ছোটবেলার সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটাই সত্যি হতে চলেছে বোধহয়। লোকজন জুতো ছুড়ছে। মাথার উপর দিয়ে, পাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুতো। ছেলেদের, মেয়েদের, হিল-ছাড়া, পেনসিল হিল, ফ্যান্সি, বুড়োটে— সব ধরনের জুতো। আতঙ্কে শ্রেয়ার হাত চেপে ধরে দ্রুতবেগে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করে ধৃতিমান। দু’বার হোঁচটও খায়। আর মুশকিলের কথা হল, আশপাশে নিরাপদ কোনও জায়গা চোখেও পড়ে না ওর।
প্রথমে ছোটবেলার দুঃস্বপ্নটার গল্প শুনিয়ে রাখি। ধৃতিমান মোলাস্কা পর্বের মানুষ এবং ম্যান্টল যুক্ত। ঝিনুক কিংবা শামুকের মতো খোলের মধ্যে থাকতে ভালবাসে। পরীক্ষায় চিরকাল রিটেনে নব্বইতে নব্বই পেলেও ওরালে দশে শূন্য পেয়েছে। ছোটবেলা থেকেই এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। ধৃতিমানের বাবা-মা অনেক ভাবে ছেলেকে স্মার্ট করার চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য বাবা-মা যখন বাচ্চাদের পড়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন, তখন ধৃতিমানের বাবা-মা জোর করে সম্বরণ ব্যানার্জির ক্রিকেট কোচিংয়ে ছেলেকে ভর্তি করাচ্ছেন। বাকি ছেলেরা যখন স্কুল পালিয়ে সিনেমা বা ক্রিকেট মাঠে, ধৃতিমান তখন ক্রিকেট মাঠ থেকে লুকিয়ে ফিরে পড়ার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
খুব ছোটবেলায় পাড়ার আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জোর করেই ছেলের নাম দিয়েছিলেন মা। রবীন্দ্রনাথের খুব ছোট একটা কবিতা— বর এসেছে বীরের ছাঁদে। ধৃতিমান গুটগুট করে স্টেজে উঠেছিল, শেখানো আদবকায়দা অনুযায়ী নমস্কারও করেছিল। তার পর ‘বর এসেছে’ বলা পর্যন্তও তেমন সমস্যা হয়নি। গোল বাধল তার পরই।
‘বর এসেছে’ বলার পরই ছোট্ট ধৃতিমান সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, প্রচুর লোক বসে আছে। এবং সবাই ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যে কবিতাটা ওর মধ্যে থেকে মাথা তুলে সবে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, তা আবার উল্টোবাগে দৌড়ে ওর ভিতরেই সেঁধিয়ে যায়। ‘বর এসেছে’ এই তথ্যটুকু দেওয়ার পর ওর আর কিছু মনে আসে না। সে বোবার মতো ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে দর্শককের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছিল, ওকে কেন স্টেজে তোলা হয়েছে। উদ্যোক্তারা ধরে-টরে ওকে স্টেজ থেকে নামায়।
পরে বাবা মজা করে মাকে বলেছিলেন যে, বর আসার পর যা-কিছু করণীয়, তা তো কন্যাপক্ষের! সেখানে ধৃতিমানের তো কিছু করার নেই। মা রেগে গিয়ে বলেছিলেন যে, দর্শকাসন থেকে লোকজন পচা ডিম আর জুতো ছোড়েনি, এই নাকি যথেষ্ট।
এর পর থেকে ধৃতিমান প্রায়ই স্বপ্ন দেখত যে, ও স্টেজে উঠে কিছু করছে আর দর্শকরা খেপে গিয়ে ওর দিকে জুতো ছুড়ছে। খেপে গিয়ে নিক্ষেপ করা জুতোর রাশি এক-একটি ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই চার দিক দিয়ে, গা ঘেঁষে, কান ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে।
‘স্কুল-পালানো’ ছেলেপুলে হয় আমরা জানি। কিন্তু ধৃতিমান ‘মাঠ-পালানো’ ছেলে। এমন ছেলে হওয়ার কিছু অ্যাডভান্টেজ আছে। যে হেতু বাইরের দুনিয়ায় ধৃতিমান কোনও দিনই অতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি, ও ওর যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেয়েছিল ঘরের কোণে, পড়ার বইয়ে, লেখাপড়ার রাজ্যে। ভীষণ ভাল রেজ়াল্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে এবং ক্যাম্পাসিংয়ে বেশ ঈর্ষণীয় ধরনের চাকরিও জুটিয়ে নিতে ওর অসুবিধে হয়নি। ওর চাকরিতে এই ‘খুব ভাল’ ধরনের রেজ়াল্টের সুবিধে ছিল, কাজের বেশিটাই ছিল টেবলওয়ার্ক, আর পোস্টিং পেয়েছিল কলকাতাতেই। ছেলে এমন একটি চাকরি পেলে যা হয়, সব বাবা-মা’ই একটি লাল টুকটুকে, ঘর আলো করা পুত্রবধূর সন্ধানে নেমে পড়েন। ধৃতিমানের ক্ষেত্রেও এই অলিখিত নিয়মের ব্যতিক্রম হল না।
চাকরির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা-মা সমস্ত বড় খবরের কাগজ, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। বঙ্গদেশে সুলক্ষণা পাত্রীর অভাব নেই। অন্তত ধৃতিমানের মতো ছেলেদের জন্য তো নেই-ই। সুতরাং ডাক বিভাগের রোজগার আর বাড়িতে চিঠির জঞ্জাল দুই-ই বাড়ল। অনলাইন প্রোফাইলের রিকোয়েস্ট বক্সগুলোও উপচে পড়তে লাগল অল্প ক’দিনের মধ্যেই।
পাশের বাড়ির শ্রেয়ার বাবা এবং ধৃতিমানের বাবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দু’জন পরস্পরের কুকর্মের গোপন সাক্ষী। দু’জনেরই ডায়াবেটিস আছে, এবং সেই কারণেই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে এক সঙ্গে লুকিয়ে মিষ্টি খান। এ রকম একটা গোপন মিটিংয়ে কথায় কথায় জানা যায়, শ্রেয়া ‘পাত্রী চাই’য়ের সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করছে। আরও জানা যায়, ‘পাত্রপাত্রী’ পরস্পরকে ভাল করেই চেনে। এমনিতে প্রতিবেশী হিসেবে মুখ-চেনা ছিল। পরে মুখোমুখি আলাপটা ঘটে যায় অঙ্কের সূত্রে। মানে ধৃতিমানের চেয়ে কয়েক ক্লাস নীচে পড়া শ্রেয়া অঙ্কটাকে কিছুতেই সুবিধে করে উঠতে পারত না। বেশ খারাপ ছিল এই বিষয়টায়। ওর সুনিশ্চিত ধারণা ছিল, আতঙ্ক কথাটার ব্যুৎপত্তি অঙ্ক থেকেই। অতি প্লাস অঙ্ক ইজ় ইকুয়াল টু আতঙ্ক।
অঙ্ক ম্যানেজ করার সহজ সমাধান পাশের বাড়িতেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। ক্লাস টেন পর্যন্ত অঙ্ক আটকে গেলে শ্রেয়া পাশের বাড়ির ‘গাবলুদা’র কাছে আসত। গাবলু যে ধৃতিমানেরই ডাকনাম, এটা বোঝার জন্য আশা করি পাঠক-পাঠিকাদের ফেলু মিত্তির বা মিতিনমাসি হওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার যতই লাজুক আর মুখচোরা হোক না কেন, ঝিমলিকে অঙ্ক বোঝাতে খুব একটা খারাপ লাগত না ধৃতিমানের। ঝিমলি কে, সবাই বুঝতে পারছেন।
ফলে এই অঙ্কের সূত্রে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দিতে, মানে চার হাত এক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাবা-মায়েদের মোটেই দেরি হল না।
বিয়ের পর থেকে অবশ্য গাবলু আর ঝিমলি, পরস্পরকে ধৃতি এবং শ্রেয়া বলে সম্বোধন করে।
যাঁরা এত ক্ষণ পড়ে এলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন যে, ধৃতিমানের প্রাক্-বিবাহ পুজোর বাজার কী রকম হত। ভিড়ভাট্টা, লোকসমাগম এড়িয়ে চলা ধৃতিমানকে তার বাবা-মা যে রকম জামাকাপড় কিনে দিতেন, ধৃতিমান তা-ই পরত। খুব ইচ্ছে হলে বা নিজের কোনও পছন্দ থাকলে অনলাইনে আনিয়ে নিত। এমনকি শুনলে অবাক হবেন, বিয়ের কেনাকাটাও কিন্তু নিজের পছন্দে করেনি ধৃতিমান। বিয়ের হইচই নিয়ে আজন্মলালিত একটা ভয় ছিল ধৃতিমানের। তবে পাড়াতেই শ্বশুরবাড়ি, নিমন্ত্রিতরা মোটামুটি সবাই চেনা, বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি ধরনের কমন পাড়া-প্রতিবেশী, আর আত্মীয়স্বজনরাও মোটামুটি খুব অচেনা নন বলে অনেকটা ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিল। অন্য পক্ষের যারা কনেযাত্রী হয়ে ধৃতিমানদের বাড়িতে এসেছিল, তারাই আবার বরযাত্রী হয়ে শ্রেয়াদের বাড়ি দাপিয়ে এসেছে। সুতরাং বিয়েতে ধৃতিমানের খুব বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। মোটামুটি হাসিমুখেই ম্যানেজ করে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা অপেক্ষা করছিল অন্য জায়গায়।
বিয়ের তিন মাসের মাথায় দুর্গাপুজো। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে স্বামী জন্মগত এবং নিজস্ব অভ্যেসে আয়ত্ত ‘মার্কেটিং’ পদ্ধতি ভুলে স্ত্রীর ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে শুরু করে দেয়। বিয়ের আগে থেকে যদি নারী-পুরুষ পরস্পরকে চেনে, তা হলে সময়টা ছ’মাসের জায়গায় তিন মাস হয়। ব্যতিক্রম আছে। তবে তাতে কিছু এসে যায় না। ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে। কিন্তু ধৃতিমান ব্যতিক্রম নয়।
বাঙালি মেয়েদের পুজোর ‘মার্কেটিং’ যে কী মারাত্মক জিনিস, তা বিবাহিত বাঙালি পুরুষ ছাড়া পৃথিবীর কেউ বুঝবে না। শ্রেয়ার প্রথম লিস্ট ছিল, কাদের জন্য জিনিস কিনতে হবে। দ্বিতীয় লিস্ট, কোথা থেকে কিনতে হবে। এই ‘কোথা থেকে কিনতে হবে’র মধ্যে আবার ছোট-ছোট করে তিন-চারটে দোকান এবং জায়গার নাম। মানে লিস্টের ‘ফার্স্ট চয়েস’-এর দোকান থেকে জিনিস পছন্দ না হলে ঘুচি-ঘুচি করে লেখা দোকানগুলোয় ঢুঁ মারতে হবে। লিস্ট দেখে ঘরের মধ্যে চব্বিশ ডিগ্রিতে এসি চলা সত্ত্বেও ধৃতিমানের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘামের সঞ্চার হয়েছিল।
শ্রেয়া বুঝতেই পারেনি যে, সে কুয়োর ব্যাঙকে নাসা স্পেসশিপে করে চাঁদে যাওয়ার কথা বলছে। ধৃতিমান যে গ্যাঙরগ্যাঙ আওয়াজ করে দু’-এক বার প্রতিবাদ জানায়নি তা নয়, কিন্তু বিবর্তনের পরে ধৃতিমানের গলার আওয়াজে সে রকম জোর ছিল না। অঙ্কের মাস্টারির দিন তো কবেই পিছনে চলে গেছে, বিবাহ-পরবর্তী দাম্পত্যে মাস্টার, থুড়ি মাস্টারনি যে এক জনই, সে কথা তো আরনতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অভিজ্ঞ মানুষমাত্রেই জানেন।
ফলে এক মায়াবী রাতে খুব ঘন হয়ে এসে শ্রেয়া মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করে, “উপর না নীচ থেকে শুরু করবে বলো তো?”
শার্সির ও-পার থেকে আসা চাঁদের আলো লজ্জায় মাখামাখি হয়ে ওদের পাশে এসে খুব নরম করে উঁকি মারে। সেই চাঁদের আলোয় ধৃতি মুগ্ধ হয়ে শ্রেয়ার মুখ দেখে। পাতলা ঠোঁটের উপর হালকা ঘামের বিন্দু অন্ধকারে হিরের মতো জ্বলজ্বল করে। প্রিয়ার কী রূপ সেই জানে, যে কখনও ভালবাসে। ধৃতিমানের কানের লতি লাল হয়ে যায়। শ্রেয়া কখনও এত প্রগল্ভ হয়নি তো! ঢোঁক গিলে অস্ফুটে খসখসে গলায় ধৃতিমান বলে, “তুমি যা বলবে।”
শ্রেয়া লাফিয়ে উঠে বসে। হাতে-হাত ঘষে বলে, “তা হলে জুতো থেকে শুরু করা যাক।”
জানালা দিয়ে গলে আসা মায়াবী জ্যোৎস্না চমকে উঠে ধড়ফড় করে উঠে বসে চাঁদের দিকে দৌড় মারে। ধৃতিমানের হাঁ-টা এত বড় হয়ে যায় যে, আর একটু হলে নীচের চোয়ালটা উপরের অংশের সঙ্গে জোড়া লাগাতে ডাক্তার ডাকতে হত। শ্রেয়ার ঠোঁটের উপর জমে থাকা কয়েক লক্ষ টাকার ঘামটা হঠাৎই ঝুটো পাথর হয়ে যায়। ধৃতিমান বুঝতে পেরে যায়, উপর কিংবা নীচের অনুষঙ্গ পুরোটাই পুজোর জুতো-জামার কেনাকাটা-ভিত্তিক। আর কিছু নয়। শ্রেয়ার ইচ্ছে নীচ থেকে, মানে পাদুকা থেকে শুরু করার। সেটাই ও বলেছে।
হগ মার্কেটের কাছে নামকরা জুতোর দোকান। ফুটপাতে-ফুটপাতে গিজগিজ করছে ভিড়। শুরু হল ‘নীচ থেকে’ পুজো মার্কেটিং। দোকানও ভিড়ে তুলকালাম, পুরো যেন অফিসটাইমের বনগাঁ লোকাল। মনে হচ্ছে, সবাই যেন এই পুজোয় শুধু নতুন জুতোই পরবে বলে ঠিক করেছে। তার উপর রোববার বলে ভিড়টা বেশি। কোনও রকমে ঠেলেঠুলে দোকানে ঢুকে উপরে ওঠা গেল।
গল্পের শুরুটা এখান থেকেই হয়েছিল। গল্পে দু’-চার জন নিস্পৃহ মুখের চরিত্র হাজির। জুতোর দোকানের দোতলাতেও জনসমুদ্র। মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকানো সেই জনগণের মাঝখানে দু’-চার জন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক জন বাঘাটে গলায় চেঁচিয়ে বলল, “একুশ দুশো একাত্তর, সাত নম্বর।” অন্য দিক থেকে সপাটে তার দিকে এক বাক্স জুতো উড়ে এল। কেউ আবার হাঁড়িচাচাকে লজ্জা দেওয়া গলায় বলে ওঠে, “পনেরো আটশো আট, পাঁচ নম্বর।” উপরের সিলিংয়ের একটা চৌকো খুপরি থেকে ঝড়াং করে নেমে আসে ফের একটা বাক্স। মেঘনাদকে যদিও দেখা যায় না।
সব দেখেশুনে খুব দিশেহারা লাগে ধৃতিমানের। ভয়ে শ্রেয়ার হাত ধরে একটা কাউন্টারের কাছে চলে আসে ও। এ রকম অদ্ভুত সংখ্যা ও শব্দের উত্তরে বিভিন্ন সাইজ়ের জুতোর ওড়াউড়ি চলতেই থাকে। এ বার কহানি মে টুইস্ট। ধৃতিমান হাতে ধরা শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে, একটা বেশ মোটাসোটা বাচ্চা ওর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। দেবদেবীরা যখন-তখন রূপ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু শ্রেয়া কী করে বাচ্চা ছেলেতে রূপান্তরিত হয়? ঝটকরে ছেলেটার হাত ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, “তুই আবার কে?”
ছেলেটা একটু ফুঁপিয়ে নিয়ে বলে, “তুমিই তো আমায় হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এলে।”
ধৃতিমান শুনেছে, ছেলেধরারা জনগণের হাতে ধরা পড়ে গেলে খুব মারধর খায়। তার উপর এখানে জুতোর পাহাড়। জুতোপেটা করার জন্য অন্তত জুতোর অভাব হবে না। আর ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। ছেলেটাকে দেখিয়ে কাউন্টারের ভদ্রলোককে ধৃতিমান সাত-তাড়াতাড়ি জানায় যে, বাচ্চাটা হারিয়ে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বোধহয় ভদ্রলোককে প্রায়ই পড়তে হচ্ছে। একটা পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম রাখা উচিত ছিল এদের। ‘অমুক জায়গা থেকে আগত তমুকের বাড়ির লোক যেখানেই থাকুন, আমাদের মঞ্চের সামনে চলে আসুন। আপনার জন্য তমুক অপেক্ষা করছে’— এ রকম একটা ঘোষণা করে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যেত। কাউন্টারের ভদ্রলোক অখণ্ড মনোযোগে টাকা গুনছিলেন। টাকার দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করেন, “খোকা, তোমার নাম কী গো?”
খোকা বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে উত্তরদেয়, “গুবলু।”
“তা গুবলু, তোমার বাবা কোথায়?”
ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে পোরা অবস্থাতেই গুবলু বাঁ হাত তুলে ধৃতিমানকে দেখায়। বিষফোড়া কখনও সুস্থ স্বাভাবিক অঙ্গ পছন্দ করে না, সে আত্মপ্রকাশের জন্য গোদকেই বেছে নেয়, এ কথা ফের প্রমাণিত হল। এরই মধ্যে পিছনে শ্রেয়া এসে দাঁড়িয়েছে। ধৃতিমান অসহায় হয়ে বলে ওঠে, “আমি মোটেই ছেলেটাকে চিনি না।”
শ্রেয়া খুব আস্তে অথচ কেটে কেটে পরিষ্কার করে বলে, “দু’-তিন মাসে একটা মানুষকে কতটুকুই বা চেনা যায়?” তার ভুরুতে, চোখে, কণ্ঠস্বরে উপচে পড়ছে গভীর সন্দেহ।
লে হালুয়া! পারলে ওখানেই ধৃতিমান ডিএনএ টেস্ট করতে রাজি। কাউন্টারের লোকটা এ বার টাকা থেকে মুখ তুলে তাকায়। মুখে চোর ধরে ফেলার হাসি। মনে হয় প্রতি দিন বেশ কয়েকটা জুতো-চোর ধরা পড়ে ওখানে। তিনি উদার গলায় সদুপদেশ দেন, “ছেলেটার মনে হয় খিদে পেয়েছে। যান, কিছু খাইয়ে আনুন। আর এ রকম করবেন না, বাচ্চাদের মনে চাপ পড়ে।”
গুবলু ততক্ষণে বাঁ হাত মুখে পুরে ডান হাতে ধৃতিমানের আঙুল জড়িয়ে ধরে।
শ্রেয়ার ভুরুতে অনেকগুলো ঢেউ। সে গটগট করে বাইরের দিকে হাঁটা দেয়। ধৃতিমানওপিছন-পিছন হাঁটে। ওর হাত ধরে গুবলুও পথে নেমে আসে।
হগ মার্কেটের সামনের রাস্তায় গাড়িঘোড়ার দাপটে ঠিক করে চলাই দায়। তার উপর শ্রেয়া পুরো রোনাল্ডোর স্টাইলে সবাইকে কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ধৃতিমান গুবলুকে নিয়ে যতটা পারা যায় ওকে তাড়া করে। শ্রেয়া প্রায় তিন-চার কিলোমিটার দূরের একটা রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়ায়। বেশ উঁচুদরের রেস্তরাঁ। তা-ই সই। ভর্তুকি দিয়ে যদি বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় তো তা-ই সই।
কোণের দিকে একটা টেবিল পাওয়া যায়। ধৃতিমান বসতেই পাশে গুবলু বসে পড়ে। মুখোমুখি শ্রেয়া। এখনও ঠিক লাঞ্চ করার সময় হয়নি। এই রেস্তরাঁর বিরিয়ানি বিখ্যাত। সেটাই বলে শ্রেয়াকে। শ্রেয়া গম্ভীর মুখে জানায় যে, ও শুধু জল খাবে। রেস্তরাঁয় ঢুকে শুধু জল খেলে মালিকের অকল্যাণ হয়। আর শ্রেয়া শুধু জল খেলে কোন মুখেই বা ধৃতিমান বিরিয়ানির অর্ডার দেয়? গুবলু খুব খুঁটিয়ে মেনু কার্ড পড়ছিল। ও একটা আইটেমে আঙুল দিয়ে বলে, “এইটা খাব আমি।”
সান-নাগচি বলে খাবারটার নাম পিতৃদেবের জন্মে শোনেনি ধৃতিমান। ওয়েটারও খুব বিনয়ের সঙ্গে জানায়, ওই ডিশটা এখন তৈরি হয় না। আসলে রেস্তরাঁর মালিকের এক বন্ধু কোরিয়ান। ওটা একটা কোরিয়ান ডিশ। অক্টোপাসের শুঁড় দিয়ে তৈরি হয়।
গুবলু নির্বিকার ভাবে বলে, “তা হলেআমি বিরিয়ানি খাব।”
গুবলু এক প্লেট বিরিয়ানির দশ ভাগের এক ভাগ খেয়ে বলে যে ওর পেট ভরে গেছে। এমন বিচিত্র পরিবার এর আগে রেস্তরাঁয় আসেনি। এই প্রথম ওরা দু’গ্লাস জল আর এক প্লেট বিরিয়ানির অর্ডার পেল। ধৃতিমান গুবলুর হাত ধরে রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে আসে। খুব কান্না পাচ্ছিল ওর। বুঝতে পারে, বাবা হওয়া খুব কঠিন কাজ। প্রথমে জুতোর দোকানে ফিরে যাবে। ওখানে গুবলুর খোঁজে কেউ না এলে লোকাল থানায় যেতে হবে। ‘নাজায়েজ়’ সন্তান বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। হয়তো নাকের বদলে নরুনের মতো, শ্রেয়ার বদলে গুবলুকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।
তবে ভরসার কথা হল, শ্রেয়া তখনও পিছু-পিছু আসছিল। দোকানে ঢুকে সটান দোতলায় উঠে যায় ওরা। দোকানের বিচিত্র আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার শোনা যায় “এসেছে, এসেছে!” যে কাউন্টারে গুবলুকে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে দু’জন স্বামী-স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে একটা গুবলুরই সাইজ়ের মেয়ে। গুবলুকে পেয়ে তারা আহ্লাদে আটখানা। ওরা গুবলুর বাবা-মা। একতলায় ওকে হারিয়ে ফেলেছিল। গুবলু নির্বিকার মুখে আঙুল চুষতে চুষতে ওর বাবাকে বলে, “এই আঙ্কেলটা খুব ভাল। আমায় বিরিয়ানি খাইয়েছে।”
শ্রেয়ার মুখেও স্বস্তির হাসি। কখন যেন ধৃতিমানের হাতটা কনুইয়ের কাছে জড়িয়ে ধরেছে।
গুবলুর বাবা খুশিতে ধৃতিমানকে জড়িয়েধরে বলে, “নিন দাদা, এ বার আপনার মেয়েকে ফিরিয়ে নিন।”
ধৃতিমান প্রায় লাফিয়ে ওঠে, “না, না... ও আমার মেয়ে নয়।”
গুবলুর সাইজ়ের মেয়েটা নাকে আঙুল পুরে ধৃতিমানকে জরিপ করছিল। গুবলুর বাবা ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, “সে কী রে, তোর বাবা কোথায়? আমি তো ভাবছিলাম গুবলুর সঙ্গে তুই বদলাবদলি হয়ে গেছিস।”
মেয়েটা অন্য হাত তুলে ধৃতিমানকে দেখায়। বিধ্বস্ত ধৃতিমানকে আড়াল করে এ বার মরিয়া শ্রেয়া এগিয়ে আসে, “আমরা কারও বাবা-মা নই।”
তার পর ধৃতিমানকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। গজগজ করতে করতে বলে, “এ বার থেকে অনলাইনে পুজোর বাজার করব।”
কথাটা শুনে বুকের গভীর থেকে একটা স্বস্তির শ্বাস উঠে আসে ধৃতিমানের। তবে তা বাতাসে মিশে যায় শ্রেয়াকে লুকিয়েই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)