Advertisement
০২ মে ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৬
Bengali Story

শূন্যের ভিতর ঢেউ

বাইক চালিয়ে কেমন এক ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরল মল্লার। অধরা স্রোতের রোমাঞ্চে, হৃৎকম্পের জলরবে সে যেন ভেসে যাচ্ছে।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

সুমন মহান্তি
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৩৪
Share: Save:

তিন নম্বর টিউশনের ছাত্র ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। তার হাল আমলের গান পছন্দ। বাজাতে গিয়ে ভুল করে। বোঝাই যায় যে প্র্যাকটিস করে না। ছাত্রটি কাঁচুমাচু মুখে বলল, “প্রচুর পড়ার চাপ, মল্লারদা। টাইম ম্যানেজ করতে পারছি না। বাবা প্রায়ই বলছে যে, বাজানো ছেড়ে দিতে হবে, সময় নষ্ট হচ্ছে।”

যত্ন করে ছেলেটিকে শেখায় মল্লার। এত মনোযোগ দিয়ে শিখিয়েও বোধহয় লাভ হবে না। মনে হচ্ছে এই টিউশনটা যাবে। গার্জিয়ানরা অবশ্যই অ্যাকাডেমিক ব্যাপারকে বেশি গুরুত্ব দেবে। এতে দোষের কিছু নেই। পেটে ভাতের জোগান না থাকলে শিল্পের সাধ বা সুযোগ কিছুই হয় না।

ঘণ্টাখানেক পর মল্লার বাইরে বেরিয়ে এসে বাইকে স্টার্ট দেয়। রাত ন’টা বাজে। রাস্তাঘাটে যানবাহনের স্রোত, মানুষের ভিড়, আলোকিত দোকানপাট, জীবনের স্রোত দেখতে তার ভালই লাগে। নির্জনতা সে একদম পছন্দ করে না। আজ নির্জনতা পেতে ইচ্ছে করছে তার। ভাল লাগার এক বোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, চুপচাপ কোথাও বসে ভাবতে চাইছে মন। শেখানোর সময় মোবাইল সে সাইলেন্ট মোডে রাখে। নেটও বন্ধ ছিল। ফোন বার করে নেট অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ভেসে উঠল। চিরশ্রী পাঠিয়েছে!

“আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।”

মল্লার চোখ কুঁচকে দু’বার পড়ল। তার বুকের নিভৃত অংশ যেন কেঁপে উঠল, রঙের স্পর্শ লাগল সেখানে, কেমন এক শিহরন ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। উত্তেজনার ঢেউ জাগল, পরমুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। সে টাইপ করল, “এই গানটা শিখতে চান পরের দিন?”

“না।”

“তা হলে?”

“তেরে মাসুম সওয়াল সে পরেশান হুঁ ম্যায়...” পাশে হাসির একটি ইমোজি ভেসে উঠল।

মল্লার লিখল, “সরল হওয়াই তো ভাল।”

“সে জন্যই তো লিখলাম। এই সারল্য সারা জীবন ধরে রাখুন।”

“ধন্যবাদ।”

চিরশ্রী লিখল, “কখন যে বুকের ভেতর ভালবাসা জন্ম নেয়, মানুষ নিজেই বুঝতে পারে না।”

“তাই?”

“তখন অনেক কিছুই ইচ্ছে করে। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে ভেতরটা গলে যায়।”

মল্লার লিখল, “হয়তো। জীবনে কখনও ভালবাসা আসেনি, তাই ফিল করি না।”

“হয়তো এসেছে। আপনি বুঝতে পারছেন না। আর টাইপ করতে ইচ্ছে করছে না। শুভরাত্রি।”

বাইক চালিয়ে কেমন এক ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরল মল্লার। অধরা স্রোতের রোমাঞ্চে, হৃৎকম্পের জলরবে সে যেন ভেসে যাচ্ছে। ভাসতে ভাসতে কোনও এক তীরে পৌঁছে যাচ্ছে সে। তীরে হাত বাড়িয়ে রয়েছে এক জন, যেন বলছে, ‘এসো, পাশাপাশি বসে নদীর ছলছল শব্দ শুনি।’

মাঝেমধ্যে সুপ্রীতির কিছু টেস্ট করিয়ে রাখে অভ্র। বাবা বাষট্টি বছর বয়সে কার্ডিয়াক অ্যাটাকে চলে যাওয়ার পর সে মায়ের ব্যাপারে সাবধানী হতে শিখেছে। ব্লাড নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর দোতলায় গিয়ে ইসিজি রুমের সামনে তারা বসল। মিনিট কুড়ি অপেক্ষার পর সুপ্রীতির ডাক এল।

মিনিট পনেরো বাদে বেঞ্চ থেকে উঠে পায়চারি শুরু করল অভ্র। এখনও হল না? ইসিজি করতে তো বেশি ক্ষণ লাগে না। আজ এত সময় লাগছে কেন?

আরও কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পর দরজা ঠেলে সুপ্রীতিকে বেরিয়ে আসতে দেখল অভ্র।

“এত দেরি হল?”

সুপ্রীতির মুখে হাসি, “একটা কাণ্ড হয়েছে।”

“কাণ্ড!”

“কে ইসিজি করল জানিস? সুমি!”

“সুমি! সেটা আবার কে?”

সুপ্রীতি বললেন, “সুমিকে বোধহয় তোর মনে নেই। থাকবেই কী করে? গত আট বছর তো মামাবাড়ি যাসনি।”

“কোন মুখে যাব? শহরে সরাসরি কেউ কিছু বলে না। ওখানে গেলেই হেঁ-হেঁ করে হেসে জিজ্ঞেস করত সবাই— ‘তার পর ভাগ্নে, কী করছ এখন?’ গেলেই তো সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।”

সুপ্রীতি বললেন, “পাত্তা না দিলেই হল। যা বলছিলাম, সুমির বাড়ি ভালাইডিহাতে। কত্ত বড় হয়ে গেছে এখন!”

“আচ্ছা,” অভ্র বলল, “চিরকালই বাপের বাড়ির কাউকে দেখলে তোমার আহ্লাদের সীমা থাকে না। নিশ্চয়ই মেয়েটির সঙ্গে গালগল্প করছিলে!”

“না। ওই টুকটাক কথা হল। খোঁজখবর নিলাম। অশোকনগরে একটা মেসে থাকে এখন। বেশি দিন তো আসেনি এখানে। দিন দশেক হল এখানে জয়েন করেছে। ঠিকানা বললাম, ফোন নম্বর দিলাম। এক দিন বাড়িতে আসতে না বলাটা অভদ্রতা হয়। তাই বললাম যে, সময় করে একদিন বাড়িতে আয়।”

“বেশ করেছ।”

“মেয়েটা বড্ড ভাল।”

“হুম। তোমার কাছে তো বাপের বাড়ির ছাগলটাও ভাল।”

সুপ্রীতি ক্ষুণ্ণ হলেন, “তোর খালি ট্যারাবাঁকা কথা! এই বাজারে কাজ পেয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। এটা কম কথা!”

“মাইনে জিজ্ঞেস করেছ নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ। বলল যে, মাসে পনেরো হাজার দেবে।”

অভ্র বলল, “ও! ওই টাকা তো থাকা-খাওয়াতেই অর্ধেক চলে যাবে। শুধু কি থাকা-খাওয়া? আরও কত খরচা আছে! হাতে কিছুই থাকবে না।”

“বয়স কম, পরে উন্নতি করতে পারে।”

“ওর উন্নতি হবে না। ও মেয়ে আনপ্রফেশনাল,” অভ্র বলল।

“সে আবার কী কথা!”

অভ্র বলল, “পেশেন্টের সঙ্গে গালগল্প করাটা আনপ্রফেশনাল কাজ। এ দিকে বাইরে প্রচুর লোক অপেক্ষা করছে।”

সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে সুপ্রীতিকে নামাল অভ্র। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রিপোর্ট ডেসপ্যাচ সেকশনে জিজ্ঞেস করে যাবে। ক’টায় রিপোর্ট পাওয়া যাবে ওখানেই বলে দেয়। ডেস্কের সামনে যেতেই তার শরীর কাঁপল তিরতির। রুমকি দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কুর্তি আর নীল জিনসে রুমকিকে ভীষণ স্মার্ট দেখাচ্ছে।

চোখ সরিয়ে নিয়ে সে রিসেপশনের এক জনকে স্লিপটা বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, “কখন পাব সমস্ত টেস্টের রিপোর্ট?”

“বিকেল চারটেয়।”

রুমকির মুখে হাসি, “কার টেস্ট হল?”

“মায়ের।”

“কী হয়েছে মাসিমার?”

“তেমন কিছু নয়। বয়স হচ্ছে, প্রিকশন হিসেবে কিছু রুটিন টেস্ট করিয়ে রাখি।”

রুমকি জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কোথায়?”

অভ্র রোগীদের বসার জায়গায় দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই তো, ডান দিক থেকে তিন নম্বরে। ওখানে বসিয়ে এসেছি।”

রুমকি কাছে গিয়ে সুপ্রীতিকে ঢিপ করে প্রণাম করে, “ভাল আছ মাসিমা?”

সুপ্রীতি ম্লান হেসে বললেন, “ভাল আছি। তুই কেমন আছিস?”

“এক রকম চলে যাচ্ছে।”

একটা সময়ে তাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসত রুমকি। মায়ের সঙ্গে ভালই ভাব জমেছিল, সহপাঠিনী হওয়ার সূত্রে মা-কে সে অনায়াসে ‘তুমি’ বলত। রুমকি এলে মা খুশি হত। ভাবী বৌমা ভেবে নিয়েছিল হয়তো। ঘরের মেয়ের মতো ট্রিটমেন্ট পেত রুমকি।

অভ্র জিজ্ঞেস করে, “তুই কেন এখানে?”

“শাশুড়ির ইউএসজি রিপোর্ট নিতে এসেছিলাম। গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে। ডক্টরকে রিপোর্ট দেখাব আজ। মনে হচ্ছে মাইক্রোসার্জারি করাতে হবে। বুঝতেই পারছিস, ঝক্কিটা আমাকেই সামলাতে হবে।”

অভ্র বলল, “তা ঠিক। তুই এখন কর্তব্যপরায়ণ হাউসওয়াইফ। সময় মানুষকে কত বদলে দেয়!”

রুমকি ঠোঁট টিপে হাসে, “মেয়েদের বদলে যেতেই হয়। ওটাই সংসারের নিয়ম। ছেলেদের না বদলালেও চলে। যেমন তুই এত বছরেও বদলাসনি।”

“অনেক বদলে গিয়েছি। খালিচোখে দেখা যায় না, কাছে থাকলে বোঝা যায়,” অভ্র ম্লান হাসে, “আসছি রে এখন। বেলা বাড়ছে।”

বাইরে এসে একটা টোটো ডেকে মাকে নিয়ে উঠে পড়ল অভ্র।

সুপ্রীতি জানতে চান, “রুমকির ছেলে
না মেয়ে?”

“ছেলে। সাত বছর বয়স। তোমাকে বলেছিলাম আগে। ভুলে গেছ,” অভ্র কথা বাড়াতে চাইল না।

বার বার রুমকির সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাচ্ছে। এটা ভাল না মন্দ, সে বুঝে উঠতে পারছে না।

অভ্রর পুরনো ক্ষতটা আবার জেগে উঠেছে আজ। বিএড শেষ করে সে তখন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাশাপাশি ইউজিসি-র নেট পরীক্ষার জন্যও পড়াশোনা শুরু করেছিল। নিজের বিষয়ের উপর তখন বেশ আত্মবিশ্বাস ছিল তার। হঠাৎই বাবা রাতে ঘুমের মধ্যে কার্ডিয়াক অ্যাটাকে চলে গেল। দুঃসময় শুরু হল। ফ্যামিলি পেনশন হিসেবে মা তখন মাসে মাত্র তেরো হাজার পেত। ওই টাকায় সংসার চলত না। দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সে মরিয়া হয়ে কাজের খোঁজ করছিল। তখনই প্রমিতদার সূত্রে সে মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভের চাকরিটা পেয়ে গেল। চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি, নেটের জন্য পড়াশোনা, সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে গেল। চাকরিটাই দৌড়ঝাঁপের, রাতে ক্লান্তিতে ঢুলত, বইয়ে চোখ রাখার ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই হত না।

চাকরি করার সময়ে মাইনে সে মন্দ পেত না। তার পর হঠাৎ রাগের মাথায় গোলমালটা সে বাধিয়ে বসল। ডক্টর উপাধ্যায়কে অনেক উপঢৌকন দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। কিছুতেই তার কোম্পানির ওষুধ লিখছিলেন না। সে সে দিন চেম্বার ভিজ়িটের সময় বলেই ফেলেছিল, “আমাদের মেডিসিন আপনার প্রেসক্রিপশনে আসছে না কেন?”

“কী করে আসবে? তোমার কোম্পানিকে বলেছিলাম যে ব্যাঙ্কক ট্রিপ স্পনসর করতে। কিছুই তো করেনি।”

“আমার এতে কোনও হাত নেই। আমি সামান্য কর্মচারী। আপনি মেডিসিন না লিখলে কোপটা আমার ওপর পড়বে। ইয়ার-এন্ডিং সামনে, টার্গেট ফিল-আপ হবে না। প্লিজ়।”

“তোমার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। প্রফেশনাল লাইনে আমি কোনও সেন্টিমেন্ট রেখে চলি না।”

তার পরই বাদানুবাদ শুরু হয়েছিল। রেগেমেগে অভ্র টেবিলে পড়ে থাকা পেপারওয়েট হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে মেরেছিল। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ঘাড় সরিয়ে নিয়েছিলেন উপাধ্যায়, পিছনের দেয়াল-আলমারিতে ধাক্কা মেরে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল গোল কাচের ভারী পেপারওয়েটটা।

‘উচিত কাজ করেছে’, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বেশ করেছে’ এমন স্লোগান তুলে শুরুতে তার পাশে অনেকেই ছিল। কয়েক দিন পরেই তাকে নিয়ে উন্মাদনা থিতিয়ে এসেছিল। তাদের ইউনিয়ন অবশ্য ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য উপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিল। অত আইন ওই বয়সে কে আর বুঝত? তখনই জানল যে, পেপারওয়েট ছুড়ে মারাটা আইনের চোখে কতটা সাংঘাতিক হতে পারে। খুনের চেষ্টার মারাত্মক অভিযোগ আনা যেতেই পারত
তার বিরুদ্ধে।

আতঙ্কে সে একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। ইউনিয়নের নেতা অরুণাংশুদার মধ্যস্থতায় কাজ হয়েছিল শেষে। ডক্টর উপাধ্যায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল তাকে। কোম্পানি তাকে স্যাক করেছিল। অন্য কোম্পানির দরজাও তার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সে একশো ভাগ বেকার হয়ে পথে নামল। ঘটনাটার বয়স প্রায় সাড়ে চার বছর হয়ে গেল। যখন চাকরিটা গেল, তখন নেট পরীক্ষা দেওয়ার উদ্যম বা তাগিদ হারিয়ে গিয়েছে। স্কুল সার্ভিস পরীক্ষাও বন্ধ। বাধ্য হয়ে টিউশন করতে শুরু করল সে। প্রথম দিকে স্টুডেন্ট জুটত না, এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর সুবাদে হাতে সামান্য টাকা আসছে। আজকাল খুব আফসোস হয় তার। ধৈর্য ধরে করতে পারলে এত দিনে চাকরির বয়স সাত বছর হয়ে যেত, অভিজ্ঞতার সুবাদে আরও ভাল মাইনেয় অন্য কোম্পানিতে জয়েন করত। একই কোম্পানিতে থাকলে হয়তো প্রোমোশনও হয়ে যেত।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE