Advertisement
E-Paper

ফার্স্ট পারফেক্ট টেন

করে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিলেন নাদিয়া কোমানেচি। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি। চিরঞ্জীব চোদ্দো বছরের একটা মেয়ে স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে মাতবে, আড্ডা দেবে এবং খেলাধুলো করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! মেয়েটা মাতল খেলাধুলো নিয়ে। তবে এমন মাতল যে ওই বয়সেই অলিম্পিক্সে সোনার মেডেল।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০

চোদ্দো বছরের একটা মেয়ে স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে মাতবে, আড্ডা দেবে এবং খেলাধুলো করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! মেয়েটা মাতল খেলাধুলো নিয়ে। তবে এমন মাতল যে ওই বয়সেই অলিম্পিক্সে সোনার মেডেল। সেই সঙ্গে বিশ্ব রেকর্ড। জিমন্যাস্টিক্সে অমনটা করা যেতে পারে, সেটা আগে কখনও কেউ ভাবেনি। চার ফুট এগারো ইঞ্চির রোমানিয়ার কিশোরী নাদিয়া কোমানেচির সেই অভাবনীয় কীর্তি চমকে দিল গোটা দুনিয়াকে।

১৯৭৬-এর মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক্স। স্কোরবোর্ড বানানোর আগে ওমেগা কোম্পানি আয়োজকদের জিজ্ঞেস করে, জিমন্যাস্টিক্সে চার ডিজিটের স্কোরবোর্ডের দরকার আছে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘প্রশ্নই নেই। জিমন্যাস্টিক্সে পারফেক্ট টেন বা দশে দশ কেউ করতে পারবে না। ওটা অসম্ভব ব্যাপার।’ সে দিন কী ভুলটাই না তাঁরা ভেবেছিলেন।

১৯ জুলাই রাত। হর্স ভল্ট, আনইভেন বারস, ব্যালান্স বিম, ফ্লোর এক্সারসাইজ— কী করছে মেয়েটা? সবটাই পারফেক্ট! কারও হাত আর শরীর এতটা নমনীয় হতে পারে? একটা বাচ্চা মেয়ের এতটা ভারসাম্য রাখার ক্ষমতা? স্কোরবোর্ড অবশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত করেছিল। চার ডিজিটের স্কোরবোর্ড তো বানানো হয়নি, হয়েছিল তিন ডিজিটের। তাই, তাতে নাদিয়ার নামের পাশে ফুটে উঠল ১.০০। সবাই তো থ। লাউডস্পিকারে ঘোষণা, ওটা ভুল, নাদিয়া কোমানেচি আসলে পারফেক্ট টেন করেছে। অলিম্পিক্সে তার পরেও কয়েক বার পারফেক্ট টেন হয়েছে। কিন্তু আর কোনও বার নাদিয়া কোমানেচি হয়নি।

১৯৮৩-র মাঝামাঝি সেই নাদিয়াকে প্রথম বার সামনাসামনি দেখা। মস্কোয় আমন্ত্রিত সাংবাদিক হয়ে গিয়েছি ওদের জাতীয় ক্রীড়া বা স্পার্তাকিয়াদ দেখতে। এক সকালে মস্কোর স্পোর্টস ইনস্টিটিউটে গিয়েছি আমাদের দেশের প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন হার্ডলার, মস্কোয় কোচেদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া মনজিৎ ওয়ালিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। মনজিতের সঙ্গে কথা বলে আসার সময়ে দেখি, স্প্রিন্টার বা স্বল্প দূরত্বের কিংবদন্তি দৌড়বাজ ভ্যালেরি বোরজোভ ১০০ মিটার দৌড়ের স্টার্ট দেখাচ্ছেন ভিন্ দেশ থেকে আসা কয়েক জন কোচকে। তাঁদের মধ্যে দেখি, সুন্দরী এক তরুণী। গায়ে আকাশি রঙের ব্লেজার। ওঁর আশপাশে দেখলাম কয়েক জন সোভিয়েত জিমন্যাস্টকে।

আমার সঙ্গী, রুশি সাংবাদিক বন্ধু আরমেন খাচাতুরিয়ান ওই তরুণীর দিকে আমার এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা দেখে শুধোলেন, ‘একে চিনতে পারছ তো?’ বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে মনে হচ্ছে এই মুখের সঙ্গে আমি পরিচিত। আরমেন এ বার বললেন, ‘মনে করে দেখো, মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক্স, তখন ওর ১৪ বছর...।’ আরমেনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম, ‘নাদিয়া, নাদিয়া কোমানেচি!’ পত্রপত্রিকায় বেরোনো ছবি আর টেলিভিশনে দেখা সেই চোখ, নাক— কিছুই তেমন বদল হয়নি। তবে মুখটা সামান্য ভরাট। কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট ওই ২১ বছর বয়সেই অবসর নিয়ে ফেলেছেন। তখন তিনি রোমানিয়ার জিমন্যাস্টদের কোচ। এ বার আরমেনকে অনুরোধ করি, প্লিজ একটু দেখো না, ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ওখানে তখন আর কোনও সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী নেই। আরমেনের উদ্যোগে আবেদন মঞ্জুর হল। পরিচয় হওয়ার পর নাদিয়ারই প্রথম প্রশ্ন, ‘ইন্ডিয়া?’ আমাদের দেশের কথা নাদিয়ার জানা ছিল না। রুশি সাংবাদিক বন্ধু ওঁকে বলেন, ‘অলিম্পিক্সে ওঁরা হকিতে অনেক বার সোনা জিতেছে।’ নাদিয়াকে বলি, মন্ট্রিয়লে ওঁর পারফেক্ট টেন-এ আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের দেশের বহু মেয়ে জিমন্যাস্টের স্বপ্ন, নাদিয়া হওয়া। বুঝালাম, ইংরেজিতে বলা কথা নাদিয়া পুরোটা বুঝতে পারছেন না। আরমেন দোভাষীর ভূমিকায় নাদিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ওঁর মুখে হাসির ঝিলিক।

মন্ট্রিয়লের চার বছর পর মস্কো অলিম্পিক্সেও নাদিয়া সোনা পেয়েছিলেন। তবে পারফেক্ট টেন করতে পারেননি। কেন হয়নি, সেটা আমার মতো অনেকেরই আপসোস ছিল। নাদিয়াকে সেই প্রশ্নটাই করি। ওঁর ব্যাখ্যা, ‘চার বছরে আমার শরীরে কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। বয়স হয়ে যায় ১৪ থেকে ১৮। ওজনও সামান্য বেড়ে গিয়েছিল। মন্ট্রিয়লের আমি আর মস্কোর আমি এক ছিলাম না।’ নাদিয়া বুঝিয়ে বলেন, মস্কোয় ব্যালান্স বিমে কসরত করার সময়ে সামান্য ভুলে পয়েন্ট কমে গিয়েছিল। তার পর সোভিয়েত জিমন্যাস্টদের দেখিয়ে বলেন, ‘এদের মতো উন্নত পরিকাঠামো, সুযোগ-সুবিধে আর ভাল ভাল কোচ তো আমাদের ছোট্ট দেশে মেলে না।’

কথা বলতে বলতে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হচ্ছি। অত সুন্দরী তবু তাঁর শরীরে কোনও প্রসাধনের ছোঁয়া নেই। শুধু ঠোঁটটা সামান্য লালচে। এত সাদাসিধে কেন তিনি? আরমেন ফের তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন আমার প্রশ্ন। নাদিয়ার সহাস্য উত্তর, ‘আসলে এখন ছোট ছেলেমেয়েদের জিমন্যাস্টিক্সে তালিম দিই। সাজগোজ প্রায় করিই না। টিচার যে!’

আমি একটু-আধটু রুশি জানি শুনে আমাদের চলে যাওয়ার সময়ে নাদিয়া বললেন, ‘দাসভিদানিয়া।’ মানে বিদায়।

১৯৮৪-র লস অ্যাঞ্জেলিস অলিম্পিক্সে গিয়ে নাদিয়াকে ফের দেখি। তবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। সে বছর তাঁকে ‘অলিম্পিক অর্ডার’-এ ভূষিত করা হয়। ২০০৪-এর আথেন্স অলিম্পিক্সেও একই সম্মান। দু’-দু’বার কারও এই সম্মান পাওয়া অলিম্পিক্সের ইতিহাসে বিরল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy