Advertisement
০২ মে ২০২৪
Bengali Feature

হেমন্তের প্রেমপত্র

দুর্গাঠাকুর ভাসানের পর থেকেই হেমন্তের শুরু। গাছের পাতায় মরচে ধরতে শুরু করে তখন থেকেই। শুরু হয় পাতা ঝরার মরসুম। ব্রোঞ্জের প্রজাপতি এসে জড়ো হয় শহর থেকে গ্রামের পথেঘাটে, মানুষের মনে। নানা বাড়ির আনাচ-কানাচে ও ছাদে জ্বলে ওঠে আকাশপ্রদীপ! একাগ্র সেই আলো যেন অন্য এক পৃথিবীর কাউকে নীরবে বলে, ‘ভুলিনি, আমরা ভুলিনি তোমায়!’

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:০৬
Share: Save:

হেমন্ত! তিনি তো মুখোপাধ্যায়! তিনি আবার ঋতু হলেন কবে?”

ছোটবেলা থেকে আজও ফিরে আসে সেই স্বর! ফিরে আসে দুর্গাপুজোর পরের শেষ বিকেলের নিরালা মফস্সল! মাথার ওপর নিবে আসা ঢালু আকাশ! নদীর ওই পারের ইটভাটার সরু চকের মতো চিমনি দিয়ে বেরনো ধুঁয়োর আবছায়া। নৌকোর মধ্যে জ্বলা পোখরাজ রঙের আলো! আর ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর মুখ, যারা পুজোর পরে কার্তিকের গোধূলিতে নিজেরাও কেমন যেন মনমরা আর আবছায়া হয়ে যেত!

বাড়িতে ছিল রেডিয়োর চল। কালো আয়তাকার বাক্সের গায়ে রুপোলি রঙের নব। মাথার ওপর গোটানো টেলিস্কোপিক এরিয়াল। দিনের বিভিন্ন সময় সেখানে নানা গান বাজত। আর যৌথ পরিবারে থাকার ফলে দাদু, কাকা, পিসেমশাই বা পিসিদের থেকে জানতাম সতীনাথ, কিশোর, মান্না, লতা, নির্মলা, সন্ধ্যার সঙ্গে হেমন্তর নামও। সাদা-কালো টিভিতে দেখতাম মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, হাতা-গোটানো বাংলা শার্ট আর ধুতি পরা এক জন মানুষকে। সেজোকাকা চেনাত, “ইনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!”

আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, আরে, এঁকে তো অনেকটা আমার মিষ্টিদাদুর মতো দেখতে!

পরে বাবার কাছে এক বিকেল হয়ে আসা নদীর পাড়ে বসে যখন জেনেছিলাম জাগতিক ঋতু পরিবর্তনের কথা, শুনেছিলাম শরৎকালে হয় দুর্গাপুজো আর তার পরেই আসে হেমন্ত, তখন পাঁচ বছরের আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হেমন্ত! তিনি তো মুখোপাধ্যায়! তিনি আবার ঋতু হলেন কবে?”

বাবা হেসে বলেছিল, “আরে নামটা এক! হেমন্ত গায়ক এবং ঋতু!”

বাবা বলেছিল এক, আর আমি বুঝেছিলাম অন্য! প্রবীণ গায়কের জন্য আমার মনে মনে শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল আরও! ভেবেছিলাম এত বড় গায়ক যে, তাঁর নামে একটা গোটা ঋতুর নাম রাখা হয়েছে!

ছোটবেলায় আমরা কত কী যে ভাবি! জীবন এক আশ্চর্য রঙিন কাগজে মোড়া উপহারের মতো আসে আমাদের কাছে! মনে হয় এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই!

তার পর সময় কাটে। আমাদের জীবনও নানা ঋতু পেরিয়ে হেমন্তে এসে দাঁড়ায়। আর তখন বুঝি, ছোটবেলার সেই রঙিন কাগজে মোড়া উপহারটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে! বুঝি, হেমন্ত শুধু কোনও বিখ্যাত গায়ক বা ঋতুর নামই নয়, এ জীবনের এক অবস্থাও বটে!

ঠিক কখন থেকে শরৎ শেষ হয়ে হেমন্তের শুরু হয়? আবহাওয়া অফিস যা-ই বলুক, আমাদের কাছে দুর্গাঠাকুর ভাসানের পর থেকেই হেমন্ত শুরু হয়ে যায়! আচমকা হাওয়ায় আর্দ্রতা কমে আসে। গাছের পাতায় মরচে ধরতে শুরু করে। দুটো-চারটে করে পাতা ঝরার শুরুও এই সময়ে। এই সময়ে ব্রোঞ্জের প্রজাপতি এসে জড়ো হয় শহর থেকে গ্রামের পথেঘাটে, মানুষের মনে। আকাশের আলো, পুরনো জামাকাপড়ের মতো, আচমকা ছোট হয়ে আসে বড় হয়ে ওঠা সন্ধের সামনে। মিহি কুয়াশা, নাগরিক আবহাওয়ায় মিশে ধোঁয়াটে মশারির মতো ঝুলে থাকে শহরের মাথায়। ক্রমে মেরুন হয়ে আসে চার দিক। আলো পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনখারাপের একটা ওড়না এসে জড়িয়ে যায় শরীরে, মনে। মনে হয় কার যেন আসার কথা ছিল, কার সঙ্গে যেন দেখা হওয়ার কথার ছিল, কিন্তু কিচ্ছু হল না। জীবন থেকে ঝরা পাতার মতো খসে গেল আর একটা বছর! একাকিত্বের বয়স বেড়ে গেল বৃথা!

মনে আছে, ছোটবেলার মফস্সলে, সেই পাড়ার ঠাকুর ভাসান দিয়ে লরির মাথায় ফেরার সময় কেমন যেন ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগত। বাড়িওয়ালার মেয়ে, মানে আমাদের সোমাদি, আমার মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দিত মাফলারের মতো করে। বলত, “ঠান্ডা লাগাস না, স্কুল খুললেই কিন্তু অ্যানুয়াল!”

সে ছিল পিঠের ওপর দিয়ে বরফের সাপ নেমে যাওয়ার সময়। হেমন্ত মানে ছিল পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়। মাঠ থেকে খেলা গুটিয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরার সময়। বাড়ির লাগোয়া পুকুরের ওই দিকে ঝাঁকড়া বাঁশবাগানের মাথায় থেমে থাকা কুয়াশার মুকুট দেখে অবাক হওয়ার সময়। হেমন্ত ছিল জোনাকির টিপ টিপ আলোর মাঝে, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে চিনে নেওয়া কোনটা কালপুরুষ! কোনটা ক্যাসিয়োপিয়া! আর জেনে নেওয়া কোথা দিয়ে বয়ে যায় আকাশগঙ্গার নক্ষত্রধারা!

মনে আছে, কোয়ার্টার্সের মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে সদ্য-ফোটা একটামাত্র তারা দেখে দাদু বলত, “এখন ঘরে ফিরতে নেই। দুটো তারা না দেখে ঘরে ফিরতে নেই!”

আমরা তাই দুটো তারা দেখার আশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দুটো-চারটে করতে করতে এক আকাশ তারা ফুটে উঠত! কখন যে উল্কা খসে পড়ত জগেশ্বরদাদুর বাড়ির পিছনের বাগানে, ছোটকাদের কাঁঠাল গাছের মাথায়, ইন্দ্রাণীদির গানের স্কুলের শেষে, খেয়ালই থাকত না!

আর ছিল আকাশপ্রদীপ! মালাপিসিদের বাড়ির মাথায়, শ্যামল পালদের বাড়ির জল ট্যাঙ্কির ওপরে, বিটুকাকাদের বাড়ির উঠোনে ও আরও অন্যান্য নানা বাড়ির আনাচ-কানাচে ও ছাদের উপরে জ্বালানো হত আকাশপ্রদীপ!

লম্বা বাঁশের মাথায়, ফুলের সাজির মধ্যে প্রদীপ বসিয়ে অনেক উঁচুতে জ্বালিয়ে রাখা হত আলো। মফস্সলের ছোট-বড় বিভিন্ন বাড়িতে সন্ধেবেলা সেই আলো জ্বলে থাকত গোটা কার্তিক মাস জুড়ে। কেউ বলত, দেবতার উদ্দেশে সেই প্রদীপ জ্বালানো হয়। আবার কেউ বলত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জ্বালানো হয় সেই আলো। যাতে তাঁরা সেই আলোর নিশানা দেখে আবার ফিরে আসতে পারেন আমাদের কাছে!

আবছায়া মধ্যবিত্ত পাড়ার মাথায় সেই নির্জন আলো দেখে কেমন যেন গা ছমছম করত আমার! একাগ্র সেই আলো যেন অন্য এক পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিত আমাদের। আমার মনে হত, এই আলো আসলে যেন বলছে, “ভুলিনি, আমরা ভুলিনি তোমায়!”

অন্য কথা বলত দীপককাকু। আমাদের কেমন যেন লতায়-পাতায় জড়ানো এক কাকু ছিল দীপক ভট্টাচার্য! হাসিখুশি মানুষটা হকি খেলত ভাল। মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথে আমায় দিয়ে যেত কর্কেট বল, দামুদার লটারি হজমি, অনঙ্গ সাহার দোকানের কারেন্ট নুন!

দীপককাকুর বাড়িটা ছিল আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তে। বিয়ে-শাদি করেনি মানুষটা। একাই থাকত। যখন একটু বড় হয়েছি, কলকাতায় চলে এসেছি, তখনও মাঝে মাঝে দীপককাকুর কাছে যেতাম এমন হেমন্তের সন্ধেবেলাগুলোয়।

দেখতাম, বরাবরের মতো দীপককাকু নিজের বাড়ির উঠোনের এক পাশে লম্বা বাঁশের মাথায় জ্বালিয়ে রেখেছে আকাশপ্রদীপ!

আমি অবাক হতাম। পরজন্ম বা ঈশ্বর বিষয়ে দীপককাকু ঘোর অবিশ্বাসী। মানুষ ছাড়া আর কারও অস্তিত্বে তার বিশ্বাস ছিল না। সে কেন প্রতি কার্তিক মাসে এমন করে আলো জ্বালিয়ে রাখে!

বড় হয়ে গিয়েছি ভেবে এক বার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা, “দীপককাকু, তুমি তো এ সব মানো না। তা হলে এমন আকাশপ্রদীপ কার জন্য জ্বালাও?”

দীপককাকু সময় নিয়েছিল একটু। তার পর আবছা গলায় বলেছিল, “রঞ্জাবতীর জন্য। আমি ওকে সাজি বলে ডাকতাম। বহু আগে এমনই কার্তিক মাসে ও আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এই ছোট্ট শহরের অন্য প্রান্তেই তার ঘর। স্বামী ও পুত্র নিয়ে তার সংসার। কিন্তু আমি আর তার সামনে যাই না। শুধু সে যদি দেখতে পায়, তাই, তার জন্য আমি ফুলের সাজির মধ্যে ছোট্ট এই আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখি তারাদের কাছে। না, সে ফিরে আসবে না জানি। কিন্তু আমি তাকে এই আলোর চিহ্নে জানাতে চাই যে, ভুলিনি, আমি তাকে ভুলিনি!”

হেমন্তের সন্ধে, তার ঝিরিঝিরে হিমেল হাওয়া, পাতা খসার শব্দ, এই সবের মধ্যে দীপককাকুকে সে দিন কেমন যেন লাগছিল! আমার সামনে বসে-থাকা মানুষটা যেন আমার সামনে নেই! আমার শুধু মনে হয়েছিল, দীপককাকু নিশ্চয়ই এই পৃথিবীর মানুষ নয়! ভেবেছিলাম, মানুষ কোথায় থাকে? যেখানে সে শারীরিক ভাবে অবস্থান করে সেখানে, না কি মন যেখানে পড়ে থাকে, সেখানেই তার বাস!

তবে বুঝেছিলাম, বুকের মধ্যে অন্যের জন্য যে আলোটুকু জ্বালিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে, সেই আলোটুকুই প্রকৃত আকাশপ্রদীপ! আর এও বুঝেছিলাম হেমন্ত আসলে এক একাকিত্বের ঋতু। একা হয়ে যাওয়ার ঋতু।

মফস্সলের নিঝুম হেমন্ত ছাড়িয়ে কলকাতায় চলে-আসা আমার কাছে ছিল অ্যালিসের আশ্চর্য পৃথিবীতে আসার মতো! এক এপ্রিল মাসে কলকাতায় চলে এলেও আমার আসল আগ্রহ ছিল এই শহরে হেমন্ত কেমন করে আসে, সেটা দেখার!

তার পর দুর্গাপুজো শেষ হল এক সময়। আর নিয়মমতো শুরু হল হেমন্তকাল! দেখলাম, এখানেও দিন স্বাভাবিক ভাবে ছোট হয়ে আসে। শুধু ধুলো-ধোঁয়ায় আকাশটা আর স্পষ্ট দেখা যায় না। বড্ড বেশি আলো এখানে! নরম আবছায়ার মাধুর্য এখানে কেউ বোঝে না। সঙ্গে এত্ত বেশি আওয়াজ! চার দিকে সারা ক্ষণ যেন লোহা কারখানার কাজ চলছে। পাতা খসে পড়ার শব্দ এখানে শোনা যায় না। জলের উপর শেষ বিকেলের হাওয়া এখানে ভাঁজ তোলে না। গাছের এলোমেলো মাথায় ঝরঝর করে ভেঙে পড়ে না অবেলার বাতাস।

শহরে দেখা প্রথম হেমন্ত আমার ভাল লাগেনি একটুও! বাড়ির সামনেই বড় রাস্তা। সেখানে ট্রাম চলত আইল্যান্ডের ওপর দিয়ে (তখনও কলকাতায় আইল্যান্ড ছিল অনেক)। হেমন্তে দেখলাম, সেই আইল্যান্ডের ঘাসে কেবল মরচে ধরেছে একটু। দেখলাম, ওই পারের চারটে পাম গাছের কিছু পাতায় জং ধরেছে মাত্র!

মনে হয়েছিল, তবে কি এ শহরে হেমন্ত আসে না? এই শহরে কি দীপককাকু বলে কেউ নেই! মনে হয়েছিল, এই শহরে হেমন্ত মানে কি কেবল মুখোপাধ্যায়!

কিন্তু তার পর আমার পাখনা খুলল। আমি আরও বড় হয়ে উঠলাম। একা একা শহরের গলি, উপগলি আর মনখারাপের পাড়া-বেপাড়াকে দেখা ও জানা শুরু হল। পরিচয় হল শহরের রেলস্টেশনের সঙ্গেও! আর বুঝলাম এখানেও হেমন্ত আসে, তবে একটু লুকিয়ে, সামান্য অভিমান নিয়ে।

শহরে হেমন্তের যে লক্ষণ প্রথম আমার চোখে পড়েছিল, তা হল প্রজাপতি। দুর্গাপুজোর পরেই দেখলাম, কোথা থেকে যেন দঙ্গল বেঁধে ব্রোঞ্জ-রঙা প্রজাপতি এসে পড়ে শহরে! ফুটপাতের ফাঁকে জন্মানো ছোট্ট ফুলগাছের মাথায় তারা ওড়ে! চলন্ত গাড়ির চাকায় চাকায় ভাসে! ফুটপাতের পাশে ঘুমিয়ে থাকা উন্মাদের কাঁধে গিয়ে বসে!

আর স্কুল ও টিউশনের যাতায়াতের মাঝে দেখলাম হেমন্তের শেষ বিকেলের রেলস্টেশন। সেখানে কেডস পরা বাউল ওভারব্রিজে বসে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খায়। পাশে থাকে ক্লান্ত খমক। অন্ধ সুলেমান বাঁশিওয়ালা স্কুল-ফেরত বাচ্চাদের এমনি এমনি নানা গান বাজিয়ে শোনায়। বৃদ্ধা মাসিমা চায়ের স্টল সামলাতে সামলাতে, ঘুগনি-রুটিবিক্রি করতে করতে গুনগুন করেন, ‘আমি যে তোমারই শুধু জীবনে মরণে/ ধরিয়া রাখিতে চাহি নয়নে নয়নে।’

দেখলাম, ক্লান্ত হকার আনমনে চেয়ে থাকে দূরের লাল সিগন্যালের দিকে। বাচ্চা কোলে এক ভিখারিনি এমনিই হাসে আচমকা হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে। আর পথের শিশু কিছু ঝরে-পড়া গুলমোহরের পাতা আর ধুলো, হাতের মুঠোয় নিয়ে সামলে রাখে সোনাকুচির মতো। বুঝলাম, এই শহরে হেমন্ত আসলে মানুষের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে, জেগে থাকে, প্রবাহিত হয়!

এর পর এক দিন বন্ধুর বাড়ি থেকে হেঁটে নিজের বাড়ি ফেরার পথে অবাক-করা একটা ব্যাপার ঘটল। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় দিন প্রায় নিবে এসেছিল আকাশে। হেমন্তের আকাশে দু’-একটা জেদি তারা ফুটে উঠেছিল কেবল। আর ফুটপাতে ফুটপাতে ছড়িয়ে ছিল হিজিবিজি আলো ও শব্দের কলকাতা! তার মাঝে একটা শুকনো-পাতা-রঙের প্রজাপতি আমার পায়ে পায়ে উড়ছিল কেবল। সেই ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক থেকে মুদিয়ালি! প্রায় তিরিশ মিনিটের হাঁটাপথে আমার একার সঙ্গী ছিল সেই প্রজাপতি! পথের হট্টগোল, বড় সিগন্যাল, গা ঘেঁষে ছুটে-যাওয়া গাড়ি, সব তুচ্ছ করে সে দিন সেই প্রজাপতিটি আমার সঙ্গে উড়তে উড়তে বাড়ি অবধি চলে এসেছিল! সেই মনখারাপের দিনগুলোয় সে ছিল আমার কিছু সময়ের আশ্চর্য বন্ধু!

তখন কবিতা পড়ছি আমরা। পড়ছি হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানের কথা। রবীন্দ্র সরোবরে হাঁটতে হাঁটতে দেখছি গাছের নীচে, পথের উপর, জলের পাশে ছড়িয়ে আছে হলুদ পোস্টকার্ড রঙের পাতারা। নিজের মতো করে বুঝলাম, কেন কবি পোস্টম্যান হয়ে ঘুরেছেন!

কলেজে পড়লাম সেই চিরবিখ্যাত লাইন, ‘সিজ়ন অব মিস্টস অ্যান্ড মেলো ফ্রুটফুলনেস’! পড়লাম, ‘অ্যান্ড গ্যাদারিং সোয়ালোজ় টুইটার ইন দ্য স্কাইজ়’।

‘অটাম’ মানে কি হেমন্ত! কিটস যে অটাম-এর ছবি এঁকেছেন তা কি আমাদের চির মনকেমনের হেমন্ত! কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে, আমাদের এই হেমন্ত যেন বা আরও বেশি কিছু! যেন ঠিক না বলতে-পারার মতো এক স্বপ্ন! না ধরতে-পারা শিমুলের বীজ! যেন বা শেষ বিকেলের মেরুন সূর্যাস্ত অবধি বয়ে যাওয়া এক নদী! মনে হয়েছে, হেমন্ত ঋতু আসলে হল জীবনানন্দ দাশ! এই ঋতু যেন চিরকালীন সেই প্রশ্ন, ‘কার মুখ?— আমলকী শাখার পিছনে’!

হেমন্ত ঋতুর কথা উঠলেই আমার মনে আসে রুনাদির কথা। গোলপার্কের কাছে ছোট্ট একটা গলির মধ্যে থাকত রুনাদিরা। আসলে কেরলের মানুষ ওরা। রুনাদির ভাল নাম ছিল সিলভিয়া টমাস। রুনাদির বাবা সেই বহু আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। ওদের বাড়ির সবাই এমন বাংলা বলত যে, শুনে কেউ বুঝতেই পারবে না যে ওরা বাঙালি নয়! আর রবিঠাকুরের গান যে কী ভাল গাইত, যে না শুনেছে বিশ্বাসই করবে না।

রুনাদি শুধু ভাল গানই গাইত না, গিটারও বাজাত দারুণ। একটা স্কুলে মিউজ়িক টিচার হিসেবে যুক্ত ছিল। আরও নানা জায়গায় যেত গান গাইবে বলে। আর এই যাওয়া-আসার মাঝেই রুনাদির আলাপ হয়েছিল নির্মাল্যদার সঙ্গে!

নির্মাল্যদা মানে নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়। শুনেছিলাম একটা কলেজে পড়ায় নির্মাল্যদা। সেই সঙ্গে দুঃস্থ শিশুদের জন্য কাজ করে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত। আর তার সঙ্গে আয়োজন করত নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এমনই একটা অনুষ্ঠানে নির্মাল্যদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল রুনাদির। সেটাও ছিল এক হেমন্তের সন্ধ্যা। কলকাতার এক বড় বাড়িতে কালীপুজো উপলক্ষে একটা ঘরোয়া গানের জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি, যীশু, পিকু সবাই গিয়েছিলাম রুনাদির সঙ্গে।

একটা বিরাট ঘরে সবাই জড়ো হয়েছিলাম। ফরাসের ওপর শ’খানেক শ্রোতা বসেছিলেন সেই ঘরে। মাথার উপর দুটো ঝাড়বাতি-সহ আরও নানা আলোয় ভেসে যাচ্ছিল সেই ঘর! ঘরের এক পাশে অন্য একটা সাদা ফরাসে বসেছিলেন শিল্পীরা। রুনাদিও বসেছিল তাদের মধ্যে।

অনুষ্ঠান শুরুর মিনিট পঁচিশেক পরে রুনাদির সুযোগ এসেছিল গান গাওয়ার! হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল সরলদা। লাজুক, চুপচাপ মানুষ। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে চোখ নামিয়ে রাখতসব সময়।

রুনাদি চাপা গলায় সরলদাকে কিছু বলে নিয়ে গান ধরেছিল। আর পুরনো ঘরের উঁচু সিলিং, মানুষের মন ও দীপাবলির রাত, সব পূর্ণ হয়ে উঠেছিল সেই গানে।

রুনাদি গাইছিল, ‘কোনো রাতে মনে কি গো পড়বে/ ব্যথা হয়ে আঁখিজল ঝরবে/ বাতাস আকুল হবে/ তোমার নিশাসটুকু পেয়ে।’

সবাই স্তব্ধ হয়ে গান শুনছিল রুনাদির। আর যীশু আমায় আলতো করে ঠেলে দেখিয়েছিল একটু দূরে-বসা এক জনকে। আমি দেখেছিলাম, নির্মাল্যদা যেন দৃষ্টিবন্ধনে, সুরবন্ধনে পড়ে যাওয়া কোনও প্রাণী! এমন করে তাকিয়েছিল রুনাদির দিকে যেন এই ঘরে, এই শহরে, এই দেশে বা এই গ্রহে আর কেউ নেই!

শ্যামলা, গালে সামান্য ব্রণর দাগ, চোখ দুটোও সাধারণ। রুনাদিকে কেউ কিছু সুন্দরী বলত না। কিন্তু আমার মনে হত এমন যার গুণ, সে সুন্দর না হয়ে যায় না। মনে হত আসলে সবাই নিজের গুণেই সুন্দর। বাহ্যিক রূপ তো আসলে পলস্তারা, সময়ের সঙ্গে ঝরে যাবেই!

আমি সে দিন নির্মাল্যদার চোখে সেই ভারী সুন্দর রুনাদিকে দেখেছিলাম। নির্মাল্যদা স্তব্ধ হয়ে দেখছিল রুনাদিকে। ওই গানের পরে রুনাদি সে দিন আরও বেশ কিছু গান গেয়েছিল। আর গোটা সময় নির্মাল্যদা যেন এক বারও পলক ফেলেনি!

ফেরার পথে হলুদ ট্যাক্সির সামনের সিট থেকে ঘুরে আমি বলেছিলাম, “যীশু, রুনাদিকে তুই কী বলবি বলছিলি?”

যীশু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে টিপিকাল বাঙাল উচ্চারণে বলেছিল, “নির্মাইল্যদা গ্যাসে গিয়া!”

রুনাদি ট্যাক্সির আবছায়াতেও যেন জ্বলে উঠেছিল লজ্জায়। বলেছিল, “হেমন্তকালে অমন হয়। এ সব সিরিয়াস কিছু নয়!”

মানুষ মাঝে মাঝে বলে এক কথা, আর মনে মনে বিশ্বাস করে অন্য কিছু! আমি বুঝেছিলাম, হেমন্ত নিশ্চুপে প্রেমে পড়ার ঋতুও বটে।

নির্মাল্যদা আর রুনাদির মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল। বাগবাজারের ছেলে নির্মাল্যদা কলেজের পরে সেই নর্থ থেকে একটা গোটা শহর পেরিয়ে আসত গোলপার্কে। আমি মাঝে মাঝেই দেখতাম ওদের। লেকের রাস্তায় হাঁটছে। কাকুলিয়া রোডের গলিতে ঘুরছে। কখনও আবার ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের সেই সিঁড়িওলা রেস্তরাঁয় ঢুকছে।

টানা দু’বছর একে অপরের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়েছিল ওরা। তার পর এল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সেই রাতটা। অক্টোবরের শেষ ছিল সেটা। বাতাসে মিহি হিম। কুয়াশায় দূরের ভেপার ল্যাম্প সামান্য ঘষাটে। তুষারপাতের মতো কলকাতা জুড়ে কৃষ্ণচূড়ার পাতারা ঝরছে। তারমধ্যে আমি গিয়েছিলাম পিকুদের বাড়ি। ভোগ খাওয়ার নেমন্তন্ন। আরও অনেকে এসেছিল সে দিন। ওটা রুনাদিদেরও পাড়া। ফলে রুনাদিও এসেছিল সেই নেমন্তন্নে।

খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরব, এমন সময় রুনাদি বলল, “কাল আমরা চলে যাচ্ছি।”

আমরা হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। বলে কী রুনাদি!

রুনাদি বলেছিল, “আমাদের দুই বাড়ির কেউ রাজি নয় এই সম্পর্কে। আমরা তাই ঠিক করেছি দূরে গিয়ে বিয়ে করব। নির্মাল্য সব ব্যবস্থা করছে। আমরা তাই চলে যাব এখান থেকে। নির্মাল্যকে আমি কিছু টাকা আর আমার সামান্য যেটুকু গয়না ছিল, দিয়েছি। টাকাপয়সা তো লাগবেই বেশ কিছু। ব্যাপারটা তোদেরই শুধু বললাম। আর কাউকে বলিস না! তুমিও কাউকে বোলো না সরলদা।”

আমরা বলিনি। কাউকে বলিনি। তবে রুনাদির আর যাওয়া হয়নি। কারণ নির্মাল্যদা আর আসেনি রুনাদির কাছে!

পরের দিন রুনাদি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষে বাড়ি ফিরে এসেছিল। মোবাইল ফোন ছিল না তখন। রুনাদিদের বাড়িতে ল্যান্ডলাইনও ছিল না। কেন নির্মাল্যদা আসেনি, সেটা জানতে পারেনি রুনাদি। কোনও দিন জানতে পারেনি।

পরে আমরা বাগবাজারে গিয়ে খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। নির্মাল্যদাকে খুঁজে পাইনি। যে কলেজে চাকরি করত বলে জানতাম, সেখানেও গিয়েছিলাম আমি আর পিকু। সেখানেও শুনেছিলাম, অমন নামে নাকি কেউ ওখানে নেই!

যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেখানেও নাকি আর আসে না নির্মাল্যদা! আমরা অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, একটা মানুষ এমন উবে যেতে পারে নাকি!

রুনাদির দিকে তাকালে আমাদের কী যে কষ্ট হত! মনে আছে, সে বার কালীপুজোয় আমরা রুনাদির কাছে গিয়েছিলাম। ওদের একতলাবাড়ির ছোট্ট ছাদে বসেছিলাম সবাই। সে দিন সরলদাও ছিল।

রুনাদি কথা বলছিল না। আকাশে ধোঁয়াশা আর বাজির রোশনাইয়ের দিকে তাকিয়ে বসেছিল চুপচাপ! তার পর এক সময় আচমকা গেয়ে উঠেছিল, ‘আমার নয়ন দুটি/ শুধুই তোমারে চাহে/ ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে/ আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে...’

আর আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম, আমার বড়বেলার হেমন্তে এসে দাঁড়াচ্ছে সেই কিশোরবেলার এক হেমন্তকাল! দেখেছিলাম, কোথায় যেন দীপককাকুর সঙ্গে এসে মিশে যাচ্ছে রুনাদি। দু’জনেই যেন বুকের সাজির মধ্যে ছোট্ট আলো জ্বালিয়ে রেখেছে কার্তিকের হিমেল হাওয়ায়! জ্বালিয়ে রেখেছে সেই আলো, যা দেখে দূরে চলে-যাওয়া প্রিয়জন ফিরে আসে আমাদের কাছে!

রাতে বাড়ি ফেরার সময়, রাস্তায় বেরিয়ে আমরা চুপচাপ ছিলাম। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

তার পর এক সময় যীশু শুধু বলেছিল, “রুনাদির এ বার কী হবে!”

সরলদা মোটা চশমার মধ্যে দিয়ে তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। নরম গলায় বলেছিল, “ও শক্ত মেয়ে, ঠিক সামলে নেবে। তা ছাড়া আমি তো থাকব! ও জানবে না হয়তো। কিন্তু আমি ঠিক থাকবওর জন্য।”

হেমন্তের আবছায়ার মধ্যে ডুবে ভেসে ঢাকুরিয়ার দিকে চলে যাচ্ছিল সরলদা। রাত ঘন হয়ে হেমন্তের কলকাতায় শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছিল একটা। আর আমি বুঝতে পারছিলাম, হেমন্ত শুধুমাত্র একাকিত্ব বা মনখারাপের ঋতুই নয়, হেমন্ত ভালবাসার ঋতুও বটে!

আমি চল্লিশের শেষের দিকে এসে পড়েছি এখন। আমারও জীবনে নানা ঋতু গিয়েছে। আর অবশেষে দেবীর ভাসানের পরে আমার জীবনে এখন উঁকি দিতে শুরু করেছে অন্য এক হেমন্ত ঋতু। বনে বনে মেরুন হতে শুরু করেছে পাতারা। কৃষ্ণচূড়ার ডাল শূন্য হতে শুরু করেছে! তবু শহরে হেমন্ত এলে আজও কত কী যে মনে এসে ভিড় করে! অতীত থেকে ফিরে আসা বাবার স্বর! মায়ের ডাক! ফিরে আসে দাদুর আকাশের দিকে হাত তুলে দেখানো একটা তারা! ভাইয়ের সঙ্গে কোয়ার্টারের মাঠে উল্কা খসে পড়া দেখে ঠাকুরের কাছে হাত জোড় করে বলা, এ বার যেন অঙ্ক পরীক্ষায় সোজা কোয়েশ্চেন আসে!

ফিরে আসে বন্ধুদের স্পর্শ! শেষ বিকেলে জেটির উপর বসে দেখা ওই পশ্চিমে, জলের মধ্যে মিশে যেতে যেতে সূর্য রেখে যাচ্ছে তার সমস্ত রং! আচমকা শুশুক লাফিয়ে উঠছে রূপকথার মতো! মনে পড়ে সেই মুখ, যে এক হেমন্তের সন্ধেবেলা নীল শাড়ি পরে এসে দাঁড়িয়েছিল কাছে। গাড়ির অন্ধকারে হাত ধরে বলেছিল, “আর একটু যাবে আমার সঙ্গে!”

এখনও হেমন্ত চলছে। দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মধ্যবর্তী একটা শূন্যতা পেরোচ্ছি সবাই। আবার শহরে ফিরে এসেছে পাতা ঝরার মরসুম! ফিরে এসেছে নতুন হিমের স্পর্শ! আর এই অবসরে আমি ও আমার মতো অনেক অনেক মানুষ তোমাকে বলছি, শোনো, তোমাকেই বলছি, হেমন্তের ঝরা পোস্টকার্ড, ব্রোঞ্জের প্রজাপতি বা আকাশপ্রদীপের চিহ্ন ধরে ধরে তুমি যদি ফিরতে পারো এখানে, দেখবে দীপককাকু, রুনাদি বা আমি ও আমার মতো অনেকে বসে আছি অন্য এক ভালবাসার হেমন্ত নিয়ে। যেখানে শূন্যতার পরেও আবার জেগে ওঠার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। রয়েছে ঢাকুরিয়ার দিকে মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া এক মুখচোরা, লাজুক সরলদা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE