আজ রিনির শরীর ভাল নেই। কিন্তু স্কুলে যেতে হবে ওকে। আজ ওর রেজাল্ট। সেভেন থেকে এইট হবে। মৌমা, অভিরূপ, মিতালিরা ওকে যে এ বার টপকাবে, সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত। কেননা, পরীক্ষা শুরুর ছ’দিন আগে তো ওর ঠাম্মা মারা গেল। পড়া হয়নি কিচ্ছু। ঠাম্মা ওকে যে কত ভালবাসত। বাবা বকলে ঠাম্মাই তো ওকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, ‘চলো দিদিভাই, আজ আমরা একসঙ্গে ঘুমোবো। বাদ দাও ওদের কথা।’ তার পর বিছানায় শুয়ে কত গল্প বলত ঠাম্মা। দত্যিদানব, ব্রহ্মরাক্ষস থেকে ভূতের গল্প। বাদ যেত না কিছুই। রিনির যে কী ভাল লাগত গল্পগুলো শুনতে! সব কিছু কি রাতারাতি ভোলা যায়। পড়া হয়নি তাই।
স্কুলে আজ মা যাবে বলেছিল। কিন্তু যখন রেডি হয়ে বেরোতে যাবে, তখন মা বলল, ‘আমি আর যাচ্ছি না, ইলেকট্রিকের বিল জমা দেওয়ার আজই লাস্ট ডেট। তোর বাবার সময় হবে না। আমাকেই যেতে হবে।’ কথাটা শুনে রিনির মনটা খারাপ হয়ে গেল। অগত্যা একাই বের হল। যেমন যায় রোজ। প্রত্যেক বার রেজাল্টের সময় মা নয়তো বাবা যায়। এ বারেই সেটা পালটে গেল। তা হলে কি বাবা-মাও ধরে নিয়েছে, রিনির রেজাল্ট খারাপ হবে!
স্কুলে যখন প্রথম পিরিয়ডে মাধবস্যর ওর হাতে রেজাল্ট তুলে দিয়ে বলল, ‘রেজাল্ট ভাল হয়নি, রিনি’, অমনি মৌমা পাশ থেকে ফিক করে হেসে উঠল। বিশ্রী একটা হাসি। এই সময় কেউ হাসে! কারও দুঃখের দিনে হাসতে আছে। রিনির মোটেও ভাল লাগেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই প্রথম মৌমা ফার্স্ট হল। রিনিও তো দু’এক বার ফার্স্ট হয়েছে ক্লাসে। কই, ও তো ও রকম ‘বিশ্রী’ ভাবে হেসে ওঠেনি কখনও! পাশে তখন মিতালিও ছিল। রিনি ওদের কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলল না।
সবাই চলে গেছে যে যার বাড়ি। শুধু দীপালি যায়নি। রিনির মন খারাপ দেখে দীপালি বলল, ‘কী করবি বল, এমন সময় দুর্ঘটনাটা ঘটল... দেখবি, এইট থেকে নাইনে তুই-ই ফার্স্ট হবি। চল, এখন বাড়ি চল।’ দীপালি নিজে খুব একটা ভাল রেজাল্ট করেনি। কিন্তু রিনিকে যে সান্ত্বনা দিল, এটা ভাল লাগল ওর। খুব আপন মনে হল। দীপালি হাত ধরে টান দিতেই পা বাড়াল বাড়ির দিকে।
কিন্তু পা যেন চলছেই না। আসলে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না রিনির। বাড়ি গেলেই তো সেই একরাশ ঝামেলার সামনে পড়তে হবে। আর এখন ঠাম্মাও নেই যে ওর হয়ে দুটো কথা বলবে। অন্তত দাদু থাকলেও চলত। কিন্তু দাদুও তো নেই। রিনি যখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, তখনই নাকি আকাশের ‘তারা’ হয়ে গেছে দাদু। এ সব কথা ঠাম্মাই ওকে বলেছিল। বাড়িতে বাবা-মা ছাড়া আর আছে তিন্নি। ওর বোন। থ্রিতে পড়ে। ও আর রিনির হয়ে কী বলবে!
যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। বাড়ি ঢুকতেই সবাই যখন জানল রিনির রেজাল্ট ভাল হয়নি, মন খারাপ হয়ে গেল সবার। কিন্তু বাবা এমন একটা ভাব করে তাকাল, যেন বিশ্বে আর কারও রেজাল্ট খারাপ হয়নি। শুধু রিনিরই হল!
সারাক্ষণ টিভি নিয়ে বসে থাকলে ও রকমই রেজাল্ট হবে।
বাবার কথাটা বেশ ঝাঁঝাল মনে হল। বাবা নিজেও জানে, রাত ন’টা বাজলে শুধু ডিসকভারি চ্যানেলটা রিনি দেখে। ওটাই একমাত্র ওর ভাল লাগে। ক্লাস ওয়ান থেকে রিনি তো এক থেকে পাঁচের মধ্যেই থেকেছে। সেভেনেই তো ওর রোল ছিল দুই। শুধু এ বারেই ওর রেজাল্টটা যা খারাপ হয়েছে। রোল হয়েছে আট। তাও তো দশের ভেতরেই আছে।
ইংরেজি পরীক্ষা যেদিন, সেদিনও তো বাড়িতে কত আত্মীয়স্বজন, লোক জন! বাবা-মা তো সব জানে। ঠাম্মার শ্রাদ্ধের কাজ ছিল সে দিন। তাই ওই কোলাহলের মধ্যে একদম পড়া হয়নি।
রেজাল্ট, পড়াশোনা এ সব ব্যাপারে মা কোনও দিনই মাথা ঘামায় না। রিনি জানে। কিন্তু আজ যেন মনে হল বাবার সঙ্গে মা’রও একটা গোপন বোঝাপড়া হয়ে গেছে। রিনিকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে হবে, তারা দুজনই রিনির রেজাল্টে খুশি নয়।
মা বলল, ‘সারা বছর মন দিয়ে পড়লে আর এটা হত না। যা হাতমুখ ধুয়ে আয়। কতক্ষণ আর বসে থাকব?’
রিনি মাথা নিচু করে ফেলল। ঠাম্মা নেই, তাই সান্ত্বনাও নেই। অগত্যা মন খারাপ করেই কলতলায় গেল রিনি।
খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেতে হল। খাওয়া-দাওয়ার পর ঠাম্মার ঘরে ঢুকল রিনি। দেওয়ালে টাঙানো ঠাম্মার ছবিটাকে প্রণাম করল দু’হাত জড়ো করে। ছবির দিকে তাকিয়ে রিনির মনে হল, ঠাম্মা যেন হাসছে! আসলে ছবিটা যে অ্যাঙ্গেলে তোলা, যে দিক থেকেই দেখা যাক না কেন, মনে হবে ঠাম্মা হাসছে। ছবিটা তুলেছিল টনিদা। রিনির মাসির ছেলে। দোলের সময় চমৎকার হাত ওর। ও হবে না তো, কে হবে ফটোগ্রাফার! ও এখন ফটোগ্রাফি কোর্স করছে। কলকাতায়।
ঠাম্মাকে প্রণাম করে বেরোতে যাবে, আর একটু হলেই রিনি পা দিয়ে ফেলছিল টুনির গায়ে। দরজার কাছে ঘাপটি মেরে বসেছিল। ঠাম্মার পোষা বেড়াল। সামলে নিয়েছে নিজেকে। ওর নাম ‘টুনি’ রেখেছিল ঠাম্মাই। অন্ধকারে ওর চোখ দুটো টুনি বাল্বের মতো জ্বলে। তাই এই নাম। যখন প্রথম প্রথম রান্নাঘর থেকে মাছের মুড়োটা কিংবা জ্বাল দেওয়া দুধটা সাবাড় করে দিত চেটেপুটে, তখন টুনি ঘরে ঢুকলেই ঠাম্মা চোখ রাঙিয়ে এমন শাসন করত ওকে, রিনিও ঘাবড়ে যেত। সব মনে পড়ে যাচ্ছে রিনির।
রিনিকে দেখেই চোখ দুটো পিটপিট করতে করতে লেজ নাড়তে লাগল টুনি। দিনরাতের বেশির ভাগ সময়টাই টুনি ঠাম্মার ঘরে কাটাত। ঠাম্মা যখন গল্প বলত রিনিকে, দরজার কাছে ঠাঁই বসে থাকত টুনি। মনে হত টুনিও মন দিয়ে শুনত সে গল্প। কিন্তু এখন সে সব অতীত। এখন তা হওয়ার নয়। টুনিকে এখন আর ঠাম্মার ঘরে খুব একটা দেখাই যায় না। সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধে হলে ঘরে ঢোকে। টুনি যে দিন প্রথম এল বাড়িতে, বেশ মনে পড়ে রিনির। মা ‘না’ করেছিল। ঘর নোংরা করবে। কিন্তু ঠাম্মার ওকে ভাল লেগে গিয়েছিল। মাকে ঠাম্মা বলেছিল, ‘মা ষষ্ঠীর জীব। কত খাবার তো এ দিক ও দিক হয়। নষ্ট হয়। ওকে দিলে সংসারের মঙ্গলই হবে।’
মা আর কথা বাড়ায়নি। তার পর ঠাম্মা টুনিকে এমন ট্রেনিং দিল যে, সকাল হলেও ও চলে যেত ভাঙা পাঁচিলের ধারে। পটি করে তার পর ঘরে ঢুকত। ঠাম্মা রোজ খাওয়ার পরে টুনির জন্য ভাত রেখে আসত কলতলায়। এখন আর টুনির জন্য কেউ কলতলায় ভাত রেখে আসে না। রিনি খাওয়ার পর দু’এক দিন থালায় ভাত রেখে দিয়েছিল। তা দেখে মা বকেছিল খুব। ভাত নষ্ট করা একদম পছন্দ নয় মা’র।
এ ক’দিন বড় বেশি ‘ম্যাও ম্যাও’ করছিল টুনিটা। হঠাৎ কী মনে হল টুনিকে কোলে তুলে নিল রিনি। তার পর গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে একটু আদর করে দিল। আলতো করে একটা চুমুও খেল। কী আনন্দ ওর! এই ক’দিনে বড় একলা হয়ে গেছে বেচারা। ঠাম্মাও ওকে এ ভাবেই ঘাড়েমাথায় হাত বুলিয়ে দিত। রোজ। রিনি জানে। সে জন্যই তো টুনি বড় ন্যাওটা ছিল ঠাম্মার। রিনি মাথা নিচু করল। আবার কী মনে হল, টুনির একটা পা টেনে নিয়ে রিনি ওর মাথায় ছোঁয়াল। চোখ বুঝল। বেশ হালকা লাগল নিজেকে! ঠাম্মার হাতের ছোঁয়া তো টুনির গায়েও আছে, না।
যা-ই হোক, টুনি তো আর চান করে না।