E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

এই ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর প্রধান হলেন ভরদ্বাজ মিশ্র। তিনি জানেন মহামন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরের বৈষ্ণব-বিরুদ্ধতার কথা।

অবিন সেন

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৫ ০৭:৪২
ছবি রৌদ্র মিত্র।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: মহারাজের মনের অবস্থা বুঝে তাঁকে নানা উপদেশ দিলেন মহাপ্রভু। এক ব্যক্তি গোপনে কোনও বার্তা নিয়ে নির্জন সমুদ্রতটে সাক্ষাৎ করলেন মহাপ্রভুর সঙ্গে। মৌখিক ভাবেই তাঁকেও উত্তর দিলেন তিনি। এর পর রায় রামাননন্দকে ডেকে বৃন্দাবন যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন মহাপ্রভু। মহারাজ, সার্বভৌম, স্বয়ং রামানন্দ কেউই চান না মহাপ্রভু নীলাচল ছেড়ে আর কোথাও যান। নানা ভাবে ভোলানোর চেষ্টা করেও এক সময় আর আটকানো গেল না তাঁকে। শীতের সময় বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে নিত্যানন্দ, হরিদাস, মুকুন্দ, রামানন্দ ও আরও অনেকে। গৌড়ের সীমানায় এসে এক যবন গুপ্তচর এসে ভিড়ল তাঁর দলে। কিন্তু মহাপ্রভুর স্পর্শে সে-ও বিগলিত হল। আশ্রয় নিল মহাপ্রভুর চরণে। কেউ বুঝতে পারল না, সুলতানের রাজত্বের সীমানায় কেন এসে থাকছেন মহাপ্রভু। কিছু দিন পরে নিত্যানন্দ প্রভু দেখতে পেলেন গভীর রাতে মহাপ্রভুর কাছে এলেন রূপ ও সনাতন দুই ভাই। তাঁরা সুলতানের দরবারের পদস্থ কর্মচারী। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতেই মহাপ্রভুর সেখানে আগমন। উদ্দেশ্য পূরণ হতেই মহাপ্রভু আর গেলেন না বৃন্দাবনে, নীলাচলে ফিরে এলেন। এ বার মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব তাঁর চরণে শিষ্য হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন।

মহাপ্রভু তাঁকে দূরে সরিয়ে দিলেন না। তিনি বুঝেছিলেন, রাজা হলেও প্রতাপরুদ্র তাঁর ভক্ত। ভগবানের কাছে সমস্ত ভক্তই সমান।

মহাপ্রভুর কৃপা পেয়ে মহারাজ ধন্য হয়ে গেলেন। কিন্তু মহাপ্রভু তাঁকে দীক্ষা দেননি। তা না দিলেও মহারাজের আনুকূল্যে সারা রাজ্যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলন বাড়তে লাগল। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল কৃষ্ণপ্রেম রাধাপ্রেমের প্রবল জোয়ার। সেই সঙ্গে দলে দলে গৌড়ীয় ভক্তরা শ্রীক্ষেত্রে এসে ভিড় জমাতে থাকল। তবে শ্রীক্ষেত্রের বৈষ্ণব আর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যে কোথাও একটা বিভাজনরেখা তৈরি হয়ে গেল। এমনকি জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডা এবং বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যে বয়ে যেতে লাগল ফল্গুধারার মতো বিভেদের স্রোত।

সমান্তরাল ভাবে এই বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল স্রোতকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করলেন না ওড়িশার স্মার্ত ব্রাহ্মণ সমাজ। না করাটাই স্বাভাবিক। ব্রাহ্মণ সমাজ ভাবতে লাগলেন, এ কেমন সন্ন্যাসী! যাঁর কাছে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের কোনও বিভেদ নেই! সবাইকেই তিনি কাছে টেনে নিচ্ছেন। শূদ্রকেও তিনি বুকে টেনে নিয়ে আশীর্বাদ করেন!

মহাপ্রভু সেই সময়ে সমাজের বুকের উপরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা জাত-পাতের বিভাজনকে টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন। ভেঙে দিতে চাইলেন বর্ণ-হিন্দুদের গড়ে তোলা জাত পাতের বেড়াজাল।

উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা দেখলেন, যাদের তাঁরা সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, যাদের মাথায় পা রেখে তাঁরা নিজেদের সমাজের শ্রেষ্ঠ আর উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, শ্রীচৈতন্য সেই অস্পৃশ্য মানুষদের বুকে টেনে নিচ্ছেন।

শ্রীচৈতন্য যেন গোঁড়া হিন্দুদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বললেন,

মুচি হয়ে শুচি হয় যদি কৃষ্ণ ভজে।

শুচি হয়ে মুচি হয় যদি কৃষ্ণ ত্যজে।।

এত বড় কঠোর কথা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সহ্য করবেন কেন? মহাপ্রভুর এই মনোভাব যখন প্রচার হতে থাকল তখন তাঁরা ক্রোধে ফেটে পড়লেন।

কিন্তু মহারাজকে তাঁরা এই বিষয়ে কোনও অভিযোগ জানাতে পারলেন না। কারণ মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব নিজেই শ্রীচৈতন্য অনুগামী।

এই ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর প্রধান হলেন ভরদ্বাজ মিশ্র। তিনি জানেন মহামন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরের বৈষ্ণব-বিরুদ্ধতার কথা।

ভরদ্বাজ মিশ্র এক দিন গোপনে গিয়ে উপস্থিত হলেন গোবিন্দ বিদ্যাধরের কাছে। গোপনীয়তার কারণ সহজেই অনুমেয়। তিনি নিয়মিত রাজ কোষাগার থেকে মাসিক দক্ষিণা পেয়ে আসছেন বিভিন্ন পূজা-উপচারের কারণে। আর মন্দিরের সমস্ত কিছুর দায়িত্বে রায় রামানন্দ। ফলে প্রকাশ্যে শ্রীচৈতন্য-বিরোধিতা করার সাহস তাঁর নেই।

সন্ধ্যার অন্ধকার সবে নেমেছে। আকাশের বুকে ভাঙা চাঁদ। প্রমোদকাননের বিলাসগৃহে মূল্যবান ঝাড়ের আলো জ্বলে উঠেছে। গোবিন্দ বিদ্যাধর একটি ফরাসে গা এলিয়ে দিয়ে মীরার ভজন শুনছিলেন। সুমধুর কণ্ঠের অধিকারিণী তরুণী গায়িকা মল্লিকা দাসীকে তিনি গৌড় থেকে উপঢৌকন হিসাবে পেয়েছেন। মল্লিকার সুমধুর কণ্ঠে তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন। সুরার নেশা ভিন্ন সঙ্গীতরস উপভোগ করতে পারছেন দেখে তিনি নিজেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছেন। সেই হেতু মনের মধ্যে তাঁর একটা প্রফুল্ল ভাব জেগে উঠেছিল। এমন সময় ভৃত্য এসে ভরদ্বাজ মিশ্রের আগমনের খবরে শোনালে তিনি একটু বিরক্ত হলেন।

তার উপরে এ ভাবে একেবারে প্রমোদকাননে এসে হাজির হাওয়াটাও তাঁর ভাল লাগল না। যদিও কিছু পরামর্শ বা আলোচনা তিনি তাঁর প্রমোদকাননেই করতে পছন্দ করেন। কিন্তু আজ তিনি যে ভাবে মল্লিকার সুরের নেশায় ডুবে যাচ্ছিলেন সেই সময়ে তালভঙ্গ হওয়াতে তাঁর বিরক্তি যেন বেশি বাড়ল। তবু ভরদ্বাজকে তিনি ফিরিয়ে দিলেন না, আবার বসিয়েও রাখলেন না। এই সব ঝঞ্ঝাট আগে মিটিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। মল্লিকাকে তিনি ইশারায় অন্যত্র যেতে বললেন।

ভরদ্বাজ ঘরে প্রবেশ করে মহামন্ত্রীকে প্রণাম জানালেন। গোবিন্দ বিদ্যাধরের সম্মতি পেয়ে উপবেশন করে তিনি একটু ইতস্তত করতে থাকলেন। মনের ভাব এমন, যেন কী ভাবে তিনি কথা শুরু করবেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

“কী সংবাদ ব্রাহ্মণকুলপতি?”

ভরদ্বাজ দ্বিধাগ্রস্ত গলাতেই বললেন, “মন্ত্রীমশাই, আর তো পারা যাচ্ছে না! ওই নদের চাল-চুলোহীন সন্ন্যাসী যা সব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, আপনি তো সবই অবগত আছেন!”

মন্ত্রীমশাই গলার ভিতরে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। বিদ্রুপের সুরে বললেন, “আমি তো অন্ধ আর বধির হয়ে আছি! কিছু দেখতেও পাচ্ছি না, কিছু শুনতেও পাচ্ছি না।”

ঈষৎ বিরতি দিয়ে পুনরায় একই শ্লেষ ধরে রেখে বললেন, “তা কী কাণ্ড হচ্ছে শুনি?”

ভরদ্বাজ বললেন, “কী বলব সে সব অনাসৃষ্টির কথা! শূদ্র-মুচি-মেথর যাকে পারছে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে! বলছে তারাই নাকি কৃষ্ণ। উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ সমস্ত ভেদাভেদকে সে তো হেলায় অগ্রাহ্য করছে। এই রকম চলতে থাকলে হয়তো কয়েক দিন পরে মানুষ আর আমাদের ভক্তিশ্রদ্ধা করবে না।”

ভরদ্বাজ থামতেই বিদ্যাধর হা হা করে হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে সান্ধ্য নীরবতা যেন খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। অলিন্দের বাইরে কয়েকটি কবুতর বসেছিল। তারা ভয় পেয়ে অন্ধকারের বুকেই ডানা মেলে উড়ে গেল। পাশের কক্ষে মল্লিকার বুক কেঁপে উঠল। সে কিছু দিন গোবিন্দ বিদ্যাধরের সঙ্গে আছে। অন্তরঙ্গ হয়েছে। কিন্তু বিদ্যাধরের মুখে এমন কঠিন হাসি সে কখনও শোনেনি।

ভরদ্বাজও অবাক হয়ে গেলেন।

হাসি থামিয়ে দিয়ে বিদ্যাধর কঠিন স্বরে বললেন, “তোমরা রাজাকে অভিযোগ জানাও! মন্দিরের প্রধান অধিকারী রায় রামানন্দকে জানাও!”

ভরদ্বাজ আরও বিমর্ষ ভঙ্গিতে বললেন, “আপনি কী বলছেন মন্ত্রীমশাই! রাজাকে জানাব? তাঁর চোখের সামনেই তো সব হচ্ছে! তাঁর প্রশ্রয়েই তো ওই সন্ন্যাসী এত সাহস পাচ্ছে। আর রাজার কি এটা উচিত কাজ হয়েছে? রাম রায়ের মতো এক শূদ্রকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব দিয়েছেন!”

উত্তেজনার সঙ্গে একটানা কথাগুলো বলে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন।

বিদ্যাধর উন্মুক্ত অলিন্দপথে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আহা! কী সুন্দর সেই আঁধার। কোন সুদূর গগন থেকে কালো ঝিল্লির মতো নেমে এসেছে। আর সেই আঁধারের গায়ে মিহি রেণুর মতো মৃদু জ্যোৎস্নার আভা লেগে আছে। সেই রেণু মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয়ে উঠছে। সহসা নিচু হয়ে জ্বলন্ত প্রদীপটিকে এক ফুৎকারে নিবিয়ে দিলেন।

বাইরের অপেক্ষমাণ অন্ধকার যেন সাগরের উচ্ছ্বাসের মতো ঘরের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ভরদ্বাজের কি বুক কেঁপে উঠল?

গোবিন্দ বিদ্যাধর সাপের মতো হিসহিস করে বললেন, “আমার কাছে এসেছ কেন? তুমি কি আশা করো আমি তোমাদের জন্যে রাজার বিরুদ্ধে যাই?”

বিদ্যাধর অন্ধকারে ভরদ্বাজের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর মনে হল, ভরদ্বাজ যেন অন্ধকারে ঘাড় নাড়লেন।

ভরদ্বাজ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে সহসা।

বিদ্যাধর তেমনই বিষাক্ত স্বরে বললেন, “তোমরা আমার অনুগামী হবে?”

অন্ধকারেই ভরদ্বাজ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ, মন্ত্রীমশাই।”

আচমকাই এক ভৃত্য এসে আবার প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে। সেই আলোয় ভরদ্বাজ দেখলেন, বিদ্যাধরের সমস্ত মুখ যেন বদলে গিয়েছে। চোখদু’টি অঙ্গারের মতো জ্বলছে।

গোবিন্দ বিদ্যাধর বলিষ্ঠ হাতে ভরদ্বাজের দক্ষিণ হাতটি টেনে এনে প্রদীপশিখার উপরে ধরে তেমনই কঠিন গলায় বললেন, “আগুনে হাত রেখে আপন পুত্রের নামে শপথ করে বলো, ‘সর্বদা আপনার অনুগামী থাকব, কখনও বিরুদ্ধতা করব না’।”

তাঁর বলার ভঙ্গিতে ধমক।

ভরদ্বাজ দেখলেন, পশ্চাদপসরণের পথ বন্ধ। আর তার প্রয়োজনই বা কী! পিছিয়ে যাবেন বলে তো আর আসেননি। দগ্ধ হাতের যন্ত্রণায় কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি সেই শপথই নিলেন।

বিদ্যাধর এ বার শান্ত স্বরে বললেন, “যা বলছি মন দিয়ে শোনো। তুমি বৈষ্ণবদের গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়ো। ভক্ত হয়ে যাও চৈতন্যের। তুমি এমন আনুগত্য দেখাবে যাতে তুমি ওই সন্ন্যাসীর ভক্তদের কাছের লোক হয়ে উঠতে পারো...” ভরদ্বাজ মিশ্রের মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠা বিস্ময় দেখে তিনি একটু থামলেন। বললেন, “বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তোমার জায়গায় অন্য কেউ এই কাজ করতেই পারত, কিন্তু তুমি মন্দিরের এক জন পুরোহিত, অনেক পান্ডাই তোমার অনুগামী। সব পান্ডাই তো আর রাম রায়ের অনুগত হতে পারে না। দরকারে তোমার অনুগামী পান্ডাদের আমি কাজে লাগাব। আর আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে শোনাই এখন তোমার পক্ষে মঙ্গল। আমার কথা না শোনার ফল তো তোমার অজ্ঞাত নয় নিশ্চয়ই!”

ভরদ্বাজ দুরুদুরু বুকে মাথা নাড়ালেন। তিনি জানেন, বিদ্যাধরের বশ্যতা স্বীকার ও অনুগমন ছাড়া এখন তাঁর আর গত্যন্তর নেই।

বিদ্যাধর আবার বললেন, “আর শোনো, এর পর থেকে আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমি প্রয়োজনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব। জানবে, এক জোড়া চোখ সব সময় তোমার উপরে নজর রাখছে।”

২০

মেয়েটি ছোট থেকেই বড় দুঃখী। জন্মের পরেই মাকে হারিয়েছিল। বিমাতার অবহেলা সইতে সইতে তার শৈশব কেটেছে। তবু ছোট থেকেই মাধবী শান্ত আর মেধাবী। তার সখীরা যখন পুতুল খেলায় মেতে থাকত তখন সে তার বড় ভ্রাতা শিখী মাহাতীর টোলের কাছে বসে এক মনে শাস্ত্র আলোচনা শুনত। শুনতে শুনতেই সে আত্মস্থ করেছিল শাস্ত্রের দুরূহ অধ্যায়সকল। সে তার সুমিষ্ট কণ্ঠে গুনগুন করে গাইত ভক্তিরসাশ্রিত সঙ্গীত। বিমাতার কাছে অবহেলিত হলেও বড় ভ্রাতা শিখী মাহাতীর সে ছিল বড় কাছের। তার ভ্রাতাই উপযুক্ত পাত্র দেখে বারো বৎসর বয়সে তার বিবাহ দেয়। কিন্তু সুখ তার ভাগ্যে ছিল না, স্বামী-সংসারও নয়। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মাধবী বিধবা হল। ভ্রাতা আর বিমাতার সংসারেই তাকে ফিরে আসতে হল শেষে।

এই আকস্মিক দুর্ভাগ্যের আঘাতে মাধবীর বয়স যেন অচিরেই বেড়ে গেল। পুতুলখেলা ছেড়ে সে শাস্ত্রচর্চা আর ভক্তিসঙ্গীতের সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করে নেয়। অবশ্য এই বিষয়ে শিখী মাহাতীর প্রশ্রয় ছিল ঢের।

নিজেকে কঠোর নিয়মকানুনের ভিতরে নিমজ্জিত রাখলেও প্রকৃতির খেয়ালকে সে কী করে ঠেকিয়ে রাখবে? যথাসময়ে ভরা যৌবন এসে তার সমস্ত মাধুরী উপুড় করে দিল মাধবীর সারা শরীরে। কুঁড়ির ভিতরে ঘুমন্ত যৌবন পাপড়ি মেলে ফুটে উঠল তার সারা অঙ্গের প্রতিটি রেখায়। সেই সঙ্গে তার কণ্ঠ ভরে উঠল সরস্বতীর আশীর্বাদে। তার ভক্তিসঙ্গীত শুনে কিন্নরদল যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসে মাটিতে। ধীরে ধীরে মাধবীর সঙ্গীতের খ্যাতি বৈষ্ণব গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে।

এক দিন ভগিনীকে সঙ্গে করে শিখী মাহাতী এলেন জগন্নাথ দাসের কাছে। উদ্দেশ্য ভগিনীর কণ্ঠের কীর্তন শোনানো। জগন্নাথ দাস শুনলেন। মুগ্ধ হয়েই শুনলেন। মাধবীর কণ্ঠে সঙ্গীত যে মধুর তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু জগন্নাথ দাস অধিক প্রীত হলেন মাধবীর ভক্তিভাবে। অন্তরের সমস্ত ভক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে যেন তার সঙ্গীতে।

শিখী মাহাতী এই মুগ্ধতা লক্ষ করে সসঙ্কোচে নিবেদন করলেন, “দাদা, যদি অনুমতি করেন, তবে মাধবী মাঝে মাঝে এসে এখানে, মানে এই বৈষ্ণব ইষ্টগোষ্ঠীতে সঙ্গীত পরিবেশন করে যেতে পারে।”

এই কথা শুনে জগন্নাথ দাস একদৃষ্টে শিখী মাহাতীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে মনে তাঁর মনোভাবের তাৎপর্য আন্দাজ করতে চাইলেন।

এই ধরনের প্রস্তাব বিস্ময়কর। এই বৈষ্ণব ইষ্টগোষ্ঠীতে কোনও মহিলা এসে সঙ্গীত পরিবেশন করবে, এই ধারণা তখনও প্রচলিত হয়নি।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy