পূর্বানুবৃত্তি: নৃসিংহ গৌড়ে গিয়েছেন বাণিজ্যের কাজে। তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না বলে রাজকুমারী তুক্কার মন খারাপ। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে তাঁর সখী শ্যামা। অন্য দিকে গৌড়ে যাওয়ার পথে একটি পান্থশালায় রাত্রি যাপন করছেন নৃসিংহ। তাঁকে সর্বদা সতর্ক থাকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন গুপ্তচর মাধব মিশ্র। নৃসিংহের সতর্কতার উপর পুরোপুরি ভরসা করতে না পেরে তিনি নৃসিংহর পার্শ্বচর পিরুমলকেও কিছু জরুরি পরামর্শ দিয়ে গেছেন। কিন্তু নৃসিংহ তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত নন। তাঁর মনের আকাশেও বারবার ভেসে উঠছে রাজকুমারী তুক্কার মুখ। এমন সময় জানলা দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় নৃসিংহ দেখতে পেলেন একটি দীর্ঘ বস্ত্রাবৃত ছায়া। পরক্ষণেই পিছনে মৃদু খসখস শব্দ শুনে তিনি পিছু ফিরে দেখেন তাঁর বিছানার উপর এক উদ্যতফণা সর্প। নৃসিংহের মুখ থেকে আর্তনাদ নির্গত হলে দ্রুত ঘরে আসে পিরুমল। তার তরবারি দিয়ে ক্ষিপ্রবেগে সে সাপটিকে দ্বিখণ্ডিত করে। প্রাণে বেঁচে যান নৃসিংহ। সে সময় পুরীতে মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব চৈতন্যদেবকে দর্শনের আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মুখে সে কথা শুনে চৈতন্যদেব সম্মত হলেন না। জানালেন, সন্ন্যাসীর পক্ষে রাজদর্শনও অনুচিত। তবে রথযাত্রার সময় নৃত্যগীতরত চৈতন্যদেবকে দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হলেন মহারাজ।
কাশী মিশ্র আবার বললেন, “মহাপ্রভু এক দিন মহারাজাকে দেখা দিতে চাইছিলেন না। অথচ আর্য, তুমি যেই রাজসিংহাসন ছেড়ে সাধারণ বেশে ভগবানের সেবায় পথে নেমে এলে, অমনি তাঁর দর্শন পেলে। পরোক্ষে হলেও তুমি এই মহামানবের দর্শন পেলে।”
পাশে সার্বভৌম ভট্টাচার্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাশী মিশ্রের কথা শ্রবণ করে তিনি বললেন, “মহারাজাকে এই ভাবে ভগবানের সেবা করতে দেখে মহাপ্রভু বড়ই প্রীত হয়েছেন। বলেছেন ‘তিনি জগন্নাথের সেবক, তিনি বড়ই সৌভাগ্যের অধিকারী’।”
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “মহাপ্রভু সরাসরি মহারাজাকে সাক্ষাৎ দিতে চান না, অথচ পরোক্ষে মহারাজের প্রতি তাঁর দয়ার অন্ত নেই। মহাপ্রভুর মায়া অসীম!”
১৭
যত দিন যায়, মহারাজ প্রতাপরুদ্রের এই মহাপ্রভু-প্রীতি অসহনীয় লাগে মন্ত্রী বিদ্যাধরের। তার উপরে মন্দিরের ভার এখন ওই শূদ্র রায় রামানন্দের হাতে। শ্রীচৈতন্যের প্রভাব না থাকলে রাজা কখনওই এই ভার রাম রায়ের উপরে দিতেন না। এর ফলে যা হল, মন্দিরের পান্ডাদের উপর মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরের যে প্রবল প্রভাব ছিল, সেটা কমতে শুরু করল।
এক বার একটা বিষয় নিয়ে রায় রামানন্দের সঙ্গে বিদ্যাধরের কলহ বেধে গেল। রথযাত্রা কাটতেই রাম রায় মন্দির প্রাঙ্গণের ভিতরেই উত্তর দিকে একটি মণ্ডপ নির্মাণ করতে চাইলেন। রাজসভায় এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে, গোবিন্দ বিদ্যাধর এর চরম বিরোধিতা করলেন। কিন্তু বিদ্যাধরের এই আপত্তি অগ্রাহ্য করেই রামানন্দকে মণ্ডপ নির্মাণের অনুমতি দিলেন গজপতি।
উল্লসিত রায় রামানন্দের মণ্ডপ নির্মাণ করাতে বেশি সময় লাগল না। এই মণ্ডপেই শুরু হলে বৈষ্ণব গোষ্ঠীর দিবারাত্র কৃষ্ণলীলা-রসকীর্তন ও আস্বাদন।
ফলে রাম রায়ের উপরে মন্ত্রীমশাইয়ের যে বিরাগের ভাব ছিল, সেই ভাব এ বার ঘৃণায় পরিণত হল। অহর্নিশ তিনি এক তীব্র দহনজ্বালায় পুড়তে লাগলেন। অথচ তাঁর প্রতি মহারাজের বিরূপ মনোভাব দিন দিন স্তিমিত হয়ে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু বিদ্যাধরের বুকের আগুনে তাতে মোটেই কোনও প্রলেপ পড়ে না। তিনি ভেবেছিলেন দক্ষিণের প্রদেশপালের সিংহাসনে বজ্রদেবকে বসিয়ে পিছন থেকে তিনিই সব পরিচালনা করবেন। তিনি জানেন বজ্রদেব ইন্দ্রিয়াসক্ত, সদা দুষ্কর্মে রত। তার পক্ষে শাসনকার্য চালানো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। সেই সুযোগে যুদ্ধরত দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। কিন্তু প্রতাপরুদ্রদেব তাঁর সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছেন।
যদিও গোবিন্দ বিদ্যাধর থেমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি সুকৌশলে মহারাজার কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে বজ্রদেবকে কর্নাটের যুদ্ধে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর অধিনায়ক করে পাঠালেন। দক্ষিণে গমনের আগে বজ্রদেব এক দিন বিদ্যাধরের কাছে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তাঁদের দু’জনের এই ধরনের সমস্ত সাক্ষাৎই হয় মধ্যরাতে। অন্ধকারের আড়ালে তাঁদের গভীর গোপন মন্ত্রণা চলল দীর্ঘক্ষণ ধরে।
বজ্রদেব চলে গেলে, বিদ্যাধর তাঁর গোপন বিলাসগৃহের শীর্ষ বাতায়নে উঠে এলেন। ছায়ার মতো তাঁর পিছনে এসে দাঁড়াল বটুকেশ্বর।
পিছনে না তাকিয়েই তিনি বললেন, “বটুক, কী খবর? সুসংবাদ এনেছ?” তাঁর কণ্ঠস্বরে আশা-নিরাশার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।
বটুক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কী হল বটুক, কথা বলছ না?” বিদ্যাধর ভর্ৎসনা করে ওঠেন।
“সুসংবাদ নেই মন্ত্রীমশাই, আজ তো ঘোড়ার গাড়ি পৌঁছেছে গৌড়ের বাজারে।”
গোবিন্দ বিদ্যাধর জ্বলন্ত চোখে ঘুরে তাকালেন। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়তে চাইছিলেন। কিন্তু নিজেকে সহসা সংবরণ করলেন। এই সময়ে ক্রুদ্ধ হওয়া সমীচীন হবে না। এখন ধৈর্য ধরার সময়। এখন সমস্ত বিষয়, সমস্ত পরিস্থিতি তাঁর বিপক্ষে যাচ্ছে। তাই এই সময়ে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটু অধৈর্য হয়ে গেলেই সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ যেন দাবা খেলার চাল। সযত্নে, শান্ত মস্তিষ্কে এগিয়ে যেতে হবে।
তবু গলার ভিতরে একটা রাগের দমক যেন বন্দি হয়ে গিয়েছে। সেটিকে তিনি বটুকেশ্বরের দিকে নিক্ষেপ করলেন, “বটুক, তোমাদের এত অর্থ দিলাম, অমন সুন্দর নারীর সঙ্গে বিয়ে দিলাম, তার বদলে তুমি আমাকে কিছু দাও।”
“আমায় ক্ষমা করবেন মন্ত্রীমশাই।”
“ক্ষমা!” গোবিন্দ বিদ্যাধর হা হা করে হেসে উঠলেন। তার পর হাসি থামিয়ে সহসা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ক্ষমা! সে তো বিষম বস্তু।”
ক্ষণকাল থেমে তিনি আবার বললেন, “শোনো, তুমি আগামী কালই দক্ষিণে চলে যাও। আমি যেমন যেমন ভাবে বলেছি, ঠিক তেমন তেমন ভাবে কাজ করো। তোমার অর্ধাঙ্গিনী আমাদের জিম্মাতেই থাকবে। তুমি যদি ঠিক ঠিক কাজ করো, তবে তার কোনও ক্ষতি হবে না।”
তিনি আবার একটু থামলেন। তার পর নিজের মনে বললেন, “বিদ্যাধর যেমন দিতে জানে, তেমন কেড়ে নিতেও জানে।”
বটুকেশ্বর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে গোবিন্দ বিদ্যাধর আবার উন্মুক্ত অলিন্দের কাছে চলে গেলেন। এ যেন ক্রমাগত বিষধর সাপ নিয়ে খেলা। বিষ! চার পাশে শুধু বিষ! নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে অন্ধকার ভারী হয়ে যাক! তিনি নিজের মনে হা হা করে হেসে উঠলেন। চরাচরের সমস্ত নিস্তব্ধতা যেন নিমেষে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। উপরের অলিন্দে কয়েকটি পায়রা বসেছিল, তারা সব যেন ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে উঠল। কপোতের ডানার সেই ব্যজনধ্বনি বহু ক্ষণ বাতাসে ভাসতে লাগল।
গোবিন্দ বিদ্যাধর মনে মনে বললেন, “আর তুমি কোথাকার কোন ঢঙী সন্ন্যাসী হে, নাকে কান্না কেঁদে কেঁদে প্রেম বিলাও!”
ঠিক সেই মুহূর্তে বহু দূরে, গৌড় নগরীর একটি সরাইখানার সামনে এক ঘোড়সওয়ার নিঃশব্দে এসে তাঁর কালো ঘোড়া থেকে নামলেন। তাঁর সমস্ত শরীর কালো বস্ত্রে আবৃত। মুখমণ্ডলে শুধু চোখদু’টি সাপের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। তিনি দরজার সামনে দাঁড়াতে ছদ্মবেশী এক রক্ষী মাথা নাড়লেন। মন্থর পায়ে সেই অশ্বারোহী সরাইখানায় প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটি ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। সাঙ্কেতিক ভঙ্গিতে তিন বার টোকা দিলেন দরজায়। দরজা খুলে একটি মুখ বাইরে বেরিয়েই তৎক্ষণাৎ আবার ভিতরে ঢুকে গেল। তার পর দরজাটি সম্পূর্ণরূপে খুলে গেল। ঘরের ভিতরটি প্রশস্ত। রুচিসম্পন্ন আসবাবে সজ্জিত। ভূমিতে সুদৃশ্য পারসিক গালিচা বিছানো। দেখে মনে হয় না, এটা কোনও সরাইখানার কক্ষ। বরং কোনও অর্থশালী ব্যক্তির ভদ্রাসনের বিশ্রামকক্ষ বলেই মনে হয়। আসলে এই সরাইখানাটি একটি ছদ্মবেশী সরাইখানা। নৃসিংহ উপরায় এই সরাইখানার অধিকারী। কিন্তু সেই কথা গুটিকয় ব্যক্তি ভিন্ন আর কারও অবগত নেই। এই সরাইখানায় কী কার্য হয়, তা গৌড়ের অধিপতিদের অজানা। সবাই জানে, এ এক ধনী আর সম্পদশালী বণিকদের বিশ্রামস্থল। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এমন মানুষদের এখানে যাতায়াত, যারা হয়তো লোকসমাজে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত। কোনটা যে তাদের আসল পরিচয়, কেউ জানে না।
অশ্বারোহী মাথা নুইয়ে নৃসিংহকে অভিবাদন জানালেন। বিড়বিড় করে বললেন, “আর্যপুত্রেরজয় হোক।”
নৃসিংহের মুখে প্রশস্ত হাসি খেলে গেল, “আমি ভাবলাম, তুমি বুঝি আজ আর আসবে না, মাধব!”
“কী যে বলেন আর্যপুত্র! আপনার সামনে যেখানে বিপদ, সেখানে আমি আসব না! তবে একটু বিলম্ব হল, কারণ পাকা খবর পেতে একটুসময় লাগল।”
নৃসিংহ উপরায় উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন মাধব মিশ্রের মুখের দিকে।
এক কিঙ্কর জলপাত্র নিয়ে এলে, মাধব কয়েক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে আবার শুরু করলেন, “প্রথমে কামরূপ, তার পর ওড়িশা, এই দুই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুলতান হুসেন শাহ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তিনি যেমন করেই হোক উৎকল অধিকার করতে চান। জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করে সেখানে গৌড়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই বিষয়ে তিনি ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সেনাপতি কেশব খাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ধূর্ত মন্ত্রী ইসমাইল গাজিও আছে। আর আছে ভীষণ ধুরন্ধর যুদ্ধকৌশলী, যুদ্ধবিভাগের মন্ত্রী সাকর মল্লিক। এই ব্যাপারে বিভিন্ন চর ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের পুরী নগরীতে। তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের খুঁজে বার করা খুবই দুরূহ। এবং সে কাজ তখনই সহজ হবে, যদি এদের মধ্যে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে।”
এক টানা কথাগুলি বলে তিনি যেন একটু হাঁপিয়ে পড়লেন। আবার এক ঢোঁক জল গলায় ঢেলে নিলেন।
নৃসিংহ বললেন, “এই সংবাদ কি মহারাজের কানে পৌঁছেছে?”
মাধব বঙ্কিম হেসে বললেন, “তা ঠিক জানি না। তবে মন্ত্রীমশাই গোবিন্দ বিদ্যাধরের কানে পৌঁছেছে। এবং তাঁর চরও ছড়িয়ে আছে গৌড়ের নানা প্রান্তে। এ বার আমার কাজ হবে, এই দুই পক্ষের চরদের মধ্যে যারা বিশ্বাসঘাতক, তাদের খুঁজে বার করা...” বলে তিনি মুচকি মুচকি হাসলেন।
ঠিক এই সময়েই উৎকলের রাজ-অন্তঃপুরে মহারানি পদ্মাদেবীর ঘুম আসছে না কিছুতেই। কিঙ্করী মন্থরা তাঁর পদসেবা করছিলেন। মহারানির তাতেও যেন একটু শান্তি হচ্ছে না। জ্যেষ্ঠপুত্র বীরভদ্র আছে কর্নাটের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই এক চিন্তা অবিরত। তার উপরে রঙ্গময়ী শ্রীইলা ক্রমশ যেন ছলাকলায় মহারাজকে বশ করে নিচ্ছে। মহারাজও দিন দিন যেন ছোটরানির বশে চলে যাচ্ছেন। বুড়ো বয়সে আবার মহারাজের মনে রং লেগেছে। শ্রীইলার পুত্র কালুয়াদেব, তাকে যেন এক দণ্ড না দেখে মহারাজ শান্তি পান না।
তবে কি তিনি ক্রমশ মহারাজের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন? দিবারাত্র এই এক চিন্তা একটা মাকড়সার মতো তাঁর সারা দেহে খেলে বেড়ায়। তার উপরে ভর করেছে পুত্রের জন্য দুশ্চিন্তা।
আর কনিষ্ঠ পুত্র! সে তো একটা পাষণ্ড! অপদার্থ! কেবল সুরা আর নারী। এর থেকে কী করে যে মুক্তি পাবেন! তিনি ভেবে পান না।
শুয়ে শুয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। পা ঝাঁকিয়ে তিনি মন্থরার হাত সরিয়ে দিলেন।মুখে বললেন, “হ্যাঁ রে, কে যেন এক সন্ন্যাসী এসেছে শুনছি পুরীতে?”
মন্থরা জানে রানিমার কী প্রয়োজন। সে চোখের কোণ দিয়ে হেসে বলল, “দূর দূর! শুধু নাকে কাঁদে। আমি এক জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর নাম শুনেছি। বৌদ্ধ তান্ত্রিক। সে কী সব যেন বশীকরণ মন্ত্র জানে।”
মহারানি শয্যার উপরে উঠে বসলেন, “কী বশ করে রে?”
মন্থরা সারা গা দুলিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল, “মানুষকে বশ করতে পারে রানিমা। আমি শুনেছি।”
মহারানি আগ্রহভরে বললেন, “তাকে এক দিন নিয়ে আসতে পারবি আমার আছে?” বলে মহারানি হাত বাড়িয়ে পায়ের একটা মঞ্জীরা খুলে ছুড়ে দিলেন মন্থরার গায়ে।
কাঙালের মতো তা কুড়িয়ে নেয় মন্থরা, মৃদু হেসে বলে, “পারব রানিমা।”
তার চোখের কোণে এক রহস্যময় হাসি জোনাকির মতো জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়।
১৮
গম্ভীরার ছোট্ট অলিন্দ দিয়ে চাঁদের আলো নেমে আসছে। যেন একদলা গলিত রুপোর প্রলেপ। সেই রুপোর আলোর অলঙ্কার যেন শোভা হয়ে ঝরে পড়ছে মহাপ্রভুর অনিন্দ্যসুন্দর দেহে। তিনি উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। উদাস সে দৃষ্টি! অস্ফুটে কৃষ্ণনাম করে চলেছেন। ভাবে বিভোর দুই নয়ন থেকে জলের ধারা নেমে এসে মুখ, বুক ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই জলের ধারার উপরে চাঁদের আলো পড়ে হীরককণার মতো জ্বলজ্বল করছে।
সময়টা হেমন্তের অবসান। প্রকৃতির দোরগোড়ায় শীত এসে হাজির হয়েছে। গবাক্ষপথে উত্তরের বাতাস এসে তাঁর অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে ঝরে পড়ছে। কিন্তু মহাপ্রভু শীত অনুভব করছেন না। ইদানীং তাঁর মনের ভিতরে এক সঙ্কট দানা বেঁধেছে। তিনি রিক্ত সন্ন্যাসী। বৈভবের স্পর্শ তাঁর কাছে গরলতুল্য। কিন্তু মহারাজের সনির্বন্ধ অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি কি ভুল করছেন! কিন্তু তিনি আবার ভাবেন, মহারাজা তো ভক্ত। ভক্তকে ভগবান কী করে দূরে সরিয়ে রাখবেন? তিনি যেন আকুল হৃদয়ে ভগবানকে সেই প্রশ্নই করছেন।
নিকটে স্বরূপ দামোদর মিঠে গলায় কীর্তন গাইছে। সেই গান হেমন্তের বাতাসে ফুলের সুবাসের সঙ্গে মিলেমিশে এক অপূর্ব মূর্ছনার মতো ক্ষুদ্র কক্ষের ভিতরে অনুরণিত হচ্ছে। কিন্তু সেই গানের স্বর মহাপ্রভুর শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।
সহসা কাশী মিশ্র কক্ষের দ্বারে এসে উপস্থিত হলেন। ঘরে প্রবেশ করে, ভূমিতে উপবেশন করে মহাপ্রভুকে প্রণাম জানালেন। তার পর চোখের ইশারায় স্বরূপ দামোদরকে কিছু ক্ষণের জন্য বাইরে যেতে বললেন।
মহাপ্রভু কোনও কথা বললেন না। শুধু তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন। তখনও তাঁর দুই নয়নে জলের ধারা।
তখনই সেই ঘরে এসে উপস্থিত হলেন মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব। তিনি এখন ছদ্মবেশে আছেন। আভূমি নত হয়ে প্রণাম করতে গিয়ে তিনি মহাপ্রভুর দুই পা জড়িয়ে ধরলেন। মহারাজের চোখের জলে মহাপ্রভুর পদদ্বয় সিক্ত হয়ে উঠল।
মহাপ্রভু দুই হাত দিয়ে মহারাজকে তুলে ধরলেন। মাটিতে বসতে সাহায্য করলেন।
মহারাজ বললেন, “আমাকে আপনার পায়ে স্থান দিন প্রভু।”
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)