Advertisement
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সাদা কালো কান্নার দাগ

তা র যে জলজ্যান্ত একটা পিসি আছে, দু’দিন আগেও আনা সেটা জানতই না। তার নামটাও যে আসলে আনা নয়, ইডা লেবেনস্টাইন, সেটাও তো সে একটু আগে, পিসির বাড়িতে বসেই জানল! জ্ঞান হওয়া ইস্তক খ্রিস্টান মিশনারিদের অনাথ আশ্রমেই বড় হয়েছে মেয়েটা। সে কী করে জানবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মরে যাওয়া তার বাবা-মা আসলে ইহুদি ছিল!

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:২৬
Share: Save:

তা র যে জলজ্যান্ত একটা পিসি আছে, দু’দিন আগেও আনা সেটা জানতই না। তার নামটাও যে আসলে আনা নয়, ইডা লেবেনস্টাইন, সেটাও তো সে একটু আগে, পিসির বাড়িতে বসেই জানল! জ্ঞান হওয়া ইস্তক খ্রিস্টান মিশনারিদের অনাথ আশ্রমেই বড় হয়েছে মেয়েটা। সে কী করে জানবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মরে যাওয়া তার বাবা-মা আসলে ইহুদি ছিল! হঠাৎ কনভেন্টের ‘মাদার সুপিরিয়র’ বললেন, সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে বাড়ির লোকের কাছে অনুমতি নিতে হবে। আর কী আশ্চর্য, ১৭ বছর বয়স অবধি যে নিজেকে অনাথিনীই জেনে এল, এই ১৮-র দোরগোড়ায় তারও একটা আত্মীয় জুটে গেল! ঠিকানাটা চার্চ থেকেই দিয়েছিল। নম্বর মিলিয়ে দরজার বেল বাজাতেই যে মহিলা এসে দোর খুুললেন, তাঁর ভেতরের শোওয়ার ঘরে একটা মাঝবয়েসি লোক তাড়াহুড়ো করে শার্টের বোতাম আঁটছে! এই মহিলাই ওয়ান্ডা গ্রুজ। আনা, থুড়ি ইডা-র পিসিমণি। একটা সিগারেট ফুরোতে না ফুরোতেই পরেরটা ধরান, পাব-এ বসে পেগের পর পেগ ভদকা উড়িয়ে দেন।

ওয়ান্ডা এক সময়ের ডাকসাইটে কমিউনিস্ট নেত্রী। কমিউনিস্ট আদালতের বিচারপতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ‘নাশ’ করেন। তবে সম্ভবত পার্টির ভেতরকার কোনও সমীকরণের জন্যই এখন, এই ষাটের দশকের গোড়ায় তাঁর ক্ষমতার লালিমা একটু ফিকে। বেচারা জনগণ স্বপ্নেও যার নাগাল পাবে না, পার্টির নেতা-নেত্রীদের জন্যেই যে সুখটান সংরক্ষিত, নামী ব্র্যান্ডের সেই দামি বিদেশি সিগারেট হয়তো এখনও জুটে যাচ্ছে, তবে হাতে মাথা কাটার দাপটটা আর নেই। তবু এই ওয়ান্ডাপিসিই তো ইডার জীবনে ‘আজ’ আর ‘কাল-পরশু’র মাঝখানে একমাত্র যোগচিহ্ন। তাই পিসির সঙ্গেই ইডা তার ‘পরিচয়’ খুঁজতে বেরোয়। জানতে চায়, বিশ্বযুদ্ধের আঁধারে তার বাবা-মা’র হারিয়ে যাওয়ার রহস্য-কাহিনি!

পিসি-ভাইঝির এই অদ্ভুত অভিযানে কট্টর কমিউনিস্ট নেত্রী যখন ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করেন, কখনও ‘পাপ’ করতে ইচ্ছে হয় কি না, আর আজ বাদে কাল যে সন্ন্যাসিনী হবে, সেই ইডা দু’গালে টোল ফেলে মিষ্টি–লাজুক হাসে, আশ্চর্য সহজ একটা মানবিক মুহূর্ত তৈরি হয়ে যায়। ছবির এই আপাতসরল চলনটাই হয়তো কিছু কিছু ভুল বোঝার সুযোগও তৈরি করে দেয়। কেউ বলতেই পারেন, এ ছবিতে না‌ৎসি হানাদারদের বীভৎসতা বা কমিউনিস্ট জমানার হৃদয়হীনতার কথা সে ভাবে নেই। কারও আবার মনে হচ্ছে, এ ছবিতে খ্রিস্টান পোলিশদের ভয়ানক ইহুদি-বিদ্বেষী, নাৎসি-বাহিনীর সহযোগী করে দেখানো হয়েছে! কিন্তু পরিচালক আসলে কোনও মন্তব্যই করেননি। শুধু ’৬০-এর শৃঙ্খলিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ পোল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ’৪০-এর যুদ্ধ-উন্মত্ত সময়ে ঘটে যাওয়া একটা পারিবারিক-ট্র্যাজেডির গায়ে ভালবাসার হাত রাখতে চেয়েছেন।

তাই ইহুদি ইডাদের আশ্রয় দেওয়া যে পোলিশ লোকটা ইডার বাবা-মা আর ওয়ান্ডার ছোট্ট ছেলেটাকে খুন করে জঙ্গলে পুঁতে দিয়েছিল, আর ইডাকে অনাথ আশ্রমে জমা করে এসেছিল, তাকে ইডা ও পিসি শেষ অবধি ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু ইডা আর ওয়ান্ডার জীবনটাও আর কিছুতেই আগের মতো থাকে না। থাকতে পারে না। কারণ তাদের ছোট্ট পরিবারের গল্প তত ক্ষণে একটা গোটা দেশ-সময়-ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হয়ে উঠেছে। সময়ের ছাপ স্পষ্ট করতেই গোটা ছবিটা সাদা-কালোয় তৈরি। ফ্রেমিংয়েও ষাটের দশকের পোলিশ সিনেমার টেকনিক। ছবিতে অনেক দূর অবধি আলাদা করে কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নেই। কিন্তু অতীতের ক্ষতচিহ্নগুলোকে নিজেদের হাতে ছুঁয়ে আসার পর নাস্তিক কমিউনিস্ট ওয়ান্ডা আর ঈশ্বরের শরণাগত মিশনারি ইডার বেঁচে থাকার মানেটাই যখন উলটেপালটে যেতে থাকে, সাউন্ডট্র্যাকে প্রথম বার বেজে ওঠেন বাখ। সময়ের গোপন কষ্ট, চাপা কান্না ছবির শরীর বেয়ে উপচে পড়ে।

sanajkol@gmail.com

অন্য বিষয়গুলি:

eda film poland shantanu chakroborty communist leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy