দু র্গাপুজোকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়াটা একটা বিশেষ দায়িত্ব বলে আমাদের মনে হত। কেন না তখন টেলিভিশন চ্যানেল বলতে তো শুধু দূরদর্শনই। সামান্য যন্ত্রপাতি, গুটি কয়েক ক্যামেরা, কিন্তু যেটার অভাব ছিল না তা হল কর্মীদের উৎসাহ। সেটাকেই পুঁজি করে, বাঙালির এই সবচেয়ে বড় আর আশ্চর্য সুন্দর উৎসবকে সব দিক থেকে তুলে ধরার পরিকল্পনা করা হত। একটু একটু করে কী ভাবে পুজোর হাওয়া উঠছে, প্রতিমা নির্মাণ, কুমোরটুলির ব্যস্ততা, প্যান্ডাল তৈরি, পুজোর নতুন ফ্যাশন, খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো, পুজোর অর্থনীতি, উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য, পুজোর আচার-পদ্ধতি, এ-সব নিয়ে আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান হত। খুব গুরুত্ব পেত শারদ সাহিত্যের দিকটি। বেশ ক’দিন ধরে পর্বে পর্বে হত শারদ সাহিত্যের অনুষ্ঠান।
পুজোয় ঘরে বসে দর্শকরা যাতে পুজো দেখতে পারেন, সে জন্য প্রথম বছর থেকেই শুরু করা হয় ‘পূজা পরিক্রমা’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের এখন যা চেহারা তা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব যেহেতু প্রথম থেকেই আমার ওপর পড়েছিল, তাই মনে পড়ে, একটু একটু করে কী ভাবে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুজো পরিক্রমা আজকের চেহারা পায়। প্রথম বছর শুধু বিভিন্ন দেবীপ্রতিমার ছবি দেখানো হয়েছিল, আর বলে দেওয়া হয়েছিল কোনটা কোন কমিটির পুজো। তাতে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বলে পরের বছর তার সঙ্গে জুড়লাম ঢাকের বাদ্যি, মিউজিক। ধারাভাষ্য দিয়ে ভাল ভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলাম বিভিন্ন পুজো আয়োজনকে। আস্তে আস্তে সংযোজিত হল পুজো-আয়োজক ও দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে সরাসরি সম্প্রচার। প্রথম থেকেই শুধু কলকাতা নয়, বাইরের বিভিন্ন শহর, গ্রামের পুজোও দেখানো হত। বনেদি বাড়ির পুজো, প্রাচীন পুজো, বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস, পুজোর ক্রমবিকাশ ক্রমে সংযোজিত হতে লাগল। এল বেলুড় মঠ থেকে সরাসরি দুর্গাপুজো দেখানোর রীতি, গঙ্গার ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন ‘লাইভ’ দেখানোর ব্যবস্থা। রাজ্য ছাড়িয়ে ভিন রাজ্যের পুজো, বিদেশের পুজোও দেখানো শুরু হয়। প্রাইভেট চ্যানেলগুলো যখন এল, তারা টিভিতে দুর্গাপুজোর মতো এত বড় একটা উৎসব দেখানোর তৈরি ফরম্যাট হাতে পেয়ে যায়। বহু টিভি চ্যানেলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুজো কভারেজ এখন ব্যাপক এক আয়োজন। কিন্তু মূল ফরম্যাট তৈরি করে দিয়েছে দূরদর্শনের ‘পূজা পরিক্রমা’ অনুষ্ঠান। পুজো আয়োজন কী ভাবে একটু একটু করে বদলে গেল, এল ‘থিম পুজো’র সংস্কৃতি, তা আমাদের বিভিন্ন বছরের ‘পুজো পরিক্রমা’ অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়েছিল। আক্ষেপের বিষয়, এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইতিহাস আর্কাইভ করা হয়নি। টেলিভিশন আসার পরেই দুর্গাপুজোর মতো এত বড় একটা সামাজিক ঘটনাকে অডিয়ো-ভিস্যুয়ালি দেখানোর সুযোগ আসে। যা রেডিয়ো বা খবরকাগজ পারেনি, তা সম্ভব করে তুলেছিল দূরদর্শন। কিন্তু সে ইতিহাস সংরক্ষণের কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই গড়ে ওঠেনি। তাই কিছুই আর ধরা নেই।
দুর্গাপুজোর পরেই আলোর উৎসবের কথা মনে পড়ে। কালীপুজো, দীপাবলিকে আমরা প্রথম থেকেই খুব গুরুত্ব দিয়েছি। ‘অল সোল্স ডে’— খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এই পার্বণটিও এক অর্থে আলোর উৎসব। ‘অল সোল্স ডে’ আমাদের অনুষ্ঠানে বিশেষ গুরুত্ব পেত, তার কারণ, এই দিনটির এক মূল আয়োজনস্থল টালিগঞ্জ সেমেট্রি ছিল আমাদের কেন্দ্র রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োর সামনেই। টালিগঞ্জ সেমেট্রি কলকাতার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সমাধিভূমিগুলির মধ্যে বড় ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সমাধিস্থল। সকাল থেকে দূরদর্শন কেন্দ্রের গেটের সামনেটায় যেন মেলা বসে যেত। ফুল, মোমবাতি, ধূপকাঠি বিক্রি হত। পরলোকগত আত্মীয়-পরিজনদের স্মরণ করার এই বিশেষ দিনটিতে খ্রিস্টধর্মের মানুষরা নানা প্রান্ত থেকে আসতেন, ফুল দিয়ে সাজানো হত সমাধি। কত বিষাদ, স্মৃতির সাক্ষীই না থাকতাম আমরা। সে-সব ক্যামেরায় ধরা হত। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে সারি সারি মোমবাতি জ্বলে উঠত, ধূপের সুঘ্রাণ। নীরব, স্মৃতিকাতর মানুষেরা পৃথিবী ছেড়ে চলে-যাওয়া তাঁদের প্রিয়জনদের স্মরণে দীপ জ্বালতেন, এক আশ্চর্য আলোর উৎসব পালিত হত। হাওয়ায় আন্দোলিত মোমবাতির শিখা যেন বলত, তোমাদের ভুলিনি। এমন নীরব আলোর পার্বণ আমরা আর দেখিনি। ‘অল সোল্স ডে’ পালনের ছবি তুলে ধরতে পেরে আমাদের অন্য রকমের তৃপ্তি হত।
দীপাবলির আয়োজনে দেখানো হত, ঘরে ঘরে মাটির প্রদীপ তৈরি হচ্ছে, সলতে পাকানো হচ্ছে। কালীপুজোর রাতে সার সার সেই সব প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হবে। বাড়ির খুদে সদস্যরা খুব উৎসাহে ক্যামেরার সামনে বলত, কে কতগুলো প্রদীপ নিজের হাতে তৈরি করেছে। একটু একটু করে সে-সব বদলে যেতে লাগল। মাটির প্রদীপের বদলে এল মোমবাতি, পরে টুনি বাল্ব-এর রাজত্ব, তার পর কখন যেন ঢুকে পড়ল চাইনিজ লাইট। অবিশ্বাস্য কম দামের এই চাইনিজ লাইট আর দীপাবলির রাত, দুটো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আমাদের নানান অনুষ্ঠান ও কভারেজের মধ্যে আলোর উৎসবে এই আলো দিয়ে সাজানোর ধরনধারণের পরিবর্তন চিত্রিত হয়েছে বছরের পর বছর, কিন্তু সে-সব ছবি রক্ষিত হয়নি। নয়তো আগামী প্রজন্ম দেখতে পেত, আমাদের এই আলোর উৎসবের পুরনো গতিপ্রকৃতি।
আলোর উৎসবের কথা বলতে বসে মনে পড়ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের শবে বরাত উদ্যাপনের কথা। শবে বরাতও তো আলোর উৎসব। খুব উৎসাহ নিয়ে শবে বরাত-এর অনুষ্ঠান করত সহকর্মী তহমিনা বেগম। বিশ্বাস করা হয়, অতীতের কাজের বিচার করে শবে বরাত-এর রাতে প্রতিটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয় আগামী বছরের জন্য। এই রাতে পরলোকগত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে আলো জ্বালানো হয় তাঁদের দোয়া চেয়ে, জান্নাতে তাঁরা শান্তিতে থাকুন, এই কামনায়।
ইহুদি সম্প্রদায়ের খুব জনপ্রিয় উৎসব ‘হানুকা’ও আলোর উৎসব। যখন বিবিসি লন্ডনে ছিলাম, তখন আমার অনেক ইহুদি বন্ধু ছিল। ‘হানুকা’ উৎসবে তাঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন। ়বিবিসি টেলিভিশনের বিখ্যাত নিউজ প্রোডিউসার সুজান বাওয়ার্স-এর বাড়িতে হানুকা উৎসবে যোগ দিয়ে, ইহুদিদের টুপি মাথায়, ডিনারের আগে সমবেত ভাবে হিব্রুতে প্রার্থনার কথা খুব মনে পড়ে। ডিসেম্বর মাসে আট দিন ধরে চলে হানুকা উৎসব। আটটি রাতেই একটা করে মোমবাতি জ্বালানো হয়, বিশেষ ইহুদি মোমদানি ‘হানুক্কিয়া’য়। এই মোমদানি উপহারও পেয়েছি ইহুদি বন্ধুদের কাছ থেকে। হানুকা হিব্রু শব্দ, যার অর্থ উৎসর্গ। কলকাতা দূরদর্শনে শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত হানুকা উৎসব নিয়ে এক বার বিশেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন। কলকাতায় ইহুদি সম্প্রদায়ের অল্প যে ক’জন মানুষ আছেন, তাঁরা নিউ মার্কেটে ইহুদিদের বিখ্যাত এক কেকের দোকানের মালিকের নেতৃত্বে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
একটা খুব সুন্দর রীতি ছিল, কার্ত্তিক মাসে পূর্বপুরুষদের আলো দেখানোর জন্য আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হত। উত্তর, দক্ষিণ কলকাতা ঘুরে কত রকম আকাশপ্রদীপের ছবি যে আমরা তুলে আনতাম দর্শকদের জন্য! এখন কলকাতায় আকাশপ্রদীপ তো প্রায় দেখাই যায় না। এক বার একটা বিশেষ অনুষ্ঠান করেছিলাম এ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের আকাশপ্রদীপ কাব্যগ্রন্থের কবিতার অংশ ‘অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ-পানে—/ যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে’ ব্যবহার করা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। আকাশে নানা রকম আকাশপ্রদীপের শট একটার পর একটা ডিজল্ভ্ করা হচ্ছে আর তার সঙ্গে বাজছে জনপ্রিয় গান ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’।
pankajsaha.kolkata@gmail.com