Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের ছবি তুলেছিলেন মুসোলিনি

কবির প্রশংসা আদায় করে নিজের ভাবমূর্তি পাকা করাই ছিল একনায়কের উদ্দেশ্য। সম্প্রতি কেরলে খোঁজ মিলল সেই ছবির। মুসোলিনিকে কবির ভুল বোঝার পিছনে ফর্মিকিরও ভূমিকা ছিল।

পারস্পরিক: মুসোলিনির ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথ। ডান দিকে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র

পারস্পরিক: মুসোলিনির ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথ। ডান দিকে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র

দিলীপ মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৩৫
Share: Save:

নিজের ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি তুলেছিলেন ইটালির বেনিতো মুসোলিনি। মুসোলিনির ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল নিমীলিত-চোখ, আত্মমগ্ন কবির পাশ ফেরানো মুখ। ১৯২৫-১৯২৬ সালে দু’বার ইটালি গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই সময় তোলা ছবি।

অনেক দিন এই দুর্লভ ছবিটির কোনও খোঁজ ছিল না। সম্প্রতি জানা গিয়েছে, ছবিটি রয়েছে তিরুঅনন্তপুরমের কাছে মাধবী মন্দিরম লোকসেবা ট্রাস্ট-এর সংগ্রহশালায়। গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী জি রামচন্দ্রন (১৯০৪-১৯৯৫) তাঁর মায়ের নামে এই সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন।

১৯২৫ সালে প্রথম ইটালি যান রবীন্দ্রনাথ। তখন থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন জেনোয়ার সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক কার্লো ফর্মিকি। পরে তিনি শান্তিনিকেতনেও আসেন। তাঁর মাধ্যমেই মুসোলিনি শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন ইটালীয় সাহিত্যের অজস্র বই। ফর্মিকির সঙ্গে রোমান অধ্যাপক জিওসেপ্পে তুচ্চিও এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার জন্য।

পরের বছর আবার ইটালি যান রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে দেখা করে মুসোলিনি জানান, রবীন্দ্রনাথের যত রচনা ইটালীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, সব ক’টিই তিনি পড়েছেন। এমন ব্যবহারে কবি মুগ্ধ হলেন, মুসোলিনির প্রশংসা করলেন। বলা হয়, মুসোলিনির কূটনৈতিক চাল অনুমান করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। আসলে, এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী কবির শংসাপত্র আদায় করে নিজের ভাবমূর্তি পাকাপোক্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এই সময়েই নিজের ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথের ছবিটি তোলেন তিনি।

কবির মুসোলিনি-ঘনিষ্ঠতা এর পরই ঘনিয়ে তোলে বিতর্ক। ইটালি ছাড়ার পর কবিকে সতর্ক করেন ফরাসি সাহিত্যিক রম্যাঁ রোলাঁ। ‘ফাসিস্ত’ মুসোলিনি সম্বন্ধে সব জানান কবিকে। কবি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। বিশ্বমঞ্চে ‘ফাসিস্ত-বন্ধু’ হিসেবে তাঁর যে ছবি তৈরি হচ্ছিল, তা ভেঙে দিতে চাইলেন তিনি। ১৯২৬-এর ৫ অগস্ট এক দীর্ঘ চিঠি লিখলেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ়কে। সি এফ অ্যান্ড্রুজ় ছিলেন ভারতের খ্রিস্টান মিশনারি ও শিক্ষাবিদ। চিঠিটি প্রকাশিত হয় ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। সেখানে কবি স্পষ্ট জানান, যে ফাসিস্ত আন্দোলন মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়, অত্যাচার দিয়ে মানুষের বিবেকের উপর জোর খাটায়, তার সমর্থন তাঁর পক্ষে কল্পনাতীত। এর পর মুসোলিনিও রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তি-আক্রমণ করেন, তাঁকে ‘অসহ্য ও তৈলাক্ত লোক’ বলেন।

মুসোলিনিকে কবির ভুল বোঝার পিছনে ফর্মিকিরও ভূমিকা ছিল। প্রথম ইটালি সফরে জেনোয়া থেকে মিলান যাওয়ার পথে ট্রেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ইটালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফর্মিকি জানিয়েছিলেন, ‘প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ইটালিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। মুসোলিনির নেতৃত্বে প্রায় এক রক্তপাতহীন বিপ্লবে ও রাজকীয় সম্মতিতে তাঁর দল ক্ষমতা দখল করে। জনসাধারণের সহযোগিতায় দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে।’ ফর্মিকি ফাসিস্ত দলভুক্ত না হলেও, মুসোলিনির সমর্থক ছিলেন।

দ্বিধাগ্রস্ত কবি অতঃপরে ১৯৩০ সালে মুসোলিনিকে চিঠি লিখেছিলেন। পরে এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠেন কবি। ক’বছর পর এঁকেছিলেন মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র।

মুসোলিনির তোলা ছবি কী করে রামচন্দ্রনের হাতে এল? তিরুঅনন্তপুরমের সেন্ট জোসেফ স্কুলে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষক কুলন্দি স্বামীর মুখে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনেন জি রামচন্দ্রন। ১৯২০ নাগাদ তিরুঅনন্তপুরমে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর সঙ্গে রামচন্দ্রনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ়। শান্তিনিকেতনে গিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছে রামচন্দ্রনের, কবিকে জানান অ্যান্ড্রুজ়। রবীন্দ্রনাথ সম্মতি দেন। এর পর আর দেরি করেননি রামচন্দ্রন। ওই বছরেই ডিসেম্বরে দাদা রঘুবীরনকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। সেখানকার আশ্রমিক জীবন, প্রভাতফেরি, মুক্ত বিদ্যালয়, প্রকৃতির সান্নিধ্য খুব ভাল লাগে রামচন্দ্রনের। গ্রামজীবনের উপর আগ্রহ তৈরি হয়। উইলিয়াম পিয়ারসন তখন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও প্রকৃতিপাঠের শিক্ষা দিতেন। তাঁর কাছে রামচন্দ্রন গ্রামজীবন গড়ে তোলার শিক্ষা পান।

শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় গাঁধীজির সঙ্গে দেখা হয় রামচন্দ্রনের। অসহযোগ, চরকার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গাঁধীর মতান্তর থাকলেও রামচন্দ্রন সমর্থন করতেন গাঁধীকেই। রামচন্দ্রন তখন শান্তিনিকেতনে ছাত্রসভার সম্পাদক। এক বিতর্কসভায় জোরালো ভাষায় খণ্ডন করেন রবীন্দ্রনাথের মত। পরের দিনই তাঁকে ডেকে পাঠান কবি। স্বাধীন ভাবে মনের কথা বলার জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে বলেন বিচারবুদ্ধি ও আত্মার স্বাধীনতার পথ সব সময় খোলা রাখতে।

এই রামচন্দ্রনই পরে প্রতিষ্ঠা করেন মাধবী মন্দিরম লোকসেবা ট্রাস্ট। ট্রাস্টের বর্তমান ম্যানেজিং ট্রাস্টি সিস্টার মৈথিলী জানিয়েছেন, মুসোলিনির তোলা সেই আলোকচিত্র অ্যান্ড্রুজ়কে উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে রামচন্দ্রনকে সেই ছবিটিই দেন অ্যান্ড্রুজ়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE