E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

এতে কী অন্তরের জ্বালা জুড়োয়! তুক্কা জানেন না। তবু লেখেন, লিখেই চলেন। অক্ষরের পর অক্ষর, বাক্যের পর বাক্য, পাতার পর পাতায় সাজিয়ে চলেন তাঁর ব্যর্থ প্রেমের দহনজ্বালা।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫ ০৫:৩০
ছবি রৌদ্র মিত্র।

ছবি রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: এক সামান্য যোদ্ধার সঙ্গে লড়াই করে বীরত্বের পরিচয় দিতে হবে, এ কথা অপমানজনক মনে হওয়ায় নিজের খড়্গাঘাতে নিজেরই শিরশ্ছেদ করেন বীরভদ্র। রাজমহিষীর বন্দিনী হওয়া এবং স্বীয় পুত্রের আত্মহননের খবর শুনে একেবারেই ভেঙে পড়লেন মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব। তিনি বিজয়নগরের সঙ্গে সন্ধির শর্ত হিসেবে আপন কন্যা তুক্কার সঙ্গে রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের বিবাহ দিতে স্বীকৃত হলেন। বিজয়নগরের সঙ্গে সাত বৎসরের যুদ্ধের অবসান হল। মহারানি পদ্মাদেবীও মুক্তি পেলেন। বিজয়নগর রাজ্যে মহারাজ কৃষ্ণদেবরায়ের সঙ্গে তুক্কার বিবাহ হল। অন্তঃপুরে এক সাধারণ নারীর মতো তুক্কা স্থান পেলেন। পরে তিনি মহারাজ কৃষ্ণদেবরায়ের কাছে প্রার্থনা জানালেন, রাজপুরী থেকে দূরে কম্বম নামক স্থানে গিয়ে তিনি থাকতে চান। কৃষ্ণদেবরায় সে ব্যবস্থা করে দিলেন। কম্বমের আড়ম্বরহীন বাসগৃহে তুক্কা আবার শুরু করলেন কাব্য ও সঙ্গীত সাধনা। অন্য দিকে নির্বাসিত নৃসিংহ তাঁর নিকট সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বিজয়নগরের উদ্দেশে। সেখানে কুডাপ্পা জেলায় বসবাস শুরু করলেন। অনেকগুলি বছর কেটে গেলেও নৃসিংহ আর সংসারী হলেন না। এক দিন নৃসিংহের মনে সামান্য আনন্দ দেওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গীরা আয়োজন করলেন শিকারের। কম্বমের অরণ্যে গিয়ে নৃসিংহ হঠাৎ শুনতে পেলেন খুব চেনা বাঁশির সুর। সেই শব্দ অনুসরণ করে তিনি গিয়ে পৌঁছলেন তুক্কার কুটিরের সামনে। বহু দিন মুখোমুখি হলেন দু’জনে।

নৃসিংহের মুখেও কোনও কথা নেই। তিনি শুধু বিপুল আবেগে ডাকলেন, “তুক্কা!”

তুক্কার ঠোঁট দু’টি সেই ভাবেই থরথর করে কাঁপছিল। তার ভিতর দিয়েই তিনি বলতে পারলেন, “তোমার তুক্কা মরে গিয়েছে, আর্যপুত্র!”

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “তুমি কেন আবার এলে!”

“তুমি খুশি হওনি তুক্কা?”

“আমার জীবনে যে সুখ-দুঃখ কোনও বোধই আর অবশিষ্ট নেই। তুমি চলে যাও। তোমাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছুই নেই।”

তুক্কার বুকের ভিতরের গভীর অভিমান থেকে এই কথাগুলি যেন বেরিয়ে এল। এক আত্মনিগ্রহের অন্তহীন হিমসলিলে তিনি নিজেকে নিমজ্জিত করে নিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে আসার কোনও অধিকারও যেন তিনি নিজেকে দেননি।

নৃসিংহ অপলক নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি যেন তুক্কার কথা সম্যক বুঝতে পারলেন। অনেক ক্ষণ পরে ভগ্ন কণ্ঠে নৃসিংহ বললেন, “তবে, মনে রেখো তুক্কা, আমি আছি তোমার জন্য। চিরদিন থাকব।”

কিন্তু এই অপেক্ষা করে থাকার কোনও নির্দিষ্ট পরিণতি আছে কি না, সেই বিষয়ে নৃসিংহের মনে কোনও সম্যক ধারণা নেই। আর নেই বলেই তিনি বড় অসহায় বোধ করেন।

সেই অসহায়তার ভিতরে কম্পিত হতে হতে বহু ক্ষণ অপেক্ষা করলেন নৃসিংহ। কিন্তু তুক্কা আর কোনও কথা বললেন না। এমনকি তিনি নৃসিংহের দিকে তাকালেনও না। প্রস্তরমূর্তির মতো অধোমুখে বসে থাকলেন। এক সময়ে প্রদীপ নিভে গিয়ে অন্ধকারে নেমে এল। কোনও পরিচারিকাও এগিয়ে এসে এই দ্বীপ জ্বেলে দিয়ে গেল না।

নৃসিংহ চলে গেছেন। কখন! সেই খবর বুঝি তুক্কার বোধে পৌঁছয়নি।

কী এক সামান্য কারণে দুই অসামান্য নিষ্পাপ হৃদয়ের ভালবাসা ব্যর্থ হয়ে গেল।

তুক্কা সেই দহন-জ্বালার কাহিনি একটু একটু করে লিখতে শুরু করলেন তাঁর ‘তুক্কাপঞ্চকম’ নামক পদ্যসমূহে।

এতে কী অন্তরের জ্বালা জুড়োয়! তুক্কা জানেন না। তবু লেখেন, লিখেই চলেন। অক্ষরের পর অক্ষর, বাক্যের পর বাক্য, পাতার পর পাতায় সাজিয়ে চলেন তাঁর ব্যর্থ প্রেমের দহনজ্বালা।

২৯

ঠিক বারো বৎসর আগে রথযাত্রার দিনে রথের উপর থেকে নৃত্যরত মহাপ্রভুকে আপন ‘প্রভু’ বলে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিলেন প্রতাপরুদ্রদেব। সেই ঘোষণায় অনেকই সন্তুষ্ট হননি। শ্রীক্ষেত্রের ব্রাহ্মণসমাজ মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মহারাজা কোনও কথাতেই কর্ণপাত করেননি। বীরপুত্রকে হারিয়ে সেই সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার থেকে পর্যদুস্ত হয়ে তিনি তখন একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন। মনে মনে তিনি তখন এক শান্তির আশ্রয় খুঁজছিলেন। মহাপ্রভুর মধ্যে তিনি যেন তাঁর আশ্রয় খুঁজে পেলেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে মহাপ্রভুর চরণে সঁপে দিলেন।

আবার এক শুক্ল পক্ষের সূচনা হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন পরেই রথযাত্রা।

ইদানীং মহাপ্রভু প্রায় সর্বদাই ভাবে আকুল হয়ে থাকেন। কথায় কথায় চোখ দিয়ে অনবরত প্লাবনের মতো অশ্রু বয়ে যায়। সেই সঙ্গে আহার নিদ্রাতেও তাঁর অবহেলা শুরু হয়েছে। ফলে দিন দিন তাঁর শরীর ক্ষয় পেতে শুরু করেছে।

এর হয়তো আর একটা কারণও ছিল। কয়েক মাস আগেই তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী স্বরূপ দামোদর পরলোক গমন করেছে। স্বরূপ দামোদর সর্বক্ষণ মহাপ্রভুর শ্রীঅঙ্গের সেবা করত। অপূর্ব কণ্ঠে কীর্তন শুনিয়ে মহাপ্রভুর সন্তোষ বিধান করত। কাশী মিশ্রের গৃহেই শুক্লা একাদশীর দিনে তার দেহান্তর ঘটল। মহাপ্রভু শোকে অধীর হয়ে গেলেন। শিশুর মতো বিলাপ করতে লাগলেন। পঞ্চসখা তাঁকে ঘিরে ধরে বসে ক্রমাগত প্রবোধ দিয়ে শান্ত করলেন।

শোকের প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে উঠে মহাপ্রভু কিছুটা শান্ত হলেন। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। সকলকে ডেকে বললেন, “চলো, সবাই মিলে স্বরূপ দামোদরের দেহ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।”

স্বরূপের মরদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে মহাপ্রভু সমুদ্রে অবগাহন করে বহুক্ষণ বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সমুদ্রের লোনা বাতাসে তাঁর সিক্ত বস্ত্র দেহেই শুকিয়ে গেল। কিছুতেই যেন তিনি নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না।

মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁর প্রিয় ভক্তরাও সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেখানে ভরদ্বাজ মিশ্রও ছিলেন। তিনি আলগোছে থেকে সব কিছু লক্ষ করেন। সব কিছু লক্ষ করাই তাঁর কাজ। মহাপ্রভু সহ সকলে আবার যখন গম্ভীরায় ফিরে এলেন, তখন ভরদ্বাজ আর ফিরলেন না। তাঁর অন্য স্থানে যাওয়ার ছিল। শোকার্ত মহাপ্রভু রাম রায়কে ডেকে পাঠালেন।

রাম রায় এলে মহাপ্রভু তাঁকে বললেন, “রাম রাজা, গৌড়ে তো কাউকে দিয়ে স্বরূপের এই আকস্মিক দেহান্তরের খবর পাঠাতে হবে।”

রায় রামানন্দ ঘাড় নাড়লেন। কিছু ক্ষণ ভেবে তার পর বললেন, “টোটা গোপীনাথের পূজক গদাধর পণ্ডিত গৌড়ের মানুষ। সে বরং গৌড়ে গিয়ে খবর দিয়ে আসুক।”

মহাপ্রভু তাঁর কথায় সায় দিলেন। পরিহাস করে বললেন, “এই জন্যই তো তোমাকে রাজা বলি। সব সমস্যার সমাধান আছে তোমার কাছে।”

তার পর আরও কয়েক মাস কেটে গিয়ে আষাঢ়ের মেঘে মেঘে বর্ষা নেমেছে। কিন্তু পুণ্যদেহের অধিকারী মহাপ্রভুর শরীরে যেন ক্ষয় শুরু হয়েছে। দামোদরের শোক কি তাঁকে এতটাই গ্রাস করেছে!

রথযাত্রা উপলক্ষে গৌড় থেকে দলে দলে ভক্তরা আসা শুরু করেছে। তারাও লক্ষ করছে মহাপ্রভুর এই শারীরিক ক্ষয়। সোনার রোদের মতো উজ্জ্বল বর্ণের উপরে যেন শ্যামল মেঘের ছায়া এসে পড়েছে। তবু, মহাপ্রভুর খোল-করতালের সঙ্গে সঙ্গে উদ্দাম নৃত্যগীতের কোনও বিরাম নেই। কিন্তু বার বার তিনি যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আগে তো এমন হত না! ভক্তরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে।

এক দিন নিত্যানন্দ প্রভু এই কথাটাই বললেন রায় রামানন্দকে, “রাম রাজা, এ যেন ভাল মনে হচ্ছে না আমার!”

“কী বিষয়ে প্রভু?”

“এই যে দিন দিন আমাদের প্রভু কেমন শীর্ণ হয়ে যাচ্ছেন। সোনার বর্ণ হয়ে যাচ্ছে কালিবর্ণ! তুমি লক্ষ করোনি?”

“করেছি। কিন্তু মহাপ্রভুকে বোঝানো কি আমার সাধ্য! আজকাল আহার করেন না ভাল করে! নিদ্রা যান না ভাল করে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে কৃষ্ণ কৃষ্ণ নামে পাগল হয়ে গম্ভীরার পাথরের ভূমিতে মাথা কোটেন।”

নিত্যানন্দ প্রভু চিন্তামগ্ন হয়ে কিছু যেন ভাবলেন। তার পর বললেন, “এক বার রাজবৈদ্যকে কি ডেকে পরামর্শ নেওয়া যায়?”

রামানন্দ সে কথায় সায় দিলেন। বললেন, “কেন যাবে না! কিন্তু আমাদের প্রভু কি রাজি হবেন?”

তাঁরা দু’জনে কথা বলছিলেন মহাপ্রভুর কিছু দূরে বসে। মহাপ্রভু নদে থেকে আগত কয়েক জন ভক্তকে নানাবিধ প্রশ্ন করছিলেন।

তখনই জগদানন্দ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি সবে নবদ্বীপ থেকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। নিত্যানন্দর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে তিনি মহাপ্রভুর কাছে গেলেন। মহাপ্রভুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, “প্রভু, শান্তিপুর থেকে অদ্বৈতাচার্য একটি তর্জা পাঠিয়েছেন আপনার জন্য।”

মহাপ্রভু স্মিত মুখে তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, “কই, পড়ে শোনাও তবে সেই তর্জা।”

বাউলকে কহিহ—লোক হইল বাউল।

বাউলকে কহিহ—হাটে না বিকায় চাউল॥

বাউলকে কহিহ—কাজে নাহিক আউল।

বাউলকে কহিহ—ইহা কহিয়াছে বাউল॥

তর্জা শ্রবণ করে কেউ কিছু বুঝতে পারলেন না। কেউ কেউ হাসাহাসি করলেন। ভাবলেন, এ তর্জা বুঝি মস্করা করে প্রবীণ অদ্বৈত আচার্য তাঁর শিষ্যকে পাঠিয়েছেন।

পিছনে ভরদ্বাজ বসে ছিলেন। তিনি মনে মনে তর্জাটিকে আত্মস্থ করে নিলেন।

কিন্তু মহাপ্রভুর মুখে হাসি নেই। তাঁর মুখমণ্ডল যেন বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে।

নিত্যানন্দ মহাপ্রভুও তর্জাটি শুনেছিলেন। তিনি এগিয়ে এলেন মহাপ্রভুর কাছে। মহাপ্রভুর মুখের পরিবর্তন তিনি লক্ষ করেছেন।

মহাপ্রভু ভক্তদের কাছ থেকে উঠে নিজের কক্ষে চলে গেলেন।

নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর এই গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মনে হল মহাপ্রভুর কাঁধ যেন কিসের অজানা এক ভারে নুয়ে পড়েছে। অসীম ক্লান্তিভরে তিনি যেন পা টেনে টেনে এগিয়ে গেলেন।

রায় রামানন্দ তাকালেন নিত্যানন্দ প্রভুর দিকে। বললেন, “তর্জার মানে তো কিছুই বুঝলাম না।”

তিনি অন্য মনে আকাশের দিকে তাকালেন। মৃদু গলায় বললেন, “দেবতার আবাহন আর বিসর্জন তাঁর উত্তমরূপেই জানা আছে।”

কথাটা বলেই তিনি থেমে গেলেন।

সে দিন রাত্রে আর মহাপ্রভু গম্ভীরা থেকে বাইরে বেরোলেন না। ভক্তদের সঙ্গেও মিলিত হলেন না।

মধ্যরাতে গোবিন্দ বিদ্যাধরের সঙ্গে প্রমোদকক্ষে দেখা করলেন ভরদ্বাজ। তাঁকে বললেন তর্জার কথা। বিদ্যাধর সেই তর্জার মানে বুঝতে পারলেন কি না, তা মুখ দেখে বোঝা যায় না। তিনি বললেন, “ঠিক আছে। তুমি এ বার বিদায় নাও।” কয়েকটি মুদ্রা তিনি ব্রাহ্মণের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিলেন।

হঠাৎ যেন ভরদ্বাজের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করল। এই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল!

ব্রাহ্মণ চলে গেলে বিদ্যাধর তাঁর একান্ত সহচর গরুড়কে ডাকলেন। দু’জনে একান্তে বসেমন্ত্রণা করলেন।

রাত্রি শেষের পূর্বেই দুই ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে পড়ল, বিদ্যাধরের গৃহ থেকে। দুই জনেরই আপাদমস্তক কালো বস্ত্রে ঢাকা। সওয়ার দু’জনকে চেনা যায় না। বোঝা যায় না তাদের গন্তব্য কোথায়। তবে পুরীর সীমানা পার হয়ে তারা একটি বৌদ্ধ সঙ্ঘে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে বেশভূষা পরিবর্তন করে তারা সাধারণ বেনিয়ার বেশ ধারণ করে গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তবে তাদের যেন ভীষণ তাড়া। দ্রুত তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে হবে।

গৌড়ের সুলতান দুই অনুচরের হাত থেকে গোবিন্দ বিদ্যাধরের বার্তা পেয়ে কিছু ক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তার পরে ধীরে ধীরে তাঁর মুখে একটা ক্রূর হাসি চওড়া হয়ে ফুটে উঠতে লাগল। তিনি বার বার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পুরী অধিকার করতে পারেননি। এই দুঃখ যেন কবরের মাটির নীচে শুয়েও তাঁর দূর হবে না। কিন্তু তিনি পরাজিত হচ্ছেন কার কাছে? এক সদা-ক্রন্দনরত সন্ন্যাসীর কাছে? ওই দারুভূত পুরুষোত্তমদেবের কী সাধ্য তাঁর দুর্ধর্ষ সৈন্যদের প্রতিহত করার! অথচ ওই সন্ন্যাসী তিল তিল করে এত বছর ধরে তাঁর মনের ভিতরে লালিত স্বপ্নকে হত্যা করেছে। এমনকি গৌড়ের শ্রেষ্ঠ দুই রত্ন, রূপ আর সনাতনকে পর্যন্ত সুলতানের আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তারা গৌড় থেকে চলে গিয়ে অস্ত্র ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছে। গৌড়েশ্বর ভেবে পান না, ওই সামান্য সন্ন্যাসীর এত ক্ষমতার উৎস কোথায়!

কিন্তু আর না! এ বার মোক্ষম সময় উপস্থিত হয়েছে। বিদ্যাধর যখন সাহায্য চেয়েছে, তখন তো সাহায্য করতেই হবে আপাতত। ওই দীর্ঘকায় সন্ন্যাসীর সুদূর বিস্তারী বরাভয়ের ছায়া যদি পুরীর আকাশ থেকে সরে যায়, তার পরের কাহিনি তো অন্য ভাবে লেখা হবে। তিনি গলা ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন।

গোবিন্দ বিদ্যাধরের উদ্দেশ্যে তিনি একটি বার্তা লেখালেন। সেই সঙ্গে চার জন বিশ্বস্ত জোয়ান সৈন্যকে নির্বাচিত করলেন।

পর দিনই তারা নদের বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর বেশ ধরে যাত্রা করল। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাদের নীলাচলে পৌঁছে যেতে হবে।

৩০

কয়েক দিন মহাপ্রভু আর গম্ভীরা থেকে বেরোলেন না। তিনি প্রায় আহার ভুলে গিয়েছেন। সারা দিন-রাত্রি ভাবে বিভোর হয়ে তিনি গম্ভীরায় শুধু মুখ ঘর্ষণ করছেন। পাথরের শীতল ভূমির কর্কশ স্পর্শনে তাঁর মুখমণ্ডল রক্তাক্ত হয়ে পড়ছে। তবু কৃষ্ণ নামে বিরাম নেই। ঠোঁট, মুখ বেয়ে রক্তধারা ক্রমশ তাঁর বুক বেয়ে নামছে। নিত্যানন্দ সহ পঞ্চসখা কিছুতেই তাঁকে থামাতে পারছেন না।

কেন তিনি এমন করছেন, সেটাও কেউ বুঝে উঠতে পারছেন না। আসলে মহাপ্রভুর মনের গভীরে ডুব দেওয়ার সাধ্যই বা কার আছে? সারাদিন যেন প্রভুর ভিতরে তিন দশা ঘোরাফেরা করে। অর্ন্তদশা, বাহ্য দশা আর অর্ধবাহ্য দশা। অর্ন্তদশায় তিনি যেন ঘোরের মধ্যে থাকেন। অর্ধবাহ্য দশায় তিনি প্রলাপের মতো অনবরত কৃষ্ণ নাম গাইতে থাকেন। আর তাঁকে ঘিরে থাকা ভক্তগণ তা শ্রবণ করে আকুল হয়ে যায়।

এমনি করে উন্মাদের মতো পাগল-পারা হয়ে কয়েক দিন কেটে গেল।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy