পূর্বানুবৃত্তি: ছোটরানি ইলা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে মহারাজকে বলে, তিনি যেন বড়রানিকে তাঁর ছেলের কাছে দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেন। অন্য দিকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বীরসিংহের কাছে মহারানি পদ্মাদেবীও তাঁর ছেলের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বীরসিংহ মহারানিকে একটি বিশেষ ধরনের শরবত খাওয়ায়। তাতে ঘোর আসে মহারানির। সেই অবসরে মহারানির যৌবনকে জাগ্রত করতে নিমগ্ন হয় বীরসিংহ। বাইরে থেকে উঁকি দিতে গিয়ে এক পরিচারিকা তখনই খুন হয়ে যায় নৃশংস ভাবে। অন্য দিকে, পূর্ণিমা রাতে নিঃসঙ্গ মহাপ্রভুর মনে তীব্র দোলাচল। তিনি ভাবছেন, নিঃস্ব সন্ন্যাসী হয়ে রাজার সঙ্গ করা কি তাঁর উচিত হচ্ছে! সাধন-ভজন ছেড়ে রাজকার্যের আলোচনায় অংশ নিয়ে কি ঠিক করছেন তিনি! তখনই তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হন রায় রামানন্দ। তাঁর সান্ত্বনায় কিছুটা আত্মস্থ হন মহাপ্রভু। তত দিনে বৈষ্ণবগোষ্ঠীতে বেশ মিশে গেছেন গোবিন্দ বিদ্যাধরের চর ভরদ্বাজ। তবে তিনি জানেন, রায় রামানন্দ তাঁকে সন্দেহ করেন।
এই রকম একটা দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতিতেও এক জনকে ভরদ্বাজ নিজের বেশ অনুগত করে নিয়েছেন। সে ছোট হরিদাস।
হরিদাস কয়েক বছর আগে রথের সময় আরও অনেক ভক্তের সঙ্গে নদিয়া থেকে নীলাচলে এসেছিল। কিন্তু আর ফিরে যায়নি। এখানে-ওখানে বিভিন্ন আখড়ায় ঠোক্কর খেতে খেতে শেষে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ভরদ্বাজের। ভরদ্বাজ তার একটা পাকাপাকি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন।
ছোট হরিদাসের চেহারা ছোটখাটো। সেই থেকেই তার ছোট হরিদাস নাম। তবে ছোট হলেও তার চেহারাটি অতি খাসা। মাথার বড় বড় চুল কাঁধের কাছে নেমে এসেছে। বড় বড় চোখ। গাত্রবর্ণ গৌর। তার গানের গলা সুরেলা। সে যখন নেচেকুঁদে হরিনাম গায়, তখন সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এক দিন ভরদ্বাজই নিয়ে গিয়েছিলেন হরিদাসকে বৈষ্ণব ইষ্ট-গোষ্ঠীতে। হরিদাসকে দেখিয়ে জগন্নাথ দাসকে বলেছিলেন, “দাদা, দেখো এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছি। খাসা গানের গলা। তেমনই নাচে অভিনয়ে পটু।”
ভরদ্বাজের কথা শুনে জগন্নাথ দাস ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘বাহ! খাসা ছেলেটি তো।’
মুখে বললেন, “নাম কী বাছা তোমার?”
হরিদাস কিছু বলার আগেই ভরদ্বাজ বেশ বিস্তারিত ভাবে হরিদাসের পরিচয় দিলেন। তার কিছুটা সত্যি আর কিছুটা কাল্পনিক।
জগন্নাথ দাস বললেন, “তা বেশ। আজ তা হলে তোমার গান শোনা যাবে।”
ছোট হরিদাস একটু তফাতে গেলে, ভরদ্বাজ বসলেন জগন্নাথ দাসের পায়ের কাছে। একটু যেন দ্বিধা আর অনুযোগের ভঙ্গি। জগন্নাথ দাস সেটা লক্ষ করে করলেন। বললেন, “কিছু বলবে ভরদ্বাজ?”
ভরদ্বাজ মাথা নিচু করে হাতে হাত ঘষতে থাকলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, “আজ্ঞে, বলছিলাম কী, মহাপ্রভু তো ওই শিখী মাহাতীর বিধবা বোন, কী যেন নাম... তাকে তো বৈষ্ণব ইষ্ট-গোষ্ঠীতে বসার অনুমতি দিয়ে দিলেন। কই মহাপ্রভু তো আপনার সঙ্গে এক বার পরামর্শ করলেন না!”
জগন্নাথ দাস একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির উদয় হল, “কে বলেছে মহাপ্রভুর সঙ্গে আমার কথা হয়নি! আমিই ওঁকে বলেছি, এতে কোনও দোষ নেই।”
“কিন্তু দাদা, আপনিই আবার বলেন নারীর সঙ্গ বৈষ্ণবদের পক্ষে হানিকর।”
“এখনও বলি। কিন্তু সাত্ত্বিক নারীতে দোষ হয় না। দেখো ভরদ্বাজ, প্রকৃত ভক্ত হতে হলে নিজের মধ্যে রাধার রূপ, নারীর ভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে। হতে হবে কৃষ্ণপ্রেমে রাধার মতো আকুল।”
ভরদ্বাজ ছদ্মভক্তি দেখিয়ে গদগদ হয়ে বললেন, “মহাপ্রভুর থেকে আপনি ভাবের কথা বেশি ভাল বলেন। আমি আপনার মধ্যে ভাবে বিভোর রাধাকে দেখতে পাই। আর মহাপ্রভু যেন পাগলিনী রাধার ভেক ধরে থাকেন।”
জগন্নাথ দাসের মুখের হাসিটা পরিবর্তিত হয়ে গেল। মহাপ্রভুর নিন্দা তাঁর ভাল লাগে না। তিনি বিরক্ত হলেন।
“তুমি এখন যাও ভরদ্বাজ।”
কিন্তু ভরদ্বাজের মধ্যে ওঠার লক্ষণ দেখা গেল না। তাঁর আরও কিছু বলার আছে।
“কিন্তু দাদা, ওই বিধবা মাধবীর ইষ্ট-গোষ্ঠীতে বসা অনেকেই পছন্দ করছে না। বিশেষ করে কিছু গৌড়ীয় ভক্ত তো ধীরে ধীরে এই মণ্ডলী ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। মহাপ্রভু তো কিছুই দেখছেন না।”
জগন্নাথ দাসের এ বার অসহ্য লাগল। তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “তুমি এখন যাও ভরদ্বাজ। এই নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”
ছোট হরিদাসকে বৈষ্ণবমণ্ডলীতে থাকতে বলে ভরদ্বাজ বেরিয়ে পড়লেন। আজকের সমস্ত সংবাদ বিদ্যাধরকে দিতে হবে।
বিদ্যাধর ইদানীং দুপুরে রাজসভা থেকে বেরিয়ে মল্লিকার কাছে চলে যান। গোবিন্দ বিদ্যাধর হয়তো বুঝতে পারছেন, তাঁর নীরস অন্তরের অন্ধকারে কোথাও ফল্গুধারার মতো রসের প্রবাহ ছিল। এত দিন তিনি তা বুঝতেই পারেননি। মল্লিকা যেন সেই মৃতপ্রায় রসের উৎসকে জাগিয়ে তুলেছে। আজকাল মাঝে মাঝে রাতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। আহা! আহা কত কাল, কত কাল পরে তার রাতে ঘুমোনোর অধিকার ফিরে এসেছে।
মল্লিকার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত ছিলেন বিদ্যাধর। এমন সময়ে গরুড় এসে ভরদ্বাজের আগমন-সংবাদ দিল। গোবিন্দ বিদ্যাধরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পার্শ্বচর গরুড়। হেন কাজ নেই, যা সে করতে পারে না তার প্রভুর নির্দেশে।
বিদ্যাধর অন্দরমহল ছেড়ে গোপন মন্ত্রণাঘরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলেন।
ভরদ্বাজের মুখ থেকে সব কথা শুনে বললেন, “ছোট হরিদাসকে দিয়ে কাজ হবে?”
ভরদ্বাজকে উৎসাহী দেখায়, “হবে, মন্ত্রীমশাই।”
গোবিন্দ বিদ্যাধর খুশি হলেন। বললেন, “আমি যেমন যেমন ভাবে বলেছি, ঠিক তেমন করে ওকে কাজে লাগাও।” তার পরে মনে মনে ভাবলেন, ‘এ বার জগন্নাথ দাসের সঙ্গে দেখা করার সময় হয়েছে। তার সঙ্গে অনেক কাজ করার বাকি। তার উপযুক্ত সময় এগিয়ে আসছে...’
মনে মনে তিনি খুশি হলেন। তাঁর মনের ভিতর থেকে কে যেন খলখল করে হেসে উঠল।
সে দিন সন্ধ্যাতেই এক আশ্চর্য নাট্য অভিনীত হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা জগন্নাথ মন্দিরে আরতি দেখে এসে মহাপ্রভু মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর প্রান্তের মণ্ডপে এসে বসলেন। সেখানে তখন নামসঙ্কীর্তন চলছিল। মহাপ্রভুকে দেখে ভক্তদের উৎসাহ যেন বহু গুণ বেড়ে গেল। বড় ভ্রাতা শিখী মাহাতীর সঙ্গে তার ভগিনী মাধবীও উপস্থিত ছিল। ভ্রাতার উৎসাহে আর মহাপ্রভুর অনুমতি পেয়ে মাধবী কীর্তন শুরু করল। সে এক অপূর্ব ভাবের গায়ন। তার কণ্ঠের রূপ ধরে যেন স্বর্গের কিন্নরীরা নেমে এসেছে সেখানে। মহাপ্রভুও তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
মাধবীর গান শেষ হলে, ভরদ্বাজ ছোট হরিদাসকে এগিয়ে দিলেন। সে এই প্রথম এত কাছ থেকে মহাপ্রভুকে দেখছে। তার তো আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে উপস্থিত কয়েক জন তার গায়ন-প্রতিভার কথা মহাপ্রভুকে জানালে, মহাপ্রভু তাকেও গাওয়ার অনুমতি দিলেন। ছোট হরিদাস শুধু গাইল না, গানের প্রতিটা পদ যেন অভিনয় করে করে দেখাল। আশ্চর্য আর মনোমুগ্ধকর তার প্রতিভা। সে যেন মাধবীর গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান গাইল। তার গান প্রেমের, সেই সঙ্গে তার গান রসেরও। ফলে সাধারণ শ্রোতাদের বাহবা পেল সে-ই বেশি।
মহাপ্রভুরও তার গান ভাল লেগেছে। তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন তিনি।
বাড়ি ফেরার পথে ছোট হরিদাসকে বললেন ভরদ্বাজ, “কী রে, মাধবীর গান কেমন শুনলি?”
ছোট হরিদাসের গলায় মুগ্ধতা ঝরে পড়ল, “আহা, অপূর্ব!”
“আর মাধবী?”
ছোট হরিদাস যেন প্রথমে প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি, তার পরে অকারণে লজ্জা-পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কোনও কথা বলে না।
ভরদ্বাজ তার মনের ভাব বুঝতে পারেন। অস্ফুট গলায় বলেন, “কী রে, চুপ করে আছিস কেন! মেয়েটি কী অপূর্ব সুন্দর না?”
ছোট হরিদাস এ বারও মুখে কিছু বলে না। অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু তার মুখ লজ্জায় যেন রাঙা হয়ে গিয়েছে।
ভরদ্বাজ অন্ধকারে তার মুখের দিকে না তাকিয়েও এটা যেন বুঝতে পারেন। তাঁর মনের ভিতরে একটা বঙ্কিম হাসি খেলা করে।
২৩
রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না ছোট হরিদাসের। বারে বারে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি অপরূপ মুখ। তার মনে হয়, স্বর্গ থেকে যেন এক অপরূপা অপ্সরা নেমে এসেছে। বার বার মাধবীর গানে অন্ধকারের ভিতরে আলো যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ক্রমে সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে দিক থেকে দিগন্তে। সহসা তার আধো ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে চেয়ে সে যেন দেখতে পায়, আলোর শিখরে পা ফেলে ফেলে চলে যাচ্ছে সেই অপ্সরা। তার মুখ ভাল দেখা যায় না। গৈরিক বসন। চুড়ো করে বাঁধা অঢেল কালো কেশ।
যোগিনী বেশে কে ও? ঘর্মাক্তকলেবরে ছোট হরিদাস শয্যায় উঠে বসে। তার সারা শরীর যেন কেঁপে ওঠে। মাধবীর মুখ তার মানসপটে ভেসে ওঠে বার বার। সে যেন কিছুতেই সেই মুখ থেকে চোখ সরাতে পারে না।
বৈষ্ণব ইষ্ট-গোষ্ঠীতে নিজেকে সকলের মধ্যমণি করে নিতে বেশি সময় লাগে না ছোট হরিদাসের। নেচে গেয়ে আসর মাতিয়ে রাখতে তার জুড়ি নেই।
মাধবীও নিয়মিত এই ইষ্ট-গোষ্ঠীতে বসে। তার সঙ্গীত ভক্তির প্লাবনে পূর্ণ। সকলকে সে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ছোট হরিদাস তার দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়, যেন এক আলোকলতা গান হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
সে উচ্ছ্বসিত হয়ে মাধবীর গানের প্রশংসা করে। মাধবী মাথা নিচু করে শুধু তা শোনে। লজ্জা পায়। সে বেশি কথা বলতে পারে না। অস্ফুটে দু’-একটা কথা বলে শুধু।
কিন্তু ইষ্ট-গোষ্ঠীতে সকলেই সরলচিত্ত ভক্ত নয়। ছিদ্রান্বেষী ভক্তেরও অভাব নেই সেখানে। তারা সব লক্ষ করে। মাধবীর প্রতি হরিদাসের এই মুগ্ধতাকে অনেকেই তির্যক দৃষ্টিতে দেখে। তাদের মনোভাবে মাঝে মাঝে নিন্দার আভাস প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেই নিন্দাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো মানুষেরও অভাব নেই। ভরদ্বাজের মতো মানুষও আছেন সেই নিন্দার চাপা আগুনে বায়ুসংযোগের জন্য।
ক্রমে ক্রমে প্রচারিত হল, মাধবীর জন্য মণ্ডলীতে ভক্তদের সাধনায় বিঘ্ন ঘটছে। ঘৃত আর অগ্নি কত দিন পাশাপাশি শান্ত হয়ে থাকতে পারে! এই প্রচার পল্লবিত হয়ে উঠতে লাগল। জগন্নাথ দাসেরও কানভারী করতে লাগল অনেকে। এক সময় তিনিও একই কথা বলতে লাগলেন। বললেন, “মাধবী যেহেতু রক্তমাংসের নারী, সে বৈষ্ণব-গোষ্ঠীর মধ্যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।”
এই কথা মাধবীর কাছে অভিশাপের মতো মনে হল। কিন্তু এই প্রচারের বিরুদ্ধে কিছু বলার বা প্রতিবাদ করার সাধ্য তার নেই। সে অসহায় নারী, বালবিধবা, বড়-ভ্রাতার সংসারে আশ্রিতা। সেই সম্মাননীয় অগ্রজই যখন তাকে নিষেধ করল, তখন মাধবী বৈষ্ণব গোষ্ঠীতে যাওয়া ছেড়ে দিল। গভীর অভিমানে সঙ্গীতচর্চাও সে ছেড়ে দিল। শুধু বিরলে আপন ঘরের এক কোণে এক কৃষ্ণমূর্তি স্থাপন করে গুনগুন করে সেই মূর্তিকেই সে তার অন্তর থেকে সঙ্গীত নিবেদন করতে লাগল।
কিন্তু ছোট হরিদাসের কাছে মাধবীর এই বৈষ্ণব মণ্ডলীতে না আসাটা বিষের মতো মনে হল। কিসের যেন একটা দংশন সারা ক্ষণ তার মনে পীড়া দিতে লাগল। তার আহার-নিদ্রায় মন নেই, সঙ্গীতে মনোযোগ নেই। সারা দিন তার মনের আকাশে মাধবীর অপরূপ মুখচ্ছবি ভেসে ভেসে বেড়ায়।
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)