E-Paper

চিক্কি

ফোল্ডিং মইয়ের ওপর উঠে উমেশ পালের বাইরের ঘরের পুরনো আর জগদ্দল সিলিং ফ্যানটা নামাচ্ছিল বগা। বহু পুরনো জিনিস, প্রায়ই ট্রাবল দেয়। ফ্যানটা সবে হুক থেকে খুলেছে, এমন সময় নীচের দিকে চেয়ে চিক্কিকে দেখতে পেল সে।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২৩

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

বগা যে কবে চিক্কিকে ভালবেসে ফেলল, তা কেউ জানে না। এমনকি বগা নিজেও প্রথমটায় টের পায়নি। চিক্কি বাড়ি-বাড়ি ঘুরে চাকুলিয়ার বাংলা সাবান ফিরি করে বেড়ায়। এমনিতে তেমন নজরে পড়ার মতো নয়। ময়লা জামাকাপড়, ঘেমো মুখমণ্ডল, চোখেমুখে বিরক্তি। তবে হ্যাঁ, তেমন নজর করে দেখলে চিক্কি খুব একটা হ্যাকছি-ও নয়। মুখচোখ কাটা-কাটা আছে, মাথাভর্তি কটাশে চুল, রোগা হলেও শরীরটা বেশ হিলহিলে।

ফোল্ডিং মইয়ের ওপর উঠে উমেশ পালের বাইরের ঘরের পুরনো আর জগদ্দল সিলিং ফ্যানটা নামাচ্ছিল বগা। বহু পুরনো জিনিস, প্রায়ই ট্রাবল দেয়। ফ্যানটা সবে হুক থেকে খুলেছে, এমন সময় নীচের দিকে চেয়ে চিক্কিকে দেখতে পেল সে। প্রায়ই দেখে, নতুন কিছু নয়। চিক্কি সাবানের ভারী ব্যাগখানা মেঝেতে রেখে একটা নীল রঙের টার্কিশ রুমালে ঘেমো মুখ মুছছে। তখনই খুট করে যেন একটা শব্দ হল বুকের মধ্যে। ওই ফিউজ় উড়ে গেলে যেমনটা হয়। এই অ্যাঙ্গল থেকে চিক্কিকে কখনও দেখেনি কিনা! কেমন যেন একটা বেকায়দায় পড়ে গেল সে। স্নানের পর ভেজা লুঙ্গিটা রোদে দিতে ভুলে গেল, দুপুরে আনমনে একটু বেশি ভাত খেয়ে ফেলল, কিন্তু কী দিয়ে খেল তা বুঝতে পারল না, একটা স্ক্রু একটু বেশি টাইট দিতে গিয়ে মিত্তিরবাড়ির মিক্সিটার প্লাস্টিকের বডিতে চিড় ধরিয়ে ফেলল। আরও প্রায় দিন তিনেক পর ঘোষবৌদির রান্নাঘরে মাইক্রোওয়েভের জন্য নতুন লাইন করতে করতে তার হঠাৎ মনে হল, সে চিক্কির প্রেমে পড়ে গেছে।

আগে বিড়ি-সিগারেট আর পান বিক্রি করে লোকে তিনতলা দালান তুলে ফেলত, আজকাল তিনবেলা খাওয়া জোটে না। দুর্গাগতির দোকানখানা তাই টিমটিম করে চলে। তবে দুর্গাগতি জানে-বোঝে খুব। পাকা মাথা আর নানা খবরের আন্ডিল। বগার সমস্যা শুনে চোখ কপালে তুলে বলে, “করেছিস কী? চিক্কির সাবানের কারবার তো চোখে ধুলো! ও আসলে পকেটমার। গুলে ওস্তাদের কাছে তালিম। আজকাল ঘরে ঘরে ওয়াশিং মেশিন আর গুঁড়ো সাবান, ক’জন আর চাকুলিয়ার ডেলাসাবান কেনে?”

পকেটমার! মাথায় একটা চক্কর খেল বগা। খবরটা খুব একটা খারাপ নয়। তার পর ভেবেচিন্তে খুব মন দিয়ে চিক্কির উদ্দেশে একখানা প্রেমপত্র লিখে ফেলল সে। তার পর সেটা ভাঁজ করে বুকপকেটে নিয়ে ঘুরতে লাগল। যদি দয়া করে পকেটমার হয়। চিক্কির সঙ্গে মুখোমুখিও হল অনেক বার, কিন্তু চিঠিখানা পকেটমার হল না তো! শুনে দুর্গাগতি বলে, “দূর ছাগল! ও হচ্ছে ঝুনো মাল, প্রেমপত্র পকেট মারতে ওর বয়েই গেছে। বরং একখানা একশো টাকার নোটের মধ্যে প্রেমপত্রখানা ভাঁজ করে গুঁজে পকেটে রেখে দেখ।”

পরদিনই গলিতে চিক্কির পাশ ঘেঁষে উল্টোবাগে যাওয়ার সময় বুকে একটা মোলায়েম টাচ টের পেল বগা। তার পর দেখল, বুকপকেট থেকে প্রেমপত্র-সহ একশো টাকা হাওয়া। না, পাকা হাত বটে মেয়েটার! হ্যাঁ, পকেটমার হতে হয় তো এ রকম! কী মোলায়েম টাচ! বুকপকেটে বার বার হাত বোলাল বগা, মুখে একটু নিরিক-থিরিক হাসি।

কদমতলায় জুতো-সারাইয়ের জন্য রোজই বসে রামভুজ। বেলা বারোটা নাগাদ সেখানে দেখা গেল, চিক্কি তার হাওয়াই চপ্পলের স্ট্র্যাপ বদলাতে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তক্কে তক্কেই ছিল বগা। আজ তার প্যান্টের ডান দিকের হিপ পকেটে একশো টাকার নোটের ভিতরে অগ্নিগর্ভ একখানা প্রেমপত্র। তার বন্ধু ভবতোষ বাংলায় এমএ পাশ, তারই পরামর্শ নিয়ে লেখা। চটিজোড়া জন্মেও পালিশ করায় না বগা। আজগিয়ে চিক্কির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল, “রামুকাকা, হাতের কাজটা হয়ে গেলে চটিটা একটু পালিশ করে দিয়ো তো!”

চিক্কি নতুন স্ট্র্যাপ-লাগানো হাওয়াই চপ্পলে পা গলিয়ে চলে যাওয়ার পর বগা হিপ পকেটে হাত বুলিয়ে গ্যালগ্যাল করে আপনমনেই হাসল। পকেট সাফ। আজ টাচটাও টের পায়নি সে। না, হাত বটে মেয়েটার! যত চিক্কিকে দেখছে, তত অবাক হচ্ছে, আর ততই প্রেমটা চড়ে বসছে মাথায়!

সে দিন দুপুরবেলায় ধর্মতলার ফাঁকা বাসে উঠেছে চিক্কি। পিছন পিছন বগাও। আজ বগার পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। পাঞ্জাবির বাঁ দিকের ঝুলপকেটে ফের একশো টাকার নোটের মধ্যে প্রেমপত্র। চিক্কি লেডিজ় সিটে বসা, তার সামনেই বগা দাঁড়িয়ে। আজ চিক্কির কাজটা বড্ড সোজা করে দিয়েছে সে। ঝুল পকেট থেকে পকেট মারা তো আনাড়িরও হাতের মোয়া।

বগাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ চিক্কি ঝামরে উঠে বলে, “আচ্ছা, তোমার মতলব কী বলো তো! বাসের সিট সব ফাঁকা থাকতেও আমার সামনে গৌরাঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ যে বড়?”

বগা একটু ঘাবড়ে গিয়ে, কথা খুঁজে না পেয়ে বলে, “না, এই এমনিই।”

চিক্কি একটু চোখ পাকিয়ে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটা মিচকে হাসি হাসল। তার পর একটু চাপা গলায় বলল, “চিঠিতে ও সব শক্ত শক্ত কথা লেখো কেন বলো তো! আমি কি ও সব বুঝতে পারি?”

বগা উজ্জ্বল হয়ে বলে, “পড়েছ?”

“পড়িনি আবার! কী সব দাঁতভাঙা কথা বাবা! বাপের জন্মে শুনিনি। তা আসল কথাটা কী তা বলবে তো! বলি, বিয়ে বসতে চাও না কি আমার সঙ্গে?”

একটু নার্ভাস হয়ে গিয়ে বগা আমতা আমতা করে বলে, “যদি চাই?”

“সেটা বললেই তো হত বাপু, এত ঘুরিয়ে নাক দেখানোর দরকার কী!”

শুনে ভারী লজ্জা পেয়ে বগা মুখ লুকোনোর চেষ্টা করল বটে, কিন্তু ফিচিক ফিচিক করে তার হাসি লিক হতেই লাগল।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Short Story Bengali Story Shirshendu Mukhopadhyay

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy