Advertisement
E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

আজ যেন কিছুতেই মনটা তাঁর শান্ত হচ্ছিল না। মনের ভিতরে কেমন যেন একটা ঝড় বইছে। নতুন করে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ স্থাপন করার পরে প্রায় মাসাধিক কাল অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সারা নগর জুড়ে যে উৎসব চলছিল, তার রেশও প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

অবিন সেন

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৫ ০৭:৫২
Share
Save

পূর্বানুবৃত্তি: অদ্বৈত আচার্যের গৃহে কয়েকটা দিন হরিনাম সঙ্কীর্তনের মধ্য দিয়ে গভীর আনন্দে কাটালেন মহাপ্রভু। তার পর এক সময় সকলকে বিদায় জানিয়ে চার সখাকে সঙ্গে নিয়ে পতে নামলেন মহাপ্রভু। আর পিছন ফিরে চাইলেন না। ওদিকে পুরীর মন্দিরে পণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য দেখতে পেলেন ভাবোন্মত্ত নিমাইকে। পরিচয় না থাকায় তিনি চিনতে পারলেন না। শুধু অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন, কে এই দিব্যকান্তি পুরুষ। মহাপ্রভু জগন্নাথ বিগ্রহের দিকে ছুটে গেলেন, কিন্তু বেদিতে পৌঁছনোর আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলেন সংজ্ঞা হারিয়ে। উদ্বিগ্ন সার্বভৌম তাঁর কয়েক জন শিষ্যকে দিয়ে মহাপ্রভুকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেখানে সপার্ষদ আঠেরো দিন অবস্থান করে তিনি বেদান্ত শ্রবণ করলেন। তার পর কৌপীনমাত্র সম্বল করে রওনা দিলেন দাক্ষিণাত্য অভিমুখে।

এই দিকটায় লোকজনের আনাগোনা কম। চুপ করে বালুকাবেলায় বসে থাকেন নৃসিংহ। বসে বসে বিপুল হাওয়ার সঙ্গে দুরন্ত ঊর্মিমালার কথোপকথন শোনেন। শুনতে শুনতে তাঁর মন কোথায় হারিয়ে যায়। অনাবিল শান্তির ঘ্রাণ পেতে থাকেন তিনি।

আজ যেন কিছুতেই মনটা তাঁর শান্ত হচ্ছিল না। মনের ভিতরে কেমন যেন একটা ঝড় বইছে। নতুন করে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ স্থাপন করার পরে প্রায় মাসাধিক কাল অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। সারা নগর জুড়ে যে উৎসব চলছিল, তার রেশও প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে। সাধারণ জনগণ আবার সে যার বাঁধাধরা কাজের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সমস্ত নীলাচলে আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছন্দ ফিরে এসেছে। যে দুর্দিনের অশুভ মেঘে পুরীর আকাশে ছেয়ে গিয়েছিল, তা যেন অন্তর্হিত হয়ে আবার সোনারঙের রোদ উঠছে। সাধারণ মানুষের মন থেকেও দুশ্চিন্তার অন্ধকার কেটে গিয়েছে। ভাবটা এমন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ তো কতই হয়, আবার এক দিন যুদ্ধ থেমেও যায়। আবার কখনও রাজ্যের সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে। সাধারণ মানুষ তাতে তেমন আমল দেয় না। শুধু সীমান্ত থেকে কোনও কোনও বাড়িতে মৃত্যুর খবর আসে কখনও, ক্ষুদ্র জনপদ নড়ে-চড়ে ওঠে, দুঃখের একটা পর্দা অলক্ষে ঝুলে থাকে কয়েক দিন। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।

নৃসিংহ ভাবছিলেন, ‘যা হল তা কি সত্যি ভাল হল? হুসেন শাহের সেনাদের এমন বাগে পেয়েও ছেড়ে দেওয়া হল! এর পিছনে কারণটা কী? ক্লান্ত সৈন্যরা আর যুদ্ধ চাইছিল না বলে বিদ্রোহ করে বসে, তাই তাদের পিছু হটতে হয়। গোবিন্দ বিদ্যাধরের এমন কথায় সত্যই কি কোনও সত্যতা আছে?’

মাঝে মাঝে এই চিন্তাটাই তাঁকে কুরে কুরে খায়।

মাধব মিশ্রর সঙ্গেও তিনি এক বার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। মাধব তার এই সন্দেহের কথা শুনে গূঢ় ভাবে হেসেছিলেন। মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, “আপনার সন্দেহ অমূলক নয়, বণিকপুত্র,” তার পরে বলেছিলেন, “মহারাজ আছেন। অন্য সমস্ত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা আছেন, এই নিয়ে নিশ্চয়ই তাঁরা ভাবছেন। আপনি এত চিন্তিত কেন, বণিকপুত্র!”

তিনি ‘বণিকপুত্র’ কথাটার উপরে যেন বেশি জোর দিয়েছিলেন।

নৃসিংহ যেন অনিচ্ছায় মাথা নেড়ে তাঁর কথায় সায় দিয়েছিলেন। মাধব সে দিন চলে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “ঠিক আছে, আমি আপনাকে যথাসময়ে খবর দেব।”

মাধব মিশ্র সেই সে চলে গিয়েছিলেন, তার পরে আর কোনও পাত্তা নেই তাঁর। তিনি এই রকমই। মাঝে মাঝে তিনি উধাও হয়ে যান। কোথায় যান কেউ জানে না। নৃসিংহও জানেন না। কিন্তু নৃসিংহের যখন দরকার পড়ে, তখন কোথা থেকে যেন সেই খবর পেয়ে যান আর অচিরেই নৃসিংহের কাছে এসে হাজির হন।

নৃসিংহ এক বার এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মহারাজকে আভাসে ইঙ্গিতে তার সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ করেছেন, মহারাজের অগাধ আস্থা তাঁর প্রধান অমাত্য গোবিন্দ বিদ্যাধরের উপর। গড়মান্দারণ দুর্গ থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে ইসমাইল গাজীর সৈন্যদের ছেড়ে দিয়ে রাজ্যে ফিরে এলে গোবিন্দ বিদ্যাধরের উপরে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন মহারাজ। যার ফলে গড়মান্দারণ একটা অমীমাংসিত সীমানা হিসাবে থেকে গিয়েছে। মহারাজের মনে হয়েছিল, জয়ী হওয়ার অবস্থায় থেকেও কোনও রকম সন্ধি না করে ফিরে আসাটা চরম অবিমৃষ্যকারিতার কাজ হয়েছে। তা সত্ত্বেও গোবিন্দ বিদ্যাধর মহারাজকে কী বুঝিয়েছিলেন, তা জানেন না নৃসিংহ।

তিনি লক্ষ করেছেন তার পরও গোবিন্দ বিদ্যাধরের উপরে মহারাজের আস্থা তেমনই অবিচলিত ছিল। প্রধান অমাত্যের পদেই বহাল রেখেছিলেন গোবিন্দ বিদ্যাধরকে।

কিন্তু তবু যেন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না নৃসিংহ। তাঁর শুধু মনে হয় পর্দার আড়ালে একটা কালো ছায়া যেন মৃদু হাওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে। মন তাঁর এতই বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, যে প্রথমটায় খেয়াল করেননি সেই বাঁশির শব্দ। সমুদ্র গর্জনের ভিতরেও মাঝে মাঝে খুব মৃদু সেই শব্দটা হাওয়ায় ভেসে আসছে। খুবই মৃদু, তবু কী মিঠে আবেশ তার।

আগেও তিনি এই শব্দটা শুনেছেন। কে এমন অন্ধকারের ভিতরে সুরের জাল বিছিয়ে দিচ্ছে।

নৃসিংহর ভিতরে যেন একটা জেদ চেপে গেল। তাঁকে জানতেই হবে কে এই অপূর্ব বংশীবাদক!

নৃসিংহ এক মুহূর্ত বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনলেন ঠিক কোন দিক থেকে শব্দটা আসছে। তাঁর এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা। যে শব্দ সাধারণ মানুষের কর্ণগোচর হয় না, তেমন মৃদুতম শব্দও তিনি শুনতে পান। ছেলেবেলা থেকে কঠিন যোগসাধনায় তিনি এই ক্ষমতা রপ্ত করেছেন। নিজের মনে তিনি এক বার মাথা নাড়লেন। বংশীধ্বনির উৎসের দিক নির্ণয় তিনি করতে পেরেছেন। সেই দিক লক্ষ করে হাঁটতে লাগলেন।

এই দিকটা বেশ নির্জন। ছোট ছোট গুল্ম সামনের দিকে, তার পর বড় বড় বৃক্ষের সারি। অন্ধকারে ভাল করে দেখা যায় না কিছু। মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো আলো এসে পড়েছে। এইটুকুই ভরসা। হয়তো একশো পা তিনি অতিক্রম করেছেন, তখনই একটি ক্ষুদ্র আলোর বিন্দু দেখা যায়। বাঁশির আওয়াজ আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি দু’-তিন মুহূর্ত সেই আলোকবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন, ওই আলোকবিন্দুর কাছ থেকেই শব্দটা আসছে।

শব্দ অনুসরণ করে কাছে গিয়ে দেখলেন, একটি ছোট কুটির। কিন্তু ঠিক দরিদ্রের কুটির নয়। ক্ষুদ্র দাওয়ার চার ধারে চারটি দ্বীপের আলোয় সেই রকমই মনে হয় নৃসিংহের। সেই আলোকমালার ঠিক মাঝখানে আলগোছে বসে আছেন অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। সুন্দর রত্নখচিত বস্ত্র তাঁর পরনে। আলুলায়িত কুন্তল জলপ্রপাতের মতো পিঠ বেয়ে নেমে ভূমি স্পর্শ করেছে। তাঁর হাতে বাঁশের বাঁশরী। আত্মসমাহিত হয়ে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, তাই প্রথমে খেয়াল করেননি। তার পর সহসা নৃসিংহকে দেখে বিস্ময়ভরা চোখ দু’টি মেলে তিনি তাকিয়ে ছিলেন। নৃসিংহকে এই ভাবে আচমকা এগিয়ে যেতে দেখে দুই জন রক্ষী উদ্যত বল্লম হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে এসেছে।

তরুণী বাম হাত তুলে তাদের নিরস্ত হতে বললেন। তিনি যেন চিনতে পেরেছেন যুবাপুরুষকে। নৃসিংহকে অন্তঃপুরের আড়াল থেকে তিনি তাঁর পিতার কাছে দেখেছেন। নামও শুনেছেন। কারণ জগন্নাথ-বিগ্রহকে ওই ভাবে রক্ষা করার পরে নৃসিংহ নামটি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া মহারাজ প্রকাশ্যে তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন।

কুটিরের ভিতর থেকে তত ক্ষণে আরও এক জন তরুণী বেরিয়ে এসেছে। এ প্রথম তরুণীর পরিচারিকা। তার নাম শ্যামা।

তরুণীর রূপে নৃসিংহের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এই আশ্চর্য সুন্দর তরুণী সামান্য কেউ নন। নিশ্চয়ই রাজপরিবারের কেউ হবেন। সেই অনুমানেই একটু ঝুঁকে তিনি তরুণীকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “আমার অপরাধ মাফ করবেন। আপনার আশ্চর্য বাঁশির সুর শুনতে শুনতে আমি চলে এসেছি। কাছ থেকে এই অপূর্ব সুর শোনার লোভ আমি সংবরণ করতে পারিনি।”

কথাটা শেষ করতে না করতেই সহসা নৃসিংহের মনে পড়ে যায় বিদুষী, সঙ্গীত-পারদর্শী রাজকুমারী তুক্কার কথা। ছেলেবেলায় কিশোরী তুক্কাকে দেখেছিলেন কয়েক বার। রথের সময়ে। ইনি কি সেই রাজকুমারী? কিছুটা সন্দেহ নিয়েই তিনি বললেন, “দীনের অপরাধ ক্ষমা করবেন রাজকুমারী।”

ক্ষণিকের তরে রাজকুমারী তুক্কা ও পাশে দণ্ডায়মান প্রিয় পরিচারিকা শ্যামার মধ্যে অপাঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়। স্মিতমুখে রাজকুমারী তুক্কা বললেন, “আপনি তো দীন নন! জগতের রক্ষাকর্তারও রক্ষাকর্তা আপনি।”

তাঁর গলার স্বরে কোনও সঙ্কোচ বা জড়তা নেই। আবার তাঁর কথার ভঙ্গিতে কোনও প্রগল্ভতাও নেই। শিক্ষা ও ব্যক্তিত্বের মিশেলে তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ভীষণ শান্ত।

নৃসিংহ এ বার রাজকুমারীর পরিচয় বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। আরও এক বার রাজকুমারীকে অভিবাদন জানালেন। বললেন, “রাজকুমারী আমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আমি আপনাদের ক্ষুদ্র সেবক।” একটু থেমে আবার বললেন, “আপনার এই নিভৃত সুরসাধনায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য আমি সত্যিই আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।”

রাজকুমারী একটা হাত আলগোছে তুলে তাঁর কথার ক্ষুদ্র প্রতিবাদ জানালেন।

পাশ থেকে প্রিয় সখী শ্যামা বলল, “দেবী, এ বার আমাদের ফিরে যাবার সময় হয়েছে।”

রাজকুমারী উঠে পড়লেন।

নৃসিংহ মনে মনে ভাবলেন, জীবনে কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে। তাঁর যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এই সব সত্যি কি না! হয়তো সবই স্বপ্ন। এখনই হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে আর কাচের মতো ঝনঝন করে ভেঙে যাবে এই সব রূপকথার দৃশ্য।

মহাপ্রভু যখন গোদাবরী নদীতীরে উপস্থিত হলেন, তখন সবে উষার আলো পুব আকাশের গায়ে লাল রঙের প্রলেপ দিয়েছে। বৈশাখের ভোরে বাতাসে অদ্ভুত এক শান্তি। ছন্দোময় তরঙ্গ তুলে সম্মুখেই বয়ে যাচ্ছে গোদাবরী। সমগ্র স্থানটি ভীষণ শান্ত, নির্জন বনরাজি বেষ্টিত। বসন্ত বিগতপ্রায়, তবু মাঝে মাঝে কোকিল ডেকে উঠছে।

মহাপ্রভু একা নন, তাঁর সঙ্গে পাঁচ সাত জন সঙ্গী। তিনি যেখানেই অবস্থান করেন, সেখানেই উৎসব শুরু হয়ে যায়। অরণ্যবেষ্টিত গোদাবরীর স্নানের ঘাট দেখে তিনি যমুনা নদীর কথা ভাবলেন। ভাবে বিভোর হয়ে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলতে বলতে তিনি কীর্তন শুরু করে দিলেন। তাঁর সঙ্গীরাও তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন। ভোরের গোদাবরী তীরে সে এক অপূর্ব উৎসব শুরু হয়ে গেল। মহাপ্রভু গান গাইতে গাইতে নৃত্য করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তাঁর দুই চোখ দিয়ে অনবরত বইতে লাগল অশ্রু। যেন দু’টি নীল পদ্ম ভোরের শিশিরে টলমল করে উঠছে। আকাশের রং তত ক্ষণে আরও ফর্সা হয়েছে। পুব আকাশের মাথার উপরে ঘন সোনার মতো সূর্যের আলোয় ভরে উঠছে চরাচর। সেই সোনার আলো মহাপ্রভুর দিব্য অঙ্গের উপরে পড়ে যেন লজ্জায় আনত হয়ে সেই চম্পকবর্ণ দেহেই লীন হয়ে যাচ্ছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে তাঁর সঙ্গীরা মহা হর্ষে আরও উচ্চস্বরে নাম-কীর্তন করতে লাগলেন।

বেলা বেড়ে গেল আরও কিছুটা। শ্রীচৈতন্য ভাবে আত্মহারা হয়ে ধীরে ধীরে গোদাবরীর শীতল জলের দিকে নেমে গেলেন। তিনি এতটাই আত্মবিস্মৃত ছিলেন যে, গোদাবরী নদীকে মনে করলেন যমুনা। সেই পুণ্য বারি মস্তকে সিঞ্চিত করে নদীকে প্রণাম করলেন। তার পর জলের আরও গভীরে প্রবেশ করে অবগাহন করে স্নান করলেন। চার পাশ থেকে অকারণে তখন অজস্র পাখি ডেকে উঠল।

মহাপ্রভু অবগাহন শেষে তীরে উঠে এলে সখা কৃষ্ণদাস পরম মমতায় শুষ্ক বস্ত্র নিয়ে এসে প্রভুর গা মুছিয়ে দিলেন। সুগন্ধি চন্দনের রসকলি এঁকে দিলেন ললাটে, কণ্ঠে, বাহুমূলে। মল্লিকা ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। প্রভু তখনও ভাবে বিভোর।

সহসা নদী তীরের শান্তি ভঙ্গ করে এক গুঞ্জন ভেসে এল। সকলে সচকিত হয়ে তাকালে দেখতে পেলেন, শিবিকা আরোহণে এক রাজপুরুষ আসছেন। তিনি পুরী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত গোদাবরী তীরবর্তী অঞ্চলের সামন্ত রাজা রায় রামানন্দ। তাঁর সঙ্গে পার্শ্বচর অমাত্যবর্গ। কয়েক জন বৈদিক ব্রাহ্মণ। রায় রামানন্দ গোদাবরী নদীতীরে তর্পণে এসেছেন।

মহাপ্রভু তখনও নদীতীরে উপবেশন করে কৃষ্ণনাম কীর্তনে মগ্ন। রায় রামানন্দ ভক্তিভরে পূজা সমাপন ও তর্পণ করে গোদাবরীর পুণ্য সলিলে অবগাহন করে তীরে উঠে এলে মহাপ্রভুর প্রতি তাঁর দৃষ্টি পড়ল। মনে মনে ভাবলেন, নবোদিত সূর্যের মতো দীপ্তিমান এই সন্ন্যাসী কে! তিনি শান্ত পায়ে মহাপ্রভুর কাছে এগিয়ে গেলেন।

এই বার শ্রীচৈতন্যের দৃষ্টি পড়ল রাম রায়ের উপরে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “তুমিই কি রাম রায়? তোমাকে তো দেখে এই দেশের রাজা বলেই মনে হচ্ছে।”

রাম বললেন, “আমিই সেই শূদ্র, দাসের দাস।”

রাম রায় তাঁর পদধূলি নিতে গেলে মহাপ্রভু তাঁকে বিরত করলেন। বরং দৃঢ় বাহুবেষ্টনে আলিঙ্গন করে তাঁকে বুকে টেনে নিলেন। রাম রায়ও আবেগে তাঁকে বাহুপাশে বেঁধে নিলেন।

মহাপ্রভু বললেন, “বলো কৃষ্ণ, বলো কৃষ্ণ...”

দু’জনের নয়ন থেকেই অশ্রু ঝরতে লাগল। দু’জনেই ভাবে বিভোর হয়ে সাশ্রুনয়নে কৃষ্ণনাম করতে লাগলেন।

তাঁদের এমতাবস্থায় দেখে আশপাশের সকলের চোখও সজল হয়ে উঠল। সকলে সম্মিলিত ভাবে কৃষ্ণকীর্তন করতে লাগলেন। গোদাবরীর তীরে আবার এক স্বর্গীয় উৎসব শুরু হল।

রাম রায়ের সঙ্গী ব্রাহ্মণরাও অবাক হয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, কে এই সন্ন্যাসী যে এমন করে এক শূদ্রকে আলিঙ্গন করতে পারে!

রায় রামানন্দও বিভিন্ন মানুষের কাছে নিমাই পণ্ডিতের সুখ্যাতি শুনেছিলেন। শুনেছিলেন নিমাই পণ্ডিত এক আশ্চর্য পুরুষ। কিন্তু এ কথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেননি যে, সেই অপরূপ দিব্যকান্তি সন্ন্যাসী তাঁকে এমন করে বুকে জড়িয়ে ধরবেন! এ যেন তাঁর কাছে এক আশ্চর্য সম্মান। তাই কিছুতেই আর চোখের জল বাধা মানছে না। অবিরত ধারায় দুই চোখ দিয়ে যেন প্লাবন বয়ে যাচ্ছে তাঁর।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel Bengali Series

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}