পূর্বানুবৃত্তি: এক বার পলাশের সঙ্গে তার মায়ের কিছু ব্যক্তিগত ওয়টস্যাপ মেসেজ দেখে ফেলেছিল দীপ। নিষিদ্ধ সম্পর্কের আভাস পেয়েছিল সে। বাবাকে কিছু বলেনি। তার ভয় হয়েছিল, যদি বাবা কোথাও চলে যান! অন্য দিকে জ্যোৎস্নাদেবীর মনে ভিড় করে আসে অতীতের নানা কথা। বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়া, সেই কারণে বাড়িতে প্রবল অশান্তি এবং ঘর ছেড়ে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে ঘর বাঁধার কথা, এমনই আরও নানা প্রসঙ্গ। মনে পড়ে যে বার মঞ্চে তাঁর প্রেমিক পুরুষটি ছিলেন কর্ণের ভূমিকায় এবং তিনি ছিলেন মা রাধার চরিত্রে, সে বারেরর তুমুল জনপ্রিয়তার কথা। রান্নাবান্না সেরে রেখে বাইরে দাওয়ায় এসে বসেন জ্যোৎস্নাদেবী। সেখানেই দুই প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কুশলবিনিময় এবং টুকটাক কথাবার্তা হয় তাঁর।
রূপার কথায় চমকে উঠলেন জ্যোৎস্নাদেবী। আয়নাটা কি মিথ্যে বলে! তিনি কি সব রূপ হারিয়েছেন!
রূপার সহচরীটি তখন বললেন, “দিদি, তুমি যে কী বলো! আমাদের জ্যোৎস্নাদি এখনও তো রূপে চাঁদের কিরণ যেন।”
রূপা বলল, “আর আমি?”
“কোথায় জ্যোৎস্নাদেবী, আর কোথায় তুমি!”
রূপা কথা না বাড়িয়ে গজগজ করতে করতে হাঁটা দিল।
পরদিন সাধনকে ডাকলেন জ্যোৎস্নাদেবী। সাধন একটু পরেই এল।
“তোর গাড়ি ভাড়া নেই তো আজকে?”
সাধন বলল, “ম্যাডাম, কাল একটা বিয়েবাড়ি আছে। আজ ফাঁকা আছি। কোথাও যাবেন?”
“ব্যাঙ্কে যাব। সেখান থেকে কাকদ্বীপে। আর কালনাগিনী নদীর তীরে একটু বসব।”
“পঞ্চমুখী গঙ্গা পেরিয়ে কালনাগিনীতে কেন বসবেন ম্যাডাম!”
“তোর মনে আছে?”
“কী বলুন তো ম্যাডাম?”
“সেই ‘কর্ণার্জুন’ পালা করেছিলাম পাথরপ্রতিমায়। নদী পেরিয়ে যেত হয়েছিল। গাড়ি ছিল ঘাটে।”
“আমি তখনও লায়েক হইনি ম্যাডাম। বাবা চালিয়েছিলেন। আমি সঙ্গে ছিলাম।”
“ঠিক, ঠিক। দিলীপ তখনও বেঁচে ছিল।”
“ম্যাডাম, রাগ করবেন না। বলছি, রাতে ফিরবেন তো?”
“আমি কেন রাগ করব! তোকে কি আর বেশি টাকা দিতে পারব! কম নিবি তো বাবা?”
“আপনার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা করে ম্যাডাম। আগে স্যর আর ম্যাডাম গাড়িতে উঠলে পাড়ার লোকের হিংসে হত। হিরো আর হিরোইন!”
“এখন ফক্কা, তাই না?”
“ম্যাডাম, মাপ করবেন, আপনি এখনও সুন্দরী। আমায় শুধু তেলের খরচাটুকুই দেবেন, কিন্তু তাতেও অনেক পড়বে।”
“পড়ুক। এক দিন তো মঞ্চে কত নকল রানি সেজেছি। আজ সব ফুরিয়ে গেছে যখন, এক বার দেখব সেই পথ— সেও কি আমাদের ভুলে গেছে! নিশ্চয়ই গেছে। অসংখ্য নরনারীর রেখাঙ্কুরের পথ আলাদা করে মনে রাখবে কী করে!”
‘কর্ণার্জুন’-এর পরই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল ও। শ্রাবণে সে বার বানভাসি অবস্থা। তবুও সুন্দরবনের মতো বিপদসঙ্কুল অঞ্চলে পালা করতে গেল দল। এক বার কর্দমাক্ত মাটিতে পা মুচকে গেছিল নটসম্রাট স্বপনকুমারের। সেই থেকে গল্প আছে তিনি নাকি ওখানে কয়েক বার হেলিকপ্টারে নেমেছিলেন। শ্রাবণের আকাশ সে দিন ছিল শান্ত। তবে কালনাগিনী জলে টইটম্বুর। মাঝি বলল, “ম্যাডাম, জলে হাত দেবেন না।”
জ্যোৎস্না জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেন?”
মাঝি বলল, “কামট আছে।”
তখন ও বলেছিল, কুমিরের ছোট প্রজাতি। হিংস্র। মুহূর্তে হাত টেনে নিয়ে যাবে। আর পা পেলে তো কথা নেই। আস্ত মানুষ ওর পেটে চলে যাবে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিলেন। ওর গা ঘেঁষে বসেছিলেন জ্যোৎস্না। কী যে নির্ভরতা ছিল ওঁর উপর!
নৌকো থেকে নামার সময় দেখা গেল, লগি রয়েছে নৌকোর কাছ থেকে পাড় অবধি। লগি মানে বাঁশের কঞ্চি। সেখানে তো দু’জন হবে না। একা পার হতে হবে জ্যোৎস্নাকে।
উনি বললেন, “নীচে তাকিয়ো না। সোজা তাকাবে। আমার মুখোমুখি তাকাবে। ভয় নেই, কিছু হলে আমি কালনাগিনীর বুকে ঝাঁপ দেব।”
ঈশ্বর ভরসা, আর তিনি। সে যে কী ভাবে পার হয়েছিলেন জ্যোৎস্না, আজও ভাবতে পারেন না।
ঘাটে নামতেই বোঝা গেল, মেলা বসে গেছে। হ্যাজাক হাতে নিয়ে নরনারী চলেছে যাত্রার আসরে। ফুচকাওয়ালা, ঘুগনি, সে সত্যি এক মেলা। মেয়েরা চুড়ি, কাঁচপোকা টিপ কিনছে, আর বিবাহিতারা নতুন করে শাঁখা পরছে।
তাঁরা যখন একটা ছোট বাসে উঠলেন যাওয়ার জন্য, হইচই পড়ে গেল। নায়ক, নায়িকা একই বাসে উঠেছেন। যদিও রাধা কর্ণের মা। কিন্তু আসল জাদু ওঁদের নামে।
বৃষ্টি কখনও ঝিরঝির করে ঝরছে, কখনও হাওয়ার সঙ্গে মিশে ঝোড়ো হয়ে উঠছে। জানলার শার্সি তিনি কখনও তুলছেন, কখনও তুলছেন না। একটু-আধটু ভিজছেন।
ঠাকুরপুকুর পেরোতেই দুপুর গড়িয়ে গেল। থ্রিএ বাসস্ট্যান্ডে কখনও কখনও অপেক্ষা করেছেন বইকি। তিনি আসবেন। তখন তো তা ছিল নিষিদ্ধ প্রেম। দিনগুলি যায় তো যায়, আর ফিরে আসে না।
ঠাকুরপুকুর পেরিয়ে গাড়ি বিষ্ণুপুর এল। এর পর আমতলা। এখানে অনেক ভাল নার্সারি আছে। অনেক চারা কেনা হয়েছিল। ফুলের, বনসাইয়ের।
গাড়িটা ডান দিকে বাঁক নিলে ডায়মন্ড হারবার।
সাধন বলল, “ম্যাডাম, ডায়মন্ড দিয়ে যাবেন? গঙ্গার ধারে বসতে পারবেন। সাগরিকার হোটেলে খাওয়াদাওয়াটা ভাল।”
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “কাকদ্বীপে খাব মোটাদার হোটেলে। এ ছাড়াও উস্তির মোড়ে মগরাহাট থানার কাছে নকুলের চায়ের দোকান আছে। ও দিকে যাত্রা করতে গেলে আমরা থামতাম। একদম মগরাহাট থানা লাগোয়া। নকুল নাকি এক সময় ডাকাতি করত। তার পর থানার মেজবাবুর প্রেরণায় সে দোকান করে, বদলে ফেলে জীবন।”
সাধন বলল, “ম্যাডাম, সে সব তো বহু আগের কথা। এখনও কি নকুল আছে?”
সামান্য চিন্তার রেখা দেখা দিল জ্যোৎস্নাদেবীর মুখমণ্ডলে। তিনি বললেন, “তাই তো! তবু এক বার খোঁজার চেষ্টা করে তো দেখি!”
সাধন হেসে বলল, “হ্যাঁ ম্যাডাম। উস্তি দিয়ে গেলে আমারও সাত কিলোমিটার বাঁচবে।”
তাই হল, গাড়ি উস্তি অভিমুখে যেতে থাকল।
যেতে যেতে একটা পার্ক দেখলেন জ্যোৎস্নাদেবী। দম্পতি ও তাঁদের শিশুসন্তান। শিশুটি দোল খাচ্ছে। চোখে জল এল জ্যোৎস্নাদেবীর। এ রকম মা তিনিও হতে পারতেন। তাঁদের জগতে ঘুরে বেড়ানো মানে এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, মফস্সলে মফস্সলে বা শিল্পনগরীতে নতুন পালা নিয়ে যাওয়া। এক সঙ্গে থাকা স্কুলবাড়ি বা বড়জোর পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে।
উস্তি পৌঁছে জানা গেল, নকুল মারা গেছে কয়েক বছর হল। দোকানটা এখন বন্ধ। গাড়ি ভুল করে পুকুরবেড়িয়া মোড় পেরিয়ে বামুনের বাজারে চলে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “রাস্তা ভুল হচ্ছে না তো!”
“না, ম্যাডাম। ডান দিকে ঘুরলে সপ্তমুখী গঙ্গা। মোহনা বাংলো। এক বার সাগরদ্বীপে গেছিলাম যাত্রা করতে, তাই ভুল হয়ে যাচ্ছিল।” সাধন হাসল। সে বেশ শান্তমনে গাড়ি চালাতে চালাতে মোটাদার হোটেলে এসে থামল।
সেখানে ইলিশ দিয়ে ভাত খেল দু’জনে। কাকদ্বীপের ইলিশ খুব কিছু সুস্বাদু নয়। তবুও আজ মন্দ লাগল না। গাড়ি রামকৃষ্ণ গ্রাম-পঞ্চায়েতকে ডানে রেখে এগোলে সারি সারি ট্রলার দেখতে পেলেন। ধীবরদের ট্রলার সব। মোবাইলে একটা ছবি তুলে নিলেন জ্যোৎস্নাদেবী।
এ বার এলেন কালনাগিনীর তীরে। আবার সে দিনের মতোই নক্ষত্রখচিত আকাশ। নৌকো তরতর করে এগিয়ে চলেছে। বর্ষার কালনাগিনী খরস্রোতা। সব একই রকম আছে, শুধু নেই সে দিনের সেই নায়ক, নেই উত্তাল জনতা, মেলা বসানো হাট, ফুচকাওয়ালা। এখনও যেন বাজছে ক্ল্যারিয়োনেট। নট-নটীরা মঞ্চে আসার জন্য উদ্বেল। হাওয়ায় কান পাতলেন তিনি, আছে কি কোনও স্বর! কোনও প্রম্পটার কি এখনও বলে যাচ্ছে মহাভারতের যুদ্ধে মহাবীর কর্ণের সেই অসম লড়াই! চোখের জলে ভিজছে কি আজও নরনারী!
না। সবটাই মিথ্যে। সবটাই সাজানো খেলাঘর। সত্যি কিছু নয় যেন।
তবে নিশ্চয়ই এখনও রয়েছে কামটের দল। নাকি তারাও আর নেই! পরখ করার জন্য সব ভুলে জলে হাত দিতেই সাধন টেনে নিল ম্যাডামকে।
মাঝি চেঁচিয়ে উঠল, “সাবধান! কামট!”
একটু হলেই জ্যোৎস্নাদেবীকে টেনে নিয়ে যেত হিংস্র কামট।
সাধন বলল, “দিদি, রাতে থেকে ভোরে বেরিয়ে গেলে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।”
জ্যোৎস্নাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ক্ষতি হবে না তো?”
“ম্যাডাম, আপনার কাছে একটা রাত কাটানো জন্ম-জন্মান্তরের পুণ্যফলে সম্ভব।”
“তোমরা যে এখনও এত ভালবাসো আমায়, ভাবলে অবাক হয়ে যাই। কোথায় থাকব, সাধন?”
“এখানে একটি সরকারি বাংলো আছে, পলাশ বলে একটি ছেলে আছে। বেশ ভদ্র।”
“চলো তা হলে।”
একটু পরেই ওরা গঙ্গা যে সাগরে মিশেছে সেই মোহনায় এল। এটাকে বলে লট এইট জেটি। ও পারে অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পেরোতে হয়েছিল। একটু হেঁটে গেল ওরা। ওখানে বাংলোটি দেখে চিনতে পারলেন জ্যোৎস্না। দুপুরে খেয়েছিলেন। আবছা মনে পড়ছে পলাশ নামটা।
সাধন ম্যাডামের কথা বলতেই ছুটে এল পলাশ। পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
বলল, “দিদি, আমায় মনে আছে?”
“মনে ছিল না ভাই, কিন্তু তোমায় দেখে সব মনে পড়ে গেল। মাগুর মাছ, কাঁচকলা দিয়ে কী অপূর্ব ঝোল করে খাইয়েছিলে।”
“সব মনে আছে আপনার!”
“তোমাকে দেখেই পুরনো ডায়েরির এখানকার পাতাগুলি খুলে গেল।”
“কয়েক দিন থাকবেন তো ম্যাডাম!”
“না, আজ রাতটুকু থাকব। একটা অমলতাস গাছ ছিল না?”
“ম্যাডাম, মারা গেছে।”
“আ-হা!” বলে উঠলেন জ্যোৎস্নাদেবী।
“কেউ জানতে পারলে আপনাকে যেতেইদেবে না।”
“ওটা কোরো না, সাধনের ক্ষতি হয়ে যাবে।”
একটা সুন্দর ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিল পলাশ। বলল, এক নম্বর ভিআইপি রুম।টিভিটা চালিয়ে দিয়ে গেল। খুনোখুনি চলছেই নির্বাচনোত্তর দিনগুলিতেও।
পর দিন বেরনোর সময় এক দল নাট্যকর্মী দেখা করতে এলেন।
এক জন বললেন, “দিদি, আমি সমিধ বসু। আমরা সবাই নোনা থিয়েটারের।”
“তোমাদের ‘অয়দিপাউস’ দেখেছি তো আমি।”
ওদের মুখ খুশিতে ভরে উঠল।
গাড়িতে ওঠার সময় বলল, “আবার আসবেন কিন্তু! বিশেষ করে ডিসেম্বর নাট্যোৎসবের সময়।”
এক জন তরুণ যুবক বলল, “আপনাকে উদ্বোধন করতে হবে।”
হাসলেন জ্যোৎস্নাদেবী। হাত তুলে প্রণাম করলেন সবাইকে। গাড়ি চলতে শুরু করল। সামান্য দুঃখ রয়ে গেল অমলতাস গাছটার জন্য।
১৮
বাড়িময় ডালে ফোড়ন দেওয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দিন পর সুধাময়ী মন দিয়ে ডাল রান্না করছে। ছেলের চিঠি এসেছে। সচরাচর চিঠি তো লেখে না। আজকাল চিঠি লেখার রেওয়াজ নেই। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে ইসরো-তে। মাত্র কয়েক দিনের জন্য বাড়ি আসতে পেরেছিল। তাই হয়তো ফোন ছাড়াও চিঠি লিখেছে। ছেলের চিঠি সুধাময়ীকে পুরনো দিনের মতো ডাল রাঁধতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ঠাকুরদা মাঝে মাঝে পুরনো কলকাতার গল্প বলতেন। শহরের অনেক জায়গায় শেয়ালের ডাক শোনা যেত। তখন নাকি শহরের যাবতীয় আবর্জনা গঙ্গায় ফেলা হত। আজও তা-ই হয়, আর এমন ভাবে চলতে চলতে গঙ্গাও দূষিত হয়ে গিয়েছে। ঘোড়ায় ট্রাম টানত। ঠাকুরদার বাবা দেখেছিলেন।
বাবা যে-হেতু যাত্রার সঙ্গে খুব যুক্ত ছিলেন, জনমেজয় এক বার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাবা, যাত্রা আসলে কোথা থেকে এল?”
হেসেছিলেন বাবা। বলেছিলেন, “মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর রাজ্যত্যাগ করলেন, তখন আশ্রমিক পর্বে তাঁর সঙ্গে যাত্রার দল ছিল। তবে আমরা তো কৃষিজীবী, আমাদের প্রধান উপাস্য হচ্ছেন সূর্যদেব। আর বিবস্বান যখন দক্ষিণায়নে গমন করেন, তখনই আসে বর্ষা, আর বৃষ্টি আনে ফসলের সম্ভাবনা। এর পর হিন্দুদের বড় উৎসব হচ্ছে রথযাত্রা। দেবতারা রথে চেপে যেতেন, সেই থেকে রথযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল যাত্রা। আসলে এক সময়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল দেবদেবীদের অলৌকিক বিভা বর্ণনায়।”
এটুকু বলে বাবা থেমেছিলেন।
ছেলে ছোটবেলায় এক দিন জিজ্ঞেস করেছিল জনমেজয়কে, “বাবা, দ্বাদশ যাত্রা কী?”
জনমেজয় বাবার সূত্র ধরে বলে গিয়েছিলেন, “বৈশাখে মঞ্চ যাত্রা, জ্যৈষ্ঠ মাসে মহাস্নান যাত্রা, আষাঢ়ে রথযাত্রা, শ্রাবণে জলযাত্রা, ভাদ্রে ধুনন যাত্রা, আশ্বিনে মহাপূজা যাত্রা, কার্তিকে দীপযাত্রা, অগ্রহায়ণে নবান্ন যাত্রা, পৌষে অঙ্গরাগ যাত্রা, মাঘে মহাদেবী যাত্রা, ফাল্গুনে দোলযাত্রা, চৈত্রে দূতী যাত্রা, বাসন্তী যাত্রা। আর সব শেষে নীল যাত্রা।”
ইসরো-তে কাজ করতে করতে ও হয়তো এ সব ভুলে যাবে।
বাইকটা রেখে ছুটতে হল ট্রেন ধরার জন্য। ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে। ওভারব্রিজে না উঠে রেল লাইন ক্রস করে কোনও ক্রমে ট্রেন ধরলেন জনমেজয়।
উঠেই দেখেন, রফিককে ঘিরে চলছে মশকরা।
দেবাশিস বলছে, “রফিকদা, জনাদার পুজোর যাত্রা ‘ম্যাকবেথ’। তুমি নাকি ম্যাকবেথ হবে।”
“পয়সা পেলে হব।”
“কী হবে বলো এক বার।”
রফিক গুম মেরে থাকে।
দেবাশিস বলে, “গুরু, এক বার বলো কী হবে?”
রফিক পায়ের জুতো খুলে বলে, “আমি তোর বাপের বয়সি, ইতরামি করার জায়গা পাসনি!”
“বলো না, এক বার, তুমি কী হবে!”
রফিক বলে, “ম্যাকবেথ। আমি সে কালের এন্ট্রান্স। তোদের মতো টোকা মাল নয়কো।”
জনমেজয় বলেন, “তোমাকে রাগাচ্ছে।”
এ বার সমীর এসে বলে, “জনাদা, রফিকদা লেডি ম্যাকবেথ মানাবে ভাল। যা টুকটুকে গায়ের রং! পাক্কা সায়েবদের মতো!”
রফিক এমনিতে বেশ ফর্সা মানুষ। গুমগুমে গলায় বলল, “আমি কী হব, তোকে তা নিয়ে মাতব্বরি করতে হবে না। যত রাজ্যের মাতব্বর এসেছে সব। ফুক্কুড়ি করতে ওস্তাদ!”
এ বার এক জন বলে, “নাজিরবাবু তোমার টাকা টি আর সেভেনে ঢুকিয়ে সাহেবের কাছে নিয়ে গেছে। আর তখন সাহেব বলেছেন, কেন উনি অফিসে আসেন না!”
“আমি তোদের সব ক’টার মাথা ভাঙব।”
রফিক বলতেই থাকেন, “নাজিরের বউ বেধবা হবে। শালা বেজন্মা। গাড়ি চাপা পড়বে।”
ট্রেন চলতে থাকে, স্টেশন পেরিয়ে যায়। রফিকের আবার এদের ছাড়া চলেও না।
বিষ্ণুপুর এলে সকলে মিলে নেমে যায়।
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)