Advertisement
১৯ মে ২০২৪
এক জন সম্রাট অশোকের আমলের। অন্য জন একেবারে হাল আমলের। এক রাতে আচমকা সংসদ ভবনের মাথায় দুই পশুরাজের দেখা। ‌আড়ি পাততেই শোনা গেল তাদের আশ্চর্য কথোপকথন!
Bengali Story

দুই সিংহের গপ্পো

হঠাৎ চোখে পড়ল সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই রকম একটি মূর্তি। চারটি সিংহ, যেন দেশের চার প্রান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চেহারায় তেমন হিংস্রতা নেই।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২২ ০৫:৩২
Share: Save:

দিল্লিতে পূর্ণিমার রাত। সংসদ ভবনের মাথায় বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল নব্য প্রতিস্থাপিত জাতীয় প্রতীকের চারটি সিংহের। কাঁহাতক আর ওই রকম বিকট হাঁ করে থাকা যায়! ঝিমুনিও এসে গিয়েছিল। হঠাৎই চোখে পড়ল সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক একই রকম একটি মূর্তি। চারটি সিংহ, যেন দেশের চার প্রান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চেহারায় তেমন হিংস্রতা নেই। তবে তাদের গম্ভীর মুখ দেখলে মনে সমীহ জাগে।

নব্য প্রতীকের একটি সিংহ বলে ওঠে, “কে রে ওখানে?”

ও দিকের সিংহরা উত্তর দেয়, “আমরা অশোক স্তম্ভের সিংহ। সারনাথের মিউজ়িয়াম থেকে এসেছি। তোদের দেখতে।”

নব্য: কেন, আমাদের দেখার কী আছে?

সারনাথ: তোদের নিয়ে যা সব শুরু হয়েছে! সব দেখেশুনে তো আমাদেরই মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়। তাই ভাবলাম, একটু দেখে যাই।

শুনেই রাগে ফের দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে নব্য প্রতীক।

নব্য: শুনুন, পূর্বসূরি বলে সম্মান দিচ্ছি। তবু বলি, আপনারা বাতিল। এখন দেশের মুখ আমরা।

সারনাথ: বাতিল কি না, সে তো সময় বলবে। তবু বলি, ভারতের যে ঐতিহ্য, তা আমাদের মধ্যেই বিদ্যমান। তোদের ওই দাঁতখিঁচুনি ছাড়া কী আছে?

নব্য: কী বলছেন জানেন? বুড়ো বয়সে কি জাদুঘরের বদলে শ্রীঘরে যেতে চান?

সারনাথ: সে তোরা ইচ্ছে করলে পাঠাতেই পারিস। দেশের জ্যান্ত মানুষদের ধরে জেলে পুরছিস! আমরা তো পাথুরে মূর্তি।

নব্য: ও সব ছাড়ুন, কাজের কথা বলুন।

সারনাথ: আমরা কার প্রতীক জানিস?

নব্য: মৌর্য সম্রাট অশোকের। সারনাথ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আপনাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

সারনাথ: ইতিহাসও শিখেছিস দেখছি! যাক তা হলে মাথায় পুরো গোবর পুরে দেয়নি।

নব্য: গোবর খারাপ নয়। গোবর থেকে ঘুঁটে হয়। ঘুঁটে উনুন জ্বালাতে লাগে।

সারনাথ: শুধু উনুন নয় রে, আজকাল দেশ জ্বালাতেও লাগে।

নব্য: কী বললেন? আর এক বার বলুন দেখি!

সারনাথ: যাকগে সে সব কথা। আসল কথা বলি। সারনাথে আমরা এলাম কী করে জানিস? সম্রাট অশোক আমাদের স্থাপন করেছিলেন। তার পর শতকের পর শতক কেটে গেল। ভেঙেচুরে আমরা তো মাটি চাপাই পড়ে গিয়েছিলাম।

নব্য: তা বেরোলেন কী ভাবে?

সারনাথ: ফ্রেডরিক অস্কার ওর্টেল বলে এক সাহেব ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ১৮৯০-এর দশকে তিনি তৎকালীন বর্মা এবং মধ্য ভারতে হিন্দু এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যের সমীক্ষা করেছিলেন। ১৯০৪ সালে স্যর জন মার্শাল সেই ওর্টেল সাহেবকেই সাঁচীর খননে নিযুক্ত করলেন। সাহেব খুঁড়তে খুঁড়তে প্রথমে একটি স্তম্ভের ভাঙা একটি অংশ পেলেন। কিন্তু তখনই আমাদের খোঁজ পাননি। শেষে আরও বিস্তৃত জায়গায় খনন শুরু করলেন এবং মাটির তলা থেকে আমাদের তুলে আনলেন।

নব্য: তার পর? কিন্তু সে তো ব্রিটিশ আমল। ওরা আপনাদের খুঁজে পাওয়ার পর নিজেদের দেশে নিয়ে চলে গেল না?

সারনাথ: না। ওই সারনাথেই মিউজ়িয়াম তৈরি করে আমাদের রেখে দেওয়া হল। তারও বহু বছর পরে দেশ স্বাধীন হল। স্বাধীন দেশ তো আর ব্রিটিশের প্রতীক ব্যবহার করতে পারে না। তাই আমাদেরই বেছে নিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তবে আমরা ছিলাম চার ভাই। কিন্তু প্রতীক তো দ্বিমাত্রিক ছবি। তাই পিছনের জনকে ছবিতে দেখা যায় না। আর নীচে মুণ্ডক উপনিষদের বাণী, ‘সত্যমেব জয়তে’ শব্দবন্ধও যুক্ত করা হল।

নব্য: এটুকুই?

সারনাথ: আরও বিশদে শুনবি? তা হলে শোন... অশোকস্তম্ভ তো বাছাই করা হল। কিন্তু প্রতীক তো আঁকতে হবে। সে সময়ে সংবিধানের চিত্র তৈরি করছিলেন আচার্য নন্দলাল বসু। তাঁকেই এ কাজের জন্য বলা হয়। আচার্য ভাবলেন, সিংহের ছবি যখন, তখন যেন জীবন্ত ব্যাপার থাকে। এক শিষ্যকে তিনি পাঠালেন আলিপুর চিড়িয়াখানায়।

নব্য: কোন শিষ্য?

সারনাথ: দীননাথ ভার্গব। বছর বিশেকের দীননাথ তখন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র। তিনি চলে এলেন আলিপুরে। দিনের পর দিন সিংহের খাঁচার সামনে বসে থাকেন। পশুরাজকে, মানে আমাদের দেখেন, শরীরের গড়ন,মুখের ভঙ্গিমা জরিপ করেন। তার ভিত্তিতেই তিনি গুরুকে স্কেচ এঁকে দিলেন। শিষ্যের কাজেই সম্মতি দিলেন নন্দলাল।

নব্য: সে তো বুঝলাম। কিন্তু তা হলেও আপনাদের চেহারা যেন কেমন কেমন!

সারনাথ: কেমন?

নব্য: কোনও রাগ নেই, আগ্রাসী ব্যাপার নেই। থম মেরে বসে রয়েছেন। আমাদের দেখুন, এক্কেবারে দাঁত খিঁচিয়ে প্রস্তুত রয়েছি। বেগড়বাই দেখলেই...আবার নীচে ওই সত্যমেব জয়-এর বাণীও নেই।

সারনাথ: সে তো বটেই। দেশে সত্যের যা জয়জয়কার দেখছি তাতে তো... এখন তো শুনি, ট্রুথ নয়, পোস্ট-ট্রুথই নাকি সব! তবে ওই হাঁ-মুখ করে দাঁতের পাটি কাকে দেখাচ্ছিস, সেটাই বুঝলাম না।

নব্য: কেন? বিরোধীদের, সমালোচকদের, শত্তুরদের। আমাদের মালিক তো আর আপনাদের ওই ধর্মাশোক হয়ে বসেনি যে, যুদ্ধ বন্ধ করে দুঃখে কাঁদতে বসবে!

সারনাথ: বাপু হে, অশোক মোটেও যুদ্ধ বন্ধ কাঁদতে বসেননি। চণ্ডাশোক বা ধর্মাশোকের ধারণা বদলে গিয়েছে।

নব্য: তা হলে ধর্মাশোক বলা হয় কেন?

সারনাথ: ধর্মাশোক শব্দটি মৌর্য আমলের কোনও সূত্রে কিন্তু নেই। তা পাওয়া যায় সারনাথ থেকে পাওয়া একটি পুরালেখতে।

নব্য: সেটি কবেকার?

সারনাথ: কুমারদেবীর সেই লেখটি অশোকের আমল থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পরের।

নব্য: আচ্ছা! তা হলে ধর্মাশোক বলা হল কেন? অশোক যে যুদ্ধ থেকে বিরতির কথা বলেছিলেন, সেটাই বা হল কেন?

সারনাথ: হুম। তার কারণ আছে।

নব্য: কী রকম?

সারনাথ: ইতিহাসবিদদের কাছে তোর প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। তবে তার আগে বলি, অশোকস্তম্ভের বিষয়ে জানা আছে? মানে, বই-টই পড়েছিস না কি শুধুই ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপ?

নব্য: দেখুন, যা বলার বলুন... ডিজিটাল মিডিয়া তুলে কথা বলবেন না।

সারনাথ: বুঝেছি, তবে শোন, অশোক ছিলেন মৌর্য সম্রাট। প্রায় সমগ্র বর্তমান উপমহাদেশ তো বটেই, দূর দূরান্তেও তাঁর প্রভাব ছিল। এই যে তোদের চণ্ডাশোক এবং ধর্মাশোকের ধারণা, তার পিছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।

নব্য: কেন? যুদ্ধ করা কি রাজনীতি নয়? দুম করে গিয়ে ঠাঁইঠাঁই করে তির ছুড়ে, সাঁইসাঁই করে তরোয়াল চালানোর দরকার নেই?

সারনাথ: প্রয়োজনে আছে, কিন্তু কথায়-কথায় যুদ্ধ করতে গেলে লাভের থেকে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। ও সব সিনেমায় ভাল লাগে, বাস্তবে নয়।

নব্য: তাই বুঝি?

সারনাথ: হ্যাঁ। শোন, বিরাট সাম্রাজ্য ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। দেশ শাসন যেমন করতে হয়, প্রজাপালনও করতে হয়। তাই শাসন করতে যেমন আমলাকেন্দ্রিক প্রশাসন প্রয়োজন ছিল, তেমনই দরকার ছিল কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে একত্রে বাঁধা প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্রাজ্যের আয়তন যদি পরিকাঠামোর থেকে বেড়ে যায়, তখনই ভারসাম্যের অভাব হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে অশোক বুঝেছিলেন, সাম্রাজ্য বিস্তার আর নয়, দৃঢ় শাসন দরকার। সেই অনুযায়ীই পদক্ষেপ করেছিলেন।

নব্য: সে সব বুঝলাম। কিন্তু তার সঙ্গে এই সিংহওয়ালা স্তম্ভের প্রয়োজন কী?

সারনাথ: তোরা জাতীয় প্রতীক করবি ভেবে তো অশোক এই স্তম্ভ তৈরি করেননি। তাঁর রাজকীয় প্রতীক হিসেবেই এর নির্মাণ।

নব্য: তা তো বটেই। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। এই চারটে সিংহের কারণ কী? পায়ের তলায় হাতি, ঘোড়া, চক্রের প্রয়োজন কেন?

সারনাথ: শোন, চরিত্র যদি দেখিস, সিংহ স্থির, গম্ভীর। প্রয়োজনে হিংস্রতম হতে পারে কিন্তু দেখলেই হামলে পড়ার প্রাণী নয়। শুধু রাজকীয় হাবভাব নয়, শাসকের যা চরিত্র হওয়া উচিত, তা সিংহের মধ্যে আছে। আমরা চার জন, চারপ্রান্তে তাকিয়ে রয়েছি। এ বার সারনাথ ছিল বৌদ্ধ ধর্মের স্থল। কাজেই একে অনেক ভাবে দেখাযেতে পারে।

নব্য: কেমন ভাবে?

সারনাথ: যদি ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে দেখিস, তা হলে রাজা চার দিকে ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার দেখ, রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে, সাম্রাজ্যের চার কোণে শাসকের সিংহদৃষ্টি রয়েছে সেটাও কিন্তু বোঝায়। ওই চার দিকের দিকপাল হিসেবেই ষাঁড়, ঘোড়া, হাতির মতো প্রাণীরা রয়েছে। আর রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক চক্র। যা অশোকচক্র বলেই তোরা জেনেছিস।

নব্য: ও, তা হলে আপনাদের সেই কারণেই বসানো হয়েছিল?

সারনাথ: ব্রোঞ্জের তৈরি চকচকে শরীর নিয়ে দেশের সংসদ ভবনের মাথায় চড়ে বসেছিস, অথচ এটাও জানিস না যে আমরা ছিলাম স্তম্ভের মাথায়। আর ওই স্তম্ভের গায়ে অশোকের লেখ উৎকীর্ণ করা ছিল। বৌদ্ধ সঙ্ঘের মধ্যে বিভেদ তৈরি করলে কোনও ভিক্ষু বা সন্ন্যাসিনীকে শাস্তি পেতে হবে— সেই চেতাবনি অশোক ওই লেখতে দিয়েছিলেন।

নব্য: এ তো ধর্মে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ?

সারনাথ: তা বলতে পারিস। তবে কি জানিস, অশোক নিজেও বৌদ্ধ হওয়ায় এবং ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় এই নির্দেশ খুব একটা গোলমাল তৈরি করেনি। তবে স্বাধীন ভারতে কিন্তু অশোকের ওই স্তম্ভের মাথাটুকুই জওহরলাল নেহরু নিয়েছিলেন। অশোকের লেখ-র কোনও অংশ কিন্তু নেওয়া হয়নি।

নব্য: আচ্ছা, তা এই চিহ্নের সঙ্গে স্বাধীন ভারতের যোগ কোথায়?

সারনাথ: অশোক তাঁর বিরাট সাম্রাজ্যের মধ্যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর গভর্নরেরা ছিলেন। কিন্তু শাসনকাজ চলত কেন্দ্রীয় ভাবেই। স্বাধীন হওয়ার পর ভারতেও দেশের সরকারের কেন্দ্রিকতারনীতি ছিল। রাজ্যে সরকার থাকলেও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যাতে আলগা না হয় তার চেষ্টা নেহরু করেছিলেন। এ বার নেহরুর ভাবনায় অশোক ছিলেন ভারতের ইতিহাসে সেরা শাসক। তাইতাঁর চিহ্নই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন বা সরকারি প্রতীক হয়ে ওঠে। দেশের টাকা বা সরকারি নথি, সবেতেই আমরা থাকা, মানে কেন্দ্রীয় শাসকের স্বীকৃতি থাকা।

নব্য: আমরাও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ চাই। গভর্নরেরাও চান।

সারনাথ: হ্যাঁ, সেই চেষ্টাই দিনরাত করছিস। তবে নেহরু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে অনেকটাই প্রতীকী রেখেছিলেন। জোর করে আরোপ করতে চাননি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সম্মান করতে জানতেন।

নব্য: রাখুন তো মশাই। ওগুলো নেহরুর বদমায়েশি। বিভেদের কায়দা। দেশকে একত্র করতে বৌদ্ধ অশোকের আদর্শ দরকার হল! এত এত হিন্দু রাজা ছিলেন! তাঁরা কী দোষ করলেন?

সারনাথ: তোরা সেটা বুঝলে তো আজ দেশের এমন দুরবস্থা হত না। শোন, ভারতবর্ষ কোনও দিনই এক সংস্কৃতির সূত্রে গাঁথা ছিল না। অশোকের আমলেও নয়, তোদের আমলেও নয়। তাই অশোক সাম্রাজ্যের ঐক্য সাধনেনিজের ‘ধম্ম’কে আশ্রয় করেছিলেন। অর্থাৎ,এমন এক ধরনের নৈতিক বার্তা যার মাধ্যমে প্রজাদের ভাবনাচিন্তা, গতিবিধি, মতাদর্শ শাসক নিয়ন্ত্রণ করবেন।

নব্য: আমরাও সেই সব নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। দেশের সব কিছু আমরাই করব।

সারনাথ: সে জানতে আর কারও বাকি নেই। এই সব কথা নিয়ে আর ঢাক পেটানোর দরকার নেই। তবে জওহরলাল নেহরু কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ চাননি। তাঁর মাথায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারণা ছিল। তবে স্বাধীনতার পরে যখন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য নিয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষ আত্মপ্রকাশ করছে, তখন গোটা দেশকে একত্র করতে অশোকের এক সূত্রে গাঁথার আদর্শকে প্রতীকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দেশকে শৃঙ্খলে বাঁধতে চাননি।

নব্য: শুধু এটুকুই?

সারনাথ: দ্যাখ, এ কথা মানতে হবে যে, জওহরলালের অশোকের প্রতি একটু বিশেষ অনুুরাগ ছিল। তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ পড়লেই বুঝতে পারবি। তা ছাড়া, ইতিহাসগত দিক থেকেও গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে এত বড় সাম্রাজ্য তৈরি করা শাসক আর তো কেউ ছিল না!

নব্য (ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে): তা হলে স্বীকার করছেন যে, আপনাদের জওহরলাল নেহরুও মোগলদের সে ভাবে স্বীকৃতি দেননি?

সারনাথ: সে তো উনি নিজের বইয়েই আওরঙ্গজ়েবের সমালোচনা করেছেন! অবশ্য সে সব তো বইয়ে লেখা। তার জন্য একটু-আধটু...

নব্য: আবার পড়াশোনা নিয়ে চিমটি কাটছেন? আচ্ছা হিন্দুস্থানকে কি এ সব পুরনো ধারণা দিয়ে এক করা সম্ভব? এ তো নানা সংস্কৃতিকে খিচুড়ি করে দেওয়ার জোগাড়!

সারনাথ: আসলে তোরাও তো বিশ্বাস করতে চাস না যে, ভারত আসলে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সমাহার। তাই একদেশদর্শিতা নিয়েই এগিয়ে চলেছিস।

নব্য: শুনুন মশাই, ও সব রাখুন। অশোকের যে এত গুণকীর্তন করছেন, উনিও তো নিজে পাথরে লিখে লিখে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতেন। আমাদের শাসকেরা করলেই ভুল?

সারনাথ: ভুল। অশোক ব্যক্তিগত ভাবে বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী হলেও তাঁর ধম্মের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম এক নয়। আর ধর্মই যখন তুললি, তখন একটু গুছিয়ে বলি। ইতিহাস তো জানবি না, উল্টে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে যাবি। অশোকের ঠাকুরদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শেষ জীবনে জৈন হয়েছিলেন। তবে জৈন ধর্মকে তিনি রাজকারবারে যুক্ত করেননি। বরং ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব ভালই ছিল। বিন্দুসার পেরিয়ে অশোকের সময়েও তা-ই ছিল। তা হলে অশোক হঠাৎ বৌদ্ধ হলেন কেন?

নব্য: কেন আবার? কলিঙ্গ যুদ্ধ করে রক্তারক্তি দেখে দুঃখ পেলেন। তাই বৌদ্ধ হয়ে গেলেন!

সারনাথ: ও মা! রাজপরিবারের ছেলে, সম্রাট হয়েছেন। যুদ্ধ করলে রক্তারক্তি হবে তা অশোক জানতেন না? তা হলে আচমকা যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে দুঃখে কাতর হবেন কেন?

নব্য: তাও বটে! তবে হলেন কেন?

সারনাথ: অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কি না, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে তিনি যেমন মানুষ ছিলেন তাতে বৌদ্ধ হলে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হতেন। কিন্তু তিনি শাসকের দায়িত্ব ছাড়েননি। সেই কারণেই তো অশোক নিজের ‘ধম্ম’ তৈরি করলেন। সেই ‘ধম্ম’ এমন এক বিষয় যাতে বৌদ্ধ ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে বটে, তবে পুরোপুরি বৌদ্ধ ধর্ম নয়। বরং প্রজাদের এক প্রকার নীতি এবং সহবত শিক্ষা।

নব্য: আচ্ছা! এখানেও রাজনীতি?

সারনাথ: দূরদর্শী শাসকের কাজই তো তাই। এমন রাজনীতি যার সদর্থক ভবিষ্যৎ থাকে।

নব্য: কী রকম?

সারনাথ: কলিঙ্গ যুদ্ধের পরবর্তী কালে অশোক বুঝেছিলেন, অখণ্ড সাম্রাজ্যের ধারণা পূর্ণ হয়েছে। এ বার আর বিস্তারের প্রয়োজন নেই। দরকার সংহতির। রাষ্ট্রদ্রোহ ঠেকাতে শান্তির বাণীর থেকে ভাল পথ আর কী? মানুষকে যদি শান্তির পথে ক্রমশ ঠেলে দেওয়া যায় তা হলে বিদ্রোহ তৈরি হবে না।

নব্য: আর?

সারনাথ: জৈন এবং আজীবিকদের প্রতিও সমান সম্মান দেখাতেন অশোক। আসলে, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী যে ধর্মমত তাঁদের সবাইকেই গুরুত্ব দিতেন তিনি।

নব্য: তা হলে অশোক হিন্দুবিরোধী! একেবারে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতেন!

সারনাথ (কিছুটা রাগত স্বরে): ব্যস, ধর্ম আর রাজনীতি শুনেই প্রশ্ন ‘কমন’ পড়ে গেল? তবে তোদের মতো বিভেদসৃষ্টি অশোক করেননি, এটা মাথায় রাখিস।

নব্য: মানে অশোক সমস্ত ব্রাহ্মণকেকচুকাটা করেননি?

সারনাথ: একেবারেই না। অশোক তাঁর লেখতে, ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণ (বৌদ্ধ ভিক্ষু), উভয়কেই সম্মান প্রদর্শন করতে বলেছেন। একই সঙ্গে দু’টি পরস্পরবিরোধী মতাদর্শকে তিনি তুলে এনেছিলেন। তিনি নিজে বৌদ্ধ হলেও সেই ধর্মকে শাসনেরঅঙ্গ করেননি।

নব্য: এটুকুই? এই কারণেই নিজের ধর্মবদলে ফেললেন?

সারনাথ: তা নয়। আরও কারণ আছে। অশোককে সিংহাসনে বসতে কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। ভাইদের সঙ্গে প্রাণঘাতী লড়াই হয়েছে। তাই সিংহাসনে বসলেও রাজদরবারের সবাই যে অশোকের পক্ষে নয়, সেটা উনি বুঝেছিলেন। তাই রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে লড়তে বৌদ্ধ ধর্মের দিকে ঝুঁকলেন। অর্থাৎ জনপ্রিয় বিকল্প শক্তিকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন।

নব্য: আবার সেই রাজনীতি!

সারনাথ: কত বার বলতে হবে যে, শাসক রাজনীতি করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে যে রাজনীতি নিজের দেশের লোকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে, তেমন রাজনীতি শাসকের কাজ নয়। বরং সমতার নীতিই আদর্শ শাসকের কাজ।

নব্য: আচ্ছা, অশোক কি নিরামিষ খেতেন?

সারনাথ: কেন? নিরামিষ খেতে যাবেন কেন? সিংহ হয়ে তোর নিরামিষ খাবারের কথা বলতে লজ্জা করে না?

নব্য: না, মানে শুনেছিলাম আর কী!

সারনাথ: অশোক তাঁর শিলালেখতে পশুবলি বন্ধের নিদান দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির রান্নাঘরে নির্বিচারে পশুপাখি হত্যাও বারণ করেছিলেন। তবে এও বলেছিলেন, রোজ দুটো করে ময়ূর এবং একটা হরিণ মারা যেতে পারে। তাই উনি নিরামিষ খেতেন এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।

নব্য: আচ্ছা, কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেও অশোক কি কখনও রোষ দেখাননি?

সারনাথ: দেখিয়েছেন। অরণ্যবাসীদের বিদ্রোহ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। না হলে ঠারেঠোরে কচুকাটা করার কথাও বলেছেন।

নব্য: ঠিক করেছেন। অরণ্য তো রাষ্ট্রের সম্পত্তি। বাস করলেই অধিকার জন্মায় না।

সারনাথ: খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি কথাটা! তবে মাথায় রাখিস, ২০২২ সাল এবং মৌর্য যুগ, একনয়। ভারত আর সাম্রাজ্য নেই, গণতন্ত্র হয়েছে। আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় মানবাধিকার, পরিবেশ আইন এ সব গুরুত্বপূর্ণ।

নব্য: অশোক তা হলে ভুল করেছিলেন?

সারনাথ: ঠিক না ভুল, তা বিচার করতে গেলে সময়ের ফারাক মাথায় রাখতে হয়। সম্রাট হিসেবে অশোক যা করেছিলেন তা গণতান্ত্রিক দেশের শাসক করতে পারেন না।

নব্য: তার মানে বলতে চাইছেন, প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না?

সারনাথ: অ্যাই, প্রজা কে? দেশের মানুষ তোদের প্রজা?

নব্য: আপনি তো অশোকের কথা বলছিলেন।

সারনাথ: ওরে, সেটা আজ থেকে প্রায় ২৩০০ বছর আগের কথা। তখন সাম্রাজ্য ছিল, রাষ্ট্রীয় কাঠামো অন্য রকম ছিল। আজ তুই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে ভারতের মানুষকে প্রজা বলছিস!

নব্য: শাসকের অধীনে তো প্রজাই থাকে!

সারনাথ: তোরা, মানে দেশের শাসকেরা কি উত্তরাধিকার সূত্রে পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিস?

নব্য: না। ও সব পরিবারকেন্দ্রিক ব্যাপার আমাদের নেই। আমরা ভোটে জিতেছি।

সারনাথ: ঠিক, গণতন্ত্রে ভোটে জিতে শাসক হয়েছিস। তার মানে দেশের মানুষ ভোট দিতে প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে পাঠিয়েছে।

নব্য: ঠিকই আসলে ওই মুখ ফস্কে...

সারনাথ: মুখ ফস্কে মনের কথা বেরিয়ে গিয়েছে। এ বার থেকে দেশের মানুষকে নাগরিক বলবি।

নব্য: আজ্ঞে।

সারনাথ: যা বলছিলাম। দেশের মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে হবে। সংহতি প্রয়োজন। কিন্তু জোর করে নয়, নিজের মত চাপিয়ে দিয়ে নয়। অশোক করে গিয়েছেন বলেই তা করতে হবে, এমন নয়।

নব্য: তা হলে নিজেদের গৌরবময় অতীতভুলে যাব?

সারনাথ: না হলে ক্রমশ পিছন দিকে এগোতে হবে। মানে পিছোতে পিছোতে দেশকে গাড্ডায় ফেলে দিতে হবে।

নব্য: তা হলে বলছেন শাসকের পরাক্রমের দরকার নেই। ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হবে? দেশের আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে তুলতে হবে না।

সারনাথ: অযথা দাঁতমুখ খিঁচোলেই পরাক্রম বোঝায় না। শাসকের শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম থাকে তাঁর আত্মবিশ্বাসে। শান্ত, ধীর, স্থির শাসকের চেহারাই যথেষ্ট। আর দেশের আত্মবিশ্বাস, শক্তি ফুটে উঠে সুশাসনে। বুঝলি?

নব্য: না, আসলে বর্তমান পরিস্থিতি তো আলাদা। তাই আর কী...

সারনাথ: কী রকম আলাদা শুনি!

নব্য: মানে এক দিকে জঙ্গি, আর এক দিকে ড্রাগন। তার উপরে দেশেও মানুষ সুখে নেই। গ্যাসের দাম, পেট্রোলের দাম, ওষুধের দাম নিয়ে বেজায় খাপ্পা। তাই একটু ভয় না দেখালে...

সারনাথ: শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে শাসকেরা চার পাশে শত্রু নিয়েই রাজত্ব করেছেন। তখন তোদের মতো রাষ্ট্রপুঞ্জ ছিল না, যে যুদ্ধ লাগলে, গোলমাল বাধলে হস্তক্ষেপ করবে। কূটনীতি আর সমরনীতির মিশেলে টিকে থাকতে হয়েছে সে যুগের শাসকদের। আবার রাজ্যের ভিতরে বিদ্রোহ, রাজপ্রাসাদের ভিতরে কলহ সামলাতে হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সামলানোর জন্য রাজপ্রাসাদের মাথায় দাঁতখিঁচুনি মূর্তি বসাতে হয়নি তাঁদের। শুনে রাখ, শাসকের কাজ শুধু যুদ্ধ করা কিংবা বিদ্রোহ দমন করা নয়। তাঁর কর্তব্যের তালিকায় থাকে জনকল্যাণও। তার বদলে যদি মানুষকে নাজেহাল করো, অকারণে ভয় দেখাও, মানুষ তো খেপে যাবেই। খোদ অশোকও অত বড় শক্তিশালী সম্রাট হয়েও জনহিতকর কাজ করতেন।

নব্য: আমরা কি করি না?

সারনাথ: তোদের যা কাজ, তার কতটা মানুষের হিতে আর কতটা তোদের উমেদারদের হিতে, সে সব নিয়ে আর মুখ খোলাস না।

নব্য: কেমন যেন দেশদ্রোহীর মতো কথা!

সারনাথ: কী বললি? শোন, মানুষকে যত এই সব বলবি, ততই মানুষ তোর থেকে দূরে সরবে। শেষে খেপে গিয়ে ওই দাঁত আস্ত রাখলে হয়!

নব্য: হুঁ!

হঠাৎ নব্য প্রতীক দেখে, সামনে সারনাথের অশোক স্তম্ভ আর নেই। আশপাশেও নেই। এত ক্ষণ ধরে যা শুনল তাতে নিজের মনেই খটকা লাগছিল তার। শেষমেশ একটা আয়না জোগাড় করে মুখ দেখতেই চমকে উঠল সে! এ কী ভয়ঙ্কর হিংস্র চেহারা তার! নিজেকে দেখে নিজেরই হাত কেঁপে গেল। হাত থেকে আয়না পড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছে। কী মনে হতে, শ্বদন্তগুলিকে মুখের ভিতরেই গুটিয়ে নিল সে।

আকাশের অন্ধকার তখন কেটে গিয়েছে। দিগন্তে দেখা দিয়েছে নতুন দিনের সূর্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story National Emblem controversy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE