E-Paper

নৌকাবিলাস

অনেক নিচু ভূমি থেকে উপরের অন্ধকার সর্পিল সেতুটাকে সত্যি সত্যি নরকের দূতের মতো লাগে এই সময়ে।

সব্যসাচী ধর

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:২৩
ছবি: প্রীতম দাশ।

ছবি: প্রীতম দাশ।

শীতের বিকেল প্রায় শেষ। অজয়ের জল নেমে গেছে মাঝপেটে। বালির চরে হালকা সবুজ ঘাস জন্মায় বর্ষার পরে, মরা নদী শ্যাওলা-সবুজ রূপ নেয়। ফুলহীন কাশের জঙ্গল কাঠিসার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আলো-আঁধারিতে মরা নদীটাকে অদ্ভুত দেখায়।

কদমখণ্ডি ঘাটের কিছুটা উজানে সদাই ঘরামির ঘর। পড়ন্ত বিকেলে নদী থেকে শীতল হাওয়া উঠে আসে। সদাই ঘর ছেড়ে নদীর ধারে এসে বসে, মকরের মেলার পর পড়ে থাকা খড়-বাতা জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে বসে।

সামনেই উল্টে রাখা একটা ছোট ডিঙিনৌকা। কিসমত জেলের এই ডিঙিটা দু’বছর হল ওই রকম ভাবেই পড়ে আছে। আর সোজা করে না কিসমত। তবে বিকেল হলে নদীর পাড়ে এসে চুপ করে তাকিয়ে থাকে নৌকাটার দিকে। এক সময় আগুনের পাশে এসে বসে কিসমত।

নিকুঞ্জ বৈরাগী এই সময় গ্রাম ঘুরে এসে নদীতে নেমে স্নান করে। কোমর জলে দাঁড়িয়ে পরনের গামছাটা খুলে নিয়ে লম্বা চুল-দাড়ি মুছে আবার ঠেঁটি কাপড় ও ফতুয়াটা পরে নিয়ে উঠে আসে পাড়ে। আগুনের পাশে এসে বসে। শীত কাটিয়ে নেওয়ার পর গাঁজার ছিলিম ধরিয়ে কয়েকটা গাঢ় টান দেয়। এর পর সদাই এবং শেষে কিসমত ভাগ পায় একটু করে। কল্কের ছাই ঠুকে ফেলে খুব জোরে ফুঁ দিয়ে ফেরত দেয় নিকুঞ্জর হাতে।

“নাওখান আর ঠারো করবা না কিসমত ভাই?” নিকুঞ্জ জিজ্ঞেস করে।

উত্তর দেয় না কিসমত। মাথাটা সামান্য নাড়ে।

একটু নেশা হলেই নিকুঞ্জ গান না করে থাকতে পারে না। থলে থেকে ডুবকিটা বের করে আপনমনে গান ধরে। গানের সুরে বলে, “এরে হেলাফেলা কোরো না— আমার রাধারাণীর চরণছোঁয়া এই তরীখানি— হেলাফেলা কোরো না, ওহে, কত ঘাটপাড়ানি কড়ি গুনে— চিন্তামণি ছেড়ো না, এরে হেলাফেলা কোরো না ...” নেশাটা জমে উঠেছে নিকুঞ্জর। উঠে দাঁড়ায়, মাথার ভিজে চুল থেকে দু’-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে পাতলা ফতুয়ার উপরে। একটু ঝুঁকে নৌকাবিলাস গেয়ে গেয়ে আগুনের অঙ্গার-সহ দুই মানুষকে কয়েক বার প্রদক্ষিণ করে, তার পর ঘরের পথ ধরে। সামান্য পিছনেই কয়েক জন বৈরাগীর আখড়া।

ভিতরে যাওয়া ধোঁয়ার নেশার কারণেই হয়তো, নৌকাটাকে দেখে বড় উদাস হয়ে পড়ে সদাই। বলে, “তোমার এই উল্টোনো নাওখানা দেখলে আমার বাপের নৌকাবিলাসের কথা মনে পড়ে। ওই করতে যেয়েই তো মাজা ভাঙলে, তার পর আর উঠলে না।”

“বলো কী সদাইদাদা? কী হয়েছিল তেনার?”

“আমার বাপ নিতু ঘরামিই পারত, জেবনের ভয় করত না। সে এক কঠিন হিসেব করে চোখের মাপ করে বড় ধানের খড়ের আঁটি গুছিয়ে গুছিয়ে চাল ছাওয়ানো। এক বার করে ঘরের চালের টুই থেকে নেমে এসো, ভাল করে ঠাওর করো, আবার চালে ওঠো— এই করে ঘরামির কাজ হত। চাল ছাওয়ানো শেষ হলে দেখে মনে হত, একখান নৌকা ঘরের উপরে উল্টো করে রাখা আছে। এরে বলে নৌকাবিলাস চাল ছাউনি। তা এই করতে যেয়ে এক দিন অনেক উঁচু কোঠার টুই থেকে মাটিতে পড়লে! বুঝলা?” একটু চুপ করে থেকে বলে, “একটা বিড়ি দাও দেখিন।”

দু’-চারটে টান দিয়ে সদাই আবার বলে, “তাইলে নাওখান আর জলে নামাবা না কিসমত? ”

গাঁজার টানে খুব আমোদ হয় ভিতরে ভিতরে, অকস্মাৎ গভীরতর দুঃখ! একচোট হেসে নিয়ে কিসমত বলে, “কী যে বলি সদাইদাদা! আমার আর এ সবের দরকার নাই। ওই তো নাওয়ের মালেক মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দেখেন। এই নাও এ বার যাবে নরকে!” কথাটা বলেই নতুন সেতুটার দিকে আঙুল তুলে দেখায় সে।

অনেক নিচু ভূমি থেকে উপরের অন্ধকার সর্পিল সেতুটাকে সত্যি সত্যি নরকের দূতের মতো লাগে এই সময়ে।

সদাই জানে, এই সেতুটা হওয়ার পর থেকেই কিসমতের পরিবারে চরম দারিদ্র নেমে এসেছে। বহুকাল থেকে তারা এই ঘাটে পারানির কাজ করত। সারা বছর ভালই উপার্জন হত তাদের। নদীর বান এলে ওর কোঁচড়েও পারানির বান আসত। তবে যে দিন বড় উৎসব করে ব্রিজের উদ্বোধন হয়েছিল, সে দিন কিসমতের ঘরে দুঃখের বান ডেকেছিল।

আগুনটা ঝিমিয়ে এসেছিল। একটা কঞ্চি দিয়ে উস্কে দেয় সদাই। অঙ্গারের লাল আভায় কিসমতের মুখ স্পষ্ট হয়। সদাই দেখে, কিসমতের চোখ থেকে জল পড়ছে। উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হল ভাই কিসমত? কাঁদো কেনে?”

কখন একটা ছেলে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটা বুঝতে পারেনি সদাই। তাকে উদ্দেশ্য করে কিসমত বলে, “জামাই বাপজান, সদাইদাদা আমাদের বড় আপনার লোক, তার কাছে লুকোছাপার কিছুই নাই, সেও হাত লাগাবে।”

রাত্রির গভীর অন্ধকারে, নদীর বালিতে চেপে বসে থাকা নৌকাটাকে তিন জন লোকে আপ্রাণ চেষ্টা করে সোজা করে। জলের ধারে টেনে নিয়ে যায়। কিসমতের জামাই বছর কয়েক আগে অজয়ের সেতুর শ্রমিকের কাজ করতে এখানে এসেছিল। তার পর বিয়ে হয়েছিল কিসমতের ছোট মেয়ে রুকসানার সঙ্গে। দুটো ছোট ছেলেও আছে। আর একটু পরে সে চলে যাবে সুন্দরবনের ও দিকে। ও দিক থেকেই এক দিন এসেছিল সে। ওর এখানে থাকার কোনও কাগজ নাই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy