আবার আসিব ফিরে
লাডেন লা রোডে, যেখানে না-ছাঁটা চা গাছ বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার তলায় এক দল সুসজ্জিত তরুণী অপেক্ষা করছে। সেন্ট অ্যান্ড্রু’জ় চার্চের পাশে থাকা সুপ্রাচীন লোরেটো কলেজ থেকে এসেছে তারা। উত্তেজিত ভাবে ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে সেন্ট জোসেফ বা গভর্নমেন্ট কলেজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। আপনি তখন মল রোড থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার উপরে নিবে যাওয়া আলোর রেখা মাখা সূর্যাস্ত দেখে ফিরছেন। অবাক হয়ে ভাবছেন ওই যে হাসপাতালের সামনে থেকে মল বা চৌরাস্তায় এগিয়ে আসছে সাত-আটশো ছেলেমেয়ের দল, হাতে তাদের মোমবাতি বা ফোনের আলো; তবে কি আবার পাহাড়ে কোনও অশনি সঙ্কেত ঘনাল?
যদি এমনটা ভাবেন, তা হলে ভুল ভাবছেন। অভিমানে যারা বাকি ভারতভূমের সঙ্গে মতপার্থক্যে প্রায়শই দূরে থাকেন, তাঁরাই বিচার চাওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছেন। অভূতপূর্ব একাত্মতায় অশুভের হাতে অকথ্য নির্যাতনের পর খুন হওয়া এক কন্যার জন্যে, আসন্ন শারদোৎসবের আগে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। মিরিক থেকে গরুবাথান, সেখান থেকে লংভিউ চা বাগান, যেখানে আমার আপনার অগোচরে অনেক দিন ধরে পারিশ্রমিক নিয়ে জোরদার আন্দোলন চলছে, সেখানেও প্রতিবাদের জন্য মিছিল বেরিয়েছে। তাদের পরোয়া নেই মূলধারার সংবাদের শিরোনামে আসার, নেতা-নেত্রী হয়ে ওঠার, এমনকি কেন তাঁরা এলেন, তার জন্য আলাদা করে কোনও ব্যাখ্যাও নেই।
সমতল থেকে চড়াইয়ের বাঁকে জবা, আম, জাম ছেড়ে আপনি পুষ্পহীন পাইন, ওক, বার্চ, চেস্টনাট, অল্ডারের মুখোমুখি হবেন। বৃষ্টিভেজা নবীন পত্রগুচ্ছ আপনাকে শারদ সম্ভাষণ জানাবে। পথের ধারে চিরাচরিত পোশাক পরা প্রৌঢ়া বুম ধরা সাংবাদিকের সামনে কড়া গলায় বলবেন, “অবশ্যই আমি প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি চাই। আমাদের মেয়েরা হাসপাতাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে হলেও তো আপনারা এ ভাবেই এগিয়ে আসবেন!” এ ভাবেই আজ শুধু কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা নয়, পাহাড় থেকে সমুদ্র-ঘেঁষা মফস্সলেও মানুষ পথে নেমেছে।
এক সময় সুবাস ঘিসিঙের আমলে দার্জিলিং পাহাড়ে পুজো হওয়া দুর্গার পোশাক নির্বাচিত হল স্থানীয় অধিবাসীদের পোশাকের অনুকরণে। আজ আসন্ন পুজোর দেবীর হাতে যেন হৃদ্স্পন্দন মাপার স্টেথোস্কোপ। রক্তের স্তূপে ছিন্নভিন্ন হয়ে থাকা আমাদের মেয়েটি যেন বলছে, অকালবোধনে আমার বিসর্জন ঘটে গেলেও আবার যেন নির্ভয়ে কোনও মায়ের কোলে আমি জন্ম নিতে পারি। হিমালয়জায়া মেনকার গর্ভ যেন আজ আমাদের গর্ভরক্ষার ডাক দিয়েছে।
কাশফুল ফোটা সন্ধ্যায়
ক্যালেন্ডার জানাচ্ছে, আর ক’দিন পরেই দুর্গাপুজো। শিউলি একটি-দু’টি ঝরছে, কিন্তু কাশফুল পূর্ণোদ্যমে তার সাদা চামর দুলিয়ে হাজির। শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ থাকার কথা এই সময়, কিন্তু বর্ষার কালো ভারী মেঘের ভ্রুকুটি থামছেই না। কোথাও জলের ছোবলে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, পাড় ভাঙছে নিয়ত, মালদহের ভূতনিতে লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। শহরেও জল গিলে নিচ্ছে দৈনন্দিন জীবন। এই উৎসব ঘিরে বহু মানুষের সারা বছরের রোজগার নির্ভর করে। মাটি ফেলে মণ্ডপ ঠিক করা থেকে প্যান্ডেলের বাঁশের জোগানদার, মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় মাটি সরবরাহকারী, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা ঢাকি, আলোকসজ্জার সাধারণ কারিগর— কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! এই সময়ের সংগৃহীত অর্থ দিয়েই শ্রমিক বাবা-মা শেষবেলায় ছোট মেয়ে ও ছেলে দু’টির জন্য ফুটপাত থেকে জামাকাপড় কেনেন। পদ্মচাষি সারা বছর জলের জোঁক তাড়িয়ে ফুল তোলার অপেক্ষায় থাকেন। দেবী সপরিবার বাবা-মায়ের বাড়ি এলে ভক্তের অঞ্জলির পাশে তাঁদের পাতেও দু’-এক টুকরো মহার্ঘ ফল-মাছ-মাংস জোটে। এঁরা পুজোয় কাজে লেগে পড়েন এ সময়ে, কিন্তু এ বারে তাঁদের মধ্যেও খানিকটা আলোড়ন। পথেঘাটে এখন আর কান পাততে হয় না। এমনিই কথা এসে পড়ে। মিস্তিরি থেকে লোকাল ট্রেনে ফেরা সাত বাড়ি কাজ সারা মেয়েটি, সবার মুখেই নানা অত্যাচার, অবিচারের কথা। একে ‘সত্যযুগ এসে গেছে’ বলে ব্যঙ্গ করার কোনও কারণ নেই। দেশ আক্রান্ত হলে যেমন সর্বদল একজোট হয়, দেশের ভিতরের সমস্যা পরে বুঝে নেবে বলে ভাবে, ঠিক সে ভাবেই ‘একমাত্র’ ঘটনার বিচার চাইছেন তাঁরা। সমস্যার পাহাড় এনে গুলিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা হচ্ছে, প্রতিবাদীরা নিজেরাও সব সময় বুঝে উঠতে পারছেন না, কিন্তু সব মিলিয়ে যে জোয়ার, তাকে ঠেকায় কে? সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি সহ্য করে এসেছিল জনগণ। ‘এ’ ভেবেছিল, ‘ওর’ সমস্যা, আমার কী তাতে? ‘ও’ ভেবেছিল, আমি তো খেতে পাচ্ছি, তা হলেই হল। ভয় কে না পায়? অপমানের ভয়, একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়, মৃত্যুর ভয়। সাধারণ, পিঁপড়ের মতো ক্ষণিক জীবনের আশঙ্কা নিয়ে আমরা যারা বেঁচে থাকি, দশপ্রহরণধারিণীর প্রতি এই জন্যই তো আমাদের এত ভক্তি, প্রার্থনা। একের হাতে যা শক্তি নেই, দশের হাতে আছে। তাই এ বারের বিষণ্ণ প্রতিমা নিজে যতই অনুজ্জ্বল থাকুন, আমাদের মনে একটা আলো জ্বলে উঠেছে, এ দেখে নিশ্চিত আশ্বস্ত হবেন।
বিপদে মোরে রক্ষা করো,এ নহে মোর প্রার্থনা
সাম্রাজ্য হারানোর ভয় শাসককে মরিয়া করে তোলে। ১৯১৯ সালের ১০ মার্চ বলবৎ করা হয় রাওলাট আইন। পঞ্জাবের অমৃতসরে ১৩ এপ্রিল ডাকা হয় প্রতিবাদ সভা। জালিয়ানওয়ালা বাগ উদ্যানে পঞ্জাবের অন্যতম বৃহৎ উৎসব বৈশাখীর দিনটি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডে। সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ থেকে পঞ্জাব জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ায় সেই সংবাদ অন্যত্র পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল স্বভাবতই। বিচলিত রবীন্দ্রনাথ গান্ধী-সহ বড় কোনও নেতাকেই পাশে পাননি। হতোদ্যম হননি তাতে। অন্তরে বিপুল বেদনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই দিনই সিদ্ধান্ত নেন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করে চিঠি লিখবেন। রবীন্দ্রনাথের ক্রোধের ভাষা যদি একটু নরম করা যায়, এমন একটা প্রস্তাব ছিল অ্যান্ড্রুজ়েরও। যথারীতি রবীন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। একক ও সাহসী প্রতিবাদের পর রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নিজের দেশেই নানা সমালোচনা শুরু হয়। সে দিন যে প্রতিবাদে কবি নিঃসঙ্গ ছিলেন, এমনটাই স্বাভাবিক আমরা ধরে নিয়েছিলাম। কোনও অন্যায়-অবিচারে কিছু অ-সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করবেন, বাদবাকি আমরা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করব বা জল মেপে যাব, এই যেন আমাদের মাথায় ঢুকে গেছিল। সংবাদে জানা যায়, প্রায় কাউকেই রবীন্দ্রনাথ পাশে পাননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীর কন্যা সরলা দেবী চৌধুরানী এই ঘটনা নিয়ে স্থানীয় ভাষায় কবিতা লিখেছিলেন। পঞ্জাবের রামভুজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। আজ দেখছি— একের পর এক লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। যাঁরা ফেরাতে পারছেন না কিছু বাধ্যবাধকতায়, তাঁদেরও কেউ কেউ পিছন থেকে সাহায্য করছেন। প্রতিটি স্তরের প্রতিটি বয়সের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমে এক জন ঠিকই বলেছেন, আগে মিছিলের জন্য লোক খুঁজতে হত। এখন মানুষ যোগ দেবে বলে মিছিল খুঁজছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ নাটকে লক্ষেশ্বর বলে, “ভারী বিশ্রী দিন! আশ্বিনের এই রোদ্দুর দেখলে আমার সুদ্ধ মাথা খারাপ করে দেয়, কিছুতে কাজে মন দিতে পারি নে।” চিরকাল এমন মন চঞ্চলের দিনে সম্রাটের দর্প উৎসবের আন্তরিকতা পণ্ড করে দেয়। ওই নাটকের সন্ন্যাসী যিনি নিজেই স্বয়ং রাজা বিজয়াদিত্য, তিনি বলছেন, “দেখো আমি কৌপীন পরে এবং গুটি কতক ছেলেকে মাত্র নিয়ে শারদোৎসব কেমন জমিয়ে তুলেছিলেম আর ওই চক্রবর্তী-সম্রাটটা সমস্ত সৈন্য সামন্ত নিয়ে এমন দুর্লভ উৎসব কেবল নষ্টই করতে পারে!”
আমরাও দেখি, যে পুজো ছিল চাঁদা তুলে বারো ইয়ারের বা বন্ধুদের, জৌলুস থাকলেও তা বিজ্ঞাপনের, জনগণের থেকে সংগ্রহের, সেখানে আমার আপনার করের টাকায় সরকারি দাক্ষিণ্য এসে গেল। ক্লাবগুলি যে প্রত্যাখ্যান করবে সে সাহসও নেই। কিন্তু একের বদলে যদি দশ হয়, ভয় ভাঙে মানুষের। রবীন্দ্রনাথেরই ‘মুক্তধারা’ নাটকে নরসিং বলে, “বাধা কত দেবে? মরতে মরতে গেঁথে তুলব”। উত্তরে বিভূতি বলে, “মরবার লোক বিস্তর চাই”। কঙ্করের উত্তর এল, “মারবার লোক থাকলে মরবার লোকের অভাব ঘটে না।” এই ‘মুক্তধারা’য় বাঁধের বন্ধন যে খুলবে, ‘তার রক্ষা নেই, বন্যায় তখনই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে’ জেনেও প্রাণ মুক্ত করার জন্যে, অবরুদ্ধ স্রোতকে অর্গলহীন করতে কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হয়। তাই স্বয়ং যুবরাজ অভিজিৎ সেই বাঁধ ভেঙে দিলেন। ‘মুক্তধারা তাঁর সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল’। এই মুহূর্তে একটি প্রাণের মূল্যে দেশের জাগরণ আমরাও দেখছি।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
বাড়ির সামনের পার্কে রোজ কোনও না কোনও ব্যানারে জমায়েত। মিছিলে বিচিত্র মানুষের, নানা পেশার, নানা বয়সের মানুষের আনাগোনা। গভীর বিস্ময়ে দেখি, ঢাকে কাঠি পড়ার সময় এসে গেলেও এ বারে কারও মনে যেন সেই ‘পুজো আসছে’ ভাবটা নেই। এক বৃদ্ধা পার্কের বেঞ্চে বসে জিরোচ্ছেন। পাশে দু’-তিনটে বিভিন্ন বয়সের ছেলেপুলে। আসন্ন দুর্গাপুজোর ফ্লেক্স টাঙানো দেখে অসহিষ্ণু কিশোরী বলে ওঠে, এই অবস্থায় পুজো করার মানে কী? আটপৌরে বৃদ্ধার উত্তরে কান পাতলে শুনতে পাবেন, তিনি খানিক আশ্বাস ও বিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলছেন, “ওই সরস্বতী হলি তোরা, লেখাপড়া গান নাচ ছবি আঁকার দেবী। আর ওই লক্ষ্মী, বাড়িতে শ্রী আনেন, অর্থসম্পদ তো বেঁচে থাকতে গেলে মানুষ চাইবে। বিপদ এলে কার্তিকবাবু দেশ বাঁচাবেন। গণেশ আছেন সব কাজে। আর ওই যে তাঁর হাতির মুখ, মানে বুনোরাও সঙ্গে থাকল পুজোর আসনে। সিংহ তো আছেই, ময়ূর থেকে ইঁদুর সবাইকে ফুল বেলপাতা ছুঁড়ে অঞ্জলি দিস তো তোরা। আর স্বয়ং মা দুগ্গা, দেবী আছেন সব অশুভকে বিনাশ করার জন্য। নানা রূপে তাঁকে আসতে হয়। মাঝে মাঝে আত্মাহুতি দিতে হয়। তার পর শিব সেই খণ্ড খণ্ড দেহ নিয়ে প্রলয় নাচেন। প্রতিকার না হলে সৃষ্টি রুদ্ধ হয়। প্রকৃতি ও প্রাণ ধ্বংস হয়...” আপনি এই প্রৌঢ়ার শিশু-ভোলানো গল্পে মুগ্ধ হতে না-ই পারেন, কিন্তু জীবনে কোনও মিছিলে পা না বাড়ানো বয়স্ক মানুষটিকে ঘামে বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষা করতে দেখে বিস্মিত হবেন অবশ্যই।
যে গার্সিয়া মার্কেসের রচনার অবিশ্বাসের বাস্তবতা বাঙালিকে চিরচমকিত রেখেছে, ওয়েব সিরিজ়ের হাড় হিম প্লটে যার দিনপ্রতি স্ক্রিনটাইম আট ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, সেও অবাক হয়ে দেখছে, আর জি করের ঘটনায় কী রকম নিশ্ছিদ্র এবং জটিল প্লট বোনা হচ্ছে। সমুদ্র উত্তাল, সুনামি স্রোতে সত্য-মিথ্যে গুলিয়ে যাচ্ছে। জনতা এত দূর উত্তেজিত যে, এত দিন ক্ষমতার আশেপাশে থাকা সুযোগসন্ধানী মানুষগুলিকে সামনে পেলেই তীব্র ভাবে আঘাত করছে। কেন এমন হচ্ছে ভাবতে গেলে উত্তর পেয়ে যাবেন সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম থেকে প্রমাণ মুছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা এবং সেটি প্রায় জনগণের চোখের সামনে, নাকের ডগায় বসেই। এই অপরিসীম অহঙ্কার, তীব্র আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত ঘৃণা আছড়ে পড়বেই। ভয় এক বার ছিন্ন হলে তাকে হুমকি দিয়ে, লোভ দেখিয়ে দমন করা কঠিন। ছেঁড়া-ফাটা নানা বিষে জর্জরিত ভারতের একটাই জিনিস আছে। ভিতরে প্রোথিত গণতন্ত্রের বোধ। তাই অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাতাদেরও জনগণের ভোটে হেরে যেতে হয়।
সাদা অর্কিডের দেশে
খারসং, কার্শিয়াং নামের মানে নাকি ‘ল্যান্ড অব হোয়াইট অর্কিড’। এই পাহাড়ের দুর্গাপূজার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। তিনধারিয়ায় রেলবাবুদের উদ্যোগে যে দুর্গাপুজো হত, এখন তা স্থানীয় জনগণের পুজো। কার্শিয়াংয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বাঙালিদের সঙ্গে বা পাশাপাশি নেপালিরা পুজোয় যুক্ত আছেন। চল্লিশের দশকের দুর্গাপুজোর এমন বর্ণনা পাই কল্যাণী হালদারের ‘স্মৃতির মালিকা’ বইয়ে— “কয়েকবার পুজোর সময় ছিল খুব সকালে। রাত তিনটায় বসাক মাস্টারমশাই এক হাতে লন্ঠন অন্য হাতে লাঠি (তখনও নির্জন,জীবজন্তুর ভয়) মুখে হরি নাম। চলেছেন নয়া কামান রেল কলোনি থেকে রাজেশ্বরী হল (যেখানে দুর্গাপূজা হবে) মহিলাদের রক্ষক হয়ে। পূজা মণ্ডপে এত রাত্রে মেয়েরা আসবে একা একা? তা কি হয়? স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব মাস্টারমশাই প্রাণবল্লভের।”
পুজোর আগে-পরের কত না গল্প! “মহালয়ার দিন ভোরের শিলিগুড়িতে প্রতিমা আনতে যাওয়া। পুজোর উপকরণ সহ প্রতিমা নিয়ে ফিরতে কখনো রাত ১২টা হয়ে যায়। পাহাড়ি পথের ট্রাকের মধ্যে বালি বিছিয়ে ওই ভারী প্রতিমা ধরে বসে আসা সহজসাধ্য নয়”— সে আমলেই কার্শিয়াং এলাকা জুড়ে কত না পুজো। সুবিখ্যাত মকাইবাড়ি, কার্শিয়াং টিবি স্যানাটোরিয়াম, ডাওহিল ভিক্টোরিয়া ফরেস্ট তিনের সংযুক্ত পুজো, অম্বোটিয়া ফাটক, গুর্খা লাইব্রেরি। লেখিকা জানাচ্ছেন, “সেখানে ওঙ্কারনাথের শিষ্য ভার্মাজির খেয়াল আঙ্গিক ভজন শোনা থেকে মেয়েরা করেছিলেন চা খাবারের স্টল, হাতের কাজের প্রদর্শনী।”
সেখানেও চলছে মানববন্ধন। আলো নিবিয়ে মোমবাতি মিছিল। আজ প্রাক্-পুজোর কেনাকাটার সময় হাতে রংবাহারি ছাতা এবং পরনে সাম্প্রতিক ফ্যাশনের পোশাক, তীব্র তরুণ বা তরুণীটি আপনাকে জোর গলায় বলবে, “আমরাও ওই আন্দোলনে আছি। হ্যাঁ, পুজো হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখার জন্য টান-টান বসে আছি আমরা।” আজকাল ওই সাদা অর্কিডের দেশে লালিগুরাস বা লাল রডোডেনড্রনের প্রকোপ বেশি। যে কোনও আন্দোলনেই তাদের নাছোড় অবস্থান আমরা দেখেছি। এ বছর ধসে বিপর্যস্ত কালিম্পংগামী জাতীয় দশ নম্বর জাতীয় সড়ক। তিস্তার খাত উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে এক দিনের বৃষ্টিতেই কিছু দিন বাদে বাদে জলের তলায়। প্রাণ হাতে করে সেই এলাকা থেকেও এ দিক-ও দিক জমায়েতে গেছে অনেকে। এই ধস-বিধ্বস্ত, তিস্তা-প্লাবিত এলাকায় গত বছর থেকেই নমো-নমো করে পুজো সারা হয়। এ বারেও হয়তো সেখানে ছোট্ট কোনও চালার নীচে দেবী আসবেন। ঝোরার ধারে বিসর্জনের কাঠামো পড়ে থাকার আগে অবধি এলাকাবাসী মণ্ডপে বসে থাকবেন। তবে অবধারিত ভাবেই তাদের চর্চায়, বিচারের আশায় থাকবে সুদূর বঙ্গ-রাজধানীর এক নির্যাতিত কন্যা।
শুরুর শুরু
বয়স বাড়তে থাকলে মেয়েদের ঘাড়ের অস্থি ও স্নায়ুঘটিত সমস্যা আসে। কারণ ব্যাখ্যা করতে হরমোন-জনিত প্রাকৃতিক ক্ষয়ের বাইরেও আর একটি কথা বলেছিলেন প্রখ্যাত ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট। বাড়ির বাইরে রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে আড্ডারত ছেলেদের দলের সামনে দিয়ে যেতে হত তাকে। উড়ে আসত তার স্বাস্থ্য শরীর এবং গঠনের ত্রুটি নিয়ে যৌনগন্ধী ও ব্যঙ্গাত্মক শব্দ ও বাক্যবাণ। বালিকা থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় অবশ্যম্ভাবী শারীরিক পরিবর্তন ঢাকার জন্য ক্রমাগত আঁচল, ওড়না টানা, হাত দু’টি দিয়ে আড়াল করার পরেও ঘাড় ঝুঁকিয়ে অধোবদনে চলাফেরা করত মেয়েটি। এই যে কৌতূহলী ও লোলুপ চোখের সামনে দিয়ে তার চলাফেরা, তাতেই মেয়ে হওয়ার অস্বস্তিতে ঝুঁকে যেত সে। ফলে একটু বয়স হতেই ঘাড়ের সমস্যা। ডাক্তার বললেন, মেয়েদের এই অস্বস্তি থেকে ঝুঁকে বসার জন্য বেশি বয়স হলে পিঠে ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয়। এই মেয়েরা বাড়িতে শুনছে, দিনকাল ভাল নয়, সাবধানে বেরোও, দেখেশুনে ফিরো। বাইরে ভিড়ের ভিতর সুযোগ বুঝলেই নিষ্পেষণের অপমান, তুলনায় কম অপরাধের মতো ইঙ্গিতময় গানের কলি। মেয়েটি পথে বাসে ট্রেনে কোনও সময় অন্যমনস্ক থাকতে পারে না। মনে মনে মেয়েটি যে ক্লাসের পড়াশোনা ঝালিয়ে নেবে, কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার হিসাবগুলো মনে মনে সাজাবে, এমনটা হবে কী ভাবে? গণপরিবহণে যাতায়াত করতে গেলে তাকে তখন শরীর বাঁচিয়ে চলার কথাই মাথায় রাখতে হয়। সে যে তখন তার অধীত বিষয়ের ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার নতুন কোনও ত্রুটির কথা ভাবতে পারবে বা অস্থিবিদ্যায় মনোনিবেশ করবে বা কবিতার টুকরো কথাগুলি মনে মনে সাজাবে বা নিছকই ঢুলে পড়তে পারবে— এমন তো হওয়া সম্ভব নয়। যে অপরাধে প্রতিবাদী ছেলেটিকে পাঁচতলা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, অথবা মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়, ঠিক সেই অপরাধে তাকে গুলি করে না মেরে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে মনে করে ছিন্নভিন্ন করা হয়। মেষপালকদের শিক্ষা দিতে তাদের অবোধ বালিকাটিকে দিনের পর দিন মন্দিরে রেখে পুরোহিত ও সঙ্গীর দল ধর্ষণ করে। পুরুষ-প্রাধান্যের সমাজ এই মেয়েটির মতো আরও অনেক মেয়েকে তার অজান্তে ঘাড় ঝুঁকে আসার হাড়ের অসুখ ধরিয়েছে।
যতই দেবীপূজা করি, রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতা। আক্রান্ত নারীর উপর অপরাধের দায় আরোপ করে হাঁপ ছাড়ে সমাজ। মেয়েটিও অস্বস্তিতে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। আর চোর কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হয়ে ওঠে। প্রার্থনা, এ বার পুজোয় মেয়েটি যেন দেবী দুর্গার মতো সতেজ ভঙ্গিতে, বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে। আঁচল আর ওড়নার আড়ালের যেন আর দরকার না পড়ে তার।
জাগরণ হেমবর্ণ
আজ আপনাদের এক অলৌকিক গল্প বলতে এসেছি আমরা। কাশফুল ফোটা সন্ধ্যায় যেন এমন খোয়াবেই মন যায়। কলকাতা ছাড়াও ওই যে মেদিনীপুর বাজারে জমায়েত দেখছেন, বীরভূমের কঙ্কালীতলায়, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নৈহাটি, শেওড়াফুলি আর সুদূর উত্তরে অসম ছোঁয়া বারবিশা আর ডুয়ার্স ছুঁয়ে নবীন শিলিগুড়ি, প্রাচীন জলপাইগুড়ি— উত্তরে বর্ষা আর হিম ঠান্ডার পর্বত-শহর-গ্রাম সব মিলে গেল একটি নামে, একটি স্লোগানে। স্বাধীনতা আন্দোলন দেখিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংগঠিত মিছিল বাদে এমন গণজাগরণ এ দেশে দেখিনি কোথাও। সবার মুখে ওই একটিই কথা, তিলোত্তমা, তোমার বিচার চাই।
আপনার চার পাশে এখন যেন এক রকম দৃশ্য। শেষ বিকেলে যে কাজের মেয়েটি এসে ঘণ্টাচারেক থেকে যেত, সে তার রুটিন বদলে ফেলেছে। তার টিউশনে যাওয়া মেয়ে এত দিন একাই যাতায়াত করত। এখন মা তাকে দিতে যায়, নিয়ে আসে। এক নবীন কীর্তনসম্রাট নানা ভাবে বৈষ্ণব তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। আপনি দেখতে পাবেন, দু’হাত তুলে হরিবোল ধ্বনিতে ভাবাবেগের প্রারম্ভে তিনিও সংসারে দেবতা এবং চিকিৎসককে এক আসনে বসিয়ে বিচার চাইছেন। পাড়ার ফুচকাওয়ালা শহর ছেড়ে দূরে একটা আস্তানা গড়ার জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। তিনি বললেন, অতিরিক্ত খরচা করে শহরের মধ্যে সদর্থেই এক ফালি জমি নিলেন। যদি বলেন, “এখানে তো কোনও দিন প্ল্যান পাস হবে না। কিনলেন কেন?” উত্তরে শুনবেন, “ঝুপড়ি করে থাকব। চাই নে বাবা পাকা ঘর। মেয়েটা ঘিঞ্জি এলাকায় সবার চোখের সামনে যাতায়াত করবে।” বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষেরা মিছিলে এলেন। কোনও কোনও যৌনকর্মী বললেন, দুর্গাপূজার সূচনার প্রয়োজনীয় মাটি তারা দেবেন না। ভিন্ন যৌনতার মানুষগুলি একের পর এক মিছিল করলেন। কবে আমরা সংখ্যাগুরুর পাশে সংখ্যালঘুদের এমন ভাবে একত্রিত হতে দেখেছি?
পূজোর উদ্যাপন অবশ্যই হবে, কিন্তু বিষণ্ণতা একটা কুয়াশা মশারির মতো ঢেকে রাখবে আমার আপনার মনের শুভ উৎসব। নিজের জীবনের বিনিময়ে একটি মেয়ে যেন কোটি মানুষের হৃদয় জুড়ে দিয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের মানসিক নৈতিক অবক্ষয় ঢাকের চড়াম চড়াম শব্দে ধসে তলিয়ে গেছে, এমনটাই স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিয়েছিলাম। আশৈশবের মূল্যবোধ, শিক্ষা যেন নিজের কাছে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হচ্ছিল। ল্যাম্পপোস্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসি অবধি কিনে নিচ্ছিল স্পর্ধার আমিত্ব। আমরা যারা প্রতিদিনের অন্যায় দেখে চুপ করেছিলাম, তাদের জন্যেই বোধহয় লেখা হল—
“আসলে তো মনে মনে বলি, ঠাকুর, এটুকু দেখো
আমাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যেন না হারায়
দেখো এঁটোকাটা ঠিক যেন জোটে
আসলে তো বলতে চাই, কোথাও কিছু হয়নি,
ওই মেয়েটিই আসলে গুজব—”
(অনিমিখ পাত্র)
সমস্ত গুজবকে ভুল প্রমাণিত করে প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাক। এই আসন্ন শারদ উৎসবের প্রারম্ভে এ ছাড়া আর কী-ই বা চাইতে পারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy