সফেদ জামাপ্যান্ট আর সাদা ঝাঁকড়া চুলে ফরসা ধবধবে লোকটি অবিকল যেন বিদেশি। বারান্দায় বসে থাকা আবীরবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মাঝবয়সি লোকটি এগিয়ে এল। এসে কোনও রকম ভণিতা না করেই বলল, ‘পাঁচটা টাকা দেবেন স্যর, মুড়ি খাব!’
কাগজ পড়ছিলেন আবীরবাবু। সেটি গুটিয়ে রেখে বললেন, ‘চেহারা স্বাস্থ্য তো দিব্যি। ভিক্ষা করো কেন! খেটে খেতে পারো না?’
শুনে বিব্রত যেন লোকটি। কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘খেটেই তো খেতে চাই কিন্তু কাজ জুটলে তবেই না! ছ’ঘণ্টা ধরে পথে পথে ঘুরছি কিন্তু এখনও একটা কাজও কপালে জুটল না!’
আবীরবাবু ঠোঁট বাঁকালেন, ‘না জোটার কী আছে। কাজের কী অভাব আছে নাকি!’
আছে স্যর আছে। আমি যে কাজ করি সেই কাজের অভাব আছে। লোকে কাজ দেবে কী, শুনেই ঠাট্টা-তামাশা জুড়ে দেয়!
ভুরু কোঁচকালেন আবীরবাবু, ‘কী এমন কাজ করো যে শুনে লোকে ঠাট্টা-তামাশা জুড়ে দেয়?’
আমি মেঘ-প্রদর্শক, স্যর। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেঘ মেঘ খেলা খেলি!
মেঘ মেঘ খেলা! বিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আবীরবাবু, ‘সেটা আবার কী পাগলামি?’
পাগলামি নয় স্যর। একটুকরো মেঘের মধ্যে কত না রূপের সহাবস্থান! আমি খেলার ছলে বাচ্চাদের ওসব রূপ চিনিয়ে দিই। পশু, পাখি, মানুষ থেকে শুরু করে বাড়ি, গাড়ি সব মেঘের স্তূপের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে। আমার কাজ হল সেগুলিকে খুঁজে বের করে বাচ্চাদের দেখিয়ে দেওয়া। এই খেলায় বাচ্চারা খুব মজা পায়, স্যর।
ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন আবীরবাবু। এমন আবার হয় নাকি, মেঘের রূপ চেনাবার জীবিকা! মেঘ মেঘ খেলা! রবিবারের দুপুর। ছুটির দিন বলে বারান্দায় কাগজ নিয়ে বসেছিলেন। ভেতরের ঘরে ছেলে, ক্লাস নাইনের বুবুন, কম্পিউটারে গেম খেলছে। মেয়ে তিতির ক্লাস সিক্সে পড়ে, ছবি আঁকায় সে মগ্ন। সারা সপ্তাহ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও রবিবারে একটু দম ফেলবার ফুরসত পায় ওরা। কিন্তু তখনও তো যা কিছু ক্রিয়াকর্ম সব ঘাড় গুঁজে! আবীরবাবু ভাবলেন, ছেলেমেয়ে দুটো কত দিন যে ঠিকঠাক আকাশের দিকে তাকায়নি কে জানে! শেষে কী মনে হওয়ায় ছেলেমেয়েদের ডাকলেন আবীরবাবু। ওরা বারান্দায় এলে আগন্তুক লোকটিকে বললেন, ‘তোমার নামটা কী ভাই?’
লোকটি হাসল, ‘পরেশ। পরেশ নন্দী। লোকে বলে মেঘওয়ালা!’
তা মেঘওয়ালা, তোমার ফি কত, ভাই?
খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই আমার ফি, স্যর।
বেশ বেশ। তা হলে আমার এই ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে খানিক মেঘ মেঘ খেলা খেলো দেখি। কিন্তু সমস্যাটা হল আকাশ তুমি পাবে কোথায়! উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির আড়ালে সবটাই যে ঢাকা পড়ে গেছে!
আপনাদের এই ছ’তলা অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ থেকে অনেকটাই পেয়ে যাব মনে হয়। যদি অনুমতি দেন তা হলে...।
মৃদু হেসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন আবীরবাবু। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেমেয়েদের বললেন, ‘ওকে নিয়ে লিফটে করে ছাদে যাও তোমরা। ও তোমাদের মেঘের রূপ চেনাবে!’
মেঘের রূপ! সে আবার কী জিনিস বাবা? বুবুন অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল।
তিতির বলল, ‘মেঘ মেঘ খেলাটা কী বাবা?’
আবীরবাবু হাসলেন, ‘যাও না ছাদে। গেলেই বুঝতে পারবে।’
‘ছাদে উঠে মেঘওয়ালা বুবুনকে বলল, ‘মেঘনাদ কার নাম বলতে পারবে?’
বুবুন গম্ভীর, ‘হ্যাঁ, পারব। রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের আর এক নাম মেঘনাদ।’
মেঘওয়ালা এ বার তিতিরের দিকে ফিরল, ‘কয়েকটা মেঘের নাম বলো তো খুকি।’
তিতির অন্যমনস্ক। ছাদে ওঠার পর থেকে লোকটাকে আড়ে আড়ে শুধু লক্ষ করেই যাচ্ছে সে। নামখানা সার্থক বটে। ফরসা রং আর সাদা চুলের লোকটাকে মেঘময় আকাশের নীচে সত্যিকারের মেঘওয়ালা বলেই মনে হচ্ছে। সাদায় সাদায় একাকার উপর নীচ! কিন্তু মেঘ নিয়ে কী খেলা খেলবে লোকটা?
তিতিরকে আনমনা দেখে মেঘওয়ালা ওর চুল নেড়ে দিল, ‘শোনো তবে কয়েকটা, কোদালে মেঘ, বাদল মেঘ, পেঁজা মেঘ, সিঁদুরে মেঘ, অলক মেঘ ইত্যাদি ইত্যাদি।’
কম্পিউটার ছেড়ে ছাদে আসতে হয়েছে বলে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত বুবুন। এর পর মেঘ নিয়ে এলেবেলে সব প্রশ্ন শুনে ওর মটকা গরম। তিরিক্ষি হয়ে তাই বলে উঠল, ‘বাবা বললেন আপনি কী সব মেঘের রূপ চেনাবেন। প্রশ্ন না করে জলদি সে সব শুরু করুন না।’
বুবুনের মন্তব্যে জিভে কামড় দিয়ে হেসে উঠল মেঘওয়ালা, ‘ঠিক আছে, এসো তাই করি। ওই যে পশ্চিম আকাশে পেঁজা তুলোর মতো এক রাশ মেঘ দেখছ। ওর মধ্যে ক’খানা প্রাণী লুকিয়ে আছে বলো তো তোমরা?’
মেঘওয়ালার কথায় বুবুন আর তিতির চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। কিছু ক্ষণ পর্যবেক্ষণ করবার পর তিতির প্রথম বলে উঠল, ‘তিনটে প্রাণীকে আমি দেখতে পাচ্ছি— বাঘ, হরিণ আর খরগোশ।’
তিতির থামতেই বুবুন বলল, ‘আমি কিন্তু আরও দুটো প্রাণীকে দেখতে পাচ্ছি। পাখি আর মাছ।’
দাদার কথায় ভীষণ উত্তেজিত তিতির, ‘হতেই পারে না। কই দেখা দেখি কোথায় পাখি আর কোথায়ই বা মাছ!’
বুবুনের বোনকে দেখিয়ে দেওয়ার পর্ব মিটতেই মেঘওয়ালা বলল, ‘একটা বাচ্চা মেয়েও কিন্তু লুকিয়ে আছে মেঘের মধ্যে। হাতে বেলুন!’
শুনেই হইহই করে উঠল বুবুন আর তিতির, ‘কোথায়, কোথায়?’
মেঘওয়ালা আঙুল তুলে মেঘ বালিকাটিকে দেখিয়ে দিয়ে হাসল একগাল, ‘এ বার দক্ষিণে ওই মেঘের স্তূপটার দিকে তাকাও। ওখানে কিন্তু বাড়ি, গাড়ি, পাহাড় সবই খুঁজে পাবে।’
এই ভাবে এক ঘণ্টা ধরে মেঘ মেঘ খেলা খেলবার পর সবাই নীচে নেমে এলে আবীরবাবু ছেলেমেয়েদের বললেন, ‘কী, কেমন লাগল মেঘ মেঘ খেলা?’
বুবুন আর তিতির সমস্বরে বলে উঠল, ‘দারুণ!’
বাচ্চাদের উচ্ছ্বাস দেখে খুশিতে আপ্লুত মেঘওয়ালা। মানুষটিকে হাসতে দেখে আবীরবাবু বললেন, ‘এত চমৎকার একটা কাজ করেও তোমাকে যে ভিক্ষা করতে হচ্ছে এটাই দুঃখের। এই নাও তোমাকে আমি একশো টাকা পারিশ্রমিক দিলাম। এর পর ছুটির দিনে এ দিকে এলে আমাদের বাড়িতে চলে এসো। এই ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে মেঘ মেঘ খেলা খেলে যেয়ো।’
মেঘওয়ালা খুশি হয়ে ঘাড় নাড়লে আবীরবাবু আবার বললেন, ‘তুমি মুড়ি খাবে বলেছিলে। কিন্তু মুড়িতে কী আর পেট ভরবে! তারচেয়ে ফ্রিজে কিছু রসগোল্লা রাখা আছে, যাওয়ার আগে সেগুলির সদ্ব্যবহার করে যাও।’
খানিকবাদে বুবুনদের মা প্লেটে করে ছ’খানা রসগোল্লা নিয়ে এলে প্লেটখানাকে প্রায় ছোঁ মেরে টেনে নিল মেঘওয়ালা। তার পর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল রসগোল্লাগুলোর উপরে। তিতিরের হঠাৎ কী যে হল, সে রসগোল্লাগুলোকে দেখতে পেল না। দেখল সাদা সাদা গোলাকার মেঘের কিছু খণ্ড মেঘ তোরণ ডিঙিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এক নতুন মেঘের রাজ্যে!