E-Paper

কুবের, বিলেস ও অন্যরা

ধীরে ধীরে উঠে বসতে বিতান এসির আওয়াজ ছাপিয়ে বাইরে বৃষ্টির শব্দও শুনতে পেল। শ্রাবণের একটানা, অঝোর বৃষ্টি।

সায়ন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:০৬
ছবি: বৈশালী সরকার।

ছবি: বৈশালী সরকার।

বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনোসময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওইগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো সঞ্চালিত হয়। একসময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে গ্রামে রেলস্টেশনে জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষ রাত্রে ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ।”

এয়ার কন্ডিশনারের হাওয়ায় ঘরে ঠান্ডাটা বেশি হয়ে গিয়েছে। আধখানা চোখ খুলে বিতান দেখল, ঘড়িতে সকাল ছ’টা। বাঁ পাশে ছোট্ট মিশুককে আঁকড়ে ধরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে আত্রেয়ী। ঘুমোক। শনিবারের সকালে এত তাড়াতাড়ি উঠে করবেই বা কী! রান্নার দিদি আসতে আসতে সেই ন’টা বেজে যাবে। আজ আবার বিতান থাকবে না সারা দিন, আত্রেয়ী একটু জিরিয়েই নিক।

ধীরে ধীরে উঠে বসতে বিতান এসির আওয়াজ ছাপিয়ে বাইরে বৃষ্টির শব্দও শুনতে পেল। শ্রাবণের একটানা, অঝোর বৃষ্টি। রাতেও যে দু’-এক বার ঘুম ভেঙেছে, বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেয়েছিল বিতান। সারা রাতই বৃষ্টি পড়েছে তা হলে! ট্রিপটা মাটি হয়ে যাবে না তো! বিবাহিত জীবনে শুধু বন্ধুরা মিলে ছুটি কাটাতে যাওয়া প্রায় হয়েই ওঠে না। অনেক কষ্ট করে সবার স্ত্রীদের ম্যানেজ করা গেছে। এক বার বাতিল হলে আবার হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। নাহ্‌, এ সব নেতিবাচক চিন্তা করাই যাবে না। ট্রিপ বলতে তো ডায়মন্ড হারবার, কোনও রকমে শিয়ালদহ পৌঁছে ট্রেন ধরলেই হল। ট্রেনে যাওয়া নিয়ে অবশ্য দু’-এক জনের খুঁতখুঁতানি ছিল, তবে আবার সেই কলেজজীবনের স্মৃতি— এই সব নস্টালজিক কারণ দেখিয়ে রাজি করানো গেছে তাদের। তাতে বিতান কিছুটা নিশ্চিন্ত। সামনে তার অনেকগুলো খরচ— নতুন ফ্ল্যাটের ইন্টিরিয়র, জানুয়ারিতে সস্ত্রীক বালি যাওয়া, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে পুরীর মন্দিরে পুজো দেওয়াতে নিয়ে যাওয়া আছে, এখন খুব বেহিসেবি খরচ করা যাবে না। সে তো আর বাকি বন্ধুদের মতো সোনার চামচ মুখে জন্মায়নি, সাবধানে থাকতে হয়।

দ্রুত জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে অ্যাপ-ক্যাব বুক করতে করতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল বিতান। শোবার ঘরের বাইরে এসি চলছে না। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে শহুরে কার্নিশ, ছাত, দেওয়ালের উপর শ্রাবণের নিরন্তর ঝরে পড়া। এই শব্দই অবচেতনে তাকে ঘুম থেকে ওঠার সময় ‘পদ্মানদীর মাঝি’ মনে পড়িয়ে দিয়েছে। বহু দিন আগে পড়া বই, তবু এখনও এ ভাবে মনে আছে বিতানের? এই বেড়াতে যাওয়ার জন্য কাল থেকে অফিস নিয়ে খুবই কম ভেবেছে বিতান, তাই কি পাতাগুলো আবার ভাঁজ খোলার সুযোগ পেয়েছে?

বাড়ির নীচে এসে দাঁড়িয়েছে সাদা গাড়িটা। গায়ে শিশিরের বিন্দুর মতো জমে আছে বৃষ্টির আদর। ওয়াইপার কাজ করে চলেছে শ্লথগতিতে। বিতান দ্রুতপায়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল।

বৃষ্টিভেজা কলকাতায় শনিবারের সকালে গাড়ি মসৃণ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনের সিটে বসে বিতান ভেজা কাচের টুকরো টুকরো জলের মধ্য দিয়ে দেখে যাচ্ছে পিছনে চলে যাওয়া ঘুমন্ত শোবার ঘর, সদ্য গরম চা কাপে নেওয়া বারান্দা, সবুজের ডালি নিয়ে সাজাতে বসা বিক্রেতা। হঠাৎই ড্রাইভার বারদুয়েক হেঁচে উঠল, কাশিও হল কয়েক বার।

বিতান একটু চিন্তিত হল, ঠান্ডা লেগে যাবে না তো? আজকাল শরীর খারাপ হলে আত্রেয়ী ভীষণ খিটখিটে হয়ে থাকে। ভয় পায়, বিতানের থেকে মিশুকের না ঠান্ডা লেগে যায়। মা হয়ে গেলে মেয়েরা নিজেদের স্ত্রী-সত্তাটা অনায়াসে পিছনে ঠেলে দিতে পারে।

ড্রাইভার আবার কাশল। বিতান এই প্রথম তার মুখের দিকে তাকাল ভাল করে। অল্পবয়সি ছেলে, খুব বেশি হলে বাইশ-তেইশ। চুল একটু উস্কোখুস্কো। পিছন থেকে দেখে যা বুঝল বিতান, ছেলেটির শরীরের অবস্থা এখন খুব ভাল নয়।

হঠাৎ জোরে একটা ব্রেক কষল ছেলেটা। সামনে দিয়ে একটি গাড়ি চলে গেল দ্রুতগতিতে। ছেলেটি স্বগতোক্তির মতো বলল, “হুট করে সামনে চলে এসেছিল, বুঝতেই পারলাম না।”

বিতান প্রমাদ গুনল। তবে ছেলেটিও যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। তার পর পকেট থেকে ফোনটা বার করে স্পিকারে দিয়ে কাকে যেন একটা ফোন করল।

ঘুম জড়ানো গলায় ও পাশথেকে ফোন ধরল কেউ। বলল, “কী রে, এত সকালে?”

ছেলেটি একটা অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল, “সকাল আবার কাল হবে গো সামাদদা। এই বৃষ্টি-ওয়েদারে তুমি কি বাড়িতে ঘুমোচ্ছ?”

ও পাশ থেকে নিরুত্তাপ কন্ঠে উত্তর এল, “কেন, তুই কোথায়?”

মেলায় প্রথম নাগরদোলা দেখে আসা কিশোরের মতো উত্তেজনায় ছেলেটি বলল, “আরে ফোন খুলে দেখো, বাজার পুরো আপ। উবার, ইনড্রাইভ দু’টোই যা দিচ্ছে— আমি তো কাল রাত থেকে বাড়ি ফিরিনি। মাঝে সাঁতরাগাছিতে দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, ব্যস।”

ও পাশের গলার স্বরে ঘুম-জড়ানো ভাবটা কেটে গেছে একদম। বলল, “বলিস কী? তা হলে তো—”

“তবে আর বলছি কী দাদা, নেমে পড়ো রাস্তায়। তোমার আবার নিজের গাড়ি, ঘরে বসে থাকলে কি লোন শোধ হবে? তোমাকে নিজের দাদা ভাবি তাই...”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, দেখছি,” বলে দ্রুত ফোন কেটে দিল সামাদ।

বিতান লক্ষ করল, ছেলেটির মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। যেন সে একটা ভাল কাজ করতে পেরেছে, এমন তৃপ্তি। তবে বিতানের ভয় হল, এর পরে ছেলেটা আবার না ঢুলে পড়ে, সারা রাত এমনিই ঘুমোয়নি বলছে।

বিতান দ্রুত জিজ্ঞাসা করল, “বাজার বুঝি খুব ভাল?”

ছেলেটা একগাল হেসে বলল, “হ্যাঁ দাদা, দারুণ। কাল রাতে ন’টা নাগাদ বেরিয়েছি। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার টাকার কাজ হয়ে গেল। মোটামুটি চার করে বাড়ি যাব।”

বিতান বলল, “চার হাজার এক দিনে?” মনে মনে একটা অঙ্ক শুরু করে ফেলল সে।

ছেলেটা বলল, “চার হাজার আমার একার তো নয় দাদা। মালিক আছে, তেলের খরচ আছে। আমি মোটামুটি থার্টি পার্সেন্ট পাবো। মানে ওই ধরো, মানে…”

বিতান বলল, “তেরোশো।”

ছেলেটা হাসল। বলল, “দেখি যদি, সন্ধ্যাবেলাও বৃষ্টিটা পড়ে…”

বিতান বলল, “গোটা শনি-রবিবারই তো বৃষ্টি হবে বলছে।”

ছেলেটা বলল, “তাই? আচ্ছা আচ্ছা। তা হলে তো…” বলতে বলতেই প্রচণ্ড জোরে হেঁচে ফেলল সে। একটু নাক টেনে বলল, “দাদা, এসিটা বন্ধ করে দিলে কিছু মনে করবেন? আসলে শরীরটা…”

বিতান সম্মতি দিল।

ছেলেটা যেন স্বগতোক্তির মতো বলে উঠল, “বৃষ্টি হলেই লাভ। শনি-রবি বৃষ্টি। আজ সন্ধ্যায় যদি...”

বিতানের মনে হল, ছেলেটা যেন পদ্মানদীর কুবের মাঝির মতো নৌকার খোলে মৃত সাদা ইলিশ মাছ ভরে উঠতে দেখছে।

ট্রেনে উঠে ডায়মন্ড হারবার পৌঁছতে অসুবিধে হল না। অসুবিধে হল না বুক করা রিসর্টে পৌঁছতেও। সারা ক্ষণই বৃষ্টি হয়ে চলেছে, মিঁয়া কি মল্লারের বিস্তার চলছে যেন। কখনও বিলম্বিত, কখনও দ্রুত লয়ে। হুগলি নদী এখানে সাগরের মতো প্রশস্ত— এ পার থেকে ও পার এই বৃষ্টির মধ্যে ভাল করে বুঝতে পারা যায় না।

বৃষ্টি ঘনিয়ে এল আরও। রিসর্টের হিসাব করে সাজানো বাগানের পামগাছেরা দুলতে শুরু করল এলোমেলো হয়ে। শালিকেরা ভিজে ভিজে কার্নিশে এসে আশ্রয় নিল। কিছুটা জোর করেই পুলে নেমেছিল বিতানরা, তবে বৃষ্টি আরও বেড়ে যাওয়ায় বেশি ক্ষণ থাকতে পারেনি। দু’-একটি যুগলকে পুলের মধ্যে অল্প অন্তরঙ্গ হতে দেখেছে সে। তবে তারাও শরীরে শরীর জড়িয়ে ভেজা তোয়ালেতে নিজেদের মুড়ে ঘরে ফিরে গেছে দ্রুত।

সারা দুপুর ঘরে বসে গাছের মাতাল নাচন দেখেছে বিতান। ডায়মন্ড হারবার গ্রাম নয়, তবুও বাংলার সবুজ প্রকৃতিতে একটানা বৃষ্টির শব্দ শুনতে থাকলে তার বিভূতিভূষণ মনে পড়ে যায়। মনে হয়, যেন এই সুসজ্জিত রিসর্ট আর আধুনিক চাকচিক্য ছাড়িয়ে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই হয়তো এখনও সেই ডোবা, সেই ঘর, সেই একাকী ব্যাঙের ডাক শোনা যাবে, বিদ্যাপতির সময় থেকে যে ব্যাঙ এমন দিনে নিজের সঙ্গীকে ডাকে— “মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী, ফাটি যাওত ছাতিয়া। ভরা বাদর মাহ ভাদর…” গুনগুন করে ওঠে বিতান।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামল। আটটা নাগাদ রিসর্টের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর এক সময় অসহ্য লাগায় বেরিয়ে এসে বিতানরা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ঝোড়ো হাওয়ায় রীতিমতো শিরশির করে উঠছে গা।

বিতানদের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। রিসেপশনে ফোন করে একটি ছেলেকে পাঠাতে বলা হল। কে যেন বলল, “এই বৃষ্টিতে আর কাকে ভিজতে পাঠাবি? ছেড়ে দে।”

কথার মধ্যেই যে ছেলেটি এসে দাঁড়াল, তার বয়স আঠারোর বেশি নয়। তার ইউনিফর্ম অত্যন্ত ঢোলা, বোঝাই যায় সে অন্য কারওটা পরে এসেছে। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল বিতানরা। তার পর যে মূলত ডাকতে উদ্যোগ করেছিল, সে-ই বলল, “বাবু, তুমি চলে যাও। আর একটু বড় কেউ আছে? তা হলে পাঠিয়ে দাও।”

ছেলেটি হতাশ হল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “না না স্যর, এক বার বলে দেখুন, আমি সব করতে পারি।”

“না মানে, এই বৃষ্টিতে…”

“দিন না স্যর। একটু টিপস দেবেন। একটু লাভের জন্যই তো...”

সিগারেটের দামের অতিরিক্ত একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল এক জন। ছেলেটি অনভ্যস্ত হাতে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে স্কুলের ছেলের মতো করিডর ধরে দৌড়তে গেল।

বিতান প্রশ্ন করে, “তুমি কি লেখাপড়া করো? ”

ছেলেটি বলল, “হ্যাঁ, স্কুলে... না না, কলেজে পড়ি।”

“তোমার মা-বাবা জানে, তুমি এখানে কাজ করতে এসেছ?”

“বাবা মাছ ধরে স্যর। ভীষণ বৃষ্টি বলে নদীতে যেতে দিচ্ছে না সরকার থেকে। বাবা তা-ও শুনছিল না। জোর করে নামতে যাচ্ছিল, নেহাত জ্বর বলে কোনও রকমে মা আর আমি মিলে আটকেছি। কিন্তু টাকাও তো লাগবে স্যর। তাই…”

অর্ধসমাপ্ত কথাটা দেওয়ালের হুকে ছাতার মতো ঝুলিয়ে রেখে বৃষ্টি-মাথায় বেরিয়ে গেল ছেলেটা।

বিতানের মনে পড়ে গেল, পদ্মানদীর কুবের মাঝিও জ্বর হলে নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিত। অসুস্থতার জন্য তার যতটা না রাগ, তার চেয়ে বেশি রাগ হত ভরা মরসুমে উপার্জন না করতে পারায়। সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’য় ছিল, “যে দৌলত তুমি দাও নি, আমার বাপ-পিতামোর কৌশল খাটিয়ে যাকে পাই, তার ওপরে তোমার খবরদারি। নির্যাতন করবে তুমি। কেন? না আমি মাছ মারি। তোমার শক্তি আরো বড়, তুমি আমাকে মারো। আমাকে যে মারে দিবানিশি, সেই মীনচক্ষু দেখিনে তোমার চোখে।”

যে ছেলেটির ট্যাক্সিতে বিতান সকালে এসেছিল, সেও হয়তো এখন অসুস্থ হয়ে নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিচ্ছে। অথবা গাবের আঠা হাজা হাতে লাগিয়ে যেমন করে মাছ ধরতে নামত ‘গঙ্গা’র জেলে তেঁতলে বিলেস, তেমন করে হয়তো প্যারাসিটামলে জ্বর চাপা দিয়ে স্টিয়ারিং ধরেছে কাঁপা হাতে। যুগ যুগ ধরে সব গরিব মানুষ এ ভাবেই বর্ষায় শরীর বাজি রেখে সারা বছরের রসদ জমিয়ে নিতে চায়। তবু হাঁড়িতে চাল বাড়ন্ত হয়, অনাহারের ক্লেশ লেগে থাকে সন্তানের মুখে। তবু আঠারোয় পা না-দেওয়া কৈশোর নিজের থেকে অনেক বড় মাপের জামায় নিজেকে গলিয়ে দিতে বাধ্য হয়— যুগ যুগ ধরে।

বিতানের ফোন বেজে উঠল, আত্রেয়ী। মিশুকের শরীর খারাপ। ঠান্ডা লেগেছে, জ্বর হয়েছে, খুব কাশছে। আত্রেয়ী একা বাড়িতে, একটু উতলা হয়ে পড়েছে।

বিতান বলল, “দাঁড়াও, ডাক্তার চ্যাটার্জিকে ফোন করি। আজ বসেছে কি না, দেখি। ওখানে বৃষ্টি কেমন?”

আত্রেয়ী বলল, “ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ি নিয়ে বেরোতে হবে, সে করে নেব।”

বিতান ডাক্তার চ্যাটার্জিকে ফোন করল। অনেক দিনের চেনা ডাক্তার, এবং ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ। উনি বর্তমান যুগের সেই বিরল কয়েক জন ডাক্তারের এক জন, যাঁকে দেখলেই রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে।

“গুড ইভনিং, ডক্টর চ্যাটার্জি। আপনি কি এখনও চেম্বারে আছেন? আসলে মিশুকের একটু...”

“আছি। এখনও টিকে আছি, সারা কলকাতার বাচ্চা নাকে সর্দি আর গায়ে জ্বর নিয়ে চেম্বারে লাইন দিয়েছে। এখনও বন্ধ করতে পারিনি চেম্বার। আজ বোধহয় এগারোটা অবধি রোগী দেখতে হবে। পাঠিয়ে দাও মিশুককে।”

বিতান বলল, “এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার তো তা হলে খুব প্রেশার যাচ্ছে আজকে।”

নাকটা সামান্য টেনে ডাক্তার চ্যাটার্জি যখন এর পর কথা বললেন, তখন প্রথম বার বিতান খেয়াল করল, ওঁর গলাটাও যেন একটু বসা-বসা।

“চাপ তো বটেই। তবে কত ক্ষণ টানতে পারব জানি না। চার দিকের সাড়ে পাঁচ লাখ ভাইরাস আমাকে ছেঁকে ধরেছে তো। তবে কি না, বোঝোই তো, মওকা এই। ইলিশের মার্কেট থাকতে থাকতে বেচতে হবে তো!” নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা করে হেসে উঠলেন ডাক্তার।

বিতান ফোন রাখল। ডাক্তার ইয়ার্কি করে কথাটা বললেন ঠিকই, কিন্তু কথাটা কি একটুও ভুল? আসলে তারা কি সবাই বিলেস, কুবেরের সঙ্গে একই সুতোয় বাঁধা। যুগ যুগ ধরে, রোদ-জল পেরিয়ে, হাড়-কাটা উত্তুরে বাতাস পেরিয়ে তারা সবাই আসলে একই উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে চলছে।

“আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে...” এই লাইনটাই কি যুগ যুগ ধরে সব বিতান, সব ডাক্তার চ্যাটার্জি, সব কুবের আর সব বিলেসের মনের কথা নয়?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Short Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy