E-Paper

নির্মলা

ফুলশয্যার রাতে নির্মলার স্বামী ধীরপায়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। তার পর শিশি থেকে দু’হাতে আলতা ঢেলে নিয়ে নির্মলার গালে আলতা মাখিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোমার মুখে একটু পাউডার মাখিয়ে দিলাম গো নতুন বৌ। তোমার বাবা বিয়েতে আসেনি কেন? অ্যাঁ? আজব লোক মাইরি!”

অরুণাভ দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০৮:২৪
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

নির্মলার চতুর্দিকে শুধু লক্ষ লক্ষ নরনারীর মুখ। যত দূরেই তাকানো যায়, শুধুই গিজগিজ করছে মানুষ। শুনশান মাঝসমুদ্রে হারিয়ে গেলে যেমন দিশাহারা অবস্থা হয়, রথের সময় পুরীর কোলাহলমুখর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়ে নির্মলার অবস্থা ঠিক তা-ই। নির্মলার চার পাশে বাংলা, হিন্দি, গুজরাতি, মরাঠি, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি নানা ভাষা মিলেমিশে এক অদ্ভুত ভাষা-কলরবের সৃষ্টি হয়েছে। তারই মধ্যে বাজছে শয়ে শয়ে কাঁসর।শোনা যাচ্ছে পুলিশের হুইসলের পিঁ-পিঁ শব্দ। চার পাশ থেকে মানুষ তাকে ঠেলছে। অদূরে জগন্নাথের সুউচ্চ প্রাচীন দেউলের চূড়ায় উড়ছে ধ্বজা। মন্দির থেকে একটু দূরে রংবেরঙের কাপড়ে সুসজ্জিত তিনটি রথ স্থির হয়ে আছে।কিন্তু নির্মলার উদ্দেশ্য অন্য।সে খুঁজছে রাস্তা; এগোনোর, কিংবা পিছোনোর।

কোন দিকে যাবে সে! ঠিক করা নেই কিছু, তবে ফিরে আর যাবে না।

জগন্নাথের মন্দিরের কাছেই কাশীনাথ পান্ডার বাড়ি। একটু আগে নির্মলা ওই বাড়ির ছাদ থেকে রথযাত্রা দেখছিল। সঙ্গে ছিল তার দাদা, ভাই, তাদের স্ত্রী-রা আর ছেলেমেয়েরা। ঘটনাক্রমে নির্মলা তাদের উপর রাগ করে ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছে। তার উদ্দেশ্য ছিল হোটেলে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু ভিড়ভাট্টায় সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। আতান্তরে পড়ে এখন তার মনে হচ্ছে, আবার কাশীনাথের বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু সেই সঙ্গে তার আশঙ্কাও হচ্ছে যে, হয়তো সে ফিরে গেলে সবাই তাকে নিয়ে হাসবে আর বলবে, ‘খুব যে তখন রাগ করে বেরিয়ে গেলে! সেই তো আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হল!’

তাদের কাছে ফেরার চেয়ে হারিয়ে যাওয়াই নির্মলার কাছে সুখের। কিন্তু জনারণ্যে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে যে, চাইলেও হারিয়ে যাওয়ার সাহস তার মধ্যে নেই। নির্মলা দেখতে পায়, একটি ছোট মেয়ে বাবার কাঁধে চড়ে রথ দেখছে, এক মা তার শিশুপুত্রকে বুকে আগলে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার পাশেই এক বৃদ্ধা মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে তার জোয়ান ছেলে। বিবাহিত মহিলারা তাদের স্বামীর হাত ধরে আছে। নির্মলার বুকের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করছে। তার মনে হয়, এই লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে সকলেরই সহায়-সম্বল আছে, শুধু সে-ই একেবারে নিঃস্ব। নিজের বলতে এক মাত্র তারই কেউ নেই।

যৌবনে নির্মলা ভারী সুশ্রী ছিল। সেই সময় এক অবস্থাপন্ন পরিবারের তরফে তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। তখন নির্মলাদের অভাবের সংসার। বাবা অকালমৃত। ছোট ভাই সুমিত তখনও ছাত্র। একমাত্র দাদা অমিতের উপরই নির্ভরশীল গোটা পরিবার।

পাত্রপক্ষের দাবি-দাওয়া কিছুই ছিল না। তবে পাত্রটি কেমন জড়বস্তু গোছের। দেখতে-শুনতে চলনসই, স্বভাবে নিতান্তই অবোলা, দু’চোখে ফ্যালফেলে দৃষ্টি। তাতে নির্মলার মা, দাদার বিশেষ আপত্তি ছিল না। বিয়ের আগে খুব কাছ থেকে হবু স্বামীকে চেনার সুযোগ নির্মলার হয়নি। বাড়ির লোকজনও বিশেষ খোঁজখবর করেননি। কে জানে, হয়তো ঘাড় থেকে কন্যাদায় নামানোটাই তখন মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছিল। তাই আর অনুসন্ধানের দরকার মনে করেননি। শান্তশিষ্ট, ভালমানুষ, গোবেচারা, বোকাসোকা— এইটুকুই তো! তাতে আর অসুবিধে কী!

ফুলশয্যার রাতে নির্মলা যখন তার শ্বশুরবাড়ির ঘরের বিছানায় দুরুদুরু বক্ষে স্বামীর প্রতীক্ষা করছে, তখন তার স্বামী ধীরপায়ে নির্মলার সামনে এসে দাঁড়াল। তার পর এক গাল হেসে শিশি থেকে হাতে আলতা ঢেলে নিয়ে নির্মলার গালে আলতা মাখিয়ে দিতে দিতে বলল, “তোমার মুখে একটু পাউডার মাখিয়ে দিলাম গো নতুন বৌ। তোমার বাবা বিয়েতে আসেনি কেন? অ্যাঁ? আজব লোক মাইরি!”

সে দিন সারা রাত ধরে নির্মলা আলতালিপ্ত মুখে রজনীগন্ধার তীব্র সুবাসের মধ্যে হতবাক হয়ে বসে ছিল। আর তার স্বামী এক মাথা মাখামাখি করে সিঁদুর পরে, বৈশাখের গুমোট গরমে সোয়েটার গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। শোয়ার আগে মাথায় সিঁদুর মাখতে মাখতে আপন মনে বলছিল, “সারা দিন যা ধকল গেছে, একটু তেল না মাখলে মাথা ঠান্ডাই হবে না! সারা রাত ঘুম আসবেই না!...”

পরদিন সকালেই চিরদিনের মতো শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসে নির্মলা। তার স্বপ্ন দেখার সেখানেই ইতি।

নির্মলার মনে আছে, এক দিন দুপুরে সে সুমিতের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে শুনছিল, ঘরের ভিতরে তার দুই ভাজ, নবনীতা আর অদিতি নির্মলার ফুলশয্যার গল্প করতে করতে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে। তাদের দু’জনের হাসির দমক নির্মলার বুকে যেন শেলের মতো বিঁধে যাচ্ছিল। সে দিন প্রথম বার নির্মলা ভেবেছিল, কে জানে, বদ্ধ পাগলটা এখনও বেঁচে আছে কি না!

মা মারা গিয়েছে বহুকাল। এখন সে অমিত, সুমিতদের সঙ্গেই থাকে। অষ্টপ্রহর সে ভাইদের সংসারে পরজীবীর মতো বেঁচে থাকার লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে। কারণ সে নিজের খাওয়া-পরার খরচ জোগাতে অপারগ; পরিবর্তে উদয়াস্ত গায়েগতরে খেটে দেয়। এখানে তাকে থাকতে গেলে এমনটা করা যে বাধ্যতামূলক, তা নির্মলার ভাই, ভাজদের হাবেভাবে প্রকাশ পায় না। কিন্তু নির্মলার আশঙ্কা, পেতে কত ক্ষণ!

সকলের জন্য রান্নাবান্না, টুবলু আর তুলির জন্য স্কুলের টিফিন তৈরি, তাদের গৃহশিক্ষকের চা-জলখাবার তৈরি, ঠাকুরঘরের জোগাড়— সবই সে করে। কারও বারণ শোনে না। অমিতের ছেলে টুবলু আর সুমিতের মেয়ে তুলি নির্মলাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু নির্মলার বিশ্বাস যে, সে এই সংসারে এক জন আশ্রিতা মাত্র। কেউ তার আপন নয়। সে সকলের কাছে উপেক্ষার পাত্র।

খেতে বসে ভাতের গ্রাস তার গলায় কাঁটার মতো বেঁধে, কারও প্রণাম নিতে সঙ্কোচ হয়, হঠাৎ কারও ভালবাসা পেলে সন্দেহে মনটা আড় হয়ে ওঠে। আর পুজোর তিন মাস আগে থাকতেই নির্মলা রাত দিন অমিত, সুমিতকে শোনায়, “আমার মাথার দিব্যি, পুজোয় আমাকে কিচ্ছু দিস না!”

আবার অপ্রাপ্তিতেও তার ক্ষোভ, অভিমানের শেষ থাকে না।

রথযাত্রার মাসখানেক আগে এক সহকর্মীর কাছ থেকে কাশীনাথ পান্ডার কথা জেনেছিল সুমিত। কাশীনাথ প্রতি বছর কিছু অর্থের বিনিময়ে তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে দর্শনার্থীদের আরামে রথযাত্রা দেখার ব্যবস্থা করেন। ঠিক হল, এ বার রথের সময় সবাই মিলে পুরী যাওয়া হবে। সুমিত বলল, “দিদি, তুইও যাবি আমাদের সঙ্গে।”

শুনেই নির্মলার বুক দুরদুর করে উঠল, সে বলল, “সে তো অনেক খরচ!”

“তোর চিন্তা কী?”

সুমিত দিদিকে ভরসা দিতে চাইল, কিন্তু নির্মলার কানে কথাটা বাজল বক্রোক্তির সুরে। সে ভাবতে লাগল, আসলে তাকে নিয়েই তো ভাইদের যত চিন্তা। সে যাওয়া মানে তাদের খরচ আর অশান্তি, দুই-ই বাড়ানো। নির্মলা বলল, “আমি যাব না।”

“কিন্তু তোর টিকিট কাটা হয়ে গেছে।”

“ক্যানসেল করে দে।”

সে দিন আর কেউ কোনও কথা বাড়ায়নি। পরদিন সুমিত অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর অদিতি নির্মলাকে অনুযোগের সুরে বলেছিল, “সে তোমাকে আনন্দ করে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলল, আর তুমি সটান মুখের ওপর না বলে দিলে!”

জবাবে নির্মলা কিছু বলেনি। সে ভেবেছিল, সত্যিই হয়তো তার ভাইয়েরা ভালবেসেই তাকে নিয়ে যেতে চাইছে। হয়তো এখনও তাদের মনে নির্মলার প্রতি এক বিন্দু ভালবাসা বেঁচে আছে। তাই সুমিত অফিস থেকে ফিরে এলে নির্মলা তাকে বলেছিল, “আমি যাব।”

কিন্তু যাত্রার কয়েক দিন আগে নির্মলার এ ধারণা বদলে গেল। এক দিন বিকেলে নির্মলা ছাদে ওঠার সময় শুনতে পেল, ছাদে নবনীতা আর অদিতির মধ্যে কথা হচ্ছে—

“যেতে রাজি না হলে সমস্যা বাড়ত। প্রায় এক সপ্তাহ আমরা বাড়িতে থাকছি না। একা বাড়িতে থাকবে। হঠাৎ করে শরীর-টরীর খারাপ হলে তখন পাড়ার লোকেরাই বলতে ছাড়বে না যে, অসহায় একটা মহিলাকে একলা রেখে দিয়ে ভাই, ভাইয়ের বৌয়েরা বাইরে ফুর্তি করতে গেছে!”

আড়ালে দাঁড়িয়ে এটুকু শুনেই পা টিপে টিপে নেমে এল নির্মলা। ঠিক তার পরেই অদিতি প্রত্যুত্তর দিল, “এই সুবাদে দিদিভাইয়ের বেড়ানোও হবে, মানুষটা তো কখনও কোথাও যায় না।”

“তা যা বলেছিস।”

কিন্তু কথোপকথনের এই অংশটুকু আর শোনা হল না নির্মলার।

ছাদ থেকে নেমে এসে ঘরে গুম হয়ে বসে থাকে নির্মলা। ভালবেসে নয়, বরং বাধ্য হয়েই ভাইয়েরা তাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, এটা ভাবার পর নির্মলার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এ কথাটা তাদের কানে গেলেই একটা অশান্তি বাধবে। নির্মলার এই ভেবে আফসোস হয় যে, হয়তো শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে না এলেই ভাল হত। হোক না পাগল, তবুও তো স্বামী! নিজের সংসার! সেখানেই কোনও ভাবে জীবনটা কেটে যেত। যন্ত্রণা হত, কিন্তু এতটা দুঃসহ হত না বোধ হয়।

রথের জন্য পুরীতে কী ভীষণ ভিড়! সমুদ্রের তীরে জনসমুদ্র। রাস্তাঘাটে পা রাখা দায়। সমস্ত হোটেল, হলিডে হোম বুকড। দিনে-রাতে রেস্তরাঁগুলোয় ক্ষুধার্ত ও অধৈর্য মানুষদের হট্টগোল, মিষ্টির দোকানগুলোয় ময়রারা দিবারাত্রি কাঁড়ি কাঁড়ি খাজা ভাজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। রথের আগে পুরীর এই ব্যস্ততাও উপভোগ্য। কিন্তু নির্মলার সে সব কিছুই ভাল লাগছে না। সমুদ্রস্নানেও তার অনীহা। সে শুধু বাড়ি ফেরার দিন গুনছে। স্বর্গদ্বারের কাছেই একটা হোটেলে তিনটে ঘর পাওয়া গিয়েছে। নিজের ঘরখানা দেখেই নির্মলার মনে হয় যে, সবচেয়ে ছোট আর বিশ্রী ঘরটাই তাকে দেওয়া হয়েছে। সেই অভিমানে নির্মলা কারও সঙ্গে কথা বলে না। মনের কষ্টে গুমরে গুমরে থাকে।

রথের দিন সকাল থেকেই জগন্নাথ মন্দিরের সামনে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছিল। বেলা বাড়তেই দলে দলে পুণ্যার্থীরা এসে ভিড় করতে লাগল। রথের সামনে রাস্তায় সুন্দর আলপনা দেওয়া হয়েছে। নর্তক-নর্তকীরা মনোহর বেশে নৃত্য করছে। বহুরূপীরা নানা দেবদেবী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন রথের কাছাকাছি ভক্তসাধারণের যাওয়া বারণ। সেবায়েতরা বলরাম, সুভদ্রাকে মন্দির থেকে বার করে এনে সুসজ্জিত রথে তুলেছেন। এ বার জগন্নাথ আসবেন। জগন্নাথ মন্দিরের কাছে কাশীনাথ পান্ডার পুরনো বাড়ির ছাদ থেকে সমস্তটা ভাল দেখা যাচ্ছে। বাড়ির ছাদে নির্মলারা ছাড়াও আরও দুই অবাঙালি দম্পতি রয়েছে।

টুবলু, তুলি তো সব দেখেশুনে অবাক। আসল সমুদ্রের চেয়ে মানুষের সমুদ্র তাদের কাছে বেশি উপভোগ্য লাগছে। সকালের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। এখন আকাশে কড়া রোদ। অদিতি মোবাইলে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। সুমিত তার মাথায় ছাতা ধরে আছে। নবনীতা ফোনে তার বান্ধবীর সঙ্গে গল্পে মশগুল। অমিত প্যাকেট খুলে চিপস খাচ্ছে। রোদ লেগে নির্মলার মাথা ধরেছে। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বসে আছে। বৌয়ের মাথায় সুমিতের ছাতা ধরা দেখে সে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে আর দু’হাত দিয়ে কপালের রগ টিপছে। তার কাছে ব্যাপারটা অসহ্য আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।

অমিত তাকে বলল, “ছায়ার দিকটায় গিয়ে বোস না।”

“না, ঠিক আছে।”

“এমন গম্ভীর হয়ে আছিস কেন?”

“ভাল লাগছে না। তোরা কখন ফিরবি?”

“এখনও রথের চাকা গড়াল না, আর তুই যাব-যাব শুরু করে দিলি!”

নির্মলা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আমি তো সে জন্যই হোটেলে থাকতে চেয়েছিলাম। তোরাই জোর করে নিয়ে এলি।”

নবনীতা ফোনালাপ থামিয়ে বলল, “সে কী! রথের দিনে পুরীতে এসে হোটেলে বন্দি হয়ে বসে থাকবে! একটু আনন্দ করবে না!”

“আমার আবার আনন্দ!” বিদ্রুপ, হতাশা নির্মলার হাসিতে মাখামাখি। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

টুবলু তার শাড়ির আঁচলে টান দিয়ে বলে, “ও পিসি, কী হল তোমার? চিপস খাবে?”

“তুই খেগে যা!” নির্মলার তিরিক্ষি মেজাজ দেখে টুবলু সভয়ে পিছিয়ে আসে।

নবনীতা অনুযোগের গলায় বলে, “বাচ্চাদের সঙ্গে কেউ ও ভাবে কথা বলে?”

“হ্যাঁ, আমি বলি! কারণ আমি খুব খারাপ!”

আর ধৈর্য রাখতে পারে না অমিত, রাগে ফুঁসে ওঠে, “সে তো তুই নিজের দোষেই নিজেকে খারাপ প্রমাণ করিস।”

নির্মলার মেজাজ চরমে ওঠে, “তাই তো! ওই পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটাকে শেষ করে দিলি তোরা! আর এখন আমাকে দুষছিস!”

নির্মলার চিৎকার শুনে উপস্থিত অবাঙালি দর্শনার্থীরা ফ্যালফ্যাল করে তাকে দেখছে।

অদিতি বলে, “ছি! ছি! এখানে টুবাই, তুলি রয়েছে, বাইরের লোকজন বসে আছে, কেন অযথা বাড়াবাড়ি করছ দিদিভাই!”

ক্ষোভে, অভিমানে রক্তটা ফুটে ওঠে নির্মলার। সে হনহন করে ছাদ থেকে নেমে আসে নীচে। তার পর হোটেলে ফেরার জন্য এক ছুটে বাড়ির বাইরে পা রেখেই জনসমুদ্রে হারিয়ে যায়।

হারিয়ে যাওয়ার পর নির্মলা বুঝতে পারে, খুব আতান্তরে পড়ে গেছে সে। শুধুই ভাবছে, সে কি এগিয়ে যাবে অনিশ্চিতের পথে, নাকি আবার ফিরে যাবে পরাশ্রয়ে অপমান সহ্য করতে? এই মুহূর্তে তারা কি নির্মলার জন্য চিন্তিত? নাকি আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত?

আকাশ আবার মেঘলা করেছে। হঠাৎ নির্মলা লক্ষ করে যে, চার পাশে হঠাৎ মানুষের ব্যস্ততা আর ঠেলাঠেলি বেড়ে উঠল। কাঁসর-সহ বাজনাবাদ্যির আওয়াজও যেন আচমকাই উচ্চগ্রামে। কী যেন দেখার আগ্রহে সকলে অধীর।

ঠেলাঠেলিতে নির্মলা ক্রমশ মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর দেখছে কৃষ্ণবর্ণ এক বিগ্রহ বিদ্যুৎঝলকের মতো ভিড়ের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে। হঠাৎ সে বিগ্রহ নির্মলার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহে শিহরন জাগে!

নির্মলা সবিস্ময়ে দেখে, ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বড় বড় গোলাকার দু’টি চোখ অপলক দৃষ্টিতে নির্মলাকে লক্ষ করছে। দুটি বিস্ফারিত নয়ন; চোখ দু’টি রং-তুলি দিয়ে আঁকা হলেও যেন জীবন্ত! দৃষ্টিতে যেন উপচে পড়ছে আনন্দ আর বিস্ময়। সেই দু’টি চোখের সঙ্গে সকলের চোখাচোখি হতেই চার দিকে এক ভীষণ কোলাহল উঠল। দূরে সমুদ্র, ক্ষণে ক্ষণে সে গর্জন করছে, সেই গর্জনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে মন্দিরের সামনে বহমান জনসমুদ্র থেকে উত্থিত গর্জন—“জয় জগন্নাথ! জয় জগন্নাথ মহাপ্রভু কী...” অনেকে সুর করে গাইছেন, “জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে...”

জগতের প্রভু মন্দির ছেড়ে পথে নেমেছেন। তাঁকে একটি বার চাক্ষুষ করার জন্য অসংখ্য প্রতীক্ষারত মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। জগন্নাথের বিগ্রহ পান্ডাদের কাঁধে ভর দিয়ে জনসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ধীরে ধীরে রথের দিকে চলেছেন। তাঁর মাথার সুন্দর চালচিত্রের মতো ছড়ানো ফুলের মুকুট তাঁর চলার তালে তালে অগ্রে-পশ্চাতে এমন ভাবে দুলছে, যেন ময়ূর পেখম মেলে নাচ ধরেছে।

নির্মলা অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ করে, এক দিকে স্বয়ং ভগবান মানুষের উপর ভর দিয়ে চলেছেন, অন্য দিকে শয়ে শয়ে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে ভগবানের উপর সমস্ত দায়ভার অর্পণ করতে। চোখের সামনে যেন ভার দেওয়া-নেওয়ার এক আশ্চর্য খেলা চলছে। নির্মলা এক ঝলক জগন্নাথকে দেখতে পায়, পরক্ষণেই তিনি মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হন, কয়েক মুহূর্ত পরে আবার তাঁকে দেখা যায় মানবমিছিল থেকে বেরিয়ে আসতে। লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাঁর মুখে খেলছে এক অপূর্ব হাসি। যেন মেঘলা দিনে বার বার লুকিয়ে পড়ছে রোদ, আর মাঝে মাঝে যখন মেঘ সরে যাচ্ছে, আলোয় আলোকময় হয়ে যাচ্ছে চরাচর।

সে হাসির প্রতিফলন দেখা যায় নির্মলার মুখেও। তার দু’চোখ জলে ভেজা।

নির্মলার সামনে দাঁড়ানো মহিলাটিও ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্বামীর অসহায় দৃষ্টি জগন্নাথের উপর নিবদ্ধ। শুধু তাঁরাই নয়, নির্মলার চার পাশে লক্ষ মানুষের দু’চোখেও দুঃখ-যন্ত্রণার অশ্রু, মুখে কষ্টমোচনের করুণ আর্তি। দেবতাকে চোখের সামনে দেখে কারও চোখের জল যেন আর বাধা মানছে না। উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে সকলের অন্তঃকরণ। ধুয়ে যাচ্ছে ক্লেদ, মালিন্য, ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা।

নির্মলা অনুভব করে, যেন তারই মুখের ছায়া চতুর্দিকের লক্ষ মুখে পড়েছে। সকলেই যেন সহায়-সম্বলহীন, সকলেই নিঃসঙ্গ, তিনি ছাড়া কারও কেউ নেই। আর রথের দিকে ধাবমান জগন্নাথের সম্মুখে প্রসারিত দু’টি হাত দেখে নির্মলার মনে হয়, যেন লক্ষ হৃদয়ের ভার বহন করে তিনি চলেছেন। সংসারে কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের কথা আর মনে পড়ে না নির্মলার।

মনের মেঘ কেটে যায়। এক অদ্ভুত আনন্দ জড়িয়ে ধরে নির্মলাকে। তার নিঃসঙ্গ ভাবটা কেটে গিয়েছে হঠাৎ।

শত শত কাঁসরের নিনাদ আর খোল-করতালের ঝমঝমে কোলাহলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মাইকের একটি ঘোষণা— “কলকাতা থেকে এসেছেন নির্মলা বিশ্বাস, আপনি হেল্প সেন্টারে যোগাযোগ করুন। আপনার পরিবারের সকলে এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Short Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy