Advertisement
E-Paper

‘জমা’টিয়া দাদুয়ানি

দাদামশাই প্রতিদিনের লাভক্ষতি, বিয়ে-টিউশন-সরষের তেলের খরচ লিখে রাখতেন। মোহনবাগান জিতলেই, সেই হিসেবে গোল। ঢালাও কুলপি মালাই। খেরোর খাতায় জমা পড়ত খুশিয়াল জীবন।মোহনবাগান হেরে গেলে আমার দাদুর ভীষণ মনখারাপ হত। ফল জানার পর সারা সন্ধে এক তলার ঘরে বসে থাকত চুপচাপ। সেই অন্ধকার থমথমে মুখ দেখে মনে হত বুঝি মানুষটার বিশাল টাকা মার গিয়েছে বা কাছের কেউ হঠাৎ মারা গিয়েছেন!

শৈবাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
তপন সিংহ-র ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমায় কর্তাদাদু। খানিক আদর-যত্ন পেলেই মেজাজ শরিফ।

তপন সিংহ-র ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমায় কর্তাদাদু। খানিক আদর-যত্ন পেলেই মেজাজ শরিফ।

মোহনবাগান হেরে গেলে আমার দাদুর ভীষণ মনখারাপ হত। ফল জানার পর সারা সন্ধে এক তলার ঘরে বসে থাকত চুপচাপ। সেই অন্ধকার থমথমে মুখ দেখে মনে হত বুঝি মানুষটার বিশাল টাকা মার গিয়েছে বা কাছের কেউ হঠাৎ মারা গিয়েছেন!

আমার দাদু বা দাদামশাই ছিলেন আমার মা-র বাবা। লেখাপড়া খুব বেশি দূর করেননি। যৌবনে পা দিয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনার দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতা এসেছিলেন রুজির খোঁজে। অনেক পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে গড়ে তুলেছিলেন একটি গেঞ্জির কারখানা। সেখানে সুতো থেকে থান বুনে তা কেটে গেঞ্জি তৈরি হত। সে গেঞ্জি বাক্সবন্দি হয়ে বিক্রি হত ‘কমলালয়’ বা ‘ডোরিনা’-র মতো দোকানে। দশ-বারো জনের পরিবারের দিন চলত সেই রোজগারে।

দাদুকে কোনও দিন সিনেমা দেখতে যেতে দেখিনি, থিয়েটারও না। অথচ সে সময়টা ছিল সপরিবারে কানন দেবী, প্রমথেশ বড়ুয়া কি ভারতী দেবী, অসিতবরনের ছবি দেখতে যাওয়ার যুগ। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন মামারা এক দিন হইহই করে একটা ফিলিপ্‌স্-এর রেডিয়ো নিয়ে এল বাড়িতে। পর দিন থেকে সকাল-সন্ধে সবাই সে যন্ত্রটাকে ঘিরে বসে। যখন যা অনুষ্ঠান হচ্ছে তাই শুনছে।

দাদু বাদে। যে ঘরে রেডিয়ো, দাদু কখনও সে ঘরে পা দিলে আড়চোখে যন্ত্রটার দিকে এক বার দেখত মাত্র। কোনও দিন কোনও অনুষ্ঠান শোনার জন্য কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে মনে পড়ে না।

চান করে দাদু কখনও চুলে চিরুনি ছোঁয়াত না। হাতের নখ দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো একটু ঠিক করে নিত মোটে। ফ্যাশন বা স্টাইলের পাড়া ছিল দাদুর কাছে নিষিদ্ধ এলাকা। কোনও বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে তাঁর যত্ন করে আঁচড়ানো চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলত, ‘এঃ টেরি কেটেছে।’ ভদ্রলোক বেশি লম্বা হলে দাদুকে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে সে কাজ করতে হত। সে ভদ্রলোক বেজায় লজ্জায় পড়তেন। সপ্তাহে দু’দিন বাড়িতে নাপিত আসত দাদুর দাড়ি কামাতে। বরাবর বাড়িতে কাচা ধুতি, ফতুয়া পরে এসেছে দাদু। কখনও পাত্রী দেখতে বা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হলে পুরো-হাতা পাঞ্জাবি গায়ে উঠত দাদুর, পায়ে তালতলার চটি। বাহন ট্যাক্সি নয়, ঘোড়ার গাড়ি।

অথচ দাদু দেখতে মন্দ ছিল না। ফরসা রং, স্বাস্থ্যবান, গড়পড়তা মানুষদের ভিড়ে চোখে পড়ার কথা। কিন্তু সে সবে নয়, দাদুর নজর থাকত মাটিতে। সেখানে আবর্জনা চোখে পড়লে পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিত রাস্তার ধারে। পেছনে আমি কি সেজমামা থাকলে বলত, ‘রাস্তায় ময়লা আছে, দেখে হাঁটিস।’

তখন অনেক বাড়িতে যেমন, আমার মামার বাড়িতেও তেমনি মাটিতে আসন পেতে বসে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। মাটিতে খাওয়া ও মেঝেতে বিছানা পেতে শোওয়া— মামার বাড়ি আর আমাদের বাড়িতে একই নিয়ম। বাড়িতে খাট ছিল মোটে একটা। কখনও মেয়ে-জামাই এলে তাদের শোয়ার ব্যবস্থা হত সেখানে।

পদবি ভট্টাচার্য। দাদুর আচরণও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের মতো। চওড়া বুকে ধপধপে সাদা পইতে, একাদশীতে ফল-মিষ্টি খাওয়া, বাড়িতে খড়ম পরে চলা-ফেরা করতে দেখেছি দাদুকে। সাদামাটা জীবন। বাড়িতে খবরের কাগজ আসত একটি— দৈনিক বসুমতী। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া বই ছিল তিনটি। রামায়ণ, মহাভারত ও গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা। তুলনায় আমাদের বাড়িতে ছিল প্রচুর প্রচুর বই। বাবা শিল্পী বলে তাঁর আঁকা বই পাওয়া যেত বিনিপয়সায়, এ ছাড়া লেখকদের কাছ থেকে উপহার হিসেবেও বই আসত অনেক।

খাওয়াদাওয়া দু’বাড়িতেই এক রকম। ডালভাত, তরকারি, মাছ। কোনও কোনও দিন মাংসও আসত। অবশ্যই পাঁঠার, মুরগি আনা বা খাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। দাদুর অভ্যেস ছিল খুঁটিনাটি সব খরচ— সংসারের এবং ব্যবসার, রোজ খেরোর খাতায় লেখা। বাবা ঠিক তার উলটো। দাদু এই যে খরচের হিসেব লিখত, তার মধ্যে প্রতিদিনের কাঁচা বাজার থেকে কারও অসুখ হলে হাসপাতালের ভর্তির খরচ— কিছু বাদ যেত না। মুরগি আনা যে নিষিদ্ধ ছিল তা আগেই বলেছি, কিন্তু পাঁঠার মাংস বা অন্য রান্নার উপকরণ হিসেবে পেঁয়াজ আনতে হত। কিন্তু শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণটির ‘পেঁয়াজ’ শব্দটি খাতায় লিখতে কলম সরত না। বাজার যেই করুক— বড় কি সেজ মামা— দাদুর নির্দেশ ছিল, পেঁয়াজের জন্য খরচ হওয়া পয়সা, পোস্ত হোক কিংবা সরষে, অন্য জিনিসের দামের সঙ্গে যোগ করে দিতে হবে। কখনও এ কাজে ভুল হলে, দাদু, যে বাজার করেছে, তাকে ফর্দ ফেরত দিয়ে বলত, ‘ঠিক করে লেখো।’ সেই ব্যক্তি জিভ কাটত। কিন্তু, সে দিন হয়তো পোস্ত বা সরষে কোনওটাই আসেনি— তাই কলমি শাকের সঙ্গে পেঁয়াজের দাম যোগ করে দিত।

আয়-ব্যয়ের হিসেব লেখাটা দাদুর কাছে একটা ‘প্যাশন’ ছিল। প্রতিদিন অনেকটা সময় খরচ হত এতে। কোনও কাজ, কারও অসুখের চিকিৎসা বা বিয়ে বাবদ কত খরচ হল, তা খাতা খুলেই বলে দিতে পারত দাদু। দিদিমা যখন মারা গেলেন— আমাদের জীবনে যেন বাজ পড়ল। পর দিন প্রতিবেশীরা এসেছেন সমবেদনা জানাতে। দাদু থমথমে মুখে পাশের বাড়ির মিত্রবাবুকে বলল, ‘বাঁচানোর চেষ্টা তো করা হয়েছিল, কিন্তু বাঁচল না যে সেটাই দুঃখ। তবে খরচ তো নেহাত কম হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি থেকে কাজ পর্যন্ত আজই হিসেব করে দেখলুম খরচ হয়েছে মোট ছ’হাজার চারশো বত্রিশ টাকা...।’

আবার বাড়িতে কোনও ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করলে, তখনকার দিনে একটা বড় খবর। দাদু খেরোর খাতা খুলে লাহিড়ি কর্তাকে বলেছে, ‘পাশ করেছে আনন্দের কথা সন্দেহ নেই, তবে তার জন্যে খরচও বড় কম হয়নি। এই দেখুন না, হিসেব আমার আলাদা করে লেখাই আছে, সেই স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে আজ পাশ দেওয়া পর্যন্ত। বাড়িতে মাস্টার এসে অঙ্ক পড়াত, তার মাইনে নিয়ে খরচ হয়েছে মোট...’

এখন টাকার দাম কমতে কমতে প্রায় শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। নামী-দামি মানুষরা চুল কাটতে সিঙ্গাপুর, জুতো পছন্দ করতে নিউ ইয়র্ক ছোটেন। মোটা মাইনের বাবা তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে এত টাকা পকেট-মানি দেন যে বেচারা সব টাকা খরচ করতে পারে না। কিন্তু তখন পয়সার মূল্য ছিল আকাশছোঁয়া। বাহুল্যবর্জনই ছিল সে কালের রীতি বা ধর্ম। সুনীতিবাবুর লেখায় পড়েছি, বৈশাখের এক সকালে তিনি কাঁধে ছাতা রেখে গড়িয়াহাটের মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর বাড়ি যাচ্ছিলেন। মহানির্বাণ মঠের সামনে পৌঁছে আর এক চট্টোপাধ্যায়— শরৎচন্দ্রের দেখা পান। তাঁরও হাতে ছাতা, কিন্তু সেই ছাতা তিনি খোলেননি। সুনীতিকুমার লক্ষ করলেন, ‘শ্রীকান্ত’র লেখকের হাবভাবে একটা অন্যমনস্ক ভাব। মুখে বিষাদের ছাপ। আচমকা তাঁর স্নেহভাজনের দেখা পেয়ে শরৎচন্দ্র একই সঙ্গে অবাক ও খুশি। কথায় কথায় জানা গেল, শরৎবাবু এই মঠের কাছের এক মিষ্টির দোকান থেকে গত রাতে এক জরুরি প্রয়োজনে দুটি টেলিফোন করেছিলেন। পকেটে পয়সা ছিল না তাঁর, তাই ফোনের চার্জ বাবদ দুই-দুই চার আনা তিনি তখন মিষ্টির দোকানের মালিককে দিতে পারেননি। সকাল হতে রোদ মাথায় করে আসা ওই বকেয়া পয়সা মেটাতে। বুঝে দেখুন, জনপ্রিয় কথাশিল্পী— যাঁর বই আজও বাঙালির ঘরে ঘরে শোভা পায়, তিনি পথে বের হতেন পকেটে কানাকড়িও না নিয়ে।

মানুষ তখন হিসেব করে চলত ঠিকই। তাই বলে যে জীবনকে উপভোগ করত না, এমন নয়। তখন রাজশেখর বসু ছিলেন, ছিলেন নবদ্বীপ হালদারও। বড়দের জন্য ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, ছোটদের জন্যে টারজান। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের বসার ঘর থেকে হোহোহাহা হাসির রোল কানে এসে বাজত। না দেখলেও, বোঝা যেত, সেই জমজমাট আসরে উকিলদাদু আছেন, আছে স্কুলে পড়া নাতি, সদ্য বেথুন থেকে পাশ করা মেয়ে, আর তার বার্ড কোম্পানির চাকুরে বর। এঁদের কারও নিজস্ব বাহন ছিল না, ছিল না একের বেশি বাসস্থান। কিন্তু তাঁরা ভীষণ ভাবে বেঁচে ছিলেন।

আমার দাদুও সেই সময়ের মানুষ। মিছিলে তাঁর মুখ দেখেনি কেউ, কিন্তু আমাদের মনে তিনি রয়ে গেছেন এখনও। যখন বয়স ছিল, তখন মাঠে গিয়ে শিবদাস, বিজয়দাস ভাদুড়ীদের খেলা দেখেছেন, দেখেছেন শৈলেন মান্না-র অনবদ্য ফ্রি-কিক। মোহনবাগান জিতে তাঁবুতে ফিরলে দাদু তখনকার ও পাড়ার নিতাইয়ের বিখ্যাত কুলপি মালাই খাওয়াতেন বাড়ির সবাইকে। যে মানুষ একটি পয়সা খরচ করার আগে বার তিন ভাবতেন, তিনি সে দিন দরাজহস্ত।

এখন আমরা ক’জন বৃদ্ধ দক্ষিণ কলকাতার যে পার্কে রোজ সকালে দু’-চার পাক হাঁটি, সেখানে প্রায়ই চুনী গোস্বামীকে দেখি। আমার সাহসে কুলোয় না। না হলে মোহনবাগান-রত্নকে বলতে ইচ্ছে করে— ভাই, আজ যদি আপনাকে আমার দাদু এমন ভাবে হাতের কাছে পেতেন, তা হলে আনন্দের চোটে যে কী করতেন, কল্পনাও করতে পারি না।

কখনও আবার ভাবি, কে বলে, দাদু নেই? সময় যতই সব উলটেপালটে দিক, দাদুরা তো সেই একই থেকে যান। তাই এখনকার যে সব বড় মানুষরা রুমাল কিনতে রোমানিয়া, পারফিউম পছন্দ করতে প্যারিস পাড়ি দেন, তাঁরা যদি কখনও কলকাতার রাস্তায় হেরিটেজ-ট্রাভেলে হাঁটেন আর শেষ বিকেলে চড়কডাঙা রোড ধরে যেতে যেতে হঠাৎ দেখেন, পুরনো তিনতলা বাড়ির একতলা ঘরে কোনও বুড়োমানুষ ধ্বংসস্তূপের মতো বসে আছেন, তবে প্রথমেই ভেবে বসবেন না যেন, ইনি আজ রেসের মাঠে বাজি হেরেছেন বা বড় কাছের কোনও প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। হতেই পারে, তিনি ভেঙে পড়েছেন কারণ— আজ ময়দানে তাঁর প্রিয় দল প্রথমে এক গোল দিয়েও, পরে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কাছে তিন গোল খেয়ে মাঠ ছেড়েছে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy