Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৪৩
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হলেন পুলিশ অফিসার। সাধারণত ঘরের মহিলারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন না। হয়তো ভয়ে, কিংবা সংস্কারবশত। এই মহিলার সাহস আছে বলতে হবে।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:০৪
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: স্বর্ণপ্রভা এক টুকরো কাগজে বেলঘরিয়ার একটি ঠিকানা লিখে রেখে যায় দীনেশের বিছানায়। সেদিন ভোররাতে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের সেই বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। পালানোর সুযোগ না পেয়ে বিপ্লবীরা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। পারস্পরিক গুলি বিনিময়ে দীনেশের হাতে এবং নলিনীর পায়ে গুলি লাগে। জগদানন্দর রিভলভারের গুলি শেষ হয়ে যায়। তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। অন্য দিকে, ধৃত বিপ্লবী দীনেশের কাছ থেকে পাওয়া চিরকুট থেকে বেলঘরিয়ার ঠিকানাটি পায় পুলিশ। সেই সূত্র ধরে এসে উপস্থিত হয় শশিকান্তদের বাড়িতে। সেখানে তখন বিস্তর আয়োজন করে মেয়ের পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে উমানাথ। পুলিশ শশিকান্তকে খুঁজতে এসেছে জেনে পুলিশের সামনে তার মুখ থেকে বেফাঁস দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় শশিকান্তর থানায় তলব হওয়ার ঘটনাটি বেরিয়ে পড়ে। পুলিশ জানায়, এ বারেও শশীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রেসিডেন্সি জেলে হাজিরা দিতে হবে।

কাল গেলে হবে না? আজ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান...” মুখ পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বললেন বিভাবতী।

মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হলেন পুলিশ অফিসার। সাধারণত ঘরের মহিলারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন না। হয়তো ভয়ে, কিংবা সংস্কারবশত। এই মহিলার সাহস আছে বলতে হবে। অফিসার এক বার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “না মা, সেটা সম্ভব নয়, আজই যেতে হবে। শুধু একটু জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপার। অপরাধীদের সঙ্গে যোগ না থাকলে আজই ছেড়ে দেওয়া হবে।”

বিভাবতী আর কোনও কথা বললেন না। কেন জানি না, আজ হঠাৎ তার নীলমণির কথা মনে পড়ছে। বিপ্লব কি রক্তে থাকে?... কে জানে? চোখ দুটো সজল হয়ে উঠল তাঁর।

শশিকান্ত প্রস্তুত হয়ে এলে, তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন দুই পুলিশ অফিসার। সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে এক জন পুলিশ অফিসার উমানাথকে বললেন, “কী অনুষ্ঠান আজ আপনার বাড়িতে?”

প্রশ্নটি শুনে উমানাথের মুখটা হাসিতে ভরে গেল। বললেন, “মেয়ের আবদারে ওর একটি পুতুলের বিয়ে হচ্ছে। তাই আর কী...”

“বলেন কী... পুতুলের বিয়েতে এত আয়োজন?” পুলিশ অফিসার নামতে নামতে বললেন।

উত্তরে উমানাথ কী বললেন, তা শোনা গেল না।

গাড়ি এসে থামল লালবাজার পুলিশ থানার সামনে। শশিকান্তকে নিয়ে দুই পুলিশ অফিসার একটি ঘরে এসে উপস্থিত হল। শশিকান্তকে একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলা হল। শশিকান্ত বসতে বসতে লক্ষ করল, উল্টো দিকে যে অফিসাররা বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের সবারই চোখ তার দিকে। যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভোররাতে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট অ্যাকশনে পুলিশের দলকে নেতৃত্ব দেওয়া দুই পুলিশ অফিসার— মুকুন্দ ভট্টাচার্য ও পোলার্ড। দীনেশের গুলিতে আহত হলেও, পোলার্ড আজ অফিসে এসেছেন। তিনি এই দলটার শেষ দেখে ছাড়বেন। গুলি তাঁর হাতে লেগেছিল বলে, ডান হাতে একটি ব্যান্ডেজ জড়ানো আছে।

মুকুন্দ ভট্টাচার্য শশিকান্তর দিকে এক বার তাকিয়ে, পোলার্ড সাহেবের দিকে তাকালেন। পোলার্ড মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে, মুকুন্দ ভট্টাচার্য শুরু করলেন। শশিকান্তর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার নাম?”

“শশিকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।”

“বিপ্লবী কাজকর্ম ছাড়া আর কী করা হয়?”

“বিপ্লবী কোনও কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত নই।”

“বেশ, পেশা তো নিশ্চয়ই একটা আছে?”

“আমি একটি সওদাগরি অফিসে চাকরি করি।”

“অফিসের নাম?”

“প্লেস সিডনস অ্যান্ড গাফ।”

“শেয়ার ব্রোকার ফার্ম?”

“হ্যাঁ।”

মুকুন্দ ভট্টাচার্য একটু চুপ করে থাকল। তার পর ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো বার করে, শশিকান্তর হাতে দিয়ে বলল, “দেখুন তো, এই কাগজে লেখা ঠিকানাটা আপনার কি না। আজ ভোররাতের অ্যাকশনে এক জন নটোরিয়াস ক্রিমিনালের পকেটে এটি পাওয়া গেছে। দীনেশ মজুমদারকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন, না হলে, আপনার বাড়ির ঠিকানা তার পকেটে এল কী করে?”

“দেখুন স্যার, দীনেশ মজুমদার বলে আমি কাউকে চিনি না, যদিও কাগজে লেখা ঠিকানাটা আমার বাড়ির।”

“স্কাউন্ড্রেল!” গর্জে উঠল পোলার্ড। বলল, “অ্যাডমিট অর ফেস দ্য কনসিকোয়েন্স।”

হাত তুলে পোলার্ডকে শান্ত হতে বললেন মুকুন্দ ভট্টাচার্য। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর। তিনি জানেন, কী ভাবে অপরাধীর পেট থেকে কথা বার করতে হয়। হাতের ইশারায় এক জন কনস্টেবলকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। কনস্টেবলটি চলে গেল এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ধৃত চার বিপ্লবীকে নিয়ে এসে হাজির করল।

“এ বার বলুন, এদের মধ্যে কে দীনেশ মজুমদার?” টেবিলের উপর একটা পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন মুকুন্দ ভট্টাচার্য।

শশিকান্ত চার বিপ্লবীর দিকে তাকাল। তিন জন পুরুষ, এক জন মহিলা। মহিলা বিপ্লবীর দিকে চেয়ে শশিকান্তর হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ঠিক দেখছে তো? না কি তার চোখের ভুল? এতটা ভুল হতে পারে? কখনওই না, এ লাবণ্যময়ী, তার লাবণ্য! এতটা পরিবর্তন? কিন্তু এখানে কেন? লাবণ্য কি সত্যিই পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে! লাবণ্যময়ী তার দিকে তাকাচ্ছে না কেন? সে কি তার শশীদাকে চিনতে পারেনি?... কেন?... কেন?

“দীনেশ মজুমদার এক জন পুরুষের নাম। শশিকান্তবাবু, আপনি এই তিন জন পুরুষের মধ্যে দেখুন। এক জন নিশ্চয়ই আপনার পরিচিত দীনেশ মজুমদার,” বললেন মুকুন্দ ভট্টাচার্য।

চমক ভাঙল শশিকান্তর। খানিকটা লজ্জিতও হল। এত ক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। পুলিশ অফিসারের কথায় আবার তিন জনকে দেখল। তার পর বলল, “বিশ্বাস করুন স্যর, এই তিন জনের কাউকে আমি চিনি না। কোনও দিন দেখিইনি।”

পুলিশ অফিসার মুকুন্দ ভট্টাচার্য কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই মহিলাটি বলে উঠল, “ওকে ছেড়ে দিন স্যর। কেন এক জন নিরপরাধ মানুষকে এই ভাবে হেনস্থা করছেন আপনারা?”

লাবণ্য... লাবণ্যময়ী! শশিকান্তর মনে আর কোনও দ্বিধা নেই যে, ঠিক সাত বছর আগে পুকুরঘাট থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই লাবণ্যময়ীই এই মেয়ে। এই কণ্ঠস্বর তার খুব পরিচিত। এ অন্য কারও হতে পারে না।

মুকুন্দ ভট্টাচার্য স্পষ্টতই অবাক হয়েছেন। চোখ দুটো ছোট করে, মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলে ওঠেন, “আপনি কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন, এই ভদ্রলোক নিরপরাধ?”

“কারণ, অপরাধী আমি নিজে। যে কাগজে লেখা নাম-ঠিকানা দেখে, আপনারা বেলঘর থেকে এই ভদ্রলোককে এখানে এনে বিড়ম্বনায় ফেলেছেন, সেই কাগজটি আমি দীনেশদার পকেটে রেখে দিয়ে এসেছিলাম,” দ্বিধাহীন কণ্ঠস্বরে মেয়েটি জানাল।

প্রত্যেকেই চমকে উঠল মেয়েটির স্বীকারোক্তি শুনে, এমনকি দীনেশও। মুখের অভিব্যক্তি দেখে এখন আর শশিকান্তর বুঝতে বাকি নেই, এদের মধ্যে কে দীনেশ মজুমদার। শশিকান্ত মনে মনে তাকে প্রণাম জানাল, যদিও বয়সে তার থেকে হয়তো ছোটই হবে ছেলেটি।

বেশ খানিক ক্ষণ নীরবতার পর মুকুন্দ ভট্টাচার্য বললেন মেয়েটির দিকে চেয়ে, “তার মানে, আপনি এই শশিকান্তবাবুকে চেনেন, তাই তো?”

মেয়েটি কোনও উত্তর দিল না। চুপ করে থাকল।

“কী স্বর্ণপ্রভা দেবী, কিছু তো বলুন!” একটু ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললেন মুকুন্দ ভট্টাচার্য।

“চিনতাম,” খুব সংক্ষেপে উত্তর দিল মেয়েটি।

“কী করে চিনতেন?”

“ওর বাড়ির কাছেই আমি থাকতাম। ওদের বাড়িটা খুব বড়। ভেবেছিলাম অত বড় বাড়িতে তিন জনের ঠিক জায়গা হয়ে যাবে, তাই... ওর কোনও দোষ নেই স্যর। ওকে ছেড়ে দিন। আমি তো আমার অপরাধ স্বীকার করলাম।”

“হুম,” বলে মুকুন্দ ভট্টাচার্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কনস্টেবল কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে ইশারায় নির্দেশ দিলেন চার জনকে অন্য ঘরে নিয়ে যেতে। কনস্টেবল চার জনকে নিয়ে যেতেই মুকুন্দ ভট্টাচার্য শশিকান্তর খুব কাছাকাছি এলেন, বললেন, “এক্সট্রিমলি স্যরি, শশিকান্তবাবু। কী করব বলুন, এগুলো পার্ট অব আওয়ার ডিউটি। আপনি এখন আসুন। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আবার ডেকে পাঠাতে পারি।”

শশিকান্ত লম্বা করিডর পেরিয়ে লালবাজারের বাইরে এসে দাঁড়াল। চলমান জীবনস্রোত বয়ে চলেছে। সে দিকে তাকিয়ে শশিকান্ত ভাবল, এই জীবনস্রোতে কত কিছু বয়ে যায়। কত কিছু হারিয়ে যায়, আবার ফিরেও আসে। সত্যিই কি ফিরে আসে আগের মতো? লাবণ্য কি ফিরে এল? না কি আবার হারিয়ে যাবে? কে জানে?

“দেখ নেহি সকতে? অন্ধা হ্যায় কেয়া?” এক হিন্দুস্থানি কোচোয়ানের তিরস্কারে চমক ভাঙল শশিকান্তর। খেয়াল হল, সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। ভুল বুঝতে পেরে সে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে যায়। লালবাজারের এই জায়গাটা শশিকান্তর খুব পরিচিত। কয়েক পা দূরেই তার অফিস। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে লালবাজার স্ট্রিটে আসে সে। যখনই এখানে এসেছে, লাল রঙের বিশাল পুলিশ থানাটির দিকে চোখ গেছে তার। কখনও ভাবেনি, এক দিন এর ভিতরেও তাকে ঢুকতে হবে। দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় তাকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সেই মামলায় কয়েক জনের ফাঁসি হয়েছিল। এখানেও কি এমন হতে পারে? বুকের মধ্যে হু-হু করে উঠল। লাবণ্যময়ীর মুখটা ভেসে উঠল। হাতঘড়িতে শশিকান্ত দেখল, বিকেল পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে।

মিনিট দশেক হেঁটে শশিকান্ত প্রিন্সেপ ঘাটে এসে পৌঁছল। ভীষণ ক্লান্ত শরীর। সারা দিন খাওয়া নেই। কাছেই একটা লোক চা-বিস্কুট বিক্রি করছিল। শশিকান্ত চা আর দুটো বিস্কুট খেল। চা খাওয়ার আগে দোকানির থেকে এক গ্লাস জল চেয়ে খেল। মে মাসের তীব্র গরমে তৃষ্ণায় এত ক্ষণ তার ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। গরম চা খাওয়ার পর তার ক্লান্তিও খানিকটা দূর হল। দোকানির পয়সা মিটিয়ে শশিকান্ত ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পুরাতাত্ত্বিক, গবেষক জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিতে তৈরি শ্বেতশুভ্র সৌধটির দিকে। একটি স্তম্ভে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে। সামনে অনন্ত জলরাশি। স্থিরদৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে শশিকান্ত প্রতিজ্ঞা করল, লাবণ্যকে সে কিছুতেই আর হারিয়ে যেতে দেবে না, কিছুতেই না।

৪৩

একটু দেরি করে ঘুম ভাঙল শশিকান্তর। গতকাল শরীর ও মনের উপর খুব চাপ গেছে। খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাড়ির নীচে উঠোনে বায়োস্কোপ দেখানো হচ্ছে। একটা কাঠের বাক্সকে ঘিরে ছোট ছেলেমেয়ের দল বসে গেছে বায়োস্কোপ দেখতে। বায়োস্কোপওয়ালা হাসান আলি বাক্সের উপর ঝুঁকে সুর করে কিছু বলে চলেছে। দোতলার জানালা থেকে তা শোনা না গেলেও, শশিকান্ত জানে ও কী বলছে। ছোটবেলায় সেও হাসান আলির বায়োস্কোপ দেখেছে। তখন হাসানের বয়স কম। চুলে তার আজকের মতো পাক ধরেনি। গোঁফও ছিল কালো ও পুরুষ্টু। বয়সের ভারে হাসান এখন একটু ন্যুব্জ। তবে তার মুখের খুশি-খুশি অমলিন ভাবটি আজও অমলিন।

খুব তাড়াতাড়ি দাঁত মেজে, চোখেমুখে জল দিয়ে শশিকান্ত নীচে নেমে আসে। হাসানের সুরেলা গান তার শ্রুতিগোচর হয়— “দেখো দেখো, তাজমহল দেখো, লাল কিল্লা দেখো, কুতুব মিনার দেখো...”

শশিকান্তকে আসতে দেখে হাসান আলির কণ্ঠস্বর উচ্চ গ্রামে ওঠে। সে আরও সুর করে বলে, “দেখো দেখো দেখো, তাজমহল দেখো, লাল কিল্লা দেখো, কুতুব মিনার দেখো।”

শশীকান্ত ধীর পায়ে বায়োস্কোপের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার খুব ইচ্ছে করে শৈশবে ফিরে যেতে। বায়োস্কোপে চোখ রেখে তাজমহল দেখতে। বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করতে...

“কী দাদাবাবু, দেখবে নাকি... নতুন বায়োস্কোপ?” হাসান বলে শশিকান্তকে।

শশিকান্ত হাসে হাসানের কথায়। বলে, “এখনও কি ওদের মতো ছোট আছি নাকি, হাসান চাচা?”

হাসান আলিও হাসে শশিকান্তর কথায়।

বায়োস্কোপ দেখানো শেষ হয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েরা উঠে পড়েছে। তাদের চোখেমুখে খুশির ভাব। হাসান আলি বায়োস্কোপ বন্ধ করে, দোতলার বারান্দার দিকে তাকাল। সাধারণত উপর থেকেই পয়সা ছুড়ে দেওয়া হয়। শশিকান্ত সেটা লক্ষ করেই হাসানের হাতে দু’আনি পয়সা গুঁজে দেয়। হাসান আলি দু’আনি পয়সা পেয়ে খুব খুশি হয়। শশিকান্তকে আশীর্বাদ করে, বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে তুলে অন্যত্র যাত্রা শুরু করে।

শশিকান্ত সুহাসিনীকে কাছে ডাকে। বলে, “তার পর হাসি, তুই তো এখন শাশুড়ি হয়ে গেলি?”

সুহাসিনী শশিকান্তর কাছে এসে অনুযোগ করে, “তোমার সঙ্গে কথা বলব না।”

“কেন?” শশিকান্ত হাসতে হাসতে বলে।

“তুমি আমার পুতুলের বিয়েতে ছিলে না কেন?”

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে, শশিকান্ত বলে ওঠে, “তোকে আমি খুব সুন্দর একটা পুতুল কিনে দেব।”

পুতুলের নাম শুনে সুহাসিনী শশিকান্তর গা ঘেষে দাঁড়ায়। বলে, “সত্যি?”

শশিকান্ত সুহাসিনীকে কোলে তুলে বলে, “একদম সত্যি।”

উপর থেকে এ দৃশ্য দেখে নিভাননী হাসেন। মনে মনে ভাবেন, গত রাতে এই শশীকে কত অপমানটাই না করল উমানাথ। এক বারও বোঝার চেষ্টা করল না, আসল ঘটনাটা কী!

লালবাজার থেকে শশিকান্ত বাড়ি ফিরেছিল রাত আটটা নাগাদ। সকাল বেলার উৎসবের রেশটুকুও নেই তখন বাড়িতে। প্রতিবেশীরা দুপুরের ভোজের পর বিদায় নিয়েছেন। বাড়িতে টিমটিম করে কয়েকটি আলো জ্বলছে। কাকার ঘর থেকে গান ভেসে আসছে। বোধহয় এই উৎসবের দিনে কাকার ঘরে মজলিশ বসেছে। শশিকান্ত পিসির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, তিনি তক্তপোশে শুয়ে আছেন। মে মাসের গরম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর হাতের পাখাটি ক্রমাগত নাড়িয়ে চলেছেন।

শশিকান্ত খুব আস্তে করে ডাকল, “পিসি...”

ধড়মড় করে উঠে পড়লেন নিভাননী। বিস্ফারিত চোখে শশিকান্তর দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে বললেন, “ফিরেছিস শশী? ওরা তোকে ছেড়ে দিল?”

“ছেড়ে দেবে না কেন! আমি কিছু করেছি না কি যে, আমার হাজতবাস হবে?”

নিভাননী উঠে এসে শশিকান্তর মাথায় হাত রাখেন। তাঁর দু’চোখ থেকে জলের ধারা নামে।

শশিকান্ত ফিরে এসেছে, খবরটা উমানাথের কানে পৌঁছয়। সুর এবং সুরের নেশায় তখন তিনি মজে ছিলেন। খবরটা কানে আসতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। গ্লাসের পানীয় এক চুমুকে শেষ করে, উঠে পড়লেন। ইয়ার-বন্ধুরা তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে, তাদের সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে নিভাননীর ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন।

সারাদিনের অনাহারের পর শশিকান্ত তখন নিভাননীর দেওয়া সন্দেশ উদরস্থ করছিল। উমানাথ শশিকান্তর সামনে এসে দাঁড়ালেন ও চিৎকার করে বললেন, “দূর হ হতভাগা, কেন এসেছিস?”

শশিকান্ত সন্দেশের পাত্রটিকে সামনের টেবিলে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

“এটা কি ওর বাড়ি নয়? শশী এখানে আসবে না তো কোথায় যাবে?”

কেউ খেয়াল করেনি, কখন এ ঘরের দরজার সামনে বিভাবতী এসে দাঁড়িয়েছেন।

বিভাবতীকে বরাবরই একটু ভয় পেয়ে এসেছেন উমানাথ। এ বারেও বিভাবতীর কথায় চুপ করে গেলেন। শুধু বললেন, “শুধু তোমাদের প্রশ্রয়ে মেজদার ছেলেটা গোল্লায় যাচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে কী করে মুখ দেখাব বলো তো?”

“তোমার বড়দার জন্যও তা হলে তোমার মুখ পুড়েছে বলো! তাঁকেও তো কয়েক বার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিল!” বিভাবতী কঠোর গলায় বললেন।

উমানাথ চুপ করে যান। তার পর ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান।

নিভাননী উমানাথের উদ্দেশ্যে বলেন, “শশীকে ওরা ছেড়ে দিল কেন, শুনবি না?”

“তোমরা শোনো...” বলে উমানাথ কিছুটা গিয়েও আবার ফিরে আসেন। বলেন, “এখন ছেড়ে দিয়েছে, পরে আবার ধরবে। ওর নাম পুলিশের খাতায় উঠে গেছে। শশী স্বীকার করুক, বা না করুক, ওর সঙ্গে বিপ্লবী দলের সম্পর্ক আছে।”

ক্রমশ


অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Novel Bengali Series Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy