ঠিক বেলা দশটায় ঘুম ভাঙল জনমেজয় চাটুজ্জের। শরীরের অবসাদ অনেকটাই কেটেছে ঘুমে। গতকাল বেশ কয়েকবার ওআরএস খেয়ে আর উপোস করে ভাল লাগছে, হালকা লাগছে। মোবাইল খুলে দেখলেন, আর ও সাহেব ফোন করেছেন। মোটাসোটা ভালমানুষ। রিংব্যাক করলেন জনমেজয়, “বলুন সাহেব!”
ওপার থেকে দীপঙ্কর ঘোষসাহেবের গলা, “আর বলবেন না! সারা রাত হাওড়া স্টেশনে কাটল।”
“কেন!” জনমেজয়বাবু বললেন।
“ট্রেনটা এত দেরি করল যে বলার কথা নয়! চন্দননগর যাওয়ার শেষ ট্রেন চলে গেছিল।”
“এ বাবা! খুব কষ্ট হল তো আপনার!”
“হ্যাঁ... তা তো হল।”
“এখন কোথায়?”
“বাড়িতে। চন্দননগরে।”
জনমেজয় এবং দীপঙ্কর— দু’জনেই একটি ক্ষয়িষ্ণু দফতরে কাজ করেন, রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন। ঘোষসাহেবের অবস্থান বেশ খারাপ। অফিসার বলে মনেই করেন না উপরমহল। কথায় কথায় অপমানিত হন। আর বছর দুই চাকরি আছে। ভাল মানুষ, খুব অভিমানী। কথায় কথায় কেঁদে ফেলেন এই রিহ্যাবিলিটেশন অফিসার।
“আগামী কাল অফিসে আসতে পারবেন!”
“আসতে তো হবেই।”
“আমাদের যিনি ইমিডিয়েট বস, লেখক মানুষ, সংবেদনশীল। আমি বলে রাখব, আপনি আসছেন।”
“খুব ভাল হয়। আমি কি স্যরকে ফোন করব!”
“করুন না!”
“কেমন ব্যবহার করবেন!” ঘোষসাহেব আবার উৎকণ্ঠাপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
“ভাল ব্যবহারই করবেন।”
জনমেজয়বাবু বললেন, “এক দিনের ছুটির জন্য ভাববেন না। আর কিছু বলবেন!”
“হাওড়া প্ল্যাটফর্মে ঘুম মন্দ হয়নি।স্বপ্নও দেখেছি।”
“কী স্বপ্ন!”
“শুধু স্বপ্ন নয়, গন্ধও পেয়েছি।”
“কিসের গন্ধ!”
“কেয়া ফুলের।”
“কেয়া পাতা জানি, কিন্তু কেয়া ফুল মনে করতে পারছি না।”
“ছেলেবেলায় মা আমাকে স্কুলের নাটকে কেয়া পাতার মুকুট দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল এক বার।”
“অভিনয় করেছিলেন!”
“ওই ছেলেবেলায় যেমন হয় আর কী!”
জনমেজয় ভাবছিলেন, চেহারাটা মন্দ নয় ঘোষসাহেবের। প্রবীণ সম্রাট আকবর বেশ মানাবে। গলাটাও ভাল।
“অভিনয় করবেন!”
“না, না। কোথায় আর করব!”
“আমাদের বীণাপাণি অপেরায়। আপনাকে সম্রাট আকবর বেশ মানাবে। কিছু মনে করবেন না স্যর, আপনার এই দীন-দুঃখী ভাবটা কেটে যাবে। আপনি নিজেকে সম্রাট আকবর ভাবতে শুরু করবেন। অভিনয়ের অনেক সুফল, স্যর।”
ঘোষসাহেব বললেন, “তার পর আবার শো-কজ় করবে আমায়!”
“মঞ্চে আপনি সম্রাট। ওদের শো-কজ়ে আর কিছু এসে যাবে না আপনার। করবেন?”
“আমি কি পারব!”
“পারবেন। আমি তো আছি।”
ফোনটা রাখলেন জনমেজয়বাবু। লোকটি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন। কত অভিনেতা তৈরি করেছেন তিনি! স্বপ্ন দেখিয়েছেন রাজা হওয়ার।
ঘরটা খুব অপ্রশস্ত। আলো-হাওয়ার প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ। তবু খুপরির জানলাটা খুললেন। বাইরে এখন রোদের তেজ তীব্র। আষাঢ়ের পয়লা হয়ে গেলেও বৃষ্টির দেখা নেই। মুখটা ধুয়ে নিয়ে আয়নার সামনে এলেন।
বাবরি-করা চুলে কত না সম্রাট আর নবাবের অভিনয় করেছেন। এই সে দিনও নিমাই করলেন! বিষ্ণুপ্রিয়া কয়েক দিন আগে চিঠি লিখেছিল, ‘রথ তো এসে গেল, নতুন পালা কি হবে!’
মনে পড়তেই মনটা নেচে উঠল। চিৎপুর। বড় ফণীবাবু, ছোট ফণীবাবু... একের পর এক নটসম্রাটদের ছবি ভেসে উঠল। বড় ফণীবাবুর চেহারা ছিল ছবি বিশ্বাসের মতো। গলাও তেমনই। আর ছোট ফণীবাবু ছোটখাটো, কিন্তু গলা আর অভিনয় অসাধারণ।
এই সময় চিৎপুর লোকে লোকারণ্য থাকত। কত মানুষের ভিড়। যাত্রার নট-নটী, ম্যানেজার, সবাই ব্যস্ত। নতুন পালাকার তখন ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। আহ! কী লেখা! ‘অচল পয়সা’।
নিজের অন্ধকার ঘরটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কেমন যেন হরিপদ কেরানি মনে হয় জন্মেজয়ের। আর বার বার সাজঘরের কথা মনে হয়।
দরজায় একটা টোকা পড়ে আর নরম আওয়াজ, “সাহেব, চা।”
জনমেজয়বাবু বলেন, “আয় ফুচু।”
ফুচু চা নিয়ে আসে।
এই দশ-এগারো বছর বয়স হবে ছেলেটার,এই বয়সে খাটা বেআইনি। এক দিন ওর মাকেডেকে বলেছেনও।
ওর মা বুদ্ধিমতী, বাড়ি-বাড়ি কাজ করে। স্বামী মারা গেছে।
বলেছে, “বাবু ও কাজ না করলে পেট চলবে কী করে! তোমার যাত্রার দলে নেবে! অ্যাক্টো করবে। ছেলেটা তো সোন্দর দেখতে! যেন গোপালঠাকুর!”
চুপ করেছিলেন জনমেজয়। দীর্ঘশ্বাস উঠে এসেছিল বুকের গভীর থেকে। এক দিন কত সহজ ছিল যাত্রায় কাউকে কাজ দেওয়া।
ফুচু চা দেয়।
জনমেজয় বলেন, “অভিনয় করতে ইচ্ছে হয়!”
ফুচু বলে, “আমায় সিনেমায় নেবে!”
“না, যাত্রায়। যাত্রা দেখিসনি!”
ফুচু মাথা নাড়ে।
“তোর মামার বাড়ি চন্দ্রকোণা রোডে তো!”
ফুচু বলে, “হ্যাঁ।”
“সেখানে কত যাত্রা করেছি এক কালে!”
ফুচুর আনা চায়ে চুমুক দেন জনমেজয়। মনটা একটু দূরে চলে যায়। চায়ে এক ধরনের মৌতাত তৈরি হয়। বিড়িতে সুখটান দিলেও হয়। তবে তিনি বরাবর বিড়ি ফুঁকতে পছন্দ করেন না। এক সময় সিগারেট টানতেন। তখন তিনি নটসম্রাটদের এক জন। পোস্টারে লেখা থাকত, ‘নামভূমিকায় সুদর্শন নায়ক জয় চ্যাটার্জি’।
ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, জনমেজয়বাবু বললেন, “এ বার বিষ্ণুপুরে সোজা রথ হবে। যাত্রাও হবে, ‘নটী বিনোদিনী’।”
ফুচু বলল, “বাপনদা ছাড়লে যাব।”
জনমেজয় বললেন, “ঠিক আছে, আমি বাপনকে বলে তোকে নিয়ে যাব।”
খুশি হল ফুচু। যদিও সে এখনও জানে না যাত্রা কেমন জিনিস। পৌরসভার হল-এ হবে। পৌরসভার কর্মীরা করবেন। হাতে সময় নেই। মাঝে মাঝে জনমেজয় রিহার্সালে গেছেন। প্রম্পট করেছেন।
যাঁরা করছেন, এঁরা কেউ তাঁকে চেনেন না। তিনি বীণাপাণি অপেরার একদা স্টার জয় চ্যাটার্জি।
চা-পান শেষ হলে জনমেজয় স্নানঘরে যান। রোববার হলেও অফিস যেতে হবে। নির্বাচন চলছে। স্ট্রং রুমের দায়িত্ব ওঁর। ওখানে কয়েকটি ট্রাঙ্কে নমিনেশনের কাগজপত্র রয়েছে। জেলা পরিষদের মনোনয়ন মহকুমাশাসকের অফিস থেকে হচ্ছে।
মাথায় জল দিতে দিতে একটু গেয়েও নিলেন জনমেজয়, ‘শচীমাতা গো, ঘুমাও তুমি ঘুমাও তুমি—আমি চলে যাই।’
এই অপ্রশস্ত মেসবাড়ির ঠিক উল্টো তাঁর পুরুলিয়ার বাড়ি।
দশ দাদুর একান্নবর্তী বাড়ি ছিল তাঁদের। শাণ-বাঁধানো খড়ের কোঠাবাড়ি। সকলে বলত বড়ঘর। সেই ঘরে বসে ছাঁচিপান থেঁতো করে মৌতাত জমাতেন বড়বুড়ি, ছোটবুড়ি আর বিস্তর অন্দরমহল। জমি বলতে বাইদ আর কানালি। চাষ করত রাখাল বাগাল মুনিষ। তাদের কোনও অর্থব্যয় দেওয়া হত না। সেই রাখাল-বাগালেরা সপরিবার এই বাড়িতেই দু’বেলা খেত। সকালে সবার এক সঙ্গে মুড়ি টিফিন হত ধামা করে। সাধারণত জলে ভিজিয়ে,কখনও কখনও ঠাম্মা চপ ভাজত। সেই গন্ধে ম-ম করত উঠোন।
ভূতমুড়ি চাল ছিল চালের সেরা।
সেই ধোঁয়া-ওঠা ভূতমুড়ি চালের ফেনাভাত, আলুসেদ্ধ আর গরম চচ্চড়ি ছিল যেন অমৃত-ব্যঞ্জন। যাত্রাদল ভোরবেলা অন্য গ্রামে রওনা দেওয়ার আগে পেট ভরে খেয়ে নিত। রুখা জায়গা, এর চেয়ে বেশি কী আর জুটবে! তাই কত খেয়েছেন বড় ফণী আর ছোট ফণীর মতো যাত্রাদলের স্টারেরা! এমন কি নায়িকা জ্যোৎস্নাবালাও ছিলেন সেই ধোঁয়া-ওঠা ভূতমুড়ি চালের ভাতের ভক্ত।
“কোথা তুমি ভারতসম্রাট শাহজাহান!”
সে কী গলা ছিল জ্যোৎস্নাদেবীর! মঞ্চ যেন কেঁপে-কেঁপে উঠত।
রাজা পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয়। পরীক্ষিৎ তক্ষকের দংশনে মারা যান। আর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সর্প-সংহার যজ্ঞের আয়োজন করেন জনমেজয়। সে এক বিরাট কাহিনি। সর্পনিধন থেকে ব্রাহ্মণ নিধন— রাজা তখন ক্রোধে অন্ধ। অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। কিন্তু কলিকালে যে অশ্বমেধ যজ্ঞ করা যায় না! শেষমেশ ক্রোধ প্রশমনের জন্য এলেন ব্যাসদেব। ব্যাসদেব বললেন, “যে পাপ তুমি করেছ, তার থেকে মুক্তির উপায় মহাভারত পাঠ।”
ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন মহাভারত পাঠ করে শোনাবেন। মাথার ওপর কালো চাঁদোয়া টাঙানো হল। মহাভারত পাঠ শ্রবণ করলেন বৈশম্পায়ন। দিন যায়, মাস যায়, ঋতু আসে, ঋতু যায়, চাঁদোয়ার রঙের পরিবর্তন হয়।
কালো রং করা হয়েছিল চাঁদোয়ায়। তার পর সম্পূর্ণ মহাভারত শ্রবণে সেই কালো চাঁদোয়া শুভ্র বর্ণে রূপান্তরিত হল।
শুভ্র এসেছে, “স্যর চলুন। বাক্সগুলি ট্রেজারি থেকে বার করতে হবে।”
জনমেজয় বললেন, “পুলিশ এসেছে!”
শুভ্র বলল, “হ্যাঁ স্যর।”
“এটিও স্যর আছেন!”
“আছেন স্যর।”
ট্রাঙ্কের নম্বর মিলিয়ে ছাড়তে লাগলেন জনমেজয়বাবু।
আহা, কোথায় যেন কেয়া ফুল ফুটেছে! গন্ধ আসছে নাকে। বহু পুরনো বিল্ডিং ট্রেজারি। তা হলে তো সাপও রয়েছে! কিন্তু ঘোষসাহেব হাওড়া স্টেশনে কী করে পেলেন কেয়া ফুলের গন্ধ!
স্মৃতি! দু’জনকেই স্মৃতি তাড়া করছে!
ট্রাঙ্ক একে একে ঢুকছে রুমগুলিতে। এখন কিছু করার নেই। কাজ শুরু হয়েছে।
দুপুরে ভাত খেতে যেতে হবে। সেলসম্যান গোবিন্দ সব কিছু দিয়ে একটা রান্না করে রাখবে। আজ মনে হবে যেন ভূতমুড়ির চালের ভাত খাচ্ছেন। স্মৃতির ভূতমুড়ি চাল।
রিং হচ্ছে মোবাইলে।
২
ঘোষসাহেব ফোন করেছেন।
জনমেজয় ফোন ধরলেন, “হ্যালো, বলুন।”
“কেয়া ফুলের গন্ধ যে পেয়েছিলাম, তারকারণ বলি।”
জনমেজয় হেসে বললেন, “বলুন।”
“হাওড়া স্টেশনে খয়ের দেওয়া পান, দুটো কিনেছিলাম। ওতে কেওড়া বা কেয়া ফুলের রস দেওয়া হচ্ছিল। সেই গন্ধের সুবাস বুকপকেটেনিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।”
জনমেজয় বললেন, “বেলাকুঁড়ির কথা বলেছিলাম আপনাকে!”
“মনে পড়ছে। তবে সবটা নয়।”
জনমেজয় স্মৃতিতে ঝাঁকি দিলেন। তাঁর একটু একটু করে মনে পড়ল, “ছাতনার বেলাকুঁড়িতে নরসিংহ বাঁধের কাছে কেয়া ফুলের গাছ দেখেছিলাম। বেশ একটা উগ্র গন্ধ, কিন্তু সুন্দর। আমাদের যাত্রাদলের আনোয়ার কেয়া ফুল কানে গুঁজে রাখত। নরসিংহ বাঁধে প্রচুর সাপও ছিল, সবাই বলত কেয়ার গন্ধে সাপ আসে।”
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)