শেখো। প্রেম থাকলে সেই পথটাই সহজ হয় অনেক। পিছল রাস্তায় একটা রেলিং-এর মতো। সেই রেলিং খসে গেলেই আছাড়। হাত-পা ভাঙলে ভাঙবে, কিন্তু আবার উঠে দাঁড়াতে হয়।

প্রেমের আর এক মূল সমস্যা হল, কিছুতেই সার্কিট ক্লোজ়ড হয় না, অর্থাৎ ক প্রবল ভালবাসে খ-কে কিন্তু খ অতটাও বাসে না ক-কে। খ-এর আবার পছন্দ গ-কে। এদিকে গ-এর রয়েছে এক বাগদত্তা টাইপের ঘ, যে কী চায় কেউ জানে না। এই ভাবে একটা লম্বা প্রেমের তার তৈরি হয়, এক শহর থেকে আর এক শহর, আমেরিকা থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে ইউরোপ। সবাই প্রেমে কিন্তু সবাই অতৃপ্ত, কারণ সার্কিট ওপেন। এই প্রেমের অতৃপ্তিই কিন্তু মানবসভ্যতার একটা বড় চালিকা শক্তি। যত দিন এই অতৃপ্তি রয়েছে, রাজারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে গেছে, কবিরা খাতার পর খাতা কবিতা লিখে ফেলেছে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষে ডুয়েল লড়েছে, না পাওয়ার যন্ত্রণায় মানুষ উন্মাদ হয়ে গেছে আরও এ রকম কত কিছু। মিলনে ব্যর্থ কাতর কত প্রেমিক-প্রেমিকা গলায় দড়ি পর্যন্ত দিয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে লোকমুখে ভৌতিক গল্পে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এর থেকে বোঝা যায় প্রেমের অতৃপ্তি মানুষকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের সামনে এনে ফেলে। সে ভাবে, তা হলে জীবনের মানে কী? আমি তো এত দিন ধরে জানতাম জীবনের মানে প্রেম। আমি যাকে এতটা ভালবাসি, সে যদি আমাকে ভাল না-ই বাসে, তা হলে তো এ জীবন অর্থহীন, এর চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়। অর্থাৎ জীবনের একটাই অর্থ, প্রেম ঠিক নয়, প্রেমে সাফল্য— আমি যাকে ভালবাসি তার থেকে যেন ভালবাসা ফেরত পাই। এখানে সাইকায়াট্রিস্ট কিংবা থেরাপিস্ট ছুটে এসে বোঝাবে ‘না, না, না সুইসাইড কোরো না! এ ভাবে ভাবো, জীবনে দুঃখ পাওয়ার আরও কত রকম উপায় খোলা রয়েছে, সেগুলো চেষ্টা করে দেখো!’ মহাপুরুষ বলবেন, ‘প্রেমে কি হার-জিত, পাশ-ফেল হয় গো? তুমি যে এক তরফা প্রেম করেছ তাই নিয়ে তুমি তার বিরহে বিলীন হয়ে থাকো, দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।’ কিন্তু ঠাকুর, আমি তো মানুষ। আমি কি পারব? এ ভাবে বুকে ব্যথা নিয়ে চললে তো দু’দিনে পটল তুলব। জীবন বেশি দামি? না প্রেম? কেউ উত্তর দেয় না।

প্রেমের শেয়ার বাজার

আজকাল আমি শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে প্রেমের খুব মিল পাই। মাঝে মাঝে মার্কেটে ইউফোরিয়া চলে, বুল মার্কেটের সময়। সব শেয়ার, ভাল কোম্পানি, ঝরঝরে কোম্পানি সবাই পাঁইপাঁই করে ঊর্ধ্বগামী। প্রেমের ভাল সময়ের মতো, যাই করছে ভাল লাগছে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠলেও মনে হয়, উফ! কী কিউট! দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলে মনে হয়, উফ! কী সাহস! ক’জন পারবে বসের মুখে রেজ়িগনেশন লেটারটা ছুড়ে মারতে? প্রেমিক সারাদিন নেশা করে পড়ে থাকলেও কী ভাল যে লাগে তখন! আহা, ওর যা ট্যালেন্ট, ওর এ সব একটু লাগে। যে দিন কাজে হাত দেবে, অবন ঠাকুর-ও ঝাপসা হয়ে যাবে। আসল চেহারা চেনাবে বেয়ার মার্কেট। দুধ কা দুধ, পানি কা পানি। মাসে মাসে ২০-৩০ শতাংশ করে যখন পড়বে, তখন ব্যথা কাকে বলে বোঝা যাবে। অতিমূল্যায়িত স্টক কিংবা ঝরঝরে কোম্পানির স্টক ধরে বসে থাকার যন্ত্রণা টের পাওয়া যায় তখন। প্রেমের শুরুতে যে বেশি উড়েছিলে, এ বার একদম সাইজ় করে দেবে। যাকে ভেবেছিলে বিশাল ট্যালেন্টেড, একটু নেশা-টেশা করে আর কি, তাকে চিনতে পারবে বেয়ার মার্কেটে। সে আসলে নেশাটাই করে। মূল ট্যালেন্টটা হাবভাবে, প্রিটেনশনে। ওরে বাবা রে! কী হয়ে গেল এটা? বাবা তা হলে ঠিক-ই বলেছিল, ছেলেটা সুবিধের নয়।

তবে নিজের ভুল মন থেকে মেনে নেওয়া কি সহজ? তখন সে নিজেকে বোঝাবে, অপদার্থ হতে পারে কিন্তু মানুষটা আসলে ভাল। অর্থাৎ ভাবছেন মার্কেট বটম আউট করছে। এইখানে আরও কিছু লগ্নি করা উচিত। কিন্তু আবার ভুল হয় কারণ, নেভার ট্রাই টু ক্যাচ আ ফলিং নাইফ। এটি মার্কেটের বটম ছিল না। কিছু দিন বাদে জানা যায়, ছেলেটি গায়ে-ও হাত তোলে। অর্থাৎ মানুষটিও ভাল নয়। শেয়ার প্রাইস আরও ২০ শতাংশ ক্র্যাশ, আরও তলানিতে। এ কী সর্বনাশ হল রে বাবা! এ তো আচ্ছা ফাঁসান ফাঁসলাম। কিন্তু প্রেম তো মানুষকে অন্ধ করে রাখে। গুরুদেব বলেছেন, ‘তুমি ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো!’ অতএব মার খেতে খেতে, বিশ্বাস রাখো। আচ্ছা বেশ, রাখলাম। এ বার মার্কেট উঠবেই। কিন্তু সখী, ভালবাসা কারে কয়? তলপেটে ঢিসুম! ঢিসুম! ঢিসুম! জানতে পারলে ব্যাটার আর একটা সংসার আছে অন্য পাড়ায়! প্রেম লোয়ার সার্কিট মারল!

আরামদায়ক অসাড়তা

যখন তুমি ভাবছ এর চেয়ে বেশি যন্ত্রণা আর কী-ই বা হতে পারে, ঠিক তখনই প্রেম এসে দরজায় কড়া নেড়ে চিনিয়ে দেবে পরের স্তরের যন্ত্রণা। আমার ‘হ্যারি মেট স্যালি’-র একটা দৃশ্য মনে পড়ে। স্যালি এক রাতে কাঁদতে কাঁদতে হ্যারিকে ফোন করে ডাকে। এর আগেই আমরা দেখেছি স্যালির ব্রেক-আপ হয়েছিল। কারণ হিসেবে স্যালি জানত যে তার প্রাক্তন, তার সঙ্গে দীর্ঘ দিন থেকেও বিয়ের বাঁধনে জড়াতে চায়নি আর স্যালি চেয়েছিল, তাই তারা সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিল। এবং এই বক্তব্যকে সত্যি ধরে নিয়ে স্যালি ব্রেক-আপটিকে অনেকটা মেনেও নিয়েছিল। হ্যারিই বরং নিজের শূন্যতার সঙ্গে সংগ্রাম চালাচ্ছিল। সেই রাতে স্যালি হঠাৎ খবর পায় তার প্রাক্তন বিয়ে করতে চলেছে! স্যালি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। স্যালির সামনে সব কিছু আবার কেমন ঝাপসা হয়ে যায়। তা হলে কি মানুষটা আমাকে মিথ্যে বলেছিল? অন্য এক জনকে যখন সে বিয়ে করছে তার মানে ‘বিয়ে’-তে তার আপত্তি ছিল না। আমাতে আপত্তি ছিল। অর্থাৎ রিজেকশন! অন্ধকার সরু গলিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্যালি এবং প্রত্যাখ্যান। আমাকে তা হলে তো সে কোনও দিনই সে ভাবে ভালবাসেনি, কিন্তু আমরা যে অতগুলো বছর একসঙ্গে থাকতাম? তা হলে এত দিন স্রেফ বোকা বনলাম? অন্যের কষ্টে মানুষ কাঁদে ঠিকই, কিন্তু নিজের অপমানে, যন্ত্রণায় মানুষ ভেঙে পড়ে। নিজে এ ভাবে ঠকে গেলে, তখন কাউকে দোষ দেওয়ার থাকে না। দোষ তো নিজেরই। বুঝতে পারা যায়নি। প্রেম তো অন্ধ করে রাখে। সত্যিকারের প্রেম তো এ রকমই হওয়ার কথা। এটাই ভালবাসা। আর হার্টব্রেক না হলে আর জীবন কী?

ভালবাসার মানুষকে বিশ্বাস করার মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই। যদি বিশ্বাসই না করতে পারি, তা হলে আর ভালবাসা কী? তা হলে তো আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো এটাও ঠুনকো, এটাতেও সন্দেহ মেশানো। তাই চার দিকে যখন মানুষ শুধু ঘৃণা ছড়াতে ব্যস্ত, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে ব্যস্ত তখন প্রেম, ভালবাসা নিশ্চয়ই একটা বিশ্বাসের জায়গার জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যেখানে মানুষ নিজেকে সুরক্ষিত বলে মনে করে। তবে জীবন অনেক বড়। আমার মনে হয় আর কুড়ি বছর বাদে আমি হয়তো জীবন, প্রেম সব কিছুকে অন্য ভাবে দেখব। এখনই খুব জোর দিয়ে বলা, যে আমি প্রেম, ভালবাসার অনেক কিছু বুঝে গেছি, বোধহয় বোকামি হবে। ওটা বাইশ বছরে মনে হত। আমার এখনও অনেক কিছু দেখা বাকি, শেখা বাকি। পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্সের লেখা অমোঘ দু’টি শব্দ ‘কম্ফর্টেবলি নাম্ব’ আমাদের বেঁচে থাকাকে খুব দারুণ ভাবে বর্ণনা করে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আমরা যখন প্রত্যেকেই অল্প অল্প অসাড় হতে বসেছি, ঠিক তখনই এলিয়টের বসন্ত হানা দেয়।

হ্যাঁ, আবার বসন্ত এসে গেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

spring

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}