এ বারে পুজায় কী দেবে গো বাবু?” কচি গলায় প্রশ্নটা এল।
মন দিয়ে পুজো কমিটির মিটিংয়ের রিপোর্ট দেখছিলেন অতীনবাবু, খেয়াল করেননি, কখন বাইরে থেকে এসে তাঁর একতলার কাজের ঘরের জানলার শিক ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট বুধু।
বাপ-মা মরা এই সাত বছরের ছেলেটা পাড়ার রঘু ময়রার দোকানে কাজ করে। ছেলেটা নাকি বিশ্বাসী, রঘু বলে। দোকানের কিছু কারিগর ভাল ছানার তাল এ দিক-ও দিক করত, সেটা ও ধরেছে। রাতে ওখানেই থাকে। মাঝে-মধ্যে রঘুর দোকান থেকে মিষ্টি দিয়ে যায় বুধু, আর যখন সময় পায়, এসে অতীনবাবুর সঙ্গে বকবক করে যায়। উনি আপত্তি করেন না।
অতীনবাবুর তিন কুলে আপন কেউ নেই। বিয়ে করে সে অভাব পূরণ করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু বিয়ের দিন হবু স্ত্রী তার প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে ফেরার। মন ভেঙে গিয়েছিল একেবারে। ওকালতির কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করলেন বহু ধরনের সামাজিক কাজকর্মে। তবে, বাপ-মায়ের মৃত্যুর পর এক শূন্যতা জীবনকে ঘিরে থাকার দরুন এই সরল মনোভাবাপন্ন ছেলেটির সঙ্গে তাঁর এক রকম সখ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
সন্ধে নেমেছে সবে। কোর্ট থেকে ফিরে, পার্বতীর করা পরোটা আর আলুর তরকারি খেয়ে কাজে বসেছেন, এমন সময় এই প্রশ্ন।
“জামা,” হেসে বললেন অতীনবাবু।
“আমারে মোবাইল দাও।”
“যা, যা... মোবাইলের কত দাম জানিস?”
“তুমি তো কত বড়লোক, দাও না!”
“সে কী রে! আমি বড়লোক? কে বলে?” আবার হাসলেন অতীনবাবু।
“কেন! পার্বতীমাসিই তো বলে।”
উফ! এই এক হয়েছে জ্বালা! পার্বতীর কাজের ব্যাপারে কোনও ত্রুটি নেই, কিন্তু বড্ড ওস্তাদ। আগডুম-বাগডুম বকে। বিশেষ করে বুধুকে। লোক পুরনো হলে যা হয় আর কী!
“না না, মোবাইল নয়,” বললেন উনি, “পুজোর সময় নতুন জামা পরবি, তবে না! তোকে এ বার একটা লাল জামা দেব, বুঝেছিস?”
“ও আমার আছে। গত বারে দিয়েছিলে।”
“না, নীল দিয়েছিলাম!” অতীনবাবুর মনে ছিল।
“না বাবু, দাও না আমারে মোবাইল!”
“তুই যা, বুধু!” ধমকে উঠলেন অতীনবাবু, “এখন আমার কাজের সময়।”
জানলার শিক ধরে নিজেকে উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বুধু, তাঁর কথায় এক পলক তাকিয়ে, শিক ছেড়ে নেমে, তাঁদের বাড়ির মাঠ পেরিয়ে, আস্তে আস্তে রঘুর দোকানে ফিরে গেল সে।
রাস্তার ম্লান আলোয় ওর যাওয়ার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে আবার কাজে ডুবে গেলেন অতীনবাবু। এটা শেষ করে আবার তিনটে ওকালতনামা নিয়ে বসতে হবে। তার পর আবার পুজো কমিটির মিটিং। এ বারে উনি প্রেসিডেন্ট। দায়িত্ব অনেক বেশি।
*****
পুজো এসে পড়ল প্রায়। এ বারে কাজ অনেক। তিন বছর পরে পাড়ার পুজোর একশো বছর হবে, তার জন্য এখন থেকেই তোড়জোড় শুরু। এ বার থেকে শুরু করা হবে সরাইকেলা থেকে ঢাকি, জামশেদপুর থেকে লাইট, কলকাতা থেকে আর্টিস্ট— এই বিরাট খরচের জন্য চাঁদা জোগাড়ের সিংহভাগ অতীনবাবুর দায়িত্ব। তা ছাড়া পুজোর ছুটির আগে কোর্টের অনেক কাজও তাঁকে এগিয়ে রাখতে হচ্ছে।
মহালয়ার পরের দিন অতীনবাবুর খেয়াল হল যে প্রায় এক মাস হতে চলল, কিন্তু সে দিনের পর বুধু একটি দিনও আসেনি। এমনিতে সে মহালয়ার দিন এসে হাজির হয়, এবং তার পুজোর জামা তাকে তিনি দিয়ে দেন। এ বারেও তার লাল জামা রেডি, কিন্তু সে গেল কোথায়?
পার্বতীকে জিজ্ঞেস করাতে সে হেসে বলল, “কে জানে কুথায়! কিন্তু রঘু কইছিল…”
“কী বলছিল?”
“বুধু প্রায়ই দোকান ছেড়ে এ দিক-ও দিক যায়, উ নাকি ইস্টিশনে ভিখ ভি মাংছে! মানে উকে দেখেছে অনেকে।”
“ভিক্ষে চাইছে? স্টেশনে? কেন?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন অতীনবাবু।
“কে জানে!”
চুপ করে গেলেন অতীনবাবু। এক বার ভাবলেন পার্বতীকে পাঠাবেন রঘুর দোকানে খোঁজ নিতে, কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ছেলেটা তা হলে মাথায় উঠে যাবে।
হল কী ছেলেটার? আর যা-ই হোক, তার তো ভিক্ষে করার কথা নয়!
*****
রহস্যভেদ হল দশমীর দিন।
পুজো এ বার আশাতীত ভাল কেটেছে। পাবলিসিটিও হয়েছিল জবরদস্ত। ফলে সিঁদুর খেলার ভিড়ে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে বাইরের মহিলারাও ছিলেন। মহিলাদের এই উৎসাহের অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক ভাবেই অতীনবাবু পাড়ারঅন্য কমিটি-মেম্বারদের সঙ্গে একটু দাঁড়িয়েছিলেন, একটু বিষণ্ণ।
মায়ের পুজো নির্বিঘ্নে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের চলে যাওয়ার পর যে অপরিসীম শূন্যতা মনকে গ্রাস করে ফেলে, তা যেন কাটতেই চায় না। হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক হুলস্থুল এবং চেঁচামেচির সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা যেন থেমে গেল এবং উনি শঙ্কিত হয়ে দেখলেন, বুধুর চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছেন অজানা এক দশাসই মহিলা, আর সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে!
“হতভাগা রাসকেল! আমার মোবাইল চুরি করিস!” বলতে বলতে সপাটে এক চড় বসালেন তিনি বুধুর ওই কচি গালে।
ডুকরে কেঁদে উঠল বুধু।
ঘটনার আকস্মিকতায় অতীনবাবু কী করবেন বুঝে ওঠার আগেই, বাকিরা তাড়াতাড়ি বুধুকে ওই মহিলার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন বটে, কিন্তু কোনও এক অজানা যন্ত্রণায় চিৎকার করেউঠল বুধু।
এ বারে আর স্থির থাকতে না পেরে দৌড়ে গেলেন অতীনবাবু।
ওর কান্নাভেজা সরলতা মাখানো চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি। বোধহয় বুধু বুঝতে পারল ওঁর মনের জিজ্ঞাসা।
কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মোবাইল দিয়ে পুজোর পেনাম পাঠাতাম বাবু।”
“প্রণাম? কাকে বুধু?”
“বাবা-মাকে। ওঁরা তো আকাশে আছেন,” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সে। “মোবাইলের কথা তো আকাশ হয়ে যায় বাবু। সবাই বলে। ওঁরা তো আমার পেনাম… আজকের দিনে…”
বাকি কথা কান্নায় ভেসে গেল তার।
বুধুকে কোনও রকম সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলেন না অতীনবাবু।
কত দোষীকে যিনি অবলীলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, তাদের প্রাপ্য শাস্তি মঞ্জুর করেছেন, আজ একটি সরল মনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার অপরাধে কোন আদালতের সামনে তিনি কাকে পেশ করবেন?
উৎসবের আনন্দ-মিশ্রিত বিষণ্ণতাকে ছেয়ে ফেলল কালো মেঘের আত্মগ্লানি। এই মামলার নিষ্পত্তি যে তাঁর এখনও জানা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)