Advertisement
E-Paper

ব্রেড বাটার মিনিমাম অর ডাই

তখনও পর্যন্ত জার্মানি দুটো দেশ ছিল। ইস্ট আর ওয়েস্ট। ইস্ট হচ্ছে কমিউনিস্টদের, আর ওয়েস্ট, এলেবেলেদের। ইস্ট জার্মানির একটা সুন্দর ছোট্ট শহরে চলেছি, নাম ল্যাইবজিগ। অসামান্য একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হত তখন ওখানে। আমি যাচ্ছি তার জুরি-চেয়ারম্যান হয়ে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০

তখনও পর্যন্ত জার্মানি দুটো দেশ ছিল। ইস্ট আর ওয়েস্ট। ইস্ট হচ্ছে কমিউনিস্টদের, আর ওয়েস্ট, এলেবেলেদের। ইস্ট জার্মানির একটা সুন্দর ছোট্ট শহরে চলেছি, নাম ল্যাইবজিগ। অসামান্য একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হত তখন ওখানে। আমি যাচ্ছি তার জুরি-চেয়ারম্যান হয়ে।

কলকাতা থেকে এয়ারোফ্লোট-এর প্লেনে মস্কো পৌঁছে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে পিলে চমকে গেল। ইস্ট বার্লিনের ফ্লাইট দু’ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে। প্লেন ছাড়ামাত্র রাত্তিরের খাবার দিয়ে দেওয়া হল সকলকে। আমি এমনিতেই পেটুক মানুষ, থালায় এক টুকরো ভাতও পড়ে থাকে না, যা দিল সব ভ্যানিশ করে দিলাম। মাথায় কী বুদ্ধি এল কে জানে, মাঝারি সাইজের চকোলেটটা শুধু পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। তার পর ঘুম। ঘুম ভাঙল, প্লেনের চাকা যখন বার্লিন ছুঁয়েছে। নেমে তল্পিতল্পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আমাকে নিতে যাদের আসার কথা ছিল তারা কোথায়! হারাধনের কোনও ছেলেকেই কোথাও দেখতে পেলাম না, বদলে ভয়ংকর ঠান্ডা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল আমাকে। গুটগুট করে লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। সেখানেও কোথাও কেউ নেই। পকেটে একটা সিগারেটও নেই। আছে খালি ডিরেক্টরের ফোন নম্বর। একটা পাবলিক টেলিফোন থেকে ফোন করতে শুরু করলাম। তারের ভেতর দিয়ে, রিসিভারের ভেতর দিয়ে গলগলানো ঠান্ডা কানের ভেতর ঢুকে পড়ল, আর কানের ভেতর থেকে পেটের নাড়িভুঁড়ির ভেতর। বুঝতে পারলাম একশো লেপের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর।

এয়ারপোর্টের কাচের দেওয়ালের বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, পুরু বরফের আস্তরণে ঢেকে গেছে শহরটাই। মনে হল সিগারেট না খেলে মরেই যাব। টেলিফোনের পাশেই একটা খোপ, খোপের ভেতর টেলিফোন ডাইরেক্টরি। কিন্তু শুধুই কি তাই? অন্য কিছু নয়? আমি যেন কী একটা দেখলাম আরও! বাক্সের ভেতর হাত বাড়িয়ে ধরলাম সেই অন্য কিছুটাকে, বের করে এনে দেখলাম এক প্যাকেট সিগারেট। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। বুঝলাম আর কোথাও না থাক, কমিউনিস্টদের দেশে ঈশ্বর অবশ্যই আছে। পর পর মাত্র চারটে সিগারেট শেষ করেছি, এমন সময় চার পাশ থেকে আমাকে ঘিরে ধরল মিলিটারির লোকজন। আদতে তারা এয়ারপোর্ট পুলিশ। কড়মড় করে কী যে বলে গেল কিছুই বুঝতে না পেরে আমি প্রথমে ইংরিজি বললাম। তার পর হিন্দি। তার পর বাংলা এবং শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, আলেস-ভু ফঁসে? যার মানে ‘তুমি কি ফ্রেঞ্চ জানো?’ গোছের কিছু। আমার ফরাসি বিদ্যে ওইটুকুনই, তাও বললাম, কারণ ভালই জানি এরা বিন্দুমাত্র ফ্রেঞ্চ জানে না। আমার সঙ্গে কথা বলা বৃথা বুঝে লম্বা মুখ করে লোকগুলো চলে গেল, কিন্তু হাঁপ ছেড়ে বসতে না বসতেই আবার ফিরে এল আর এক জনকে নিয়ে। বুঝলাম এ হচ্ছে ‘হেড অফিসের বড়বাবু’। কোনও রকমে ইংরিজিতে সে বোঝাতে পারল, রাত বারোটার পর এয়ারপোর্ট রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া, কারওই থাকার নিয়ম নেই। অনেক বোঝালাম, আমি ওদের দেশের সরকারি অতিথি, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। বলল, বড়জোর একটা গাড়ি দিয়ে তোমাকে রেল স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারি। ওইখানে ওয়েটিং রুমে সারা রাত্তির থাকতে পারো। ল্যাইবজিগ-এর ট্রেন এলে সোজা উঠে পড়বে, যদিও সকাল সাতটার আগে কিছুই আসবে না, কারণ বরফে ঢেকে গেছে সমস্ত কিছু। পাততাড়ি গোটাতেই হল। যত রকম গরম জামা ছিল, সবই পরে ফেলেছি তত ক্ষণে। হাতে ঝোলানো ছিল চিদুদা, মানে, চিদানন্দ দাশগুপ্তের কাছ থেকে ধার করা ওভারকোট। আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে সাদা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কালো গাড়িটা।

মালপত্র টানতে টানতে ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি, তাজ্জব ব্যাপার! চার-পাঁচটা টিকিটবাক্স আর বেঞ্চিতে মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে লোকজন। এক-এক জনের নাকডাকার শব্দে কাচের জানলা থেকে বরফ খসে পড়ছে, এক-এক জনের নাকডাকায় সেই বরফ আবার ফিরে আসছে জানলার গায়ে। ওপরে সারি সারি লোহার রড লাল হয়ে রয়েছে। তাদের তাপে মুহুর্মুহু নিজের হাড়ের ঠকাঠক শব্দ একটু কমল বোধহয়। রাত তখন দুটো পার হয়ে গেছে। ঘুমন্ত এক মাতাল জার্মানকে ঠেলা মারতে সে পা’দুটো একটু সরাল, আমি বসলাম। রাত বাড়তে লাগল আর আমার পেটের ভেতর বাঘের ডনবৈঠক শুরু হয়ে গেল। জীবনে অনেক বার খিদের চোটে কেঁদে ফেলেছি আমি, কিন্তু সে বারের সেই খিদে পরের জন্মেও মনে থাকবে। মনে পড়ে গেল চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’। চার পাশে যেগুলো শুয়ে আছে তারই একটাকে ধরে খেয়ে ফেললে হয় না!

আস্তে আস্তে চারটে বাজল, তার পর পাঁচটা, তার পর ছ’টা। বাইরে বেরিয়ে দেখি, সমস্ত লাইন চাঁই-চাঁই বরফে ঢেকে গেছে। সাতটার ট্রেনও বাতিল। ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে সেই ন’টা। তত ক্ষণে লাইন থেকে বরফ সরানো হবে। পকেটে দশ ডলার ছিল। তখনকার সময়ে ইস্ট জার্মানির মার্ক-এ তা দিয়ে টিকিট কাটার পর হাতে যা থাকল, তা ‘পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা’ও নয়, ঢের কম, খাবারের ট্রলি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটার কাছ থেকে এক টুকরো পাঁউরুটিও পাওয়া যাবে না। হঠাৎ চিদুদার ওভারকোট খুলে ফেললাম, তার তলার ব্লেজার খুলে ফেললাম, পুলওভার... সবাই দেখছে আমাকে, ভাবছে কোথাকার পাগল! আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে পড়েছে মনে পড়েছে মনে পড়েছে! শার্টের পকেট থেকে টেনে বের করলাম সেই চকোলেটকে। এক সেকেন্ডে শেষ! কিন্তু তাতে কি হয়! তিমি মাছের পেট একটা ইঁদুর ঢুকলে তিমির কি কিছু যায়-আসে!

ল্যাইবজিগে নেমে দেখলাম, দুজন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। সব রাগ গিয়ে পড়ল ওদের ওপর। ওরা বোঝাল, বারোটার পর এয়ারপোর্ট চত্বরে থাকার নিয়ম নেই বলে গত রাতে তাদের ফিরে আসতে হয়েছিল। পেট চাপড়ে বললাম, ‘হাংরি। ব্রেড বাটার মিনিমাম অর ডাই।’ আরও তিন বার পেট চাপড়ালাম যাতে বোঝানোয় কোনও খামতি না থাকে। তারা বলল, বারোটার আগে আমাকে হোটেলে ঢুকতে দেবে না। তা-ই নিয়ম। তবে খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে এক্ষুনি। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে একটা রেস্তরাঁয় গিয়ে ঢুকলাম। একশো পাউন্ড পাঁউরুটি, একশো পাউন্ড মাখন আর একশোটা ডিমের একটা ওমলেট খেয়ে মন শান্ত হল, মুখে হাসি ফুটল, চোখের জল ঢুকে গেল চোখের ভেতর। এত ক্ষণে হাত মেলালাম তাদের সঙ্গে, জড়িয়ে ধরলাম। এক জন বলল, আমি তোমার সেক্রেটারি। তোমার সঙ্গেই থাকব।

রাস্তায় বেরিয়ে একটু দূরে প্রায় পাঁচ-ছ’শো বছরের পুরনো একটা চার্চ দেখিয়ে লোকটি বলল, ওখানে যাবে? একটা জিনিস দেখাব তোমায়। আমরা এগিয়ে গেলাম... ভেসে আসছে পিয়ানোর শব্দ। ‘ওই যে গ্র্যান্ড পিয়ানোটা দেখছ, ওটা কার জানো? তোমার সবচেয়ে প্রিয়, যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর।’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম পিয়ানোটার দিকে। মনে পড়ল, ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টরকে কথায় কথায় বলেছিলাম, আমার সবচেয়ে ভালবাসার শিল্পী বাখ, মডার্ন মিউজিক-এর বাবা। পিয়ানোতে তখন বাজছে বাখের ‘আভে মারিয়া’ আর আমি সমস্ত রাগ, খিদে, ক্লান্তি ভুলে আবার খুঁজে পাচ্ছি চেনা আমিটাকে। জল আসছে চোখে, আবার।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy