E-Paper

ভয়ানক

আজ মিল থেকে বেরিয়ে চার পাশটা ভীষণ নির্জন লাগল। বৃষ্টিও হয়ে গেছে। একাই হাঁটতে হবে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। মিলের মধ্যে কয়েক জন ঘাপটি মেরে বসে মদ খাচ্ছিল।

বিনতা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫১
ছবি: বৈশালী সরকার।

ছবি: বৈশালী সরকার।

জুটমিলে বড় অর্ডার আছে। অনেকের মতো অতসীও ওভারটাইম খাটছে আজ। ওর টাকার দরকার। ক্লাস নাইনঅবধি পড়ে কাজে ঢুকেছে পড়া ছেড়ে দিয়ে। বাবার অকালমৃত্যুর পর এ ছাড়া উপায় ছিল না। ভাইটা দিদি-অন্তপ্রাণ। ওকে পড়াবে অতসী, যত দূর পারবে।

যখন মিল থেকে বেরোল, রাত হয়ে গেছে। ও যাদের সঙ্গে ফেরে, তারা অনেক ক্ষণ চলে গেছে। একা ফিরতে হবে। সে তা পারবে, কিন্তু ভয় একটাই। ভয়ানক লোকটা আজও দাঁড়িয়ে নেই তো বাইরে? মনে হয় না, নিশ্চয়ই যথাসময়ে এসে ফিরে গেছে। অতসী যে ভিতরে, জানবে কেমন করে?

লোকটার নাম দিয়েছে ও ‘ভয়ানক’। দেবে না কেন, যা চেহারা! যেমন লম্বা, তেমন স্বাস্থ্য। কাঁধ অবধি চুল। আর এত কালো যে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যাবে না। আর কী চোখ! চোখেই গিলে খায় অতসীকে। নিজের টোটোতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিলের সামনে ছুটির সময়, রোজ।

কার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ওই ভয়ানক লোকটা? সত্যিই কোনও সওয়ারি তোলে, নাকি অতসীর জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে? এক দিন বাগে পাবে এই আশায়! পাবে না কোনও দিন, কারণ টোটোতে ও চড়বেই না। জোর করে যদি তুলে নেয়? নাহ্, সাহস পাবে না।

আজ মিল থেকে বেরিয়ে চার পাশটা ভীষণ নির্জন লাগল। বৃষ্টিও হয়ে গেছে। একাই হাঁটতে হবে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। মিলের মধ্যে কয়েক জন ঘাপটি মেরে বসে মদ খাচ্ছিল। ওরা বেরিয়ে আসার আগেই এখান থেকে সরে পড়তে হবে। কিন্তু ওটা কে? ভয়ানক লোকটা না? টোটোয় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! ওরে বাবা, আজ তো ওকে ধরবেই। কেউ নেই কোথাও।

মিল থেকে লোকগুলো দুলতে দুলতে বেরোচ্ছে। ওদের ও চেনে। অন্য সেকশনে কাজ করে। অতসীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে অনেক দিন, পারেনি। ওদের মধ্যে কেউ সিটি বাজাল। ওকে দেখে ফেলেছে।

অতসী এগনোর চেষ্টা করল। কিন্তু এ কী! ভয়ানক লোকটা টোটো নিয়ে চলে এসেছে। ওকে ইশারায় টোটোতে উঠতে বলল। ইস! বললেই হল, উঠবেই না। দৌড় লাগাবে ও। পিছন ফিরে দেখল দলটা আসছে টালমাটাল পায়ে। ওই যে কথায়বলে না, ‘আগে হাঁটলে পোড়া কপাল, পিছে চললে ফাটা কপাল।’

ভয়ানকটা গম্ভীর স্বরে বলল, “উঠে এস, পৌঁছে দেব। ওরা তোমায় ধরে ফেলল বলে... ওভারটাইম খাটতে গেলে কেন এই দুর্যোগের দিনে?”

অতসী উঠেই পড়ল টোটোয়। ব্যাটা সব জানে, শয়তান একটা। তবু ঠিক আছে, এখানে একটা লোক। দরকার হলে লড়ে যাবে। কিন্তু পিছনেএকটা দল।

টোটো চলছে। লোকগুলোর মুখের সামনে থেকে গ্রাস হারিয়ে গেল। ভয়ানকটা অতসীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কী চোখ!

বাসস্ট্যান্ডে এসে ভয়ানক বলল, “নামবে এখানে? একটাও বাস নেই স্ট্যান্ডে।” রাস্তার কাহিল অবস্থা। জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। থমথমে, ফাঁকা, শুনশান চার দিক।

“বাস আসবে না, তবে ওরা এসে যাবে ফিস্ট করতে। নামতে চাইলে নেমে পড়ো।”

কী শয়তান লোকটা! ভয়ও দেখাচ্ছে, নামতেও বলছে। মরিয়া হয়ে অতসী বলল, “না, নামব না।”

গলার মধ্যে ঘোঁত শব্দ করে টোটো ছোটাল ভয়ানক। হাসল নাকি ওটা?

আজ বুঝি বাগে পেয়েছে! অতসী ভাবল, অন্ধকারে টোটো থামিয়ে কিছু করতে গেলে, ও যা পাবে তা-ই দিয়ে পিছন থেকে মারবে এক ঘা। কিন্তু কী দিয়ে মারবে? ব্যাগের মধ্যে শুধু টিফিনকৌটো। ওটা কি অস্ত্র হতে পারে? দেখা যাক।

অতসী বলল, “আমি লোহাপাড়ায় যাব। পরে আপনার ভাড়া মিটিয়ে দেব। আজ টাকা নেই।”

গলার মধ্যে শব্দ করে ভয়ানকটা কী যেন বলল, সেটা ‘জানি’ বা ‘জানি না যেন’— যে কোনও একটা হতে পারে।

মাঝে মাঝে টোটোর গতি কমাচ্ছে। আর ঘুরে অতসীকে দেখছে। রাস্তা খারাপ বলে করছে, নাকি মাপছে ওকে? সুযোগের অপেক্ষা করছে বোধহয়। বুকটা চমকে চমকে উঠছে অতসীর। আজই বোধহয় শেষ দিন ওর জীবনের। মা-ভাই টেরও পাবে না। চোখে জল এসে গেল ওর।

ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল ভয়ানক লোকটা বলল, “বাড়িতে জানিয়ে দাও দেরি হচ্ছে কেন, না হলে চিন্তা করবে।”

অতসী বলল, “ফোনের চার্জ নেই,” বলে ফেলেই নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে হল। কী দরকার ছিল সত্যি কথাটা বলার! শুনিয়ে শুনিয়ে এমনি কিছু বলতে পারত, যাতে লোকটা ঝামেলা না বাড়ায়।

ঠিক রাস্তায় যাচ্ছে তো? এত অন্ধকার, ভাল করে দেখাও যাচ্ছে না। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো পোস্ট অফিসটা। ঠিকই যাচ্ছে। কিন্তু সামনে কয়েকটা ছেলে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ওরে বাবা, এই ভয়ানকটাই ডেকে এনেছে নাকি ওদের? সবাই মিলে ওকে…

হঠাৎ ভয়ানকটা মাথা ঘুরিয়ে ওকে বলল, “মাথায় ঘোমটা দিয়ে বোসো।”

এটা আবার কী চালাকি শয়তানটার? তবু ও ঘোমটা দিল। যাতে রাস্তার ছেলেগুলো ওর মুখটা দেখতে না পায়। একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, “কোথাকার সওয়ারি, কেষ্টদা?”

টোটো দাঁড় করাল না লোকটা, চলতে চলতেই জবাব দিল, “সওয়ারি না, ফ্যামিলি।”

ছেলেগুলো সরে দাঁড়াল। সাঁত করে টোটো পেরিয়ে গেল।

একটু গিয়েই ঝাঁকুনি দিয়ে পাশের বড় নালার রাস্তাটা ধরল। কেন এই রাস্তা নিল ভয়ানকটা? এটা আরও খারাপ আর জনমানবহীন রাস্তা। এখানেই বুঝি ওকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়ে নালায় ছুড়ে ফেলেচলে যাবে!

সামনে থেকে ফাটা বাঁশের মতো গলা এল, “এই রাস্তাটা শর্টকার্ট।”

শর্ট কাট, হ্যাঁ তা বটে। কিন্তু অতসী মনে মনে যেটা ভাবছে, ভয়ানকটা জেনে যাচ্ছে কী করে?

টোটোর গতি কমছে-বাড়ছে। অতসী ব্যাগ খুলে ব্লেডটা বার করল। যদি কিছু করতে আসে, ছুঁতেই দেবে না। নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলবে।

তার পর ভাবল, ‘আমিই মরে যাব, শয়তানটা দিব্যি থাকবে? দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি।’ ও ব্যাগ খুলে মিলের বিলের পিছনে ডট পেন দিয়ে লিখল, “আমার মৃত্যুর জন্য কেষ্ট টোটোওয়ালা দায়ী।” বুঝবে বাছাধন!

এই সবে অতসী ব্যস্ত ছিল, খেয়াল করেনি, টোটোটা কখন লোহাপাড়ায় ঢুকে পড়েছে। একেবারে অতসীর বাড়ির সামনে এসেথামল টোটো।

ভয়ানকটা বলল, “যাও, দরজায় কড়া নাড়ো। কেউ খুললে আমি চলে যাব।”

পড়ি-মরি করে নেমে দৌড়ল অতসী। নিজেদের দরজায় দুমদাম ঘা মারল। দরজা খুলল মা। হুস করে চলে গেল টোটোটা।

রাত্তিরে একা একা অতসী ভাবল, ঠিকই নাম দিয়েছে ওর— ভয়ানক। শুধু আর একটা শব্দ জুড়তে হবে, ভাল। মানে ‘ভয়ানক ভাল’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy